↬ মাদকাসক্তি ও তার প্রতিকার
↬ মাদকদ্রব্য ও আমাদের যুবসমাজ
↬ মাদকাসক্তি ও তার প্রতিকার
↬ মাদকাসক্তির অভিশাপ
↬ মাদকাসক্তি ও যুবসমাজ
↬ মাদকাসক্তির কুফল
↬ মাদকাসক্তির পরিণাম
↬ মাদকাসক্তি প্রতিরোধ
↬ সর্বনাশা নেশা: মাদকাসক্তি
↬ মাদকাসক্তি ও বিপন্ন ভবিষ্যৎ প্রজন্ম
↬ মাদকের কুফল ও তার প্রতিকার
ভূমিকা : আধুনিক বিশ্বে নিত্যনতুন আবিষ্কার মানব জীবনকে একদিকে যেমন দিয়েছে স্বাচ্ছন্দ্য ও গতিময়তা, অন্যদিকে তেমনি সঞ্চারিত করেছে হতাশা ও উদ্বেগের। পুরাতন সামাজিক ও নৈতিক মূল্যবোধের অবক্ষয় ঘটছে দিনে দিনে, নতুন মূল্যবোধও সবসময় গ্রহণযোগ্য হয়ে ওঠেনি। সামগ্রিকভাবে হতাশা, আদর্শহীনতা, বিভ্রান্তি, বেকারত্ব, রাজনৈতিক অস্থিরতা, সামাজিক-ধর্মীয় ও নৈতিক মূল্যবোধের অবক্ষয় ইত্যাদি নানাবিধ কারণ যুবসমাজকে মাদকাসক্ত করে তুলছে। তাই বর্তমান বিশ্বসভ্যতা যে কয়টি মারাত্মক সমস্যার সম্মুখীন, মাদকাসক্তি তার অন্যতম।
মদকদ্রব্য ও মাদকাসক্তি : মাদকদ্রব্য হচ্ছে সেসব বস্তু যা গ্রহণের ফলে স্নায়ুবিক বৈকল্যসহ নেশার সৃষ্টি হয়। সুনির্দিষ্ট সময় পর পর তা সেবনের দুর্নীতি আসক্তি অনুভূত হয় এবং কেবল যেসব মাদকদ্রব্যের সেবক সর্বাধিক সেগুলো হলো গাঁজা, ফেনসিডিল, হেরোইন, রেকটিফাইড স্পিরিট, মদ, বিয়ার, তাড়ি, পঁচুই, ঘুমের ওষুধ, প্যাথেড্রিন ইনজেকশন ইত্যাদি। এসব মাদকদ্রব্য গ্রহণ করে নেশা সৃষ্টিকে মাদকাসক্তি বলা হয়। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার (WHO) মতে, মাদকাসক্তি হচ্ছে চিকিৎসা গ্রহণযোগ্য নয় এমন দ্রব্য অতিরিক্ত পরিমাণে বিক্ষিপ্তভাবে গ্রহণ করা এবং এসব দ্রব্যের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়া।
মাদকাসক্তির কারণ : মাদকাসক্তির কারণ বহুবিধ। এ পর্যন্ত বিজ্ঞানী, গবেষক। চিকিৎসকরা মাদকাসক্তির অন্তরালে যে কারণগুলো সক্রিয় বলে চিহ্নিত করেছেন সেগুলো নিচে আলোচিত হলো :
১. সঙ্গদোষ : মাদকাসক্তির জন্য সঙ্গদোষ একটি মারাত্মক কারণ। কারণ কোনো বন্ধুবান্ধব বা পরিচিত ব্যক্তি নেশাগ্রস্ত হলে সে তার সঙ্গীদেরও নেশার জগতে আনার আপ্রাণ চেষ্টা চালায়। এক পর্যায়ে সুস্থ সঙ্গীটিও নেশাগ্রস্ত হয়ে পড়ে সেজন্য বলা হয়ে থাকে, ‘সৎ সঙ্গে স্বর্গবাস, অসৎ সঙ্গে সর্বনাশ।’
২. কৌতূহল : কৌতুহলও মাদকাসক্তির একটি মারাত্মক কারণ। মাদকাসক্তির ভয়াবহতা জেনেও অনেকে কৌতূহলবশত মাদকদ্রব্য গ্রহণ করে। এভাবে একবার দুবার গ্রহণের ফলে এক পর্যায়ে সে মাদকাসক্ত হয়ে পড়ে।
৩. সহজ আনন্দ লাভের বাসনা : মানুষ অনেক সময় আনন্দ লাভের সহজ উপায় হিসেবে মাদকের প্রতি ঝুঁকে পড়ে এবং ধীরে ধীরে মাদকাসক্ত হয়ে পড়ে।
৪. পারিবারিক কলহ : প্রতিটি সন্তানই চায় তার পরিবারের অভ্যন্তরে মা ও বাবার মধ্যে সুসম্পর্ক বজায় থাকুক। কিন্তু অনেক পরিবারে মা ও বাবার মধ্যে সুসম্পর্কের পরিবর্তে প্রায়শ দ্বন্দ্ব ও কলহ লেগে থাকে, যা অনেক সন্তানই স্বাভাবিকভাবে মেনে নিতে পারে না। ফলে এক পর্যায়ে এসব সন্তান মাদকাসক্ত হয়ে অন্যভাবে মানসিক প্রশান্তি খোঁজার চেষ্টা করে।
৫. ধর্মীয় মূল্যবোধের বিচ্যুতি : ধর্মীয় মূল্যবোধ ও জ্ঞান মানুষের মধ্যে মানবতাবোধ ও ভ্রাতৃত্বের বিকাশ ঘটায় এবং মানুষকে চরিত্রবান করে তুলে সঠিক পথে পরিচালিত করে। কিন্তু সাম্প্রতিক ধর্মীয় মূল্যবোধ থেকে বিচ্যুতি মাদকাসক্তি বিস্তারে সহায়ক ভূমিকা পালন করছে।
৬. মাদকদ্রব্যের সহজলভ্যতা : নেশাজাতীয় বস্তুটি যদি মানুষের হাতের কাছে না থাকে তবে মানুষ নেশা বা মাদকাসক্ত হবার সুযোগ কম পাবে। কিন্তু বাংলাদেশে প্রশাসনিক দুর্বলতার কারণে অনেকটা প্রকাশ্যেই মাদকদ্রব্য ক্রয়-বিক্রয় হয়। মাদকদ্রব্যের সহজলভ্যতার কারণে মাদকাসক্তদের সংখ্যাও দিন দিন বাড়ছে।
মাদকাসক্তি ও বিপন্ন ভবিষ্যৎ প্রজন্ম : বিশ্বব্যাপী মাদকদ্রব্যের অপব্যবহার এবং চোরাচালানের মাধ্যমে এর ব্যাপর প্রসার ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য এক মারাত্মক হুমকি সৃষ্টি করেছে। মাদকের নিষ্ঠুর ছোবলে অকালে ঝরে যাচ্ছে বহু তাজা প্রাণ এবং অঙ্কুরেই বিনষ্ট হচ্ছে বহু তরুণের সম্ভাবনাময় উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ। বাংলাদেশের বিভিন্ন ক্ষেত্রে মাদকাসক্তির ধ্বংসাত্মক প্রভাব নিয়ে নিচে আলোচনা করা হলো :
১. যুবসমাজের ওপর প্রভাব : মাদকদ্রব্যের অবৈধ পাচার আমাদের দেশের যুবসমাজের ওপর মারাত্মক ক্ষতিকর প্রভাব বিস্তার করছে। প্রেমে ব্যর্থতা, হতাশা, বেকারত্ব, দারিদ্র্য, কৌতূহল প্রভৃতির কারণে আমাদের দেশের যুবসমাজের এক বিরাট অংশ মাদকদ্রব্যের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ছে। মাদকদ্রব্যের ওপর এ নির্ভরশীলতা যুবসমাজের এক বিরাট অংশকে অবচেতন ও অকর্মণ্য করে তুলেছে।
২. সামাজিক বিশৃঙ্খলা : যারা মাদকে আসক্ত হয়ে পড়ে তারা যে কোনো উপায়ে মাদকজাতীয় দ্রব্য সংগ্রহের চেষ্টা করে। বাংলাদেশের বিভিন্ন শ্রেণীর মাদকাসক্তরা মাদকদ্রব্য সংগ্রহের জন্য চুরি, ডাকাতি, ছিনতাইসহ বিভিন্ন ধরনের অপরাধমূলক কাজে জড়িত হয়। এভাবে সমাজের বিভিন্ন জায়গায় সামাজিক বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি করে।
৩. নৈতিক অধঃপতন : মাদকদ্রব্যের সাথে অবৈধ যৌন সম্পর্ক, পাপ এবং পতিতাবৃত্তির ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বিদ্যমান। মাদকদ্রব্য সেবনের ফলে ব্যক্তির ব্যক্তিত্বের বাহ্যিক আচরণ বা মুখোশ খুলে যায়। আসক্তদের বিবেক লোপ পায়। ফলে অতিরিক্ত মাদক সেবনের পর স্বভাবতই যৌনসংক্রান্ত যে কোনো ব্যাপারে ব্যক্তির মাঝে চরম নৈতিক অধঃপতন দেখা দেয়।
৪. সামাজিক ও ধর্মীয় মূল্যবোধের অবক্ষয় : মাদকাসক্ত ব্যক্তিরা যেহেতু আসক্ত হবার পর তাদের চেতনা হারিয়ে ফেলে, তাই পরবর্তীকালে তারা পূর্বের আদর্শ ও মূল্যবোধ ধরে রাখতে পারে না। আমাদের দেশের মাদকাসক্ত ব্যক্তিরা তাদের সামাজিক ও ধর্মীয় মূল্যবোধ থেকে ক্রমেই সরে পড়ছে।
৫. অপরাধপ্রবণতার হার বৃদ্ধি : আমাদের দেশে মাদকাসক্তি সমস্যা ক্রমাগতভাবে মানুষের মধ্যে অপরাধপ্রবণতা বৃদ্ধি করছে। নেশা গ্রহণের ফলে ব্যক্তির মাঝে অস্বাভাবিকতা, অপ্রকৃতিস্থতা, বিচারবুদ্ধিহীনতা ও পাশবিকতা ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পাচ্চে। আসক্ত ব্যক্তির মধ্যে অপরাধপ্রবণতা বৃদ্ধির ফলে সমাজে অপরাধ ও অনাচার বেড়ে যাচ্ছে।
মাদকাসক্তি সমস্যা সমাধানের উপায় : বিশ্বজুড়ে মাদকাসক্তি একটি জটিল সামাজিক সমস্যা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করায় এ সমস্যা সমাধানের জন্য স্থানীয়, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে কর্মসূচি গ্রহণ করা হচ্ছে। এ সমস্যা মোকাবিলার জন্য সবচেয়ে বৈজ্ঞানিক প্রক্রিয়া হচ্ছে প্রতিকারমূলক ও প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা। নিচে এসব ব্যবস্থা নিয়ে আলোচনা করা হলো :
ক. প্রতিকারমূলক ব্যবস্থা বা পদক্ষেপ : মাদকাসক্তদের শারীরিক, মানসিক ও পদক্ষেপ গ্রহণ করাকে প্রতিকারমূলক ব্যবস্থা বলা হয়। আসক্ত ব্যক্তিদের প্রথমে তার পরিবেশ থেকে সরিয়ে আনা হয়, যাতে সে আর পুনরায় মাদক গ্রহণ করার সুযোগ না পায়। পরে তাকে সুস্থ ও স্বাভাবিক করার জন্য কোনো চিকিৎসাকেন্দ্রে ভর্তি করে চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয়, যাতে ব্যক্তি পরিপূর্ণরূপে সুস্থ হয়ে তার হারানো ক্ষমতা ফিরে পায় এবং স্বাভাবিকভাবে নিজেকে খাপ খাইয়ে নিতে পারে। মাদকাসক্তি প্রতিরোধে প্রতিকারমূলক ব্যবস্থার বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে।
খ. প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা : মাদকাসক্তির করাল ছোবল থেকে সমাজ ও সমাজের মানুষকে রক্ষা করার জন্য যেসব প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়া হয় তাকেই প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা বলে। মাদকাসক্তি নিয়ন্ত্রণে প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা হিসেবে যেসব পদক্ষেপ নেয়া হয় সেগুলো নিম্নরূপ :
১. মাদকদ্রব্যের উৎপাদন ও আমদানি নিষিদ্ধকরণের লক্ষ্যে সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর সাথে সমন্বিত কার্যক্রম গ্রহণ করে প্রতিরোধ ব্যবস্থা জোরদার করা।
২. স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন পাঠ্যসূচিতে মাদকের ক্ষতিকর দিকগুলো অন্তর্ভূক্তির মাধ্যমে ব্যাপক সচেতনতা কার্যক্রম চালু করা।
৩. বিভিন্ন সভা, সমিতি, সেমিনার, আলোচনা ও অন্যান্য প্রচার মাধ্যমগুলোতে প্রচারের মাধ্যমে মাদক প্রতিরোধের ব্যবস্থা করা।
৪. মাদক প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণ সংক্রান্ত আইনের বাস্তবায়ন করা।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায়, মাদকদ্রব্যের অপব্যবহারজনিত সমস্যা আজ বিশ্বব্যাপী। লাভজনক এ ব্যবসাকে কেন্দ্র করে আন্তর্জাতিক চোরা-চালানী চক্র গড়ে উঠেছে। এ সমস্যার ভয়াবহতার কথা বিবেচনা করে জাতিসংঘের মহাসচিব বলেছেন, ‘এ বিশ্বকে মাদকমুক্ত করা এক বিশাল সমস্যা।’ বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে এ ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষার জন্য মাদকাসক্তি নিরাময় ও প্রতিরোধ আন্দোলনে আপামর জনসাধারণকে এগিয়ে আসতে হবে।
[ একই রচনা আরেকটি বই থেকে সংগ্রহ করে দেয়া হলো: ]
ভূমিকা : মানব সত্যতা যখন বিস্ময়কর সম্ভাবনা দিয়ে নতুন সহস্রাব্দে এসে দাঁড়িয়েছে তখন আমাদের দেশের তরুণ প্রজন্মের বিশাল উল্লেখযোগ্য অংশ আক্রান্ত এক সর্বনাশা মরণ নেশায়- সে নেশা মাদকের। এক গভীর ষড়যন্ত্রের শীকার আমাদের তরুণেরা। যে তরুণের ঐতিহ্য রয়েছে সংগ্রামের, প্রতিবাদের, যুদ্ধজয়ের, তাদের সেই ঐতিহ্যকে নস্যাৎ করার জন্যে উঠে পড়ে লেগেছে আন্তর্জাতিক মাফিয়া চক্র। তাদের ভবিষ্যৎকে অসাড়, পঙ্গু ও ধ্বংস করে দেওয়ার জন্যে চলেছে ভয়ঙ্কর এক চক্রান্ত। জাতির মেরুদণ্ডকে অথর্ব করে দেওয়ার জন্যে তাদের ছলে-বলে-কৌশলে টেনে নেওয়া হচ্ছে নেশার করাল বলয়ে। আর তার ফলে মাদক নেশার যন্ত্রণায় ধুঁকছে শত সহস্র প্রাণ। ড্রাগের ফাঁদ থেকে বেরিয়ে আসার দুঃসাহস হারিয়ে ফেলছে দুর্মর তরুণ্য।
সর্বনাশা নেশার উৎস : নেশার ইতিহাস বেশ প্রাচীন হলেও তা ছিল অত্যন্ত সীমিত পর্যায়ে। মদ, গাঁজা, ভাং, আফিম, চরস, তামাকের নেশার কথা শুনে এসেছে মানুষ। উনিশ শতকের মধ্যেভাগে বেদনানাশক ওষুধ হিসেবে যে মাদকের ব্যবহার শুরু হয় তার ইংরেজি নাম ড্রাগ। ফরাসি বিপ্লবের সময় পরাজিত সৈনিকদের অনেকে হতাশা থেকে মুক্তি পেতে মাদকের আসক্ত হন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহতার কালেও নানা কারণে ব্যথা উপশম ছাড়াও নেশার উপকরণ হিসেবে ড্রাগের ব্যবহার বৃদ্ধি পায়। এই প্রেক্ষাপটে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের কলম্বিয়া, বলিভিয়া, ব্রাজিল, ইকুয়েডর ইত্যাদি এলাকায় মাদক ড্রাগ তৈরির বিশাল বিশাল চক্র গড়ে ওঠে। এভাবেই বেদনানাশক ‘ড্রাগ’ ক্রমে পাশ্চাত্যের ধনাঢ্য সমাজে এক ব্যাপক নেশার ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এক জরিপে জানা যায়, ধনাঢ্য দুনিয়ার শতকরা আশিভাগ লোক একসময় কমবেশি ‘ড্রাগ’-এর নেশার কবলে ছিল। আর এখন আমাদের মতো দরিদ্র দেশেও তা মারাত্মক সংক্রামক অভিশাপের মতো ছড়িয়ে পড়ছে। দু’বেলা যেখানে সবার ভাত জোটে না সেখানেও যত্রতত্র এমনকি দ্ররিদ্র্য-পীড়িত বস্তি এলাকায় ড্রাগের সহজ প্রাপ্তি দেখে অবাক না হয়ে পারা যায় না।
বিভিন্ন ধরনের ড্রাগ ও তাদের ব্যবহারের ধরন : সাম্প্রতিককালে আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদের মদতপুষ্ট ড্রাগ ব্যবসায়ীরা নানা ধরনের মাদক ড্রাগের ব্যবসা ফেঁদেছে। এই ধরনের মাদক ড্রাগের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ইয়াবা, আফিম, হাসিস, হেরোইন, কোকেন, হেম্প, মারিজুয়ানা, ব্রাউন শুগার, এল.এস.ডি. স্মাক ইত্যাদি। এসবের ব্যবহারের পদ্ধতিও নানা রকম। ধূমপানের পদ্ধতি, ‘ইনহেল’ বা নাকে শোকার পদ্ধতি, ‘স্কিন পপিং’ বা ইনজেকশনের মাধ্যমে ত্বকের নিচে গ্রহণের পদ্ধতি এবং ‘মেইন লাইনিং’ বা সরাসরি রক্ত প্রবাহে অনুপ্রবেশকরণ পদ্ধতি। বিভিন্ন রকম ড্রাগের মধ্যে ইয়াবা আজ সব নেশাকে ছাড়িয়ে গেছে। এই মাদক শক্তিও অত্যন্ত তীব্র। আরেক মরণ নেশার নাম হেরোইন। এক গ্রাম হেরোইনের ষোল ভাগের এক ভাগ দু-তিনবার ব্যবহার করলে এমন আসক্তি সৃষ্টি হবে যে আসক্ত ব্যক্তি সহজে আর এই নেশা থেকে নিজেকে মুক্ত করতে পারবে না। নিছক কৌতূহলবশত যদি কেউ হেরোইন সেবন করে তবে এই নেশা সিন্দাবাদের দৈত্যের মতো তার ঘাড়ে চেপে বসে। তখন প্রচন্ড মানসিক শক্তি এবং চিকিৎসকের অনুপুঙ্খ পরিচর্যা ছাড়া আসক্ত ব্যক্তি এ নেশার কবল থেকে সহজে মুক্তি পায় না।
মাদকাসক্তির পরিণাম : ড্রাগ চোরাচালানি সিন্ডিকেটের ভাড়াটিয়া লোকের পাল্লায় কিংবা অসৎ লোকের প্ররোচনায় পড়ে অথাব নিতান্ত কৌতূহলবশত কেউ ড্রাগের নেশায় পড়লে সর্বনাশা নেশা তাকে পেয়ে বসে। নেশার কারাগারে বন্দি হয়ে দিনের পর দিন তাকে ড্রাগ ব্যবহার করতে হয়। মাদকাসক্তির ফলে তার আচার-আচরণে দেখা যায় অস্বাভাবিকত্ব। তার চেহারার লাবণ্য হারিয়ে যায়। আসক্ত ব্যক্তি ছাত্র হলে তার বইপত্র হারিয়ে ফেলা, পড়াশোনায় মনোযোগ কমে যাওয়া, হেরোইনের খরচ জোগাতে চুরি করা ইত্যাদি নতুন নতুন উপসর্গ ধরা পড়ে। হেরোইনের প্রভাবে রোগীর শারীরিক প্রতিক্রিয়াও হয় নেতিবাচক। ড্রাগ নেওয়া শুরু করলে তার শরীরে অতিরিক্ত সুখের অনুভূতি হয়। শরীর মনে হয় পালকের মতো হালকা। তার স্নায়ু দুর্বল হয়ে পড়ে, মননশক্তি ভোঁতা ও অসাড় হয়ে পড়তে থাকে। ক্ষুধামান্দ্যের ফলে শরীরের ওজন অস্বাভাবিকভাবে কমে যায়। তার শরীর ভেঙে পড়ে এবং ক্রমে স্নায়ু শিথিল ও অসাড় হয়ে শেষ পর্যন্ত সে মারাক্তক পরিণতির দিকে এগিয়ে যায়।
মাদক-নেশা দ্রুত প্রসারের কারণ : বিশ্বব্যাপী সমীক্ষা চালিয়ে দেখা গেছে, মূলত কাজে-কর্মে, শিক্ষা-দীক্ষায় পিছেয়ে পড়ার কারণে প্রায় ক্ষেত্রে হতাশ তরুণরা সাময়িক ভালো লাগার আকর্ষণে নেশা-কবলিত হয়। বিশেষ করে নৈরাশ্য, হতাশা, সামাজিক অস্থিরতা এবং জীবনের অর্থশূন্যতা ও দুঃখবোধ থেকে সাময়িক স্বস্তি লাভের আশা থেকেই এই উৎকট নেশা ক্রমবিস্তার লাভ করছে। পাশাপাশি এ কথাও সত্য যে, সর্বাধুনিক সভ্যতাগর্বী অনেক দেশে বিপথগামী মানুষ এবং বহুজাতিক সংস্থা উৎকট অর্থলালসায় বেছে নিয়েছে রমরমা মাদক ব্যবসার পথ। নেশার ঐ কারবারিরা সারা বিশ্বে তাদের ব্যবসায়িক ও আরোও কিছু হীন স্বার্থ রক্ষায় এই নেশা পরিকল্পিতভাবে ছড়িয়ে দিচ্ছে। অন্যদিকে মাদকাসক্তির কারণ হিসেবে আধুনিক মনোবিজ্ঞানীদের অভিমত, সমাজজীবনে সুস্থ বিনোদনের অভাব ক্রমেই প্রকট হয়ে উঠেছে বলে সহজেই মানুষ নেশার কবলে পড়েছে।
মাদক চোরাচালান : সীমান্তপথে কিংবা আকাশপথে চোরাচালানের মাধ্যমে ড্রাগ পাচারের নেটওয়ার্ক গড়ে তুলেছে আন্তর্জাতিক বেশ কিছু চোরাচালানি সিন্ডিকেট। কিছুকাল আগেও মায়ানমার, থাইল্যান্ড ও দক্ষিণ ভিয়েতনাম নিয়ে গড়ে উঠেছিল আন্তর্জাতিক মাদক চোরাচালানের স্বর্গভূমি- ‘গোল্ডেন ট্রায়াঙ্গল’ বা ‘স্বর্গ ত্রিভুজ’। ভিয়েতনামে কমিউনিস্ট সরকার প্রতিষ্ঠিত হলে ’স্বর্ণ ত্রিভুজে’র রমরমা অবস্থান যায় ভেঙে। কিন্তু চোরাচালানি চক্র কিছুদিনের মধ্যেই ইরান, পাকিস্তান ও আফগানিস্তানকে নিয়ে গড়ে তোলে ড্রাগ পাচারের নতুন স্বর্গভূমি ‘গেল্ডেন ক্রিসেন্ট’।
মাদকাসক্তি প্রতিরোধ : ড্রাগ-ড্রাগন বিশ্বজুড়ে যে মাদক বিষ ছড়িয়ে দিচ্ছে তার কালো থাবা থেকে নিজেদের বাঁচাবার উপায় কী? এ সমস্যা নিয়ে বিশেষজ্ঞরা হিমশিম খাচ্ছেন। সমাজসেবীরা উৎকণ্ঠা ও উদ্বেগ প্রকাশ করছেন। ১৯৮৬ সালে মাদকাসক্তি বিষয়ক এক দলিলে এই অভিমত প্রকাশ করা হয়েছে যে, বিশ্বব্যাপী হেরোইনের প্রভাব থেকে মানুষকে মুক্ত করা সহজসাধ্য ব্যাপার নয়। তাহলে কি মানুষ পৃথিবীতে মাদক নেশার হাত থেকে বাঁচাতে পারবে না? সৃষ্টির সেরা জীব মানুষ কি এই সর্বনাশা নেশার কবলে ক্রমে নিঃশেষ হয়ে যাবে? এই প্রশ্ন সামনে রেখেই বিশ্বব্যাপী বিবেকবান মানুষ মাদকবিরোধী আন্দোলনে অংশ নিচ্ছে। দেশে দেশে মাদকবিরোধী সংস্থা ও সংগঠন গড়ে উঠছে। তারা মাদক বিরোধী গণসচেতনতা গড়ে তোলার কাজে সক্রিয়ভাবে কাজ করে যাচ্ছে। আমাদের দেশও এক্ষেত্রে পিছিয়ে নেই। মাদকাসক্তির বিরুদ্ধে সামাজিক ও পারিবারিক প্রতিরোধ গড়ে তোলার লক্ষ্য নিয়ে তৎপরতা শুরু হয়েছে। এসব তৎপরতার লক্ষ্য হচ্ছে:
১। ড্রাগ আসক্তদের প্রতি সহানুভূতিশীল দৃষ্টি নিয়ে ভেষজ চিকিৎসার পাশাপাশি মানসিক চিকিৎসার ব্যবস্থা গ্রহণ এবং তাদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনা;
২। ব্যাপক সাংস্কৃতিক উদ্দীপনা ও সুস্থ বিনোদনমূলক কার্যক্রমের সঙ্গে, তরুণদের সম্পৃক্ত করে নেশার হাতছানি থেকে তাদের দূরে রাখা;
৩। মাদকাসক্তির কুফল ও মর্মান্তিক পরিণতি সম্পর্কে ব্যাপক প্রচারণার মাধ্যমে সকলকে সচেতন করা;
৪। মাদক ব্যবসা, চোরাচালানের বিরুদ্ধে গণপ্রতিরোধ আন্দোলন গড়ে তোলা; এবং
৫। বেকার যুবকদের জন্যে ব্যাপক কর্মসংস্থান সৃষ্টি।
উপসংহার : মাদকাসক্তির মতো সর্বনাশা নেশার করাল গ্রাসে পড়ে আমাদের তরুণ প্রজন্ম অথর্ব ও অসাড় হতে চলেছে- এ দেখে সর্বস্তরের মানুষ আজ শঙ্কিত ও উদ্বিগ্ন। এটি সমস্যা মোকাবেলায় একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ইতিবাচক দিক। এ মারাত্মক সমস্যা সম্পর্কে সচেতন থেকে আগামী দিনের সুস্থ, সুন্দর, আনন্দ-উজ্জ্বল সমাজ জীবন গড়ে তোলার লক্ষে আমাদের মাদকদ্রব্য ব্যবহার রোধ করার বাস্তব ও কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। মাদকাসক্তি নিরোধকল্পে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা মনে করে, মাদকজাত ওষুধের ব্যবহার বন্ধ করা একান্ত দরকার। সেই সঙ্গে ব্যক্তিগতভাবে প্রত্যেকের মাদক বিষ বর্জনকেও তারা অপরিহার্য বলে বিবেচনা করেছে। মাদক নেশার বিরুদ্ধে একসময় রবীন্দ্রনাথসহ অনেকেই কলম ধরেছিলেন। আজ মাদকমুক্ত সমাজ গড়ে উদ্বুদ্ধ করায় আমাদের শিল্পী-সাহিত্যিকদেরও এগিয়ে আসতে হবে। মনে রাখতে হবে, ড্রাগ-ড্রাগনের রাহুগ্রাস থেকে দেশ ও জাতিকে রক্ষা করার দায়িত্ব কেবল সরকারের নয়, দল-মত-নির্বিশেষে আমাদের সবার।
রচনাতি আর বর করা দরকার
ReplyDeleteবড়* হবে
Deleteসুন্দর রচনা
ReplyDeleteসুন্দর রচনা
Deleteখুব সহজ,,সকল।কথা এখানে তুলে ধরাহয়েছে
Deleteথ্যাঙ্কু।
ReplyDeleteখুবভালো
ReplyDeleteThank u
ReplyDeleteAta amar school project a khub kaje lagbe.
Thanks a lot
ReplyDeleteরচনাটি অনেক ভালো।কিন্তু আর বড় হলে ভালো হতো।
ReplyDeleteEtar pdf nai?
ReplyDeleteNice
ReplyDeleteGood
ReplyDelete👍🏻
ReplyDelete