কিছু কিছু শব্দারর্থ বুঝতে আমাদের শিক্ষিত সমাজের মাঝে মাঝে কষ্ট হয়। তাঁরা কি না জেনে বুঝেন না, নাকি বুঝেও বুঝেন না? নিচে আমি কিছু শব্দ ও অর্থ দিলাম। কেউ না বুঝলে বুঝে নিতে পারেন-
সমাজপতি:
পতি অর্থ স্বামী, একজন বিবাহিত নরীর ভরণপোষণের দাবীদার। তবে সমাজপতি অর্থ সমাজের কর্তা, যিঁনি সমাজের ভালো মন্দের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। এখানে সমাজের প্রত্যেকটা নারীর স্বামী নয়।
বিচারপতি:
যিঁনি সকল বিচার কার্যের কর্তা। যাঁর বিচারের উপর কোনো কথা চলে না। 'বিচারপতি' শব্দটির শেষে 'পতি' আছে তার মানে এই নয় তিঁনি সকল বিচারকের স্বামী। অর্থাৎ সকল মহিলা বিচারকের স্বামী।
রাষ্টপতি:
যিঁনি একটি রাষ্টের সর্বোচ্চ ক্ষমতার অধিকারী। এখানেও শেষে 'পতি' আছে। তার মানে কি এই যে তিঁনি রাষ্টের সকল নারীর স্বামী?
দেশমাতা/দেশমাতৃকা:
দেশকে আমরা মা ডাকি। তার মানে এই নয় দেশ আমাদের দশ মাস দশ দিন গর্ভে ধারণ করেছে। দেশ আমাদেরকে প্রসব করেছে। তার মানে এই নয় দেশ আমার গর্ভধারিণী মা হয়ে গেছে। দেশকে মা ডাকা হয় কারণ জন্মের পর মায়ের বুকের স্তন পান করে যেমন বাঁচি, মায়ের বুকের স্তনের পর আমরা ভাত মাছ খেয়ে বাঁচি, এবং এগুলো দেশের বুকে থাকে। মায়ে বুক যেমন সন্তানের প্রথম আশ্রয়, মায়ের পর দেশের বুক হচ্ছে আমাদের একমাত্র আশ্রয়। তাই দেশকে মায়ের সাথে তুলনা করা হয়।
নদীমাতৃক:
নদী মাতা যার তাকেই বলা হয় নদীমাতৃক। এখানেও শেষে মাতা আছে। নদীকে কেন্দ্র করে এই দেশে কোটি কোটি মানুষ বেঁচে আছে। আমাদের দেশের এমন কোনো জেলা খুঁজে পাওয়া যাবে না যে জেলায় নদী নেই। এই নদী আমাদের কোটি কোটি মানুষকে বাঁচিয়ে রেখেছে। তাইতো নদী আমাদের মা। তার মানে এই নয় নদী আমাদের প্রসব করেছে।
নগরপিতা:
যিঁনি একটি নগরের দেখা-শুনার দায়িত্বে থাকেন তাঁকে নগরপিতা ব'লে। ইংরেজীতে বলে 'মেয়র'। এইখানে শব্দের শেষে 'পিতা' আছে। পিতা অর্থ বাবা। তার মানে এই নয় যিঁনি নগরপিতা তিঁনি নগরের প্রত্যেক মানুষের পিতা বা বাবা।
জাতির পিতা/জাতির জনক:
অন্য সব গুলোর মত এখানেও শেষে 'পিতা' বা 'জনক' আছে। যার অর্থ বাবা। যিঁনি জন্ম দেন। তার মানে এই নয় তিঁনি একটা দেশের প্রত্যেকটা মানুষের বাবা অথবা তিঁনি একটা জাতীর বাবা। স্বাধীনতা সংগ্রামের মধ্য দিয়ে জন্ম নেয়া প্রায় প্রত্যেকটা দেশেরই জাতির পিতা আছে।
আমাদের দেশ '৭১ এর আগে ছিলো পাকিস্তানের অধীনে। তখন আমাদের ডাকা হতো 'পাকি', 'পাক-জাতি' বা 'পাকিস্তানি'। '৭১ স্বাধীনতার মধ্য দিয়ে আমরা 'পাকিস্তানি' থেকে 'বাংলাদেশী’ হলাম। অর্থাৎ নতুন একটা জাতের উদ্ভব হয়েছে, যার নাম 'বাঙালি জাতি' বা 'বাংলাদেশী'। এই যে নতুন একটা জাতের জন্ম নিয়েছে পৃথিবীর বুকে আর যিঁনি এই নতুন জাতকে তৈরি করে দিয়েছেন বা সৃষ্টি করেছেন তাঁকেই বলা হয় 'জাতির পিতা'।
আমরা বাঙালিরা এই সহজ বিষয় গুলো বুঝি না। আমরা ধর্মের সাথে, এটার সাথে, ঐটার সাথে মিশিয়ে মুর্খের মত কাজ করি। মুসলমানরা বিশ্বাস করে জাতির পিতা 'হযরত ইব্রাহিম (আ)'। এইটা দ্বারা বুঝানো হয় শুধু মাত্র মুসলিম জাতির পিতা।
হিন্দুরা বিশ্বাস করে জাতির পিতা 'মনু'। তার থেকে পুরো মানব জাতীর জন্ম। এটাও তাদের একান্ত নিজস্ব বিশ্বাস।
এইরকম প্রত্যের ধর্মের আলাদা আলাদা মত বা বিশ্বাস থাকতে পারে। তা শুধু ঐ ধর্মের একান্ত বিষয়।
কিন্তু এটা হলো একটি দেশের জাতিত্বের বিষয়, সমগ্র ধর্ম বা সমগ্র বিশ্বের বিষয় নয়, শুধু মাত্র পৃথিবীর মাঝে ক্ষুদ্র একটা দেশের বা অঞ্চলের বিষয়। এখানে হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান, চাকমা, মার্মা, গারো সকলেই আমরা বাংলাদেশী। আগে ছিলাম পাকিস্তানি। যিঁনি আমাদের নতুন করে পরিচয় সৃষ্টি করে দিয়েছেন 'বাংলাদেশী' জাতি হিসেবে, তিঁনিই ‘জাতির পিতা’। এখানে ধর্ম-বর্ণের কোনো সম্পর্ক নেই।
আমরা শোকাহত:
(২০১৬ সালের ১৫ই আগস্ট লিখেছিলাম)
ধন্যবাদ, নতুন কিছু শিখতে পারিলাম।
ReplyDelete১৯৪৭ এর আগেও আপনার পূর্বপুরুষেরা কিন্তু বাঙালিই ছিলেন।
ReplyDelete