স্বার্থমগ্ন যে জন বিমুখ
বৃহৎ জগৎ হতে, সে কখনো শেখে নি বাঁচিতে
ব্যক্তিস্বার্থ চিন্তার সংকীর্ণ জীবনবৃত্তে আচ্ছন্ন জীবন মানুষের প্রকৃত জীবন নয়। মানুষের জীবনে তা পূর্ণতার স্বাদ বয়ে আনে না। বরং আত্মকেন্দ্রিকতার বলয় থেকে বেরিয়ে বৃহত্তর মানবসমাজের সঙ্গে গভীর যোগসূত্র রচনাতেই মানব জীবনের সার্থকতা।
মানুষের জীবনে বাঁচা বলতে কেবল শারীরিক অস্তিত্ব রক্ষাকে বোঝায় না। টিকে থাকা আর বাঁচা এক জিনিস নয়। কুয়োর হহ্বরে যে ব্যাঙ দিনের পর দিন নিরাপদে টিকে থাকে সে জীবনকে উপভোগ করতে পারে না। অথচ যে প্রজাপতি জগতের আলো-হাওয়ার প্রাণবন্ততায় রঙিন পাখা মেলে ওড়ে সে সত্যিই বাঁচে। সে প্রজাপতির জীবনসীমা হয়তো স্বল্পকালের। কিন্তু বিশ্বের সঙ্গে যোগে তার জীবন সার্থক। মানুষেরও যথার্থ পরিচয় সবার মধ্যে সবার সঙ্গে বাঁচার মধ্যে। কারণ, ‘দিবে আর নিবে মিলাবে মিলিবে’- এ বোধই মানুষের সমাজবন্ধনের মূলসূত্র। তাই যে মানুষ একমাত্র ব্যক্তিস্বার্থ হাসিলের লক্ষ্যে সমাজ জীবন থেকে কেবল নিতে চায়, সমাজকে কিছু দিতে চায় না সে শুধু সামাজিক স্বার্থের ক্ষতি করে না, ক্ষুদ্র সংকীর্ণতা তাকে জগৎ-বিচ্ছিন্নও করে তোলে। তার জীবন হয়ে ওঠে ঘৃণা, ধিক্কৃত। স্বার্থের সংকীর্ণ গণ্ডিতে আবদ্ধ হলে মানুষ অন্যের প্রতি স্নেহ, মমতা, ভালোবাসা, সহানুভূতি ও সহমর্মিতার স্বাভাবিক হৃদয়-ধর্মও হারিয়ে ফেলে। তার অবস্থা হয় বিলাসী ড্রয়িংরুমের চার দেয়ালের মধ্যে মুক্ত আলো-হাওয়াহীন পরিবেশে বেড়ে ওঠা টবের গাছের মতো। বিশাল আকাশের নিচে মুক্ত আলো-হাওয়া অমৃত-স্পর্শময় জীবনের স্বাদ সে পায় না। সে মানুষের জীবনে নেই জীবনের সত্যিকার তাৎপর্য, নেই জীবনের গৌরব। সত্যিকারের জীবনরসিক মানুষ কখনো আত্মস্বার্থমগ্ন সংকীর্ণ গণ্ডির চার দেয়ালে আবদ্ধ থাকতে পারে না। সমগ্র মানবসমাজকে নিয়েই তার জগৎ। সে কেবল নিজের জন্যে বাঁচে না, সবার সঙ্গে সবার জন্যে বাঁচে। সে জানে স্বার্থসুখ সত্যিকারের সুখ নয়। জানে, পরের কারণে মরণেও সুখ। নিঃস্বার্থ মন নিয়ে পরের জন্যে জীবন উৎসর্গ করে সীমাহীন ভালোবাসায় তার বুক ভরে ওঠে। সে জীবনকে পূর্ণভাবে উপভোগ করার আনন্দ পায়।
সবার সঙ্গে, সবার মধ্যে, সবার জন্যে বাঁচাতেই মানব জীবনের সার্থকতা।
এই ভাবসম্প্রসারণটি অন্য বই থেকেও সংগ্রহ করে দেয়া হলো
মূলভাব : স্বার্থলোলুপতা ও আত্মসুখপরায়ণতা মুনষ্যত্বের পরিপন্থী। যে শুধু মাত্র নিজস্ব স্বার্থচিন্তায় তৎপর, জগৎ ও জীবনের বৃহৎ আঙ্গন থেকে যে স্বেচ্ছা- নির্বাসিত। জগৎবাসীর ভালো- মন্দ, সুখ-দুঃখ, মঙ্গল-অমঙ্গল তার হৃদয় মনকে স্পর্শ করে না।
সম্প্রসারিত ভাব : এ পৃথিবীর আলো-আঁধারি স্বার্থপর ও আত্মসুখপরায়ণ লোকের মানসরাজ্যে কোনরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে না। বিরাট এ জগৎ সংসারে কল্যাণ-অকল্যাণ সম্পর্কে যে একান্ত নির্লিপ্ত ও উদাসীন তার বেঁচে থাকা না থাকা সমান। কেননা, জীবনের সার্থকতা স্বার্থপরতায় নেই, আছে পরার্থপরতায়। পরোপকারে নিমগ্ন থেকে এবং বিশ্বজনের কল্যাণ সাধনায় আত্ম- নিয়োগ করে মানুষ জীবনের উদ্দেশ্যকে সফল করার পথে অনেক দূর এগোতে পারে। অপর দিকে, শুধুমাত্র আত্ম-স্বার্থের প্রতিই যার মন-প্রাণ নিবন্ধ, যে শুধুমাত্র নিজের লাভের গুরুত্ব দেয়, সে নামে বেঁচে থাকলেও প্রকৃত অর্থে মৃত। কেননা, জীবনের সবচেয়ে বড় ধর্মই হল বাইরের জগতের সঙ্গে আদান-প্রদান। অনুক্ষণ ও প্রদান শুধুতো জীবের দেহই করে না, মনও করে। বস্তুতঃ মানুষের ক্ষেত্রে এ মনের প্রভাব বা মানসিকতার ক্রিয়া সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। এতএব জীবধর্ম থেকে যার বিচ্যুত এবং বিশেষ করে মানবজীবনের মহিমা যাদের কাছে অবলুণ্ঠিত, তারা প্রকৃত জীবন- ধারণ প্রণালী সম্পর্কে এখনও অজ্ঞ। স্বার্থপরতার মোহজাল মানুষকে এমনভাবে আচ্ছন্ন করে যে, ক্রমশই তারা নিজেদের ও বৃহত্তর মানবগোষ্ঠীর মধ্যে এক দুর্লঙ্ঘ প্রাচীর গড়ে তোলে।