যত বড় হোক ইন্দ্রধনু সে
সুদূর আকাশে আঁকা
আমি ভালোবাসি মোর ধরণীর
প্রজাপতিটির পাখা
অধরা সৌন্দর্যের মাধুরী চিরকাল মানুষকে আকৃষ্ট ও মুগ্ধ করেছে। তাকে নিয়ে তার কত কল্পনা, কত স্বপ্ন, কত আকাঙ্ক্ষা। সুদূর আকাশের বিশাল ক্যানভাসে মেঘ-বৃষ্টি ও আলো-ছায়ার খেলায় তৈরি রামধনুর অনুপম ও অনবদ্য বর্ণিল শোভাও মানুষকে অভিভূত। কিন্তু হাজার চেষ্টা করেও মানুষ কখনো সেই সৌন্দর্যকে হাতের নাগালে ধরতে পারে নি। আকাশের রামধনু যত সুন্দরই হোক না কেন, শেষ পর্যন্ত তা সুদূরের এবং নিতান্তই ক্ষণস্থায়ী এক প্রাকৃতিক সৌন্দর্য। বাস্তবের পৃথিবীতে তা চির অধরা।
রামধনুর বর্ণিলতা যত হৃদয়গ্রাহী ও নয়নলোভা হোক না কেন পার্থিব মানুষের জীবন বাস্তবতার সঙ্গে তার কোনো যোগ নেই। তাই যে মানুষ দৈনন্দিন বাস্তবতার কঠিন মাটিতে পথ চলে, তার কাছে অবাস্তব কল্পনার চেয়ে বাস্তবতা অনেক বেশি গুরুত্ববহ, অনেক বেশি কাম্য। তাই অধরা সৌন্দর্য যত নান্দনিকই হোক না কেন শেষ পর্যন্ত মানুষ বাস্তবের সৌন্দর্যকে অধিকতর গুরুত্ব না দিয়ে পারে না। তাই দূর আকাশের রামধনুর চেয়ে মাটির পৃথিবীতে আলোয় হাওয়ায় উড়ন্ত প্রজাপতির সৌন্দর্যের মূল্য তার কাছে অনেক বেশি। বাস্তববাদী কবি জানেন, রোমান্টিক স্বপ্ন চোখে নিয়ে আকাশের অধরা সৌন্দর্য নিয়ে হয়তো ক্ষণিক ভাবালুতা করা চলে, কিন্তু বাস্তব জীবনে তা নিতান্তই অপ্রয়োজনীয়। তাই কল্পনার রামধনুর সৌন্দর্যের চেয়ে বাস্তবের প্রজাপতির সৌন্দর্য তার কাছে অধিকতর কাম্য।
পৃথিবীবাসী মানুষ কল্পনার চেয়ে বস্তু পৃথিবীকেই অনেক বেশি ভালোবাসে। তার মধ্যেই সে তার নান্দনিক মনের খোরাক খুঁজে ফিরতে চায়।
এই ভাবসম্প্রসারণটি অন্য বই থেকেও সংগ্রহ করে দেয়া হলো
অধরার সৌন্দর্যে মানুষ অধিক মোহমুগ্ধ হয়। তাকে পেতে চায় হাতের মুঠোয়। সে নিয়ে তার আকাঙ্ক্ষার শেষ নেই, কল্পনাবিলাসের অন্ত নেই। নাগাল-বহির্ভূত বস্তু মানুষের কল্পনার সামগ্রী -যা ঠিক নয়। কেননা বাস্তব আর কল্পনা এক নয়।
বাস্তক আর কল্পনার মধ্যে দুস্তর ব্যবধান। মানুষ মাটির পৃথিবীর সন্তান। প্রকৃতির লতা-পাতা, গাছ, ফুল, পাখি এসব নিয়েই তার পরেবেশ। এই মাটির পৃথিবীকে নিয়েই তার অভ্যস্ত জীবনযাত্রা অব্যাহত গতিতে এগিয়ে চলছে। তথাপি মানুষ স্বপ্নবিলাসী। দূরের আকাশের সাতরঙা ইন্দ্রধনুর বিচিত্র বর্ণচ্ছটা মানুষের স্বপনচারী মনকে হাতছানি দেয়। কিন্তু যা ক্ষণস্থায়ী, যা ধরা-ছোঁয়ার বাইরে তা যত বড় বা যত সুন্দরই হোক না কেন তার চেয়ে আকর্ষণীয় চির পরিচিত নিত্যদিনের ধূলিমাখা এই পৃথিবী। কেননা বর্ণসুষমায় ইন্দ্রধনু যতই মনোমুগ্ধকর ও নয়নরঞ্জক হোক না, বাস্তবের সঙ্গে তার কোনো সম্পর্ক নেই, জীবনের বাস্তবক্ষেত্রে তা সম্পূর্ণ গুরুত্বহীন। বাস্তবের কঠিন মাটিতে পা ফেলে মানুষকে জীবন চালাতে হয়। বাস্তবকে উপেক্ষা করা মোটেই সম্ভবপর নয়। সেজন্য দূরের রঙধনুর চেয়ে নাগালের মধ্যে যে ছোট্ট প্রজাপতিটি তার রঙিন পাখায় ভর করে ওড়ে বেড়ায় তার মধ্যেই বিমূর্ত সৌন্দর্যকে উপলব্ধি করা যায়। সুতরাং বহু দূরের সৌন্দর্য যা হাতের নাগালে নয়, এমন সৌন্দর্যের চেয়ে জীবনের সুখ কাছাকাছি সহজ উপভোগ্য সাধারণ সৌন্দর্যের মূল্যযে অনেক বেশি, তাতে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই। তাই সীমার বাহিরে কোনো বস্তুই উপভোগ্য বলে বিবেচিত হতে পারে না। কল্পনার ভাবালুতা অর্মত্যচারী করে, অনৈসর্গিক স্বপ্নলোকে বিচরণ করায়, তাতে রোমান্টিক ভাবনার হয়ত কিছু খোরাক হতে পারে, কিন্তু বাস্তবজীবনে তার প্রয়োজনীয়তা কতখানি তা ভেবে দেখা দরকার। যেখানে ‘ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী গদ্যময়’, সেখানে রামধনুর বর্ণসুষমা নিয়ে ভাবালুতা পরিহাসতুল্য।
আকাশকুসুম পরিকল্পনা না করে সাধ ও সাধ্যের মধ্যে সামঞ্জস্য বজায় রেখে চলা উচিত। দুষ্প্রাপ্য অলীক কোনো কিছু পাওয়ার দুরাশা না করে যা হাতের কাছে তা নিয়ে সন্তুষ্ট থাকাই উত্তম।