ভাবসম্প্রসারণ : দ্বার বন্ধ করে দিয়ে ভ্রমটারে রুখি / সত্য বলে, আমি তবে কোথা দিয়ে ঢুকি?

দ্বার বন্ধ করে দিয়ে ভ্রমটারে রুখি
সত্য বলে, আমি তবে কোথা দিয়ে ঢুকি?

মানুষের জীবনের পথ সত্য-মিথ্যায় আকীর্ণ। সত্য-সন্ধানী মানুষ চান মিথ্যার কুহকে পথভ্রান্ত না হতে। কিন্তু সত্যকে পাওয়ার কোনো সহজ ও চেনা রাস্তা নেই। জীবনে বাস্তব অভিজ্ঞতার মাধ্যমেই সত্য-মিথ্যার যাচাই হয়। তাই মিথ্যার ছলনার ভয়ে জগৎ ও জীবনবিমুখ হয়ে কেউ যদি কর্মজীবনে পা না বাড়ান তবে মিথ্যাকে হয়তো ঠেকানো যায়, কিন্তু সত্যকে উপলব্ধি করা যায় না।

জগতে ভালো-মন্দ, সুন্দর-অসুন্দরের মতো সত্য-মিথ্যা পাশাপাশি অবস্থান করে। সত্যের পথ মানুষকে আলোকিত করে আর মিথ্যার পথ মানুষকে বিভ্রান্ত করে। একদল গোঁড়া সত্য-সন্ধানীদের ধারণা, জগৎ সংসার মিথ্যা কুহকে ভরা। তাই তাঁরা সদাচারের নিয়মনিষ্ঠ সাধনায় ব্রতী হয়ে জগৎ সংসার ও জাগতিক মোহবন্ধনকে পরিহার করার ওপর গুরুত্ব দেন। তাঁদের ভয়, তা না হলে মানুষ ভুলের মোহে পথভ্রান্ত হবে। কিন্তু এভাবে মিথ্যাকে ঠেকাতে গেলে বাস্তবের সঙ্গে জীবনের বাস্তব যোগ ঘটে না। ফলে শেষ পর্যন্ত জীবনের সত্য উপলব্ধি করাও সম্ভব হয় না। বস্তুত, জীবনের অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়েই মানুষ সত্য মিথ্যাকে চিনতে শিখে। চিন্তা ও কাজে নানা ভুলভ্রান্তির মধ্য দিয়েই মানুষ সত্যের স্বরূপকে চিনে নেয়। ভুলভ্রান্তির অভিজ্ঞতা থেকেই মানুষ সন্ধান পায় সত্য পথের। মিথ্যাকে ঠেকাবার চেষ্টায় জীবনের সমস্ত দুয়ারগুলো বন্ধ করে দিলে সত্য মানুষের দুয়ারে কখনো আপনা আপনি এসে ধরা দেয় না। সাঁতার শিখতে হলে যেমন পানিতে নামতে হয়, সত্যকে পেতে হলে তেমনি নামতে হয় জীবনের পথে।

ভুল-ভ্রান্তির ভয়ে কর্মবিমুখ হলে তাতে জীবনে সাফল্য আসে না, নিত্য নতুন সত্য আবিষ্কারও সম্ভব হয় না।


এই ভাবসম্প্রসারণটি অন্য বই থেকেও সংগ্রহ করে দেয়া হলো


মানুষের জীবনে সত্য-মিথ্যা, ভাল-মন্দ একত্রে জড়িয়ে আছে। একটিতে ছাড়া অপরটিকে যথাযথ উপলব্ধি করা যায় না বলে উভয়েই উভয়ের পরিপূরক। তাই জীবনের প্রয়োজনে সত্য-মিথ্যা চিরন্তন। পৃথিবীতে যারা মিথ্যা ও ভূল-ভ্রান্তিকে বাদ দিয়ে কেবলমাত্র সত্য লাভের পথ খোঁজে তারা কখনোই সত্যের নাগাল পায় না। বস্তুত জীবনের অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়েই সত্য এবং মিথ্যাকে, ভ্রান্তি এবং অভ্রান্তিকে চিনে নিতে হবে।

সত্যই জীবন, সত্যই আলো- পৃথিবীতে মানুষ চায় মিথ্যার কুহকে পথভ্রান্ত না হতে, তার একান্ত কাম্য ও লক্ষ্য ’সত্য’। কিন্তু সত্যকে সহজে পাওয়ার ও চেনার কোনো পথ নেই। কেননা সত্য এমন কোন বিশুদ্ধ ধারণা নয় যে তাকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে জীবনের সকল গতিবিধিকে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। সত্য হল একটি আপেক্ষিক ধারণা। জীবনের বাস্তব অভিজ্ঞতার মাধ্যমেই সত্য-মিথ্যাকে চিনে নেওয়া যায়। দিনকে যেমন রাতের সাথে তুলনা করেই চেনা যায়, তাপকে যেমন শৈত্যের সাথে তুলনা করে অনুভব করা যায়, সত্যকে তেমনি মিথ্যার পাশাপাশি রেখেই উপলব্ধি করতে হয়। ভুল বা মিথ্যা মানবজীবনের অনিবার্য একটি ঘটনা। তাকে স্বীকার করেই তাকে অতিক্রম করতে হয়, এড়িয়ে গেলে নয়। মানবজীবনের একেকটি ভুল মানুষকে এক বা একাধিক সত্যের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়। পার্থিব জগতে সত্য ও মিথ্যার রয়েছে পাশাপাশি অবস্থান। সত্য-মিথ্যা পরস্পর এমন অবিচ্ছেদ্য যে, নিরবচ্ছিন্ন সত্য এবং মিথ্যাকে পৃথক পৃথকভাবে উদ্ঘাটন করা সম্ভবপর নয়। জীবনের বাস্তব অভিজ্ঞতায় দুর্গম পথে চলতে চলতে এ-সব ভুলভ্রান্তি ও মিথ্যাকে অপসারিত করেই মানুষকে সত্যের মুখোমুখি দাঁড়াতে হয়। অজস্র ভুলভ্রান্তিকে অতিক্রম করলেই যথার্থ সত্যের সন্ধান মেলে। যেমন অন্ধকারের মধ্যেই আলোর উজ্জ্বলতা ধরা পড়ে, তেমনি ভ্রান্তির মোহাবরণকে ছিন্ন করেই সত্যের জ্যোতির্ময় রূপ ধরা পড়বে। শিশু যেমন আছাড় খেতে খেতে হাঁটতে শেখে, মনুষও তেমনি ভুলভ্রান্তির মধ্য দিয়ে সত্যকে চিনে নেয়। জীবনের সকল দ্বার রুদ্ধ করে দিলে হয়ত ভ্রান্তিকে ঠেকানো যায়, কিন্তু সত্যকে পাওয়া যায় না। আকরিক ধাতু যেমন মটির সাথে মিশে থাকে, মটি পরিষ্কার করে তাকে পেতে হয়, জীবনের পথেও তেমনি সত্য ও মিথ্যা মিলে আছে। জীবন-অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়েই সত্যকে প্রতিষ্ঠা করতে হয়। এ-জন্যে কাঙ্ক্ষিত হিরন্ময় সত্য উদ্ঘাটনে বাস্তবের কঠিন ও দুর্গম পথে প্রয়োজন নিঃশঙ্ক দীপ্ত পদচারণা।

ছোটখাট ভুলভ্রান্তি সত্যকে পাওয়ার পথে প্রতিবন্ধক বা অন্তরায় নয়, বরং ভুলভ্রান্তি থেকে বাস্তব অভিজ্ঞতা লাভ করেই মানুষ প্রকৃত সত্যকে উদ্ঘাটন করে।

2 Comments

Post a Comment
Previous Post Next Post