দণ্ডিতের সাথে
দণ্ডদাতা কাঁদে যবে সমান আঘাতে
সর্বশ্রেষ্ঠ যে বিচার
ন্যায়বিচার একটি অত্যন্ত সূক্ষ্ম ব্যাপার। সমাজে শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষা ও অপরাধ প্রবণতা রোধ করার স্বার্থে অপরাধীর দণ্ডদানের ক্ষেত্রে আবেগ বা ভাবালুতার যেমন স্থান নেই, প্রতিহিংসা বা কোনো পূর্বধারণার প্রভাবও পরিহার্য। অবিচল ধৈর্য এবং নিরপেক্ষভাবে বিচার করাই কাঙ্ক্ষিত, যদি অপরাধীকে দণ্ডিত করতে হয়, তা ক্রোধ বা ঘৃণা সহযোগে না হওয়াই বাঞ্ছনীয়। এতে অবিচারের সম্ভাবনা থেকে যায়। এক্ষেত্রে নিরপেক্ষতার সঙ্গে সহানুভূতির মাত্রা যোগ হলেই বিচার মানবিক রূপ পায়, এর শ্রেষ্ঠত্ব তখনই।
আধুনিক সমাজে বিচারের মূল লক্ষ্য প্রকৃত অপরাধীর যথাযোগ্য শাস্তি বিধান এবং সেই সঙ্গে নিরপরাধের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। এই লক্ষ্য তখনই সাধিত হবে যখন বিচারে প্রামাণিক সাক্ষ্য ও মানবিক বিবেচনার সমন্বয় ঘটবে। পূর্বধারণার প্রভাবদুষ্টতা তো বটেই, পেশাদারি নির্লিপ্ত মনোভাবও এখানে কাম্য নয়। অভিযুক্ত বা অপরাধী ব্যক্তি প্রথমত একজন মানুষ। সে আমাদের সমাজেরই একজন। ব্যক্তিমানুষের অপরাধ প্রবণতার পিছনে কেবল যে ব্যক্তি নিজে দায়ী থাকে তা নয়, অনেক সময় পরোক্ষভাবে সমাজও তাকে অপরাধপ্রবণ করে তোলে। তাই অপরাধীর বিচারের ক্ষেত্রে তার প্রতি মমত্ববোধ সর্বদাই একটি কাঙ্ক্ষিত গুণ। বিচারকের কাছেও এটা আশা করা যায়। অপরাধীকে যান্ত্রিকভাবে শাস্তি বিধানের চেয়ে তার মধ্যেকার শুভচৈতন্যকে জাগ্রত করে তাকে সমাজ জীবনের কল্যাণধর্মী মূলস্রোতে পুনরায় ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে দণ্ড বিধান করতে হলে বিচারককে হতে হয় সমব্যথী ও সহানুভূতিশীল। তবে এই মমত্বের অর্থ এই নয় যে, বিচারক গুরু পাপে লঘু দণ্ড দেবেন। তাহলে মমত্ববোধই আইনকে প্রভাবিত করবে। বিচারক অবশ্যই তাঁর পবিত্র দায়িত্ব পালনের সর্বোচ্চ আসন থেকে নিরপেক্ষবাবে পবিত্র দায়িত্ব পালন করবেন। তবে তিনি যদি নিজেকে আসামির কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে বিচারকের ভূমিকা পালন করেন, যদি দণ্ডিতের শাস্তির বেদনায় ব্যথিত হন এবং তাঁর বিচার যদি নির্মমতা ও নিষ্ঠুরতার পরিচায়ক না হয় তবে সে বিচার শ্রেষ্ঠ বিচার। কারণ, আসামির প্রতি সহানুভূতিশীল থেকেও বিচারক যদি তাকে শাস্তি দিতে বাধ্য হন, তবে সেই বিচারের সৌক্তিকতা সম্পর্কে কোনো সন্দেহ থাকে না। দণ্ডিত স্বজন হন বা অপরিচিত হন, বিচারের চিরায়ত মনুষ্যত্বের আদর্শে অনুপ্রাণিত বিচার সর্বাবস্তায় আইনের সুপ্রয়োগে সাহায্য করে। তাহলেই বিচার হয় সার্থক।
এই ভাবসম্প্রসারণ অন্য বই থেকেও সংগ্রহ করে দেয়া হলো
বিচারকের কাজ অপরাধীর শাস্তি বিধান করা। বিচারের মূল লক্ষ্য হল প্রকৃত অপরাধীর শাস্তি বিধান করা এবং নিরপরাধের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। এই লক্ষ্য তখনই সার্থক হবে, যখন বিচারের মধ্যে প্রামাণিক সাক্ষ্য ও মানবিক বিবেচনার সমন্বয় ঘটবে।
ন্যায়-অন্যায় নিয়েই আমাদের কর্মজীবন। ন্যায়নিষ্ঠ ব্যক্তি সর্বত্র সাধুবাদ পেয়ে থাকে। পক্ষান্তরে, অন্যায়কারী হয় দণ্ডিত। অন্যায় করেছে বলে অন্যায়কারীকে যথোচিত শাস্তি দিতে হয় বটে, তবে সে শাস্তি যান্ত্রিক না হওয়াই কাম্য। কারণ, অন্যায়কারীও মানুষ। অন্যায়কারী হিসেবে তার প্রাপ্য শাস্তি, একইসাথে একজন মানুষ হিসেবে তার প্রাপ্য সহানুভূতি, মমত্ববোধ এবং ভালবাসা। তাই তাকে সংশোধনের পথ দেখাতে হবে। তার নির্মল জীবনযাপনের সম্ভাবনার দ্বার খুলে দিতে হবে অপরাধীকে ন্যায়ের পথে আনাই বিচারের লক্ষ্য হওয়া উচিত। এ প্রসঙ্গে পবিত্র বাইবেলে ঘোষিত হয়েছে, ’পাপকে ঘৃণা কর, পাপীকে নয়।’ তাই অপরাধীর প্রতি সহানুভূতিশীল হয়ে বিচারকের দায়িত্ব পালন করতে হবে। একমাত্র সহানুভূতিমিশ্রিত দণ্ডই পারে অন্যায়কারীর মনে অনুশোচনা জাগাতে; অন্যথায় তার মনে আইনের প্রতি লেশমাত্র শ্রদ্ধাবোধ থাকবে না, সে আরও বেপরোয়া হয়ে উঠতে পারে। বিচারের মাধ্যমে অপরাধীকে বুঝিয়ে দিতে হবে অপরাধ নিন্দনীয়। তবে এই মমত্বে অর্থ এই নয় যে, বিচারক গুরু পাপে লঘু দণ্ড দেবেন। তাহলে বিচারকার্য ব্যাহত হবে। এ প্রসঙ্গে এ উক্তিটি প্রণিধানযোগ্য, The judge is not real judge who has no humanitarian feeling for the accesed –অর্থাৎ, অপরাধীর প্রতি সহৃদয় অনুভূতিহীন বিচারক প্রকৃত বিচারক নয়। বিচারক অবশ্যই তাঁর পবিত্র দায়িত্ব পালনের সর্বোচ্চ আসন থেকে নিরপেক্ষভাবে পবিত্র দায়িত্ব পালন করবেন। এটাই সকলের কাম্য।
বিচারকের দায়িত্ব সুকঠিন বলেই তিনি সমাজের শ্রেষ্ঠ মর্যাদার আসনে সমাসীন। দণ্ডিতের প্রতি বিচারকের সমবেদনা থাকতেই পারে, কিন্তু তা যেন তাঁর প্রাপ্য দণ্ডকে লঘু না করে। বিশ্ববিধানের শৃঙ্খলাকে যে ভঙ্গ করেছে, মনুষ্যত্বকে যে আঘাত করেছে দণ্ড তাকে গ্রহণ করতেই হবে। হৃদয়াবেগের বশীভূত হয়ে তার অপরাধকে মার্জনা করার অধিকার কারোর নেই। ভালবাসা সত্ত্বেও যিনি অপরাধীকে মার্জনা না করে যথাযোগ্য দণ্ড দিতে পারেন তিনিই শ্রেষ্ঠ বিচারক। দণ্ডিতের বেদনা তাঁর বুকে বাজবে, কিন্তু দণ্ডদানে তিনি অবিচলিত থাকবেন।
Thank you very much.
ReplyDelete