ভাবসম্প্রসারণ : কত বড়ো আমি, কহে নকল হীরাটি- / তাই তো সন্দেহ করি নহ ঠিক খাঁটি

কত বড়ো আমি, কহে নকল হীরাটি-
তাই তো সন্দেহ করি নহ ঠিক খাঁটি
অথবা
দেখিতে যা বড়,
চক্ষে যাহা স্তূপাকার হইয়াছে জড়ো,
তারি কাছে অভিভূত হয়ে বারে বারে
লুটায়ো না আপনায়।

মহৎ প্রতিভা এবং মহান সুকৃতি আত্মপ্রচারের অপেক্ষা রাখে না। গুণমুগ্ধ অনুসারী, উপকৃত উত্তরাধিকারী এবং ঘনিষ্ঠ সুহৃদজনের কাছে তা পায় অকুণ্ঠ স্বীকৃতি। আর তার প্রকাশও স্বতঃস্ফূর্ত। আত্মপ্রচার এক হাস্যকর আস্ফালন, তা ব্যক্তির অন্তঃসারশূন্য রূপটিকেই প্রকট করে তোলে। মানুষের যে অহংকার থাকে না, তা নয়। যে অহংকার আত্মবিশ্বাস যোগায়, তার প্রকাশ হয় বিনীত, পরিমিত ও রুচিশীল। জ্ঞানী-গুণী ব্যক্তি নিজের গুণগত বৈশিষ্ট্যেই হন আলোকিত মানুষ। তাঁর নিজের ক্ষমতা জাহিরের প্রয়োজন হয় না। তাঁদের সুকৃতির আলোতেই লোকে তাঁদের পরিচয় পায়। কিন্তু যাদের কোন সুকৃতি নেই তারাই প্রচারসর্বস্ব পন্থায় নাম কেনার জন্যে ব্যাকুল হয়ে ওঠে।

সূর্যের আলো যেমন স্বতঃদীপ্ত, ফুলের সুবাস যেমন স্বতোৎসারিত, মানুষের স্বভাবজাত ও অর্জিত গুণাবলিও তেমনি। প্রকৃত গুণীব্যক্তির তাই স্বীকৃতি পাবার জন্যে বাড়তি চেষ্টার প্রয়োজন নেই। তাই দেখা গেছে, প্রকৃত ধীমান কখনো অহেতুক আত্মপ্রচারের কৌশলী পন্থা অবলম্বনে মেতে ওঠেন না, স্বীকৃতি বা সমাদরের মুখাপেক্ষী এঁরা নন। নিজেদের অন্তঃকরণকে পবিত্র আত্মপ্রসাদে আলোকিত করেই তাঁরা সন্তুষ্ট। মানবব্রতী নীরব সাধনাতেই এঁরা মগ্ন থাকেন। পক্ষান্তরে যাদের কর্মের ভাণ্ডার শূন্য; নিষ্ঠা, সাধনা ও শ্রমে যারা বিমুখ তারাই সাময়িক সমাদরের আশায় আত্মপ্রচারণার মাধ্যমে নিজের মহিমা কীর্তনের পথ বেছে নেয়। এবং এভাবেই আত্মপরিতৃপ্তি লাভ করে। শূন্য কলসি যেমন সামান্য আঘাতেই বড় শব্দ করে, গুণহীন অসার ব্যক্তিরাও তেমনি কারণে-অকারণে নিজের ঢোল নিজে বাজায়। সুযোগ পেলেই অন্যকে ছোট করে নিজের অসাধারণত্ব প্রমাণ করতে সচেষ্ট হয়। এদের এই আত্মপ্রচার-প্রবণতা স্বভাবতই এদের অবদানের গুরুত্ব সম্পর্কে সন্দেহ উদ্রেক করে। এরা আসলে খাঁটি হীরে নয়, নকল হীরে তা বুঝতে ‍খুব দেরি হয় না।


এই ভাবসম্প্রসারণটি অন্য বই থেকেও সংগ্রহ করে দেয়া হলো


মূলভাব : সমাজে এক শ্রেণীর মানুষ আছে, যারা নিজেকে ভাল মানুষ বলে জাহির করলেও লোকের কাছে এরা ঘৃণারই পাত্র।

সম্প্রসারিত ভাব : নিজের আসল পরিচয় গোপন রেখে যদি নিজেকে বড় বলে অহংকার করা হয় তাহলে তার অন্তসারশূণ্যতা সহজেই ধরা পড়ে। মিথ্যা বাহদুরী জীবনকে বড় করে না, বরং আসল পরিচয় বের করে নিজের দীনতাকে সহজে ব্যক্ত করে দেয়।

নকল হীরা নিজেকে বড় বলে প্রচার করার চেষ্টা করে। তার এ অহংকারবোধ থেকে তার আসল পরিচয় বড় হয়ে ওঠে। সে নিজে নকল বলে বড়র বড়াই করে। সে যদি আসল হীরা হত তবে তার অহংকার করার প্রয়োজন হত না। সে যে বড় তা তার নম্রতা থেকে প্রকাশ পেত। নিজের হীনতা গোপন করার জন্য সে মিথ্যার আশ্রয় গ্রহণ করে। পরিণামে তা স্বরূপ প্রকাশ পেয়ে যায়। মানুষের মধ্যেও এ বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যায়। নিজের দুর্বলতা গোপন রাখার জন্য অনেকে মিথ্যার আশ্রয় নেয়। কিন্তু মিথ্যা দিয়ে সত্য গোপন করা যায় না। সত্যের স্বরূপ এক সময় প্রকাশিত হয়ে পড়ে। আর যে ব্যক্তি মহৎ সে তার চরিত্রে সংযমী হয় এবং অহংকারের আশ্রয় গ্রহণ করে না। তার মহত্ত্ব তার কাজের মাধ্যমে ফুটে ওঠে। কিন্তু হীনপ্রাণ ব্যক্তিরা নিজের নীচ পরিচয় গোপন রাখার জন্য অনাবশ্যক বাহদুরী করে। আর এ বাহদুরীই তার স্বরূপ প্রকাশ করে দেয়।

যারা সত্যিকারের ভাল মানুষ তারা কখনো অন্যায়ের সাথে আপোস করে না। এবং মিথ্যাকে প্রতিহত করে। অর্থাৎ ভাল মানুষ কখনও মিথ্যার আশ্রয় গ্রহণ করে না।

1 Comments

Post a Comment
Previous Post Next Post