প্রবন্ধ রচনা : বাংলাদেশের প্রাকৃতিক দুর্যোগ

ভূমিকা : জীবন-সংগ্রামী মানুষ প্রতিকূল প্রকৃতিকে জয় করে গড়ে তুলছে সভ্যতার সৌধ। কিন্তু বৈরী প্রকৃতি সুযোগ পেলেই মানুষের জীবন ও সম্পদের ওপর আঘাত হানে। আকস্মিক প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে তছনছ করে দেয় মানুষের সাজানো সংসার, ভেঙে চুরমার হয়ে যায় কত মানুষের স্বপ্নসৌধ। কোনো কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগের প্রতিকূলতায় হয়ত মানুষ অভ্যস্ত হয়ে যায়, যেমন বাংলাদেশের নিম্নাঞ্চলে ছোটখাটো জলস্ফীতি বা প্লাবন। কিন্তু আকস্মিক বিশাল প্লাবন যখন ভয়াবহ বন্যায় রূপ নিয়ে ঘর-দোর, ধন-সম্পদ, ফল-ফসল সব ভাসিয়ে নিয়ে যায় তখন মানুষের স্বাভাবিক জীবন হয়ে পড়ে বিপর্যস্ত। বেঘোরে প্রাণ হারায় মানুষ, নষ্ট হয়ে যায় ক্ষেতের ফসল, বিপুল ক্ষয়ক্ষতি হয় ঘরবাড়ির, গৃহপালিত পশুপাখির। প্রাকৃতিক বিপর্যয় বলতে এ ধরনের ঘটনাকেই বোঝায়। মূরত আবহাওয়া বা ভৌগোলিক কারণে এগুলো ঘটে থাকে এবং এর ফলে মানুষের জীবন, সম্পদ কিংবা প্রাকৃতিক পরিবেশের মারাত্মক ক্ষতি হয়।

বিভিন্ন ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগ : প্রকৃতিতে যে নিরন্ত্রর তেজস্ক্রিয়া সংঘটিত হচ্ছে কিংবা বায়ুমণ্ডলে যে বিষাক্ত ধাতুর মিশ্রণ ঘটছে তাও এক ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগ, কিন্তু তা আমরা সবসময় খেয়াল করি না। আর এক ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগকে বলা চলে মানবসৃষ্ট দুর্যোগ। যেমন চের্নোবিল পারমাণবিক দুর্ঘটনা। বৃক্ষনিধনের ফলে সৃষ্ট বন্যা পরোক্ষভাবে মানবসৃষ্ট প্রাকৃতিক দুর্যোগের মধ্যে পড়ে। কিন্তু প্রাকৃতিক দুর্যোগ বলতে সাধারণত সেগুলোই বেশি পরিচিত ও আলোচিত যা আকস্মিকভাবে হঠাৎ হঠাৎ ঘটে এবং যার ফলে বিপুল ও ব্যাপক বিপর্যয় ঘটে থাকে। দুনিয়াজোড়া ভয়াবহ প্রাকৃতিক দুর্যোগগুলোর মধ্যে পড়ে সাইক্লোন বা সামুদ্রিক ঝড়, জলোচ্ছ্বাস, বন্যা, খরা, ভূমিধস, ভূমিকম্প, আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাত ইত্যাদি। এ ধরণের দুর্যোগে বহু মানুষের প্রাণহানি ঘটে, পরিবেশ বিপর্যস্ত হয়, উৎপাদন ব্যবস্থা ভেঙে পড়ে, বিপন্ন মানুষের জীবন রক্ষার জন্যে অন্যদের সাহায্যের দরকার পড়ে।

প্রাকৃতিক দুর্যোগের ভয়াবহতা : মুহূর্তে লণ্ডভণ্ড ও ধ্বংস করার সবচেয়ে বেশি ক্ষমতা রাখে ভূমিকম্প এবং আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাত। ১৯০৬ সালের ভূমিকম্পে সানফ্রানসিস্কো শহরের প্রায় সবটাই ধ্বংস হয়ে যায়। ১৯৭৬ সালে চীনের সাংচি প্রদেশে ভূমিকম্পের ফলে ৮ লক্ষ ৩০ হাজার মানুষ প্রাণ হারায়। সর্বশেষ ২০১৫ সালে নেপালে সৃষ্ট ভূমিকম্পে নেপাল, চীন, ভারত ও বাংলাদেশে প্রায় ৬ হাজার ৫’শ মানুষ মারা যায়। আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাতের ফলেও ক্ষয়ক্ষতি হয় মারাত্মক। ৭৯ খ্রিষ্টাব্দে ইতালির ভিসুভিয়াস আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাতে হারকুলেনিয়াম ও পাম্পেই শহর সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত হয়। ১৮৮৩ সালে ইন্দোনেশিয়ায় ক্রাকতোয়া আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাতে ও বিস্ফোরণে এক দ্বীপের অর্ধেক বিলুপ্ত হয় এবং ৩৬ হাজার লোক প্রাণ হারায়। অগ্নুৎপাতের ফলে কেবল যে বিস্তীর্ণ এলাকা জ্বলন্ত লাভা ও কাদায় তলিয়ে যায় তা নয়; ধোঁয়া, বিপুল ভস্ম ও বিষাক্ত গ্যাস পরিবেশের ওপর মারাত্মক বিরূপ প্রতিক্রিয়া ঘটায়। আবহাওয়াগত যেসব প্রাকৃতিক বিপর্যয় তার মধ্যে পড়ে বিভিন্ন ধরনের ঘুর্ণিঝড়, খরা, বন্যা ও প্রকৃতিক অগ্নিকাণ্ড ইত্যাদি। ১৯৭০ সালে বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলের ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া সাইক্লোন ও জলোচ্ছ্বাসে ৫ লক্ষ লোকের মৃত্যু হয়। ১৯৯১ সালে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার সমুদ্রোপকূলে প্রাণ হারায় দেড় লক্ষ লোক। ২০০৭ সালে ঘূণিঝড় সিডরে প্রায় ২,২১৭ জন মানুষ মারা যায়। পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে বন্যায় প্রতিবছর ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হলেও বন্যার প্রকোপ সবচেয়ে বেশি দক্ষিণ এশিয়ায়। বাংলাদেশের বন্যা তার প্রমাণ। সর্বশেষ ২০১৬ সালে গত ২৮ বছরের মধ্যে সব চেয়ে ভয়াবহ বন্যা হয়, এতে প্রায় ৩৪ লক্ষ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। খরায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় কৃষিখাত। ফলে কৃষিনির্ভর অর্থনীতি ভেঙে পড়ে। বিশ শতকের সবচেয়ে ভয়াবহ খরায় বিপর্যস্ত হয়েছিল আফ্রিকার সাহেল অঞ্চল। এই খরা ১৯৬৮ সালে শুরু হয়ে ১২ বছর অব্যাহত থাকে। কয়েক বছর আগে ইন্দোনেশিয়ায় শতাব্দীর সবচেয়ে মারাত্মক খরায় বনে দাবানল লেগে যায়। আর এর ফলে প্রচণ্ড ধোঁয়া আর কুয়াশা মিলে তৈরি ধোঁয়াশায় মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড, ব্রুনাই, ফিলিপিনসহ ‍বিপুল এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে। এসব এলাকায় মাসের পর মাস স্বাভাবিক কাজকর্ম অচল হয়ে পড়ে। এর ফলে এসব এলাকায় কৃষি ফসল দারুণভাবে মার খায়।

প্রতিকার ও প্রতিরোধের উপায় : যথাযথ প্রস্তুতি গ্রহণ করা হলে অনেক ক্ষেত্রে প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও বিপর্যয় মোকাবেলা করে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ বহুলাংশে কমানো সম্ভব হয়। এই প্রস্তুতিমূলক কাজের মধ্যে যেটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তা হল আগাম সতর্কতা। আবহাওয়া বিজ্ঞানের যুগান্তকারী অগ্রগতির ফলে এখন বন্যা, ঘুর্ণিঝড় ও জ্বলোচ্ছ্বাস, খরা ইত্যাদি সম্পর্কে আগাম সতর্কতা প্রদান সম্ভব হচ্ছে। উপযুক্ত প্রস্তুতি গ্রহণ করার মাধ্যমে সাম্প্রতিক কালে ঘূর্ণিঝড়ের মতো দুর্যোগ মোকাবেলায় বাংলাদেশের যথেষ্ট সাফল্য অর্জিত হয়েছে। এ ছাড়া দুর্যোগ মোকাবেলা কার্যক্রমের মধ্যে পড়ে দুর্যোগকালে ক্ষয়ক্ষতি যথাসম্ভব প্রশমনের ব্যবস্থা গ্রহণ, দুর্যোগের পর ও পুনর্বাসন ও পুনর্গঠন, দুর্যোগ প্রতিরোধে পদক্ষেপ গ্রহণ এবং দুর্যোগ মোকাবেলার লক্ষ্যে অবকাঠামোগত ও সামাজিক উন্নয়নের ব্যবস্থা গ্রহণ।
দুর্যোগ মোকাবেলার বিষয়টি সাম্প্রতিককালে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছেও বিশেষ গুরুত্ব পেয়েছে। জাতিসংঘ বিশ্বব্যাপি দুর্যোগ মোকাবেলার ক্ষেত্রে সচেতন প্রয়াসে সবগুলো সদস্য দেশকে সম্পৃক্ত করার জন্যে বিশ শতকের ৯০-এর দশককে প্রাকৃতিক দুর্যোগের ক্ষতি কমাবার আন্তর্জাতিক দশক হিসেবে পালন করেছে।

বাংলাদেশে প্রকৃতিক দুর্যোগ : বাংলাদেশে যেসব প্রাকৃতিক দুর্যোগ সাধারণত প্রায়ই স্বাভাবিক জনজীবনকে বিপর্যস্ত করে তোলে সেগুলো হল বন্যা, টর্নেডো, সাইক্লোন, জলোচ্ছ্বাস, নদীভাঙন, জমিতে লবণাক্ততার আক্রমণ ইত্যাদি। মাঝে মাঝে দেখা দেয় খরা। কখনো কখনো ভূমিকম্পেরও প্রকোপ দেখা দেয়। এসবের মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ রূপ নিয়ে আসে সাইক্লোন বা সামুদ্রিক ঝড় ও জলোচ্ছ্বাস। এর ফলে প্রায়ই বিপুল ক্ষয়ক্ষতি বহন করতে হয় আমাদের। আমাদের দেশে বন্যা প্রায় নিত্য নৈমিত্তিক ঘটনা।

উপসংহার : বর্তমানে সারা বিশ্ব প্রাকৃতিক দুর্যোগের বিপুল ক্ষয়ক্ষতি এড়াবার লক্ষে দুর্যোগ মোকাবেলার দিকটিকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছে। আমাদের দেশে ভৌগোলিক কারণে প্রাকৃতিক দুর্যোগপ্রবণ এলাকা হিসেবে বিশেষভাবে চিহ্নিত হয়ে আছে। এখানে অহরহ প্রাকৃতিক দুর্যোগ ঘটছে, বিপুল ক্ষয়ক্ষতি হচ্ছে। তাই বিপর্যয়ের হাত থেকে রক্ষা পেতে দুর্যোগ মোকাবেলার জন্যে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নিয়ে আমাদের এগুতে হবে। দুর্যোগের ক্ষয়ক্ষতি এড়ানোর লক্ষ্যে জনগণকে সচেতন ও শিক্ষিত করে তুলতে হবে। যে-কোনো লোক যেন যে-কোনো পরিস্থিতিতে দুর্যোগ প্রস্তুতি, ত্রাণ ও পুনর্বাসনের কাজে দ্রুত অংশ গ্রহণে সক্ষম হয় সেজন্যে বিশেষ প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। এ ব্যাপারে চাই জাতীয় কর্মোদ্যোগ এবং দলমত নির্বিশেষ সকলের সক্রিয় অংশগ্রহণ।

7 Comments

  1. nice rochona
    Rochanar pera gula ektu beshi hole valo hoi

    ReplyDelete
    Replies
    1. Tor vallage na ja dise? J joto pae se Toto chae

      Delete
  2. You can some point which are briefing like বন্যা, সাইক্লোন, ভূমিকম্প and all that.

    ReplyDelete
  3. Very helpful. I'm reading this just a night before my Bengali exam so it's like a blessing for me to have this paragraph about this matter. Thank you so much. Keep writing 😉

    ReplyDelete
Post a Comment
Previous Post Next Post