রচনা : বিজ্ঞান শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা

↬ বিজ্ঞান শিক্ষার গুরুত্ব

↬ বিজ্ঞান শিক্ষার উপযোগিতা

↬ গঠনমূলক কর্মে বিজ্ঞান


ভূমিকা :
"We need science more
than ever before."
                                                   -Holden
শিক্ষার প্রকৃত উদ্দেশ্য সুপ্ত মানুষ্যত্বের জাগরণ; সৎ ও অসত্যের এবং ভালো ও মন্দের পার্থক্য নির্ণয় করে আত্মোপলব্ধি। বিজ্ঞান শিক্ষা একটি বিশেষ ধরনের শিক্ষা হলেও শিক্ষার মূল স্রোতধারা থেকে বিচ্ছিন্ন নয়; বরং কোনো কিছু বিশেষরূপে জানার অর্থই যদি হয় বিজ্ঞান তো বিজ্ঞান শিক্ষার অর্থ এমন এক শিক্ষা যা মানুষকে বিভিন্ন বিষয়ে বিশেষরূপে জানতে সহায়তা করে। আবার এই জানা ব্যাপারটি একদিকে যেমন জ্ঞানের পরিপোষক, অন্যদিকে তেমনি জ্ঞানের বিনাশক। অতএব, বিজ্ঞান শিক্ষা বলতে এমন এক শিক্ষা বোঝায়, যা আমাদের জ্ঞানান্ধকার দূর করে যথার্থ জ্ঞানের আভাস দেয় এবং মনুষ্যত্বের জাগরণ ঘটিয়ে আত্মোপলব্ধি তথা বিশ্বজগতের স্বরূপ উপলব্ধিতে সহায়তা করে।

বিজ্ঞান শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা ও গুরুত্ব : জীবনে সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য বিধানকল্পে মানুষ একদা বিজ্ঞানচর্চা শুরু করেছিল। বিজ্ঞানের কল্যাণ মূর্তিতে বিমুগ্ধ মানুষ সেদিন পরম বন্ধুর মতো বরণ করে নিয়েছিল তাকে। বিজ্ঞানের হাত ধরে মানুষ সেদিন পেয়েছিল জীবনের নিরাপত্তার প্রতিশ্রুতি, পেয়েছিল জীবনের সুখ এবং স্বাচ্ছন্দ্যের আশ্বাস। মানুষ সেদিন বিজ্ঞানকে জিবনযাত্রার সহচর করে জীবনকে করে তুলছিল সহজ এবং স্বাভাবিক। বিজ্ঞানের এই গুরুত্ব ও বিশিষ্টতাকে মেনে নিলে সকল দেশে সর্বকালে এর উপযোগিতাকে মানতে হয়। যুগে যুগে মানুষ কমবেশি পরিনাণে তা মেনেও নিয়েছে। তাই শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে বিজ্ঞানের যেমন উন্নতি ঘটছে, বিজ্ঞান শিক্ষাও তেমনি হয়েছে সম্প্রসারিত। মানুষ শিখেছে যে, জ্ঞানজগৎ পারাবার অতিক্রমণের অন্যতম শ্রেষ্ঠ তরণী এবং জগৎ রহস্যের স্বরূপ অন্বেষণে আগ্রহী না হলে স্ব স্ব চৈতন্যের বিকাশও অসম্ভব। মানুষের এই গভীর গোপন অনুভূতিই তাকে বিজ্ঞান শিক্ষায় অনুপ্রাণিত করেছে এবং দেশে দেশে, কালে কালে মানুষ একদিকে বাহ্যিক প্রয়োজনে অন্যদিকে অন্তর্নিহিত প্রেরণার তাগিদে বিজ্ঞান শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা বা গুরুত্ব উপলব্ধি করেছে।

বিজ্ঞান আমাদের শিক্ষা দেয়- যে শিক্ষা ধারাবাহিক বিশ্লেষণপন্থী ও বাস্তবসম্মত। একটি বাস্তব কার্যকরণ নিয়মের আবিষ্কার বিজ্ঞানের কাজ। কেন হচ্ছে, কী জন্য হচ্ছে, বিজ্ঞানই তা বলে দিতে পারে। বিজ্ঞানের ব্যাপক বিস্তারে, বিকাশে, রূপদানে যেকোনো জাতি বা দেশের সর্বাঙ্গীণ উন্নতি নির্ভর করে। কেবল ছোট বড় কলকারখানা গড়ে তোলা বিজ্ঞানের কাজ নয়, কৃষির উন্নতির জন্যও বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির সাহায্য নেওয়া হয়ে থাকে। চাষাবাদের উন্নতির জন্য, নদীর ধারা নিয়ন্ত্রণের জন্য, বন্যা নিয়ন্ত্রণ, কুসংস্কার দূরীভূত, বেকারত্বের লাঘব ইত্যাদির জন্য বিজ্ঞানের সাহায্য গ্রহণ করা হয়। কাজেই বিজ্ঞান শিক্ষার ‍গুরুত্ব অনেক।

দেশ ও জাতি গঠনে বিজ্ঞান শিক্ষা : দেশ ও জাতি গঠনের ক্ষেত্রে নানা ধরণের বিজ্ঞান শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা আছে। উন্নয়নশীল একটি দেশের জন্য প্রচুর ডাক্তার, প্রকৌশলী যেমন দরকার, তেমনি দরকার কৃষিবিজ্ঞানী ও পশুবিজ্ঞানী। তবে মনে রাখা দরকার যে, সাধারণ বিজ্ঞান শিক্ষা সবাই পারে, কিন্তু কারিগারি বিজ্ঞান শিক্ষার আয়োজন করতে হবে দেশের প্রয়োজনের দিকে লক্ষ রেখে। উচ্চতর বৈজ্ঞানিক গবেষণাও এমনভাবে পরিচালিত হওয়া উচিত, যাতে একদিকে তা দেশের কল্যাণ বিধানে সমর্থ হয় এবং অন্যদিকে বিদেশের কাছে স্বদেশের ভাবমূর্তিকে উজ্জ্বল করে। উপযুক্ত কাজ না পেয়ে বিজ্ঞান বিদ্যায় উচ্চ শিক্ষিত বহু ব্যক্তি আজ যে বিদেশে পাড়ি দিচ্ছে, বিদেশে পড়ালেখা শেষ করে আর দেশে ফিরে আসছে না, এটা দেশ এবং জাতির জন্য অত্যন্ত লজ্জাকর ও ক্ষতিকর। বিজ্ঞানে উচ্চ শিক্ষিতরা যেমন স্বদেশের কথা ভাবে না, দেশও তেমনি তাদের কথা ভাবে না। অর্থাৎ দেশের সঙ্গে তাদের আত্মিক যোগসূত্রটি যেমন, তেমনি দেশের বৈষয়িক অগ্রগতির পথটিও অবলীলাক্রমে বিঘ্নিত হয়।

সামাজিক মানুষের জীবনে বিজ্ঞান শিক্ষার প্রভাব : সমাজের বিভিন্ন শ্রেণির মানুষের জীবনে বিজ্ঞান শিক্ষার প্রভব ও প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম। বিজ্ঞানের সঙ্গে সামান্যতম পরিচিত চাষী মাত্রই জানেন যে, সময়মত বৃষ্টি না হলে অদৃষ্টকে ধিক্কার দিতে দিতে চোখের জলে বুক ভাসিয়ে লাভ নেই। তার চেয়ে কৃত্রিম উপায়ে পানি সেচের ব্যবস্থা করা বুদ্ধিমানের কাজ। সত্য বলতে কি, বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশের কৃষকদের মধ্যে উপযুক্ত বিজ্ঞান শিক্ষার প্রসার কৃষি উৎপাদনের ক্ষেত্রে যুগান্তর আনতে পারে। উন্নত বীজ, উপযুক্ত সার, কীটনাশক ওষুধ এবং এক কথায় বিজ্ঞানভিত্তিক চাষাবাদ সম্পর্কে তারা যদি শিক্ষা পায় তাহলে প্রকৃত কৃষিবিপ্লব অচিরেই ঘটানো সম্ভব। কলকারখানায় কর্মরত শ্রমিকদের কিছুটা বিজ্ঞান শিক্ষা কাজের খাতিরেই অর্জন করতে হয়। কিন্তু সে শিক্ষার বেশিরভাগই যেহেতু যান্ত্রিক বা হাতে কলমে, তাত্ত্বিক সত্যের নিরিখে নয়, তাই প্রকৃত বিজ্ঞান শিক্ষায় শিক্ষিত হবার সুযোগ এদেশের অধিকাংশ শিল্পশ্রমিকই পায় না। এর ফলে এরা কখনো বা দুর্ঘটনায় সহজে শিকার হয়, আবার কখনো বা বহু বিচিত্র ভুল অভ্যাস ও ধারণাকে প্রশ্রয় দিয়ে নিজেদের সর্বনাশ নিজেরাই ডেকে আনে। বিজ্ঞান শিক্ষার উপযোগিতা মধ্যবিত্ত সমাজেও যথেষ্ট। মধ্যবিত্ত ঘরের একজন কলা বিভাগের স্নাতক পরীক্ষায় ভালো ফলই করুক না কেন বিজ্ঞান বিষয়ে অন্তত সাধারণ শিক্ষা যদি তার না থাকে তাহলে বলতে হবে, সে শিক্ষা অসম্পূর্ণ। ধনী বা উচ্চবিত্ত ঘরের ছেলেমেয়েরা টাকার জোরে অনেক কিছুই করতে পারে, এমনকি দেশ-বিদেশে গিয়ে সস্তায় ডিগ্রি সংগ্রহ করাও কঠিন কিছু নয়।

বিজ্ঞান শিক্ষার নানা স্তর ও উপকারিতা : বিজ্ঞান শিক্ষার রয়েছে নানা স্তর। উচ্চতর, মাধ্যমিক ও প্রাথমিক। বিজ্ঞান সম্পর্কে অন্তত প্রাথমিক জ্ঞান অর্জন না করলে এ যুগে শিক্ষাই অসম্পূর্ণ থাকে। ব্যক্তিগত জীবনে যেমন সমাজজীবনেও তেমনি মানুষ তার যথার্থ ভূমিকা পালনে অক্ষম হয়। স্বাস্থ্যরক্ষার সাধারণ বিধিনিয়মগুলো যে জানে না, খাদ্যের গুণাগুণ বা রোগ প্রতিরোধের ব্যবস্থা সম্পর্কে যার কোনো ধারণা নেই, নাগরিক হিসেবে নিশ্চয় সে দায়িত্বশীল হতে পারে না। বিজ্ঞান সম্পর্কে সাধারণ জ্ঞান থাকলে নানাদিক দিয়ে সুবিধা। কেউ রোগের যন্ত্রণায় বা সাময়িক স্নায়ু বৈকল্যের ফলে ভুল বকলে ওঝা ডাকতে হয় না, অষ্টগ্রহ সম্মেলন বা স্কাইল্যাব বা পূর্ণগ্রাস সূর্যগ্রহণকে উপলক্ষ করে ঘরবাড়ি ছেড়ে পালাতে হয় না, শুধু তাবিজ বা মাদুলিকে সম্বল করে নিজেকে দৈবের হাতে সঁপে দিতে হয় না। এছাড়া বিজ্ঞান সম্পর্কে মোটামুটি ধারণা যাদের আছে, অর্থাৎ যারা মাধ্যমিক পর্যায়ের বিজ্ঞান শিক্ষায় নিজেদের শিক্ষিত করেছেন তারা তো এক হিসেবে ভাগ্যবান। তারা বিশ্বজগতের মধ্যে নিয়মের সূত্র অনুধাবন করেন, জগৎ-সংসারের বিভিন্ন ঘটনার মধ্যে কার্যকারণ সম্পর্কে আবিষ্কার করেন এবং সবচেয়ে বড় কথা, জগৎ-সংসারের স্বরূপ উপলব্ধির ব্যাপারে অনেকখানি জানেন। উচ্চতর বিজ্ঞান শিক্ষা সকলের পক্ষে সম্ভব নয়। যারা যোগ্য এবং যথার্থই আগ্রহী, শুধু তারাই এই শিক্ষা লাভের সুযোগ পান। উচ্চতর বিজ্ঞান শিক্ষা মানুষকে নব নব আবিষ্কারের উদ্বুদ্ধ করে দেশ ও জাতি গঠনে বিরাট ভূমিকা রাখে।

বিজ্ঞান শিক্ষার অভাবের কুফল : বিজ্ঞান শিক্ষার অভাবে যুগে যুগে সমাজ ও সভ্যতার অপূরণীয় ক্ষতি করেছে। সাগরে সন্তান বিসর্জন এবং সতীদাগের কথা ছেড়ে দিলেও বর্তমান যুগে দেবীকে প্রসন্ন করার বাসনায় নরবলির কথা বা ’সজ্ঞানে গঙ্গালাভ’-এর আশায় মুমূর্ষু রোগীকে গঙ্গা তীরে নিয়ে গিয়ে বুক সমান পানিতে ডুবিয়ে রাখা, আল্লাহকে খুশি করতে নিজের সন্তানকে কোরবানি করা সবাই বিজ্ঞান শিক্ষার অভাবে ঘটে যাওয়া ঘটনা। ডাইনী ভেবে কল্যাণময়ী আর্ককে একদিন পুড়িয়ে মারা হয়েছিল। আজো ডাইনী সংবাদ শোনা যায়। আজো দেখা যায় ভূতপ্রেতের অস্তিত্ব স্বীকার করে ঝাড়-ফুঁকের আশ্রয় নেওয়ার দৃশ্য। বিজ্ঞান শিক্ষার অভাবেই এমন উদ্ভট ধারণা পোষণ করছে মানুষ আর ভোগ করছে তার কুফল।

বিজ্ঞানের প্রভাব ও সুফল : বিজ্ঞান শিক্ষা মানুষকে যুক্তিনিষ্ঠ ও বিচারশীল করে। অন্ধ আবেগ, ভুল বিশ্বাস ও সর্বনাশা মূর্খতার কবল থেকে বাঁচায়। বিজ্ঞান শিক্ষার গুণে মানুষের বুদ্ধির বিকাশ ঘটে, চিন্তা-ভাবনা ও বোধশক্তির উন্নতি হয় এবং সবচেয়ে বড় কথা, সত্যোপলব্ধির পথে সে অনেক দূর এগিয়ে যায়। বিজ্ঞান শিক্ষা কুসংস্কারের বড় শত্রু। ’নজর’ লেগে ছেলে রোগা হয় বা গাছ মরে যায়, সামান্য পরিমাণেও যারা বিজ্ঞান শিক্ষা অর্জন করেছেন, নিশ্চয় তারা এসব কুসংস্কারে কান দেন না, বিশ্বাস করেন না। এছাড়া দেহের কোন একটি স্থানে টিকটিকি পড়লে অর্থাগম, হাঁচি-কাশির সাথে উন্নত-অবনতির সম্পর্ক, স্বপ্নযোগে প্রাপ্ত বিশেষ কোন দৈবীর দৈব ক্ষমতা বিজ্ঞান শিক্ষায় শিক্ষিতদের কাছে এর কোনো গুরুত্ব নেই। ধর্মের নামে গোঁড়ামিকে যারা প্রশ্রয় দেয়, প্রকৃত বিজ্ঞান শিক্ষা তাদেরও চৈতন্য জাগরণে সাহায্য করে।

সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগ : বিজ্ঞান শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা বা গুরুত্ব সম্পর্কে প্রচার-প্রচারণা চালিয়ে বিজ্ঞান শিক্ষায় উদ্বুদ্ধ করার জন্য সরকারের উদ্যোগই প্রধান। কৃষকদেরকে, শ্রমিকদেরকে বিজ্ঞান বিষয়ে জ্ঞানদানে সরকারকে উদ্যোগী হতে হবে। বিভিন্ন বিজ্ঞান মেলার আয়োজন এ বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। বিজ্ঞান শিক্ষার অগ্রগতির জন্য সরকারের পাশাপশি বেসরকারি সামাজিক সংগঠনগুলোরও এগিয়ে আসতে হবে।

উপসংহার : বিজ্ঞান শিক্ষার প্রয়োজনীয়তার কথা স্বীকার করে আগে আমাদের জনসাধারণকে শিক্ষিত করে তুলতে হবে। এদেশের কোটি কোটি মানুষ এখনো জগৎসংসার সম্পর্কে পুরোপুরি অজ্ঞ। আমাদের মনে রাখতে হবে, জাতির বিপুলসংখ্যক মানুষকে বাদ দিয়ে মুষ্টিমেয় লোক বিজ্ঞান শিক্ষায় শিক্ষিত হলে জাতীয় উন্নয়ন সম্ভব নয়। তাই দেশের সার্বিক উন্নতির লক্ষ্যে বিজ্ঞান শিক্ষার ওপর গুরুত্ব আরোপ করতে হবে এবং যথাসম্ভব আর্থিক দিক থেকে সহজলভ্য করতে হবে বিজ্ঞান শিক্ষাকে।


আরো দেখুন :

7 Comments

  1. আমি রচনাটি দিয়ে ভালো নমবর েয়েছি তাই বলছি আপনা দেরকে

    ReplyDelete
  2. খুব ভালো রচনা ,
    ধন্যবাদ

    ReplyDelete
  3. It's a very good composition for the students and besides, it helped me a lot to complete my assignment.

    ReplyDelete
  4. i read your books
    in lockdown
    i love to read your libary books

    ReplyDelete
  5. ami class e ei rochona likhe 10 e 10 peyechi

    ReplyDelete
Post a Comment
Previous Post Next Post