বিদ্যা বিনয় দান করে, বিনয় দ্বারা জগৎ বশীভূত হয়
বিদ্যা মানুষকে জ্ঞানদান করে, তাকে অন্ধকার জগৎ থেকে আলোর জগতে নিয়ে আসে।
বিদ্যা মানুষের অন্তরের চোখকে খুলে দেয়। মানুষ তখন জগৎ ও জীবন সম্পর্কে জানতে পারে; নিজের সম্পর্কে জানতে পারে। বিদ্যা বা শিক্ষা একটি জীবনব্যাপী প্রক্রিয়। ব্যক্তির সর্বাঙ্গীণ বিকাশের মাধ্যমে বাঞ্ছিত আচরণে পরিবর্তন আনয়নই শিক্ষার লক্ষ্য। তাই বলা হয়, “Education is the total development of a man and is a behavioural change in a man.” শিক্ষার উদ্দেশ্য শুধু পাঠ্যপুস্তক পাঠ করে পরীক্ষায় পাস করা নয় বা এর উদ্দেশ্য ভালো ফল করে ভালো চাকরি করা নয়। এর উদ্দেশ্য মানুষকে অর্থ চিন্তার শৃঙ্খল থেকে মুক্তি দান করা। তাকে মূল্যবোধ ও বিনয়ের শিক্ষাদান করা। যাদের মধ্যে বিনয়, মূল্যবোধ ও অপরের প্রতি যথাযথ সম্মান নেই, তাদের আমরা পশু বলতে দ্বিধাবোধ করি না। কারণ, মানুষ ও পশুর মধ্যে পার্থক্য এই যে মানুষের মধ্যে মনুষ্যত্ব মূল্যবোধ ও বিনয়ের অস্তিত্ব বিদ্যমান। আর পশুর মধ্যে মূল্যবোধ বা বিনয় নামক কিছুই নেই। আমাদের মানব সমাজেও আমরা মানুষরূপী পশু দেখতে পাই। অনেকেরই রেজাল্ট ভালো অথচ তাদের বিনয় জ্ঞান নেই। পথিমধ্যে একজন বৃদ্ধকে ঠেলে ফেলে সে অগ্রসর হয়। এটাই কি তার শিক্ষা বা জ্ঞান। শুধু পাঠ্যপুস্তকের মধ্যে জ্ঞান সীমাবদ্ধ নয়। আমাদেরকে বহির্বিশ্বের আচার-আচরণ, মনীষীদের বিনয়চারিতা সবই জানতে হবে এবং সুষ্ঠুভাবে এর প্রতিফলন ঘটাতে হবে। বিদ্যার যথার্থ মূল্যও নিরূপিত হয় মানুষের জীবনের সাথে তার সম্পর্কের তারতম্যে। বিদ্যা মানুষের কর্ম, প্রথা ও আচরণকে প্রভাবিত করে। বিদ্যা মানুষকে ভদ্রতা ও বিনয়ের শিক্ষা দেয়। বিদ্যা মানুষকে সুন্দরভাবে ও বিনয়ের সাথে অন্যের প্রতি আচরণ করতে শেখায়। তাই মানুষের আচরণে আসে বৈপ্লবিক পরিবর্তন। যে ব্যক্তি বিনয়ের সাথে মানুষের সঙ্গে কথা বলে, সবাই তাকে ভালোবাসে। তার আচরণে মুগ্ধ হয়। প্রশংসায় হয় মুখরিত। ফলে সে জ্ঞানের বাস্তবতা উপলব্ধি করতে পারে। বিশ্বের বিভিন্ন খ্যাতনামা ব্যক্তি যারা জগৎকে বশীভূত করতে সক্ষম হয়েছিলেন তাঁদের জীবনের প্রতি, তাঁদের আচার-আচরণের প্রতি দৃষ্টি দিলে আমরা দেখতে পাই যে, তাঁরা সবাই ব্যক্তিজীবনে খুব বিনয়ী, নম্র ও ভদ্র ছিলেন। মহনবী (স.) বিনয়গত সুন্দর আচরণ দিয়ে রুক্ষ শাসনহীন আরববাসীর মন জয় করতে সক্ষম হয়েছিলেন। তাদেরকে করেছিলেন বশীভূত। বিদ্যা দ্বারা আমরা সেগুলো জানতে পারি। বিখ্যাত দার্শনিক সক্রেটিস নিঃশঙ্ক চিত্তে বিনয়ের সাথে এক পেয়ালা বিষ পান করে তাঁর বিনয়ের পরিচয় রাখেন। তাই আমাদের উচিত শুধু গ্রন্থগত বিদ্যা গ্রহণ না করে, বিদ্যা দ্বারা বিনয়াবনত আচরণ অর্জন করা এবং সেই বিনয় দ্বারা মানুষের মন জয় করা।
বিদ্যা সাধনায় অর্জিত হয়- এর প্রভাবে মানুষ প্রকৃত মানুষ হয়। ফলে জগৎ-সংসার হয় তার বশীভূত। যা প্রতিটি মানুষের জন্য একান্ত অপরিহার্য।
এই ভাবসম্প্রসারণটি অন্য বই থেকেও সংগ্রহ করে দেয়া হলো
মূলভাব : মানুষের জীবন গঠনের জন্য বিদ্যার্জন করা অপরিহার্য। বিদ্যা দ্বারা মানুষ যেমন জগতকে জয় করতে পারে, তেমনি বিদ্যা ছাড়া মানুষ জগতে কোন কিছুই লাভ করতে পারে না।
সম্প্রসারিত ভাব : বিদ্যা মানুষের আচরণের পরিবর্তন ঘটায়। বিদ্যার আলো অজ্ঞতা ও মূর্খতার হাত থেকে মানুষকে রক্ষা করে। বিদ্যার আলোকে আলোকিত না হলে মানুষের জীবন হয়ে উঠে অন্ধকারাচ্ছন্ন। তাই মানুষের মনুষ্যত্ব বিকাশের একমাত্র অবলম্বন হল বিদ্যা। বিদ্যা মানুষের জীবনের অমূল্য সম্পদ। যা দ্বারা মানুষ তার সঠিক পথ খুঁজে পায়। এটি মানুষকে মহৎ গুণের অধিকারী হতে সাহায্য করে। মানুষের চরিত্রের একটি মহৎ গুণ হল বিনয়। আর এটি অর্জন করতে হলে প্রয়োজন শিক্ষার। বিদ্যা যেমন মানুষের মনুষ্যত্ব বিকাশিত করে, তেমনি বিনয়ও মানুষের জীবনকে সুন্দর ও সুদূরপ্রসারী করে বেড়ে তোলে। স্পর্শমণির ছোঁয়ায় লোহা যেমন সোনা হয়ে উঠে তেমনি বিনয়ী চরিত্রের অধিকারী লোকের সংস্পর্শে আসলে মানুষের পশুবৃত্তি ঘুচে যায়, জন্ম নেয় সৎ, সুন্দর, মহৎ জীবনের আকাঙ্ক্ষা। আর চরিত্র যদি নৈতিক অধঃপতনের কবলে পড়ে তাহলে শিক্ষিত সমাজে বিদ্যা হয়ে উঠে মূল্যহীন। শক্তির দ্বারা মানুষ অনেক কিছু করতে পারে কিন্তু যদি বুদ্ধি, বিনয় থাকে তাহলে শক্তি সেখানে মূল্যহীন। যথার্থ বিদ্যার্থী ব্যক্তি যেমন নিজের জীবনকে সাজাতে গোছাতে পারে তেমনি সমাজের এমনকি বিশ্বের মানুষের উপকারে কাজ করতে পারে। আর যদি সেটা সম্ভব হয় তাহলে বিদ্যা অর্জন সার্থক হয়। সমাজ আলোকিত হয়, দেশ ও জাতি প্রগতির পথে এগিয়ে যেতে পারে। এভাবে বিদ্যাকে জীবনের সাথে কাজে লাগাতে পারলে জীবন হয়ে উঠে সুন্দর ও সুখময়।
বিদ্যা মানুষের জীবনের অমূল্য সম্পদ। আর বিদ্যার আলোকে মনুষ্যজীবন হয়ে উঠে আলোকময়। বিদ্যার সাথে যদি বিনয় থাকে তাহলে মনুষ্যজীবন আরো আলোকিত হয়।