প্রবন্ধ রচনা : বাংলাদেশের কৃষক

ভূমিকা : বাংলাদেশ একটি কৃষিপ্রধান দেশ। এখানকার শতকরা পঁচাশিজন লোক নির্ভর করে কৃষির ওপর। বাকি পনেরো জন মাত্র শিল্প, ব্যবসায়, চাকরি ইত্যাদি কাজে নিযুক্ত। সুতরাং বাংলাদেশ কৃষকের দেশ একথা বললে হয়তো কিছুমাত্র অত্যুক্তি হয় না। কারণ, তারাই বিপুলভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠ। অথচ, ভাগ্যের এমনই নির্মম পরিহাস, এদেশে কৃষকরাই সর্বাধিক অবহেলিত এবং তাদের অবস্থাই সবচেয়ে বেশি শোচনীয়।

কৃষিনির্ভরতা : অন্যদিকে এদেশের যাবতীয় সম্পদ অর্জিত হয় কৃষির মাধ্যমে। কৃষির সাহায্যেই আমরা আমাদের খাদ্যশস্য, শাকসবজি, ফলমূল ও তরিতরকারি উৎপাদন করি। বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রা উপার্জনের প্রধান উৎপাদিত দ্রব্য হল শাকসবজি, ফলমূল ও তরিতরকারি উৎপাদন করি। বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রা উপার্জনের প্রধান উৎপাদিত দ্রব্য হল পাট। পাট কৃষিজাত দ্রব্য; শিল্পের জন্য প্রয়োজনীয় কাঁচামালও পাওয়া যায় এ কৃষিজাত দ্রব্য থেকে। যে-বছর দেশে ভালো ফসল হয় সে-বছর দেশে অবস্থাও হয় সচ্ছল এবং যে-বছর দেশে দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়, অনাহারে মানুষ মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। সুতরাং এটা স্পষ্টভাবেই দেখা যাচ্ছে এদেশের সমৃদ্ধি ও সচ্ছলতা সম্পূর্ণভাবে নির্ভর করে কৃষির ওপর। অথচ আমাদের দেশে কৃষকেরা সবচাইতে বেশি বঞ্চিত, অবহেলিত ও অভাবগ্রস্ত। তাই কৃষকের উন্নতি না হলে দেশের সামগ্রিক উন্নতি কোনোদিন সম্ভব নয়।

খাদ্য উতপাদনে কৃষি : বাংলাদেশের মোট ভূমির পরিমান ১৪.৪ মিলিয়ন হেক্টর । যার প্রায় ১৩.৩ শতাংশ জুরে রয়েছে বনভুমি। ২০.১ শতাংশ জুরে রয়েছে স্থায়ী জলধার, শিল্পকারখানা, রাস্তা ঘাট ইত্যদি এবং অবশিষ্ট 66.6 শতাংশ জমি কৃষি কাজের জন্য ব্যাবহার করা হয়। এর ৯০ শতাংশ জমিতে খাদ্যশস্য উতপাদন করা হয়। বাংলাদেশের ৮০ শতাংশ খাদ্যশস্য কৃষি ও কৃষক জোগান দেয়।

কৃষকদের দুরবস্থা : একদিন বাংলাদেশ ছিল সুজলা, সুফলা, শস্যশ্যামলা চির-আনন্দের দেশ। বাংলাদেশের মাঠভরা ছিল সোনালি ধান, গোলাভরা ছিল গরু আর পুকুরভরা ছিল মাছ। ইংরেজদের শাসনকাল থেকে এদেশের কৃষকদের অবস্থা ক্রমশ খারাপ হতে থাকে। ব্রিটিশ আগমনের পর থেকে গ্রামবাংলার মানুষ শহরমুখী হতে আরম্ভ করে। কারণ, কুটিরশিল্পের পরিবর্তে তখন আধুনিক যন্ত্রসভ্যতার বিকাশ ঘটতে থাকে এদেশে। গ্রামের অনেক মানুষ বেকার হয়ে পড়ে। তারা আস্তে আস্তে পাড়ি জমায় শহরের দিকে। ইংরেজ আমলে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত কায়েম হওয়ায় জমির মালিক হলো জমিদাররা। তার পর থেকে এদেশের কৃষকদের অবস্থা আরও শোচনীয় হতে থাকে। নানা অর্থনৈতিক টানাপোড়েন ও সামাজিক পরিবর্তনের ফলে এদেশের কৃষকদের অবস্থার অবনতি ঘটে।

বাংলাদেশের কৃষক মানে এখন দারিদ্র্যের প্রতিমূর্তি। রোগ-শোক-পুষ্টিহীনতা ও দারিদ্র্যের প্রেষণে জরাজীর্ণ বাংলার কৃষক আজ প্রায় নিঃস্ব। এখন কৃষক বলতে আমাদের চোখে ভেসে ওঠে এক করুণ মূর্তি। গ্রামের এক জীর্ণ কুটিরে তার বাস, মাথার ওপর কোনো রকমে একটি ছাউনি আর চারদিকে কোনো রকমে বেড়া দিয়ে তারা দিন যাপন করছে দুর্ভাগ্যের চরম অভিশাপের মধ্যে।

ভূমিহীন কৃষক : বাংলাদেশের শতকরা পঁচানব্বই জন কৃষক ভূমিহীন। তাদের নিজের জমি না থাকয় কষ্টার্জিত ফসলের মোট অংশটুকু জমির মালিককে দিয়ে তাদের হাতে এমন কিছু থাকে না। দুঃখ দারিদ্র্য তাদের কোনোদিন শেষ হয় না, যে-তিমিরে তাদের জীবন সে-তিমিরেই থেকে যায় সারা জীবন। বছরের বেশির ভাগ সময় একজন কৃষককে কাটাতে হয় অর্ধাহারে বা অনাহারে। কৃষকদের এ অবস্থা হওয়ার আরও কিছু কিছু কারণ রয়েছে। আমাদের দেশের কৃষকসমাজ আধুনিক শিক্ষার কোনো স্পর্শ পায় না। তাই তারা জানে না ফসল উৎপাদনের আধুনিক উপায়। কম পরিশ্রমে অধিক ফসল লাভের যে-পন্থা সেটা তাদের জানা নেই। তা ছাড়া নানা অপচয় ও অশিক্ষার ফলে পরিবারের লোকসংখ্যার চাপ তাদের জীবনকে দুর্বিষহ করে তোলে। গ্রামের কৃষকরা দূরদর্শী নয়। তারা নানা সামাজিক সংস্কার পালন করতে গিয়ে ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়ে। সে ঋণ শোধ করতে না পেরে দেউলিয়া হয়ে যায় অনেকে।

কৃষকদের জন্য করণীয় : এদেশ যখন কৃষিপ্রধান দেশ এবং কৃষিই যখন এদেশের প্রধান সম্পদ, তাই কৃষকদের বাঁচিয়ে রাখতে হবে আমাদের। তাদের অবস্থার উন্নতি করতে হবে। ভূমিহীন কৃষকদের ভূমি দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। কৃষিঋণ যেন ঠিকমতো ভূমিহীন কৃষকদের হাতে পড়ে সে ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। কৃষকদের কাছে স্বল্পমূল্যে সার ও কৃষিসরঞ্জাম সরবরাহ করতে হবে। গ্রাম্য মোড়ল, ফড়িল, ফড়িয়া ও কিছু সংখ্যক অসাধু কৃষি বিভাগের কর্মচারীর হাত থেকে কৃষকের হাতে যেন কৃষি-সাহয্য ঠিকমতো পৌঁছায় সেদিকে লক্ষ রাখতে হবে।

সরকরি কর্মসূচি : সরকার বর্তমান নিরক্ষরতা দূরীকরণের ব্যাপক কর্মসূচি হাতে নিচ্ছে। গ্রামে কৃষকদের সাক্ষর করবার জন্য স্বেচ্ছাসেবকরা দল বেঁধে অভিযান চালাচ্ছে। এতে গ্রামবাংলার কৃষকরা সচেতন হবে, তাদের ভাগ্যোন্নয়ন সম্পর্কে এখন তারা নিজেরাই বুঝতে পারবে। সরকার নানারকম প্রচারমাধ্যমের দ্বারা কৃষিকাজের নানা প্রয়োজনীয় তথ্য সরবরাহ করে ও উৎসাহ দিয়ে বর্তমানে কৃষকদের অনুপ্রাণিত করছেন। কৃষকদের কৃষি উপকরণ, সার সরবরাহ ও জমিবণ্টন ছাড়া বছরের অন্য সময় কাজ করবার জন্য কুটিরশিল্পের ব্যবস্থা করে দিতে হবে। তা হলে কৃষকরা ঘরের কোণে অলস ও নিশ্চেষ্ট হয়ে আর বসে থাকবে না।

উপসংহার : একদিন এই বাংলাদেশকে কবি কল্পনা করেছিলেন সোনার বাংলারূপে। আমাদের দেশে এখনও যে-সম্পদ, প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও ভূমির উর্বরতা আছে তাতে এদেশকে সত্যিই আমরা রূপায়িত করতে পারব সোনার বাংলায়। তবে পরিবর্তন করতে পারে যারা তারা হলো এদেশের কৃষক। তাই কৃষকের ভাগ্য পরিবর্তিত হলে, কৃষির উন্নতি হলে, তবে এদেশ হবে সুন্দর, এদেশ হবে সত্যিকারের সোনার বাংলা।

6 Comments

Post a Comment
Previous Post Next Post