প্রবন্ধ রচনা : বাংলাদেশের বন্যা ও তার প্রতিকার

↬ বাংলাদেশের বন্যা

↬ বন্যা

↬ বাংলাদেশের বন্যা ও তার প্রতিকার


ভূমিকা :
কখনো বৃদ্ধের শীর্ণ কাঁধে
কখনো বা অসহায় শিশুর
অবসন্ন ললাটে
আমি রাখি হাত-
দেখি প্রতিদিন বিশাল বন্যার ঢলে ভেসে যায়
গ্রামের বিস্তৃত মাটি ঘর মাঠ চালা মানুষের একান্ত আশ্রয়।
                                                                                                           -লে. জে. হুসাইন মোহাম্মদ এরশাদ

প্রকৃতির রূপসী কন্যা আমাদের এই দেশ। এই প্রকৃতিই আবার কখনো কখনো হাজির হয় রণচণ্ডী রূপ নিয়ে। প্রকৃতির রুদ্র মুর্তিকেই আমরা বলি প্রাকৃতিক দুর্যোগ। প্রতি বছরই বাংলাদেশে বিভিন্ন ধরনের প্রকৃতিক দুর্যোগ দেখা দেয়। ক্ষুধা, দারিদ্র্য, বেকারত্ব, জনসংখ্যা বিস্ফোরণের মতো সমস্যার দেশে একটি ভয়াবয় প্রাকৃতিক দুযোগ হলো বন্যা। ভৌগোলিক এবং ভূতাত্ত্বিক অবস্থানের কারণেই বন্যা এদেশের নিত্যসঙ্গী। তাছাড়া এদেশে জালের মতো ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে অসংখ্য নদ-নদী। এবং হিমালয়ের বরফগলা পানির কারণে নদীর দু-কূল ছাপিয়ে বন্যা হয়। ফলে ডুবে যায় গ্রামের পর গ্রাম। এদেশে প্রতি বছর বন্যার ফলে কোনো না কোনো অঞ্চল ক্ষতিগ্রস্ত হয়। যার ফলে দেশে অর্থনৈতিক অবস্থার চরম বিপর্যয়ের সৃষ্টি হয়। দুঃখ দুর্গতিতে মানুষের জীবন অতিষ্ঠ হয়ে ওঠে। সর্বোপরি দেশের সামগ্রিক উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হয়।

বাংলাদেশে বন্যার প্রকৃতি : বাংলাদেশে প্রায় প্রতি বছরই বন্যা দেখা দেয়। বন্যার রূপও বড় ভয়ংকর। চার দিকে শুধু পানি আর পানি। গাছপালা ঘরবাড়ির চিহ্ন দেখা যায় না। অত্যধিক বৃষ্টিপাতের ফলে জলস্ফীতি দেখা দেয় এবং সঙ্গে সঙ্গে নদ-নদীতেও প্লাবন আসে। বর্ষা আর প্লাবনের এই অস্বাভাবিক অবস্থাই হলো বন্যা। প্রাকৃতিক দুর্যোগ হিসেবে বন্যা দেখা দেয় যা ভয়াবহ পরিণতি ঘটিয়ে মানুষের জীবনে ডেকে আনে দুর্ভোগ। বাংলাদেশে প্রতি বছর বন্যার ফলে কোনো না কোনো অঞ্চল ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এর ফলে দেশের অর্থনীতি চরম বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়। দুঃখ-দুর্গতিতে মানুষের জীবন অতিষ্ঠ হয়ে ওঠে।

বন্যার প্রকারভেদ : বাংলাদেশে সাধারণত চার প্রকারের বন্যা দেখা যায়। যথা :

১. ফ্ল্যাশ ফ্ল্যাড বা আকস্মিক বন্যা : এই বন্যা স্বল্পস্থায়। এই বন্যা যেমন আকস্মিকভাবে খুব দ্রুত ঘটে তেমনি আবার খুব দ্রুতই এর পানি নেমে যায়। সাধারণত পাহাড়ি ঢল থেকে এ ধরনের বন্যার সৃষ্টি হয়। স্বল্পস্থায়ী হলেও এ বন্যার ক্ষয়-ক্ষতির পরিমাণ তুলনামূলকভাবে বেশি।

২. বৃষ্টিবিধৌত বন্যা : আমাদের দেশে অতিবৃষ্টির কারণে কিছু নিচু এলাকা প্লাবিত হয়। অনেক স্থানে নিষ্কাশনের ব্যবস্থা ভালো না। সেসব স্থানে এই ধরনের বন্যার কারণে অনেক ক্ষয়-ক্ষতি সাধিত হয়।

৩. সমুদ্রোপকূলীয় বন্যা : বাংলাদেশের দক্ষিণে সমুদ্র উপকূলবর্তী অঞ্চলে সাধারণত এই ধরনের বন্যা দেখা যায়। সমুদ্রে ১২ ঘণ্টা পর পর জোয়ার আসে। স্বাভাবিক জোয়ারের সঙ্গে ঝড়ো হাওয়া যুক্ত হলে জলোচ্ছ্বাস হয়। ১৯৬০, ১৯৬১, ১৯৬৩, ১৯৬৫, ১৯৭০, ১৯৮৫, ১৯৮৬, ১৯৯১ এবং ১৯৯৭ সালে বাংলাদেশের সমুদ্র উপকূলবর্তী অঞ্চলে এই ধরনের জলোচ্ছ্বাসজনিত বন্যা হয়েছে।

৪. মৌসুমি বন্যা : এই বন্যা অপেক্ষাকৃত দীর্ঘস্থায়ী এবং প্রলয়ঙ্করী হয়।

প্রেক্ষাপট : সুপ্রাচীনকাল থেকেই ভৌগোলিক অবস্থানগত কারণে বাংলাদেশের মানুষ বন্যার সঙ্গে যুদ্ধ করে আসছে। বিগত ৬০ বছরে বাংলাদেশে প্রায় ৩০টির মতো বড় ধরনের বন্যা সংঘটিত হয়েছে। এর মধ্যে ১৯৫৪, ১৯৫৫, ১৯৭৪, ১৯৮৫, ১৯৮৮, ১৯৯১, ১৯৯৮, ২০০০, ২০০৪ এবং সর্বশেষ ২০০৮ সালের ভয়াবহ বন্যার কথা উল্লেখ করা যায়। বাংলাদেশের মানুষ বন্যার ভয়াল থাবা থেকে মুক্তি পেতে চাইলেও মুক্তি পাচ্ছে না। বাংলাদেশে বন্যার অন্যতম প্রধান কারণ হলো অতিবৃষ্টি। এদেশে স্বাভাবিক গড় বৃষ্টিপাতের পরিমাণ হলো ২৩২০ মিলিমিটার যার ৮০ ভাগেরও বেশি জুন থেকে সেপ্টেম্বর মাসে সংঘটিত হয়। অতিবৃষ্টি ছাড়াও বন্যার আরেকটি কারণ হলো উজান থেকে আসা পাহাড়ি ঢল। হিমালয় থেকে নেমে আসে বিপুল জলরাশি এবং তা ভারত ও নেপালের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে আসে। বাংলাদেশের পদ্মা, মেঘনা ও ব্রহ্মপুত্র নদীর মধ্য দিয়ে বঙ্গোপসাগরে পতিত হয়। এ পানি প্রবলবেগে প্রবাহিত হওয়ার সময় প্রবল চাপের কারণে বন্যার সৃষ্টি হয়।

বন্যার কারণ : বাংলাদেশে বন্যার কারণকে মূলত দুটি উপায়ে ব্যাখ্যা করা যায়। যথা:

ক. প্রাকৃতিক কারণ ও
খ. কৃত্রিম কারণ

নিম্নে এগুলো সম্পর্কে বিস্তারিতভাবে আলোচনা করা হলো:

ক. প্রাকৃতিক কারণ :
১. ভৌগোলিক অবস্থান : ভৌগোলিক অবস্থান বাংলাদেশে বন্যার একটি অন্যতম প্রধান কারণ। বাংলাদেশ গঙ্গা, যমুনা ও মেঘনার মিলনস্থলে অবস্থিত পৃথিবীর বৃহত্তম বদ্বীপ। এটি সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে মাত্র ৬-৭ মিটার উঁচু। বর্ষাকালে উল্লিখিত তিন নদীর অববাহিকায় পানি একসঙ্গে এসে পড়ে। এর ফলে বাংলাদেশে পানির প্রবাহ বৃদ্ধি পায় এবং বন্যা হয়।

২. পৃথিবীর উত্তাপ বৃদ্ধি ও বনাঞ্চল ধ্বংস : একদিকে পৃথিবীর উত্তাপ বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং অন্যদিকে বনাঞ্চলসমূহ দ্রুত ধ্বংসপ্রাপ্ত হচ্ছে। এর ফলে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ বাড়ছে। বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির ফলে হিমালয়ের বরফ গলে তা নিচে নেমে আসছে। এ পানি গঙ্গা, যমুনা, মেঘনা দিয়ে প্রবাহিত হয়ে আমাদের দেশে আসে এবং বন্যার সৃষ্টি হয়।

৩. নিম্নাঞ্চল ভরাট হওয়া : আমাদের দেশের প্রায় প্রত্যেক অঞ্চলেই রয়েছে বড় বড় নিম্নাঞ্চল এবং ছোট জলাভূমি। এই জলাভূমিগুলো প্রধান তিনটি নদীর পানি সংরক্ষণ করে। কিন্তু এগুলো ধীরে ধীরে ভরাট হয়ে যাওয়ায় পানি ধারণ ক্ষমতা হ্রাস পেয়েছে। ফলে বর্ষা মৌসুমে পানি প্রবাহ বৃদ্ধি পেলে বন্যার সৃষ্টি হয়।

৪. মৌসুমি বায়ুর প্রবাব : বর্ষাকালে আমাদের দেশে মৌসুমি বায়ুর প্রবাবে বাতাস দক্ষিণ-পূর্ব দিক থেকে উত্তর-পশ্চিম দিকে প্রবাহিত হয়। এতে জলস্রোতের দক্ষিণমুখী নিঃসরণ বাধা পায়। তখন প্রবল বৃষ্টিপাতের ফলে বঙ্গোপসাগরের পানি সমতল থেকে ৩-৪ ফুট বেড়ে যায় এবং এই পানি নদীপথে দেশের অভ্যন্তরে চলে আসে। একই সময়ে দক্ষিণ ভারতের মহানন্দা, গোদাবরী, কৃষ্ণা ও কাবেরী নদীর পানি বঙ্গোপসাগরের দিকে আসে। কিন্তু হুগলি নদীতে প্রবেশপথ না পেয়ে তা দক্ষিণ-পূর্ব দিকে বাঁক নেয় এবং গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্রের মিলিত শাখার সঙ্গে যুক্ত হয়ে বাংলাদেশের নদীগুলোকে স্ফীত করে তোলে। ফলে নদী ভরাট হয়ে সমুদ্রে প্রবেশের পথ না পেয়ে বন্যার সৃষ্টি হয়।

৫. সামুদ্রিক জোয়ার ও জলোচ্ছ্বাস : গঙ্গা, যমুনা ও মেঘনা এই তিনটি প্রধান নদীর মোহনায় বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট জোয়ারের পানির চাপ নদীর পানির চাপের চেয়ে ৫ গুণ বেশি। জোয়ার ও জলোচ্ছ্বাসের কারণে নদীর পানি প্রবাহ বাধা পায় এবং তা সাগরে পতিত না হয়ে ওভার ফ্লো হয়ে বন্যার সৃষ্টি করে।

৬. ভূ-গর্ভের অগভীর স্তরে পানি প্রবাহ : ভূ-গর্ভের অগভীর স্তরে পানি প্রবাহের ফলে বন্যার সৃষ্টি হয়।

৭. নিম্নচাপ : বর্ষকালে বাংলাদেশে সমুদ্রে নিম্নচাপের সৃষ্টি করে। এ নিম্নচাপ বন্যা পরিস্থিতিকে আরও গুরুতর করে তোলে।

খ. মানবসৃষ্ট কারণ বা কৃত্রিম কারণ
১. অবকাঠামো নির্মাণ : মানুষ তার জীবনযাত্রার সুবিধার জন্য নদী অববাহিকায় ব্রিজ নির্মাণ করেছে। এছাড়া জলবিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য বাঁধা এবং বন্যা নিয়ন্ত্রণের জন্য বেড়িবাঁধ নির্মাণ করেছে। নদীর তীর বরাবর বেড়িবাঁধ নির্মাণের ফলে নদীর পানি অববাহিকায় প্লাবিত হতে পারে না। ফলে দীর্ঘদিন ধরে নদীর তলদেশে পলি-বালি সঞ্চিত হয়ে নদীর তলদেশ ভরাট হলে বন্যার প্রকোপ বৃদ্ধি পায়।

২. বৃক্ষ নিধন : গঙ্গা, যমুনা নদীর উৎসস্থলে ব্যাপকভাবে বন ধ্বংসের ফলে বন্যার প্রকোপ বৃদ্ধি পেয়েছে। স্বাভাবিক অবস্থায় বৃষ্টির পানি নদী-নালায় আসার আগে বনাঞ্চলের গাছপালা, ঝোপ-ঝাড়, ঝরা পাতা ও শিকড়ে বাধা পেয়ে ভূগর্ভে প্রবেশ করার সুযোগ পায়। কিন্তু আমাদের দেশে ব্যাপক হারে বনাঞ্চল ধ্বংস হওয়ায় বৃষ্টিপাতের বেশিরভাগ পানি বাধা না পেয়ে নদীতে চলে আসায় নদীর পানি প্রবাহ বৃদ্ধি পেয়ে বন্যার সৃস্টি হয়। এছাড়া নদীর উৎসে বনাঞ্চল কেটে ফেলায় বিরাণ এলাকায় প্রভূত পলিমাটি জমা হয়ে প্রবাহ পথ বন্ধ হয়ে যায়।

৩. গঙ্গা নদীর ফারাক্কা বাঁধ : বাংলাদেশের বন্যার একটি প্রধান কারণ হলো পশ্চিমবঙ্গের ফারাক্কা বাঁধ। এ বাঁধ নির্মাণের পূর্বে ভাগীরথী নদীতে বর্ষাকালে প্রতি সেকেণ্ডে প্রায় ১,৩০,০০০ ঘনফুল পানি প্রবাহিত হতো। বাঁধ নির্মাণের পর তা হ্রাস পেয়ে দাঁড়ায় ৮০,০০০ ঘটফুটে। এই হ্রাসপ্রাপ্ত ৫০,০০০ ঘনফুট পানি বন্যার প্রকোপ বাড়িয়ে তুলেছে। ভারত প্রতি বছর শুকনো মৌসুমে পারাক্কায় পানি আটকে রাখে এবং বর্ষা মৌসুমে সবগুলো গেট একঙ্গে খুলে দেয়। এর ফলে বাংলাদেশে বন্যার আশঙ্কা আরও বৃদ্ধি পায়।

৪. ভুমিক্ষয় : অপরিকল্পিতভাবে রাস্তাঘাট, ব্রিজ, কালভার্ট, দালানকোঠা প্রভৃতি নির্মানে নিম্নভূমির অতিরিক্ত ব্যবহারের কারণে ভূমি ক্ষয় হয়ে যায়। তাছাড়া ভূমিকম্পের ফলে অতিরিক্ত মাটি ক্ষয় হয়ে নদীমুখ বন্ধ ও নদীর দিক পরিবর্তন করে ফেলছে। এর ফলে নদীর পানির ধারণ ক্ষমতা হ্রাস পাচ্ছে এবং বন্যার প্রকোপ বৃদ্ধি পাচ্ছে।

বন্যার সমস্যার প্রতিকার : বন্যার ক্ষয়-ক্ষতি ও দুর্ভোগ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য আমাদের দেশে এখনও পর্যাপ্ত তেমন কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি। বাঁধ নির্মাণের মাধ্যমে বন্যা নিয়ন্ত্রণের কিছুটা চেষ্টা করা হলেও তা তেমন ফলপ্রসূ হয়নি। সাম্প্রতিককালের বন্যা এ কথাই প্রমাণ করে। ভৌগোলিক অবস্থানগত কারণে স্থায়িভাবে বন্যা প্রতিরোধ করা সম্ভব নয়। তবে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে বন্যার ভয়াবহতা ও ক্ষয়-ক্ষতির পরিমাণ কমানো যেতে পারে। বন্যা প্রতিরোধের ক্ষেত্রে তিন ধরনের পন্থা অবলম্ন করা যেতে পারে। যথা-

ক. তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা
খ. দীর্ঘমেয়াদি ব্যবস্থা
গ. সমন্বিত ব্যবস্থা

ক. তৎক্ষণিক ব্যবস্থাসমূহ :
১. প্রাক্-সতর্কীকরণ ব্যবস্থা : বন্যা প্রতিরোধে এ সম্পর্কে পাক্-সতর্কীকরণ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। প্রযুক্তিগতভাবে এই ব্যবস্থা গ্রহণের সক্ষমতা বাংলাদেশের রয়েছে। ভূতাত্ত্বিক ও আঞ্চলিক পরিবাহ-এর মাধ্যমে সতর্কীকরণ ব্যবস্থার উন্নতি ঘটানো যায়।

২. ত্রাণব্যবস্থা সক্রিয়করণ : বন্যা পরবর্তী সময়ে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন ত্রাণসামগ্রীর। তাই বন্যা-পরবর্তী ত্রাণব্যবস্থা সক্রিয় রাখতে হবে। ত্রাণব্যবস্থা সক্রিয় রাখার উদ্দেশ্যে ও ত্বরিত সাহায্য সরবরাহের জন্য আঞ্চলিক পর্যায়ে যথেষ্ট ত্রাণসামগ্রী মজুদ রাখার ব্যবস্থা করতে হবে।

৩. আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণ : বন্যাদুর্গত এলাকায় মানুষকে দীর্ঘদিন পানিবন্দী হয়ে থাকতে হয়। প্রয়োজনীয় আশ্রয় কেন্দ্র না থাকার কারণে প্রবল বন্যার সময় কাউকে হয়ত ঘরের চালে আশ্রয় নিতে হয় এবং দীর্ঘ সময় সেখানেই কাটাতে হয়। এ দুর্দশা থেকে মানুষকে রক্ষা করতে হলে পানিবন্দী এলাকায় প্রতিটি ইউনিয়ন পর্যায়ে একটি করে জরুরি আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণ করতে হবে। এ লক্ষ্যে একটি বিদ্যালয়গৃহকে বহুতল ভবনে রূপান্তরিত করা যেতে পারে এবং তাতে অন্তত ৩,০০০ লোক ধারণ করার ব্যবস্থা থাকতে হবে।

৪. স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান স্থাপন : সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়সমূহকে বন্যা প্রতিরোধের জন্য আরও কার্যকর ও সক্রিয় হতে হবে। এক্ষেত্রে একটি দুর্যোগসংক্রান্ত স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান স্থাপন করা যেতে পারে। প্রতিষ্ঠানটি বন্যাসহ সকল দুর্যোগ সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ, সংরক্ষণ, গবেষণা ও পরিচালনা করবে।

৫. অন্যান্য ব্যবস্থা : সরকার ও জনগণের বন্যার আগাম প্রস্তুতি গ্রহণ করা, ঘরবাড়ির ভিটে উঁটু করা, গুচ্ছগ্রাম গড়ে তোলা, বন্যার প্রকোপে বেঁচে থাকার উপযোগী ধান উদ্ভাবন ও চাষ করা ইত্যাদি পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে বন্যার ক্ষয়-ক্ষতি থেকে রক্ষা পাওয়া যেতে পারে।

খ. দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা : বন্যা প্রতিরোধে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনাসমূহই মুখ্য। দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনাসমূহ নিম্নরূপ:

১. রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত : নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার জন্যই আমাদের বন্যা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচি গ্রহণ করতে হবে। এক্ষেত্রে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত, নেপাল, ভুটান ও আমাদের বন্য নিয়ন্ত্রণের দীর্ঘমেয়াদি ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নিতে হবে।

২. বাঁধ নির্মাণ : বন্যা নিয়ন্ত্রণের জন্য পানি প্রবেশের উৎসসমূহ বন্ধ করত হবে। এ লক্ষ্যে ব্রহ্মপুত্র, গঙ্গা ও তিস্তা নদীতে বাঁধ নির্মাণ করতে হবে। এগুলো ছাড়াও দেশের বিভিন্ন বাড়ির মুখে বাঁধ দিতে হবে।

৩. পোন্ডার নির্মাণ : দেশের উপকূরবর্তী অঞ্চলে বন্যা নিয়ন্ত্রণের জন্য স্বয়ক্রিয় জোয়ার বিরোধী গেটের মতো কাঠামো দ্বারা সাগরের জোয়ার অনুপ্রবেশ রোধ করা যেতে পারে। এছাড়া জলাব্ধ এলাকায় পোন্ডার নির্মাণ করে পানি পাম্প করে বের করার ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে।

গ. সমন্বিত ব্যবস্থা : ভারত, নেপাল, ভুটান ও চীনকে নিয়ে বন্যা নিয়ন্ত্রণের জন্য আন্তর্জাতিক পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। এছাড়া বন্যা নিয়ন্ত্রণের জন্য আরও কিছু পরিকল্পনা গ্রহণ করা যেতে পারে-

১. বর্ষাকালে অতিবৃষ্টির পানি দ্রুত নিষ্কাশনের জন্য প্রধান নদী ও শাখা নদীগুলোর মুখ খনন করতে হবে।
২. নদীর তীর বরাবর উঁচু করে বাঁধ নির্মাণ করা।
৩. পানি যেন বেশি পরিমাণে সাগরে চলে যেতে পারে এ উদ্দেশ্যে নদীর তলদেশ খনন করতে হবে।
৪. নদীর মুখ বন্ধ করে রাস্তাঘাট সেতু নির্মাণ করা যাবে না।
৫. ব্যাপকভাবে বনায়ন কর্মসূচি গ্রহণ করা।
৬. নদী খনন অত্যন্ত ব্যয়বহুল হলেও পদ্মা, মেঘনা, যমুনা তিনটি প্রধান নদীকে নিয়মিত ড্রেজিং করে পানি সংরক্ষণের ক্ষমতা বাড়াতে হবে। খননকৃত মাটি দ্বারা উঁচু বন্যা আশ্রয় কেন্দ্র তৈরি করতে হবে।
৭. কৃষি উৎপাদন ব্যবস্থাকে বন্যা উপযোগী করতে হবে।

বন্যায় সৃষ্ট অসুবিধাসমূহ : বন্যা যে বাংলাদেশের মানুষের কত ভয়াবহ অসুবিধা সৃষ্টি করে তা ভাষায় কেবল ভাষায় বর্ণনা করা সম্ভব নয়। বন্যা যখন তার স্বাভাবিক মাত্রা অতিক্রম করে মারা যায় তখন মানুষ হারায় তাদের ঘরবাড়ি, ফসল। বন্যার এই রূপ খুবই মারাত্মক। মানুষের জমির ফসল, ঘরবাড়ি সব পানির নিচে তলিয়ে যায়। পশু-পাখি, গাছপালা পানিতে ভেসে যায়। অনাহারে মানুষ, গবাদিপশুর প্রাণহানি ঘটে। বন্যা পরবর্তী সময়ে ছড়িয়ে পড়ে মহামারী, রোগব্যাধি। ছন্দের জাদুকর কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত বাঙালি সম্পর্কে বলেছেন- “বাঘের সঙ্গে যুদ্ধ করিয়া আমরা বাঁচিয়া আছি।” আজ আর সেই বাঘ নেই বাঘের পরিবর্তে আছে বন্যা। বাঘের চেয়ে সে কম ভয়ংকর নয়।

উপসংহার : বন্যা বাংলাদেশের মানুষে কাছে এক সর্বনাশা দৈত্য যে তাদের জীবনকে তছনছ করে দেয়। এ দৈত্যের ভয়ে তাই তারা সর্বদাই ভীত। বন্যার তাণ্ডবলীলায় প্রতিবছর শত শত মানুষ মারা যায়। এই অবর্ণনীয় পরিস্তিতি থেকে দেশবাসীকে মুক্তি দিতে সরকারকে বাস্তব ও বিজ্ঞান সম্মত পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। বন্যার কতগুলো কারণ নিতান্তই নৈসর্গিক। এগুলো পুরোপুরি দূর করা কখনোই সম্ভব নয়। তবে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে বন্যার প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তোলা কোনো দুঃসাধ্য ব্যাপার নয়। বন্যার প্রধান কারণ হলো পানি বৃদ্ধি এবং অতিরিক্ত পানি নিষ্কাশনের উপযুক্ত ব্যবস্থার অভাব। বর্তমান যুগ বিজ্ঞানের যুগ। প্রাকৃতিক দুর্যোগের ভয়ে এখন আর বসে থাকা চলে না। সুষ্ঠু পরিকল্পনা এবং উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে বন্যা প্রতিরোধ করা যায় এবং বন্যার ক্ষয়-ক্ষতি অনেকাংশে কমিয়ে আনা যায়।

3 Comments

Post a Comment
Previous Post Next Post