প্রবন্ধ রচনা : বৈশ্বিক উষ্ণায়ন ও জলবায়ু পরিবর্তন

↬ বৈশ্বিক উষ্ণায়ন ও বাংলাদেশ

↬ জলবায়ুর পরিবর্তন ও বৈশ্বিক উষ্ণায়ন

↬ বৈশ্বিক উষ্ণতা ও বাংলাদেশ

↬ জলবায়ু পরিবর্তন ও বাংলাদেশ

↬ জলবায়ু পরিবর্তন

↬ জলবায়ু পরিবর্তন ও এর প্রভাব

↬ বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলন-২০১৭


ভূমিকা : জলবায়ু পরিবর্তন বর্তমান বিশ্বের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে উপনীত হয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনের সবচেয়ে বড় কারণ বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি- যার ফলে আবহাওয়া পরিবর্তিত হয়েছে। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বেড়েছে এবং বিশ্ব নিয়মিত প্রাকৃতিক দুর্যোগের সম্মুখীন হচ্ছে। বৈশ্বিক উষ্ণতা বেড়ে যাওয়ার কারণ বায়ুমণ্ডলের তাপমাত্রা বৃদ্ধি এবং এই তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ার প্রধান কারণ গ্রিন হাউজ ইফেক্ট। সূর্য থেকে আগত তাপশক্তি পৃথিবীপৃষ্ঠকে উত্তপ্ত করে এবং এ বিকিরিত তাপশক্তির অধিকাংশই পুনরায় বায়ুমণ্ডলে ফিরে যায়। কিন্তু মানবসৃষ্ট দূষণ এবং বনভূমি উজাড় করার ফলে বায়ুমণ্ডলে গ্রিন হাউস গ্যাসের পরিমাণ আশঙ্কাজনকভাবে বেড়ে গেছে, যা কার্বন ডাই-অক্সাইড, মিথেন ও নাইট্রাস অক্সাইডের সমন্বয়ে গঠিত। এর ফলে বিকিরিত তাপশক্তি পুনরায় বায়ুমণ্ডলে ফিরে যাওয়ার পথে বাধাপ্রাপ্ত হয় এবং এভাবেই বায়ুমণ্ডলের তাপমাত্রা বৃদ্ধি পায়। আধুনিককালে ব্যাপক হারে জীবাশ্ম জ্বালানি দহন, বনাঞ্চল ধ্বংস, শিল্পায়নের ফলে গ্রিন হাউজ ইফেক্টের মাত্রা অনেক বেশি বেড়ে গেছে। এর ফলে ১৮৫০-১৯৬০ সালের মধ্যে পৃথিবীর তাপমাত্রা প্রায় পাঁচগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। এই অতিরিক্ত তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে বর্তমান বিশ্ব প্রতিনিয়ত বিভিন্ন পরিবেশগত বিপর্যয়ের সম্মুখীন হচ্ছে। পরিবেশ বিপর্যয়ের ফলে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ দেশের মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম।

বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির কারণ : পৃথিবী বেষ্টনকারী আবহাওয়ামণ্ডলের কারণে পৃথিবী প্রাণ ধারণ ও বসবাস উপযোগী হয়েছে। মহাশূন্যের আবহাওয়ামণ্ডলে ‘ওজোন স্তর’ নামে অদৃশ্য এক বেষ্টনী বিদ্যমান, যা পৃথিবীতে সূর্যের ক্ষতিকর অতিবেগুণি রশ্মি প্রবেশ রোধ করে এবং বিকিরণ প্রক্রিয়ায় পৃথিবী থেকে আসা তাপ মহাশূন্যে পুনরায় ফিরে যেতে সহায়তা করে। কিন্তু মানব সৃষ্ট দূষণ ও বনাঞ্চল ধ্বংসের ফলে প্রকৃতি প্রদত্ত নিরাপত্তা বেষ্টনী, ওজোন স্তর ক্ষয়প্রাপ্ত হচ্ছে। গৃহস্থালি পণ্য যেমন- ফ্রিজ, এয়ারকন্ডিশনার, বিভিন্ন ধরনের স্প্রে ইত্যাদিতে ব্যবহৃত হয় ক্লোরোফ্লোরো কার্বন (সিএফসি) গ্যাস, যা শিল্পকারখানাতেও ব্যবহৃত হয়। এই অবমুক্ত সিএফসি মহাশূন্যের ওজোন স্তর ক্ষয়ের অন্যতম কারণ। এছাড়া গৃহস্থালি ও শিল্পবর্জ্য, কলকারখানা ও যানবাহনের ধোঁয়া প্রভৃতি থেকে ক্রমবর্ধমান হারে নির্গত হচ্ছে কার্বন ডাই-অক্সাইড, নাইট্রাস অক্সাইড ও মিথেন গ্যাস। একদিকে পরিবেশ দূষণ ও অপর দিকে বনভূমি উজাড় করার ফলে অতিরিক্ত কার্বন ডাই-অক্সাইড শোষিত হচ্ছে না। এর ফলে বায়ুমণ্ডলে কার্বন ডাই-অক্সাইডের মাত্রাতিরিক্ত বৃদ্ধি দেখা দিচ্ছে, যা সূর্য থেকে আগত তাপ বায়ুমণ্ডলে ধরে রাখে। এভাবে একদিকে ওজোন স্তরের ক্ষয়জনিত কারণে মাত্রাতিরিক্ত সূর্যের অতিবেগুনি রশ্মি পৃথিবীতে পৌঁছাচ্ছে, অন্যদিকে বায়ুমণ্ডলে প্রতিনিয়ত তাপ সঞ্চিত হচ্ছে। এভাবে পৃথিবী হয়ে উঠেছে উত্তপ্ত। সামগ্রিকভাবে পরিবেশ বিপন্ন হওয়ার ফলে পৃথিবী প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের সম্মুখীন হচ্ছে।

বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি ও বাংলাদেশে এর প্রভাব : পরিবেশ বিজ্ঞানীদের মতে বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির ফলে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত দেশের মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। সাম্প্রতিককালে বাংলাদেশে যেসব বড় ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগ দেখা দিচ্ছে তা মূলত জলবায়ু পরিবর্তনের কারণেই দেখা দিচ্ছে। বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধিই মূলত এ পরিবর্তিত জলবায়ুর জন্য দায়ী। বৈশ্বিক উষ্ণায়নের ফলে বাংলাদেশের সম্ভাব্য ভয়াবহ পরিণতিসমূহ আলোচনা করা হলো :

১. সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি : বিশ্ব উষ্ণায়নের একটি সম্ভাব্য পরিণতি হলো সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি। বায়ুমণ্ডলে তাপমাত্রা বৃদ্ধি ফেলে ভূপৃষ্ঠের তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাবে। এর ফলে সমুদ্রের পানির উত্তাপ বৃদ্ধি পাবে এবং পানি সম্প্রসারিত হলে সমুদ্রের আয়তন ও পরিধিকে বাড়িয়ে তুলবে। উষ্ণায়নের ফলে হিমালয়সহ অন্যান্য পর্বতচূড়ায় জমে থাকা বরফ গলে যাবে এবং সমুদ্রের পানির উচ্চতা বেড়ে যাবে। এর ফলে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির সাথে সাথে প্লাবিত এলাকার পরিমাণও বেড়ে যাবে। উত্তর ও দক্ষিণমেরুর গ্রীনল্যান্ড, অ্যান্টার্কটিকাসহ অন্যান্য ভূ-ভাগের বরফ গলে যাবে, যা সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা আশঙ্কাজনকভাবে বাড়িয়ে তুলবে। এভাবে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি পাবে।

বাংলাদেশ বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ ব-দ্বীপ, যেখান অসংখ্য নদ-নদী বয়ে চলেছে। পৃথিবীর তাপমাত্রা ১ ডিগ্রি সেলসিয়াস বৃদ্ধি পেলে বাংলাদেশের ১৯ শতাংশ ভূমি সমুদ্রগর্ভে বিলীন হয়ে যাবে। এর ফলে ৫৫ মিলিয়ন লোক ক্ষতিগ্রস্ত হবে। বাংলাদেশে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা প্রতিবছর ৭ মিমি হারে বাড়ছে, যেখানে ভূ-পৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির হার ৫-৬ মিমি/বছর। এর ফলে বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির হার ১-২ মিমি/বছর। Intergovernmental Panel of Climate Change (IPCC)-এর এক সমীক্ষায় বলা হয় বর্তমান অবস্থার প্রেক্ষিতে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা প্রতি দশকে ৩.৫ থেকে ১৫ মিমি বৃদ্ধি পেতে পারে। এমনকি ২১০০ সাল নাগাদ তা ৩০ সেমি থেকে ১০০ সেমি এ পৌঁছাতে পারে। তাই সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি বাংলাদেশের জন্য ভয়াবহ বিপর্যয় সৃষ্টি করবে।

২. মরুভূমির বৈশিষ্ট্য : বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির ফলে একদিকে যেমন পৃথিবীর নিচু এলাকাসমূহ সমুদ্র গর্ভে বিলীন হয়ে যাবে তেমনি পৃথিবীর বিভিন্ন অংশে মরুভূমির বৈশিষ্ট্য দেখা দেবে। বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি পাওয়ার সাথে সাথে ভূ-পৃষ্ঠে পানির পরিমাণ ক্রমাগত হ্রাস পাবে। ফলে সমগ্র ভূমি মরুভূমিতে পরিণত হবে। এর ফলে কৃষিকাজ মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে এবং জীববৈচিত্র্য হুমকির সম্মুখীন হবে। বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলে ইতোমধ্যে মরুভূমির বৈশিষ্ট্য দেখা দিয়েছে। এর ফলে খাদ্য উৎপাদন ব্যাহতসহ তা দেশের অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।

৩. নিম্নভূমিতে প্লাবন : বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি পাওয়ার ফলে বাংলাদেশসহ পৃথিবীর অন্যান্য নিম্নভূমি সমুদ্রগর্ভে বিলীন হয়ে যাবে। বায়ুমণ্ডলে তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ার ফলে অ্যান্টার্কটিকার বরফ গলে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বেড়ে যাবে এবং উপকূলীয় এলাকাসমূহ ক্রমেই নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির ফলে বাংলাদেশের প্রায় ১ লাখ ২০ হাজার বর্গ কিমি এলাকা প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে ক্ষতির সম্মুখীন হবে। পরিবেশবিজ্ঞানীদের মতে, বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির এ ধারা অব্যাহত থাকলে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা এই শতাব্দীর শেষ দিকে ২০-৬০ সেমি পর্যন্ত বাড়তে পারে। জলবায়ু পরিবর্তিত হলে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ বেড়ে যাবে এবং নদ-নদীর পানির পরিমাণ বৃদ্ধি পাবে। আমাদের দেশের অধিকাংশ নদীর উৎস দেশের বাইরে ভারত ও নেপালে। তাই একদিকে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি ও অপরদিকে ব্যাক ওয়াটার ইফেক্ট যুক্ত হয়ে ভয়াবহ বন্যার সৃষ্টি করবে।

৪. জীববৈচিত্র্য ধ্বংস : বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির ফলে জীববৈচিত্র্য মারাত্মক হুমকির মুখে পড়েছে। বায়ুমণ্ডলের তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে ভূ-পৃষ্ঠের তাপমাত্রাও বৃদ্ধি পাচ্ছে। যার প্রভাবে বনাঞ্চলসমূহ ধ্বংস হওয়ার আশংকা দেখা দিচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বিভিন্ন প্রজাতির মাছ ও জলজ প্রাণী বিলুপ্তির পথে। পরিবেশ ও ভূ-বিজ্ঞানীদের মতে, সমুদ্রের উচ্চতা মাত্র ১ মিটার বৃদ্ধি পেলে সুন্দরবনের ৭০ ভাগ তলিয়ে যাবে। জীববৈচিত্র্য ধ্বংস হয়ে গেলে তা বিশ্বের জন্য অত্যন্ত ভয়াবহ ফলাফল বয়ে আনবে। পরিবেশ তার ভারসাম্য হারিয়ে ফেলবে।

৫. নদ-নদীর প্রবাহ-হ্রাস এবং পানির লবণাক্ততা বৃদ্ধি : বাংলাদেশ কৃষিপ্রধান দেশ। জমিতে সেচ ও নৌ-চলাচলের জন্য নদ-নদীর স্বাভাবিক প্রবাহ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে নদ-নদীর স্বাভাবিক প্রবাহ বিঘ্নিত হয়। এর ফলে প্রধান প্রধান নদীর প্রবাহ হ্রাস পাবে এবং নদীর ক্ষীণ প্রবাহের কারণে সামুদ্রিক লোনা পানি সহজে দেশের অভ্যন্তরীণ নদীপ্রবাহে প্রবেশ করে নদ-নদীর পানিতে লবণাক্ততা বাড়িয়ে দেবে। ফলে সামুদ্রিক লোনা পানি উজান অঞ্চলে প্রবেশ করায় কৃষিতে প্রয়োজনীয় মৃদু পানির অভাব দেখা দেবে এবং দেশের সম্পদের বিপুল পরিমাণ ক্ষতি সাধিত হবে। বর্তমানে বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলে ও দূরবর্তী দ্বীপসমূহের প্রায় ১.৪ মিলিয়ন হেক্টর এলাকায় লোনা পানি প্রবেশ করায় উম্মুক্ত জলাশয় ও ভূগর্ভস্থ পানি লবণাক্ত হয়ে পড়েছে। জলবায়ু পরিবর্তিত হওয়ার সাথে সাথে এই লবণাক্ততার মাত্রা আরও বৃদ্ধি পাবে।

৬. আকস্কিক বন্যা : পাহাড়ি ঢলের কারণে বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে বিশেষত মেঘনা অববাহিকায় প্রতিবছর আকস্মিক বন্যা দেখা যায়। দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে প্রায় ৪ হাজার বর্গ কিলোমিটার এবং দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের প্রায় ১ হাজার ৪০০ বর্গ কিলোমিটার এলাকা এ ধরনের আকস্মিক বন্যার শিকার। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বৃষ্টিপাত ও পাহাড়ি ঢলের পরিমাণ আরো বেড়ে যাচ্ছে। ফলে আকস্মিক বন্যার পৌনঃপুনিকতা, ক্ষতির পরিমাণ ও তীব্রতা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাবে। বর্তমানে দেশের উত্তরাঞ্চলে বিশেষত সিরাজগঞ্জ ও এর আশপাশের এলাকাসমূহে বন্যা ভয়াবহ রূপ ধারণ করে।

৭. নদী ভাঙন : বাংলাদেশে মোট সমুদ্র তটরেখার পরিমাণ ৭১১ কিলোমিটার এর মধ্যে সুন্দরবন উপকূল ঘিরে রয়েছে ১২৫ কিলোমিটার এবং কক্সবাজার সমুদ্র সৈকত ১২০ কিলোমিটার দীর্ঘ (সূত্র-বাংলাপিডিয়া)। এছাড়া সমুদ্র উপকূল বরাবর রয়েছে গঙ্গা ও মেঘনা অববাহিকায় অবস্থিত অসংখ্য প্রশস্ত জোয়ার ভাটা সমভূমি এবং নদী মোহনায় রয়েছে বদ্বীপ। নদীসঙ্গমে অবস্থিত এসব বদ্বীপ ও সমুদ্র তটরেখা বরাবর ভূখণ্ড প্রতিনিয়ত পরিবর্তনশীল। কিন্তু এ পরিবর্তনশীল বৈশিষ্ট্যের মাঝে এক বিশেষ ভারসাম্য বজায় থাকে। কিন্তু বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি পেলে এ ভারসাম্য বিঘ্নিত হবে। বর্তমানে দেশের উপকূলীয় অঞ্চলে নদী ভাঙনের তীব্রতা বৃদ্ধি পেয়েছে। অতিরিক্ত বৃষ্টিপাতের ফলে মেঘনা ও পদ্মার তীরবর্তী এলাকাসমূহে নদী-ভাঙনের ফলে বাংলাদেশের বিপুল পরিমাণ জনগোষ্ঠী সর্বস্বান্ত হয়ে পড়েছে।

৮. খরা : মাটিতে আর্দ্রতার অভাব অর্থাৎ বৃষ্টিপাতের তুলনায় বাষ্পীভবনের মাত্রা বেশি হলে খরা দেখা দেয়। বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির ফলে জলবায়ু পরিবর্তিত হচ্ছে যার প্রভাব বাংলাদেশেও দেখা দিচ্ছে। বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে বর্ষাকালে প্রয়োজনীয় বৃষ্টিপাত ও পানির অভাবে কৃষিকাজ মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে এবং ফসল উৎপাদনও ক্রমাগতভাবে হ্রাস পাচ্ছে। শীতকালেও এ অঞ্চলে বৃষ্টিপাতের তুলনায় বাষ্পীভবনের হার বেশি। এর ফলে মাটির আর্দ্রতা হ্রাস পায় এবং কৃষিকাজের ব্যাপক ক্ষতি সাধিত হচ্ছে। বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির সাথে সাথে খরার প্রকোপ আরো বৃদ্ধি পাবে এবং বর্তমানের মাঝারি ধরনের খরা উপদ্রুপ এলাকা মারাত্মক খরা উপদ্রুপ এলাকায় পরিণত হবে।

৯. সামুদ্রিক ঝড় ও জলোচ্ছ্বাস : সাধারণত সামুদ্রিক ঝড় সৃষ্টি হয় উত্তপ্ত বায়ু ও ঘূর্ণিবায়ু থেকে। ঘূর্ণিঝড় সৃষ্টির পেছনে অন্যান্য প্রক্রিয়া সক্রিয় থাকলেও পানির উত্তাপ বৃদ্ধিই মূল কারণ। বাংলাদেশে প্রতিবছর মে-জুন মাসে যে সামুদ্রিক ঝড় হয় তাতে উপকূলীয় জেলাসমূহে ব্যাপক ক্ষতি সাধিত হয়। বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি পাওয়ার সাথে সাথে সমুদ্রের পানির তাপমাত্রাও ক্রমবর্ধমান হারে বেড়ে যাবে। স্বাভাবিকভাবেই সামুদ্রিক ঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের তীব্রতাও বেড়ে যাবে। সাম্প্রতিক সময়ে ‘সিডর’ বাংলাদেশে যে ধ্বংসযজ্ঞের চিহ্ন রেখে গেছে তা বর্ণনাতীত। পরিবেশ বিজ্ঞানীদের মতে এটা বাংলাদেশের জন্য বড় ধরনের আঘাত। সিডর, সুনামি, সাইক্লোনসহ অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগ মূলত জলবায়ুর দ্রুত পরিবর্তনেরই ফলাফল। আর পরিবেশ দূষণের ফলে বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধিই জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য দায়ী। মানব সৃষ্ট দূষণের ফলে জলবায়ু পরিবর্তনের যে ধারা ‍সৃষ্টি হয়েছে, বাংলাদেশের জন্য তা সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ। দূষণের জন্য বিশ্বের শিল্পায়িত দেশগুলোর দায়ভার সবচেয়ে বেশি। কিন্তু এখন পর্যন্ত অনেক ধনী রাষ্ট্রই ‘কিয়োটো প্রটোকল, ১৯৯৭’ কার্যকর করেনি।

বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি ও বাংলাদেশে সম্ভাব্য ক্ষয়ক্ষতি : বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির ফলে জলবায়ু পরিবর্তন ও এর প্রভাবে সম্ভাব্য ক্ষয়-ক্ষতি ইতোমধ্যে বিশ্বজুড়ে আতঙ্ক সৃষ্টি হয়েছে। বাংলাদেশ ও তার প্রতিবেশী দেশসমূহে ক্ষয়-ক্ষতির মাত্রা অত্যন্ত ব্যাপক হবে বলে পরিবেশ ও ভূ-বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে বাংলাদেশের উচ্চতা কম থাকার কারণে বাংলাদেশে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ আরও ভয়াবহ হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এছাড়া সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশ নিয়মিত প্রাকৃতিক দুর্যোগের সম্মুখীন হচ্ছে যা জলবায়ু পরিবর্তনেরই ফলাফল। বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির ফলে বাংলাদেশে যে সকল ক্ষতি হতে পারে তা নিম্নরূপ:

ক. বিপন্ন জনগোষ্ঠী : বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থার প্রেক্ষিতে কোনো মাঝারি ধরনের প্লাবনে দেশের ৬৫ শতাংশ জনগোষ্ঠী প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির ফলে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়বে এবং প্লাবন এলাকার পরিধি ক্রমেই বাড়তে থাকবে। ফলে বিপুল জনগোষ্ঠীর জীবন ও জীবিকা বিপন্ন হয়ে পড়বে।

খ. অবকাঠামোগত ক্ষয়ক্ষতি : ১৯৯০ সালের পরিসংখ্যান অনুযায়ী বাংলাদেশে মোট বাস্তুগত সম্পদের পরিমাণ ১৮০০০ বিলিয়ন টাকা। এর মধ্যে ভৌত অবকাঠামো রয়েছে ২৮০ বিলিয়ন টাকা মূল্যের। বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি ও সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির ফলে প্লাবনের তীব্রতা বাড়বে এবং অবকাঠামোগত ব্যাপক ক্ষতি সাধিত হবে। IPCC-এর সমীক্ষা অনুয়যায়ী ২০১০ সাল নাগাদ বাংলাদেশে প্লাবনজনিত কারণে বস্তুগত সম্পদের ক্ষতির পরিমাণ হবে ২৪২ মিলিয়ন টাকা।

গ. বিপন্ন কৃষি : বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি পেলে বাংলাদেশের কৃষি খাত মারত্মক ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হবে। কৃষিখাতের ওপর এ বিপর্যয় দেশের আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থার ওপর ব্যাপক নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। IPCC-এর সমীক্ষা অনুয়ায়ী প্লাবনের কারণে দেশে আমন ধানের উৎপাদন ১৩.৬ মিলিয়ন মেট্রিক টন হ্রাস পাবে। এমনকি জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য দেশের কৃষি উৎপাদন বর্তমানের তুলনায় প্রায় ৭০ শতাংশ কমে যেতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। শীত মৌসুমে বাংলাদেশে প্রায় ৩৬০০ বর্গ কিমি এলাকা খরার কবলে পড়ে। বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির সাথে সাথে খরার ব্যাপ্তি আরো বেড়ে তা ২২০০ কিমি পর্যন্ত সম্প্রসারিত হবে। গত কয়েক দশক ধরে বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে বর্ষা মৌসুমের ফসলের ওপর খরার প্রতিকূল প্রভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তন হলে দেশের মধ্য-দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে গমের আবাদ অসম্ভব হয়ে পড়বে এবং আলুর চাষও ব্যাপক ক্ষতির মুখে পড়বে। এছাড়া প্রয়োজনীয় সেচের অভাবে দেশের উত্তর-পশ্চিম ও মধ্য-পশ্চিমাঞ্চলে চাষাবাদ ব্যাপকভাবে ক্ষতির সম্মুখীন হবে।

ঘ. লোনা পানির অনুপ্রবেশ : দেশের মোট জনসংখ্যার ১৫ শতাংশ সমুদ্র তীরবর্তী অঞ্চলে বসবাস করে। IPCC-এর সমীক্ষা অনুযায়ী সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা ১০০ সেমি বৃদ্ধি পেলে ২৫,০০০ বর্গ কিমি এলাকায় লোনা পানির অনুপ্রবেশ ঘটবে। ফলে দেশের প্রায় ৩ কোটি ৫০ লাখ লোকের জীবন ও জীবিকা ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এছাড়া লোনা পানি প্রবেশের ফলে দেশের চিংড়ি শিল্প ব্যাপক ক্ষতির সম্মুখীন হবে। দেশের নদ-নদীতে লোনা পানির অনুপ্রবেশ ঘটলে স্বাদু পানির মৎস্য সম্পদ ধ্বংস হবে এবং জলজ প্রাণী ও উদ্ভিদের জীবন বিপন্ন হবে।

ঙ. পরিবেশ বিপর্যয় : বাংলাদেশের জনসংখ্যার তুলনায় প্রাকৃতিক সম্পদ অত্যন্ত অপ্রতুল। বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি পেলে জলবায়ুতে যে ক্ষতিকর প্রভাব ফেলবে তা বাংলাদেশের জন্য ভয়াবহ পরিণাম ডেকে আনবে। জলবায়ু পরিবর্তিত হলে সম্পদের অপ্রাপ্যতা আরো বেড়ে যাবে এবং প্রাকৃতিক সম্পদ দ্রুত বিনষ্ট হবে। ইতোমধ্যে দেশের বৃহৎ বনভূমি সুন্দরবন ও হাওর অঞ্চলের পরিবেশীয় ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছে।

বৈশ্বিক উষ্ণতা রোধে আমাদের করণীয় : বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি শুধুমাত্র বাংলাদেশের জন্য নয় বরং সমগ্র বিশ্ব ও মানবজাতির জন্য হুমকিস্বরূপ। ভৌগোলিক অবস্থান ও ভূ-প্রাকৃতিক অবকাঠামো বাংলাদেশকে যতটা কুফলভোগী করেছে, এ সংকট সৃষ্টিতে আমাদের দেশের ভূমিকা শিল্পোন্নত দেশের তুলনায় খুবই নগণ্য। এখনই সময় এ সংকট মোকাবিলায় এগিয়ে আসার। বৈশ্বিক উষ্ণতা রোধে আমাদের সবচেয়ে যে বিষয়গুলোর ওপর জোর দিতে হবে তা হলো-
১. ব্যাপকভাবে বনায়ন কর্মসূচি গ্রহণ করতে হবে। এ ধারাবাহিকতায় দেশের সমুদ্র উপকূলবর্তী এলাকায় ও নদী তীরবর্তী এলাকাসমূহে বনায়ন কর্মসূচি যত দ্রুত সম্ভব শুরু করতে হবে। ফলে নদী ভাঙন ও সামুদ্রিক ঝড়ের তীব্রতা কমে যাবে।
২. বৃক্ষনিধন রোধ করতে হবে। কারণ বৃক্ষই প্রকৃতি থেকে ক্ষতিকর কার্বন ডাই-অক্সাইড গ্যাস শোষণ করে এবং অক্সিজেন নির্গমন করে। ফলে পরিবেশের ভারসাম্য বজায় থাকে।
৩. বায়ুমণ্ডলের উত্তাপ বাড়ায়, এমন ক্ষতিকর গ্যাসের নির্গমন কমাতে হবে।
৪. পরিবেশ সহায়ক জ্বালানির ব্যবহার বাড়াতে হবে।
৫. শিল্পকারখানার জ্বালানি সাশ্রয় করতে হবে এবং উৎপন্ন বর্জ্য বিশুদ্ধকরণের ব্যবস্থা নিতে হবে।
৬. সর্বোপরি দেশের সবাইকে এ ভয়াবহ দুর্যোগ মোকাবিলায় এগিয়ে আসতে হবে।

উপসংহার : একবিংশ শতাব্দীর সন্ধিক্ষণে মানবজাতি যখন সভ্যতার চরম শিখরে, ঠিক তখনই এ মানবজাতি তার পরিবেশকে ঠেলে দিচ্ছে চরম বিপর্যয়ের দিকে। মানুষ তার প্রয়োজনে একদিকে যেমন পরিবেশ ও প্রাকৃতিক সম্পদকে ব্যবহার করছে অপরদিকে পরিবেশকে করে তুলছে বিষাক্ত। পরিবেশ দূষিত হচ্ছে প্রতিনিয়ত এবং পরিবেশের ভারসাশ্য দ্রুত বিনষ্ট হচ্ছে। এ বিশ্ব আমাদেরই, আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে তাই এ ভয়াবহ বিপর্যয়ের হাত থেকে বাঁচাতে আমাদেরই এগিয়ে আসতে হবে।


[ একই প্রবন্ধ আরেকটি বই থেকে সংগ্রহ করে দেয়া হলো ]


ভূমিকা : বিশ্বের মানুষ তার চারপাশের পরিবেশের সঙ্গে সমন্বয় করে সুপ্রাচীনকাল থেকে জীবনযাপন করে আসছে। পরিবেশ বলতে চারপাশের আলো-বাতাস, মাটি-পানি, পাহাড়-পর্বত, সাগর-নদী, উদ্ভিদ, প্রাণিজগৎ সবকিছুর সম্মিলিত রূপ বুঝায়। মানুষ আর তার পরিবেশের মধ্যে যতদিন সমন্বয় বিদ্যমান ছিল ততদিন মানুষ নির্ভাবনায় ছিল। কিন্তু সভ্যতার বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধির ফলে পরিবেশেও পরিবর্তন দেখে দিয়েছে। তার মধ্যে আশঙ্কাজনক হয়ে উঠেছে জলবায়ু পরিবর্তন। এতে সারা বিশ্বে বড় ধরনের পরিবেশ বিপর্যয়ের সম্ভাবনা রয়েছে। বিশ্বনেতৃবৃন্দ সচেতন ও কার্যকর পদক্ষেপ গৃহীত না হলে সভ্যতার বিনাশ অনিবার্য। এই লক্ষ্য নিয়েই ২০১৭ সালের ৬ নভেম্বর থেকে ১৭ নভেম্বর ২০১৭ পর্যন্ত ডেনমার্কের রাজধানী কোপেনহেগেনে ১৯৭টি দেশের প্রতিনিধির অংশগ্রহণে অনুষ্ঠিত হলো বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলন। ধনী ও দরিদ্র দেশগুলোর মধ্যে বিভাজন তৈরি হয়ে সম্মেলনে অচলাবস্থা সৃষ্টির পরও শেষ পর্যন্ত কিছু সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত ও স্বাক্ষরিত হয়েছে জলবায়ু পরিবর্তনের সাথে বাংলাদেশের প্রাকৃতিক দুর্যোগের নিবিড় সম্পর্ক বিদ্যমান। তাই জলবায়ুর পরিবর্তন ও বৈশ্বিক উষ্ণায়নের পরিপ্রেক্ষিতে বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলন ২০১৭ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ।

জলবায়ু পরিবর্তনের বৈশ্বিক চিত্র : বিশ শতকের আশির দশক থেকে গ্রিনহাউস গ্যাসের প্রভাবে প্রতিবছর পৃথিবীর তাপমাত্রা গড়ে ০.১ ডিগ্রি সেলসিয়াস বৃদ্ধি পেয়েছে। এ হারে পৃথিবীর উষ্ণতা বাড়তে থাকলে বর্তমান শতকের দিকে কুমেরু অঞ্চলের প্রচুর বরফ গলে যাবে। আমাদের কাছাকাছি হিমালয় অঞ্চলেও ব্যাপক পরিবর্তন ঘটছে। আইপিসিসি (ইন্টার গভর্নমেন্টাল প্যানেল অন ক্লাইমেট চেঞ্জ), অর্থাৎ জলবায়ু পরিবর্তন পর্যবেক্ষণের জন্য ৬২০ জন বিশিষ্ট বিজ্ঞানীর সমন্বয়ে গঠিত বিশেষজ্ঞ দল সমর্থন করেছে যে, “গত শতকেই পৃথিবীর তাপমাত্রা ০.৭৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস বৃদ্ধি পেয়েছে। আমাদের কাছে এ বৃদ্ধি সামান্য মনে হলেও আবহাওয়া জগতে এ বৃদ্ধি অসামান্য গুরুত্ব বহন করে।” এভাবে বাড়তে থাকলে ২০৫০ সালে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা ১৫৩ সেন্টিমিটার বেড়ে যাবে এবং ২১০০ সালে তা পৌঁছে যাবে ৪৬০ সেন্টিমিটারে। জলবায়ুর পরিবর্তনের ফলে স্থল ও জলজ জীববৈচিত্র্য মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। বিভিন্ন পরিবেশ, কৃষি পরিবেশ, বন পরিবেশ, দ্বীপাঞ্চলের পরিবেশ, পার্বত্য পরিবেশ, মেরু পরিবেশ ইত্যাদি। সুমেরু অঞ্চলে বরফ গলার পরিমাণ আগের বছরের চেয়ে দ্বিগুণ বেড়েছে। গ্রিনল্যান্ডের বরফের ছাদ গলে যাওয়ার আশঙ্কা সৃষ্টি হয়েছে। ফলে সাগরের উচ্চতা কয়েক মিটার বৃদ্ধির মাধ্যমে পরিবেশে নানা ধরনের পরিবর্তন ঘটবে। এই পরিবর্তনে প্রাণী ও উদ্ভিদ জগতের প্রায় ২৫ ভাগ নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে এবং প্লাবিত হবে উপকূলীয় অঞ্চল। অতিবর্ষণ দেখা দেবে পৃথিবীর নিম্নতর অক্ষাংশের দেশসমূহে। পক্ষান্তরে পৃথিবীর উত্তর ও দক্ষিণ গোলার্ধে চলবে খরা, তাপপ্রবাহ এবং অনাবৃষ্টি। পরিবর্তিত সেই আবহাওয়ায় ফসল উৎপাদন দেখা দেবে চরম বিপর্যয় ও অরণ্য সম্পদের প্রাচুর্য থাকবে না। বাংলাদেশের মতো বৃষ্টিনির্ভর অঞ্চলে ফসলহানির পরিমাণ আশঙ্কাজনক হারে বেড়ে ৫০ ভাগ দাঁড়াবে। ইতোমধ্যে যেসব পরিবর্তন লক্ষ করা গেছে তাতে আশঙ্কার প্রতিফলন ঘটার সম্ভাবনাই বেশি। উনিশ শতকের মাঝামাঝি থেকে পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা ০.৬ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড বৃদ্ধি পেয়েছে, যার প্রভাব পড়ছে সারা বিশ্বে। বিশ শতকে পৃথিবীর সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা ১০-২০ সেন্টিমিটার বেড়েছে, সুইজারল্যান্ডের জমাটবাঁধা বরফের সামগ্রিক আয়তন হ্রাস পেয়েছে প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ, সুমেরু অঞ্চলে গ্রীষ্ম-পরবর্তী সময়ে এবং প্রাক শরৎকালে বরফের পুরুত্ব প্রায় ৪০ ভাগ কমেছে এবং কেনিয়ার পর্বতমালা থেকে বরফ হারিয়ে গেছে শতকরা ৯২ ভাগ, আর কিলিমানজারো থেকে শতকরা ৮২ ভাগ হারিয়ে গেছে। আলাস্কার উত্তরাঞ্চলের বনভূমির প্রতি ১০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রা বৃদ্ধির জন্যে ১০০ কিলোমিটার উত্তর দিকে স্থানচ্যুত হয়েছে। সম্প্রতি বিলুপ্ত সোনালি ব্যাঙ ও হারলেকুইন ব্যাঙকে ইতোমধ্যেই জলবায়ু পরিবর্তনের প্রথম শিকার হিসেবে শনাক্ত করা হয়েছে।

বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলন-২০১৭ : বিশ্বের অধিকাংশ দেশের সরকারেই এখন স্বীকার করছে, জলবায়ু পরিবর্তন মানবসভ্যতা ও প্রকৃতির জন্য মারাত্মক হুমকিস্বরূপ। শুধু ইন্টার গভর্নমেন্টাল প্যানেল অন ক্লাইমেট চেঞ্জ (আইপিসিসি)-এর গবেষণা নয়, বরং অনেক আগে থেকে বৈজ্ঞানিক প্রতিবেদনগুলো উষ্ণতা বৃদ্ধির প্রভাবের বিষয়টি বলে আসছে। দু বছর আগে ইন্দোনেশিয়ার বালি দ্বীপে জলবায়ু বিষয়ক জাতিসংঘ সম্মেলনে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধিরা জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয়ে একটি চুক্তি নিয়ে কাজ করতে একমত হয়েছিলেন। এরই ধারাবাহিকতায় অনুষ্ঠিত হয় কোপেনহেগেন জলবায়ু সম্মেলন-২০১৭। জলবায়ু নিয়ে তেইশতম এ বিশ্ব সম্মেলন ইউনাইটেড নেশনস ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশন অন ক্লাইমেট চেঞ্জ (ইউএনএফসিসিসি) সমিট বা Conference of the Parties (COP) 23 নামে পরিচিত। এই সম্মেলনে জলবায়ুর পরিবর্তন ও বৈশ্বিক উষ্ণায়ন বিষয়ে মানবসভ্যতার অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টির প্রয়োজনীয় সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়।

পরিবর্তিত জলবায়ুর প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ : জলবায়ুর পরিবর্তন বৈশ্বিক বিষয় হলেও বাংলাদেশের মতো দরিদ্র দেশগুলো এর পরিণতি অধিক মাত্রায় ভোগ করে থাকে। সম্প্রতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাতজন নোবেল বিজয়ী জলবায়ু পরিবর্তনে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে এ বলে উৎকণ্ঠা প্রকাশ করেছেন যে, বিশ্বের অন্যতম নিচু এলাকায় বাংলাদেশের মানুষের বসবাস। বিশ্বের ক্রমবর্ধমান উষ্ণতায় সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি পেলে ২০৫০ সালের মধ্যে বাংলাদেশের ২০ শতাংশ এলাকা ডুবে যাবে। কোটি কোটি মানুষ হবে পরিবেশ শরণার্থী। ক্ষতি হবে ফসলের, বৃদ্ধি পাবে খাদ্যাভাব ও রোগশোক, বাধাগ্রস্ত হবে উন্নয়ন উদ্যোগ।

সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধিতে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে প্লাবনজনিত ক্ষতির সম্মুখীন হতে পারে বাংলাদেশের প্রায় ১২০ হাজার বর্গকিলোমিটার অঞ্চল। এই উচ্চতা যদি ১ মিটারও বৃদ্ধি পায় তবু দক্ষিণের দ্বীপগুলো এবং সুন্দরবনের ২০ শতাংশ চলে যাবে পানির নিচে। এতে করে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক প্রাণী এবং উদ্ভিদ প্রজাতি ধ্বংশ হয়ে যাবে। জলবায়ু পরিবর্তিত হলে দেশব্যাপী বর্ষার সময় বৃষ্টিপাত বাড়বে, ফলে বেড়ে যাবে বন্যার প্রকোপ। পক্ষান্তরে শকনো মৌসুমে দেশের প্রধান প্রধান নদীর প্রবাহ আরও অনেক কমে যাবে। নদীর ক্ষীণপ্রবাহের কারণে সামুদ্রিক লোনাপনি দেশের ভেতরে এসে নদনদীর পানিতে লবণাক্ততা বৃদ্ধি করবে। বর্তমানে উপকূলীয় অঞ্চল এবং দূরবর্তী দ্বীপগুলোর ১.৪ মিলিয়ন হেক্টর এলাকায় লোনাপানি প্রবেশ করায় উন্মুক্ত জলাশয় ও ভূগর্ভস্থ পানি লবণাক্ত হয়ে পড়েছে। পানিতে লবণাক্ততা বৃদ্ধি মাটির উর্বরাশক্তিকে হ্রাস করে, এতে ফসলের উৎপাদন অনেক কমে যায় এবং সামগ্রিকভাবে কৃষি ও অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। জলবায়ু পরিবর্তিত হলে এ ক্ষতির পরিমাণ আশঙ্কাজনক হারে বেড়ে যাবে। শুধু তাই নয়, বর্ষা মৌসুমে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ বেড়ে যাওয়ার কারণে আকস্মিকভাবে বন্যা দেখা দেবে এবং ক্ষতি হবে অসংখ্য প্রাণের। আবার শুকনো মৌসুমে বৃষ্টিপাতের অভাবে দেখা দেবে খরা। বেড়ে যাবে উষ্ণতার প্রকোপ। উত্তাপ বাতাস ও ঘূর্ণিবায়ু থেকে সৃষ্টি হবে সামুদ্রিক ঘূর্ণিঝড় এবং জলোচ্ছ্বাস। যদিও ঘূর্ণিঝড়ের পেছনে একাধিক কারণ হয়েছে, তবু পানির উত্তাপ বেড়ে সামুদ্রিক ঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের তীব্রতা। এতে উপকূলীয় জেলাগুলো মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে এবং বিপন্ন লোকের সংখ্যাও বেড়ে যাবে আনুপাতিক হারে। বাংলাদেশের মোট ৬৫০ কিলোমিটার দীর্ঘ সমুদ্র তটরেখা রয়েছে। এর মধ্যে সুন্দরবন উপকূল ঘিরে আছে ১২৫ কিলোমিটার তার কক্সবাজারের সমুদ্র সৈকত হলো ৮৫ কিলোমিটার। হাজার হাজার বছর ধরে উপকূলীয় এলাকায় ভাঙাগড়া চলছে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ভাঙাগড়ার এ ভারসাম্য বিনষ্ট হবে এবং অকল্পনীয় ক্ষতি হবে মানুষের। বিশ্বের বহু দেশই আজ এ ধরনের ক্ষতির মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বৈশ্বিক উষ্ণায়ন ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের ভয়াবহতা বৃদ্ধির অন্যতম প্রধান কারণ জলবায়ুর পরিবর্তন। এ থেকে মুক্তির উপায় উদ্ভাবন ও তা কার্যকরের উদ্দেশ্য নিয়েই কোপেনহেগেনে অনুষ্ঠিত হলো বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলন ২০১৭।

জলবায়ু পরিবর্তন সম্মেলনের চুক্তি : কোপেনহেগেনে জলবায়ু সম্মেলনের চুক্তিতে বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির মাত্রা পাক শিল্প পর্যায়ের তুলনায় অতিরিক্ত ২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের (৩.৬ ডিগ্রি ফারেনহাইট) মধ্যে সীমিত রাখার প্রস্তাবকে স্বীকৃতি দান এবং আগামী ৩ বছর উন্নয়নশীল দেশগুলোকে ৩০ বিলিয়ন ডলার (দু লাখ দশ হাজার কোটি টাকা) সাহায্যের অঙ্গীকার করা হয়। পাশাপাশি জলবায়ু পরিবর্তনের সাথে মানিয়ে নেওয়ার জন্য দরিদ্র দেশগুলোকে ২০২০ সাল পর্যন্ত প্রতিবছর ১০০ বিলিয়ন ডলার (সাত লাখ কোটি টাকা) সাহায্যের একটি রূপরেখা প্রণয়ন করা হয়। চুক্তিতে শিল্পোন্নত দেশগুলোর কার্বন নিঃসরণ হ্রাস পর্যবেক্ষণের একটি প্রক্রিয়াও অন্তর্ভুক্ত করা হয়। তবে। ২০২০ ও ২০৫০ সাল নাগাদ কার্বন নিঃসরণের কোনো লক্ষ্যমাত্রা চুক্তিতে নির্ধারণ করা হয়নি।

জলবায়ু সম্মেলন থেকে আমাদের প্রাপ্তি : ডিনমার্কের রাজধানী কোপেনহেগেনে ২০১৭ সালের ৬ নভেম্বর শুরু হওয়া জলবায়ু সম্মেলন শেষ হয়েছে ১৭ নভেম্বর। সম্মেলনে ১৯৭টি দেশ অংশগ্রহণ করে। অংশগ্রহণকারী দেশগুলো একটি সমঝোতায় পৌঁছতে সক্ষম হয় এবং একটি অঙ্গীকারনামা তৈরি করে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে আফ্রিকা, ক্ষুদ্র-দ্বীপপুঞ্জ এবং স্বল্পোন্নত দেশগুলোকে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। এই সম্মেলনে বাংলাদেশ দাবি করেছে, তারাই সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত দেশ। কিন্তু খাপ খাওয়ানোর তহবিলের ১৫ শতাংশ পাওয়ার আশায় গুড়েবালি পড়তে পারে, কারণ আফ্রিকার শক্তিশালী অবস্থানের কারণে তহবিলের প্রায় ৮৭ শতাংশ সেখানেই দিতে হবে। কাজেই বাংলাদেশের প্রাপ্তি কতটুকু হবে এবং এ সম্মেলনের সাফল্য বাংলাদেশের দুর্যোগ মোকাবিলায় সহায়ক হবে কি না তা এখন দেখার বিষয়।

উপসংহার : বাংলাদেশ এমনিতেই প্রাকৃতিক দুর্যোগের দেশ। এ দেশে প্রতিবছর নানা ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগ সংঘটিত হয়। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে এ দুর্যোগ আরও ভয়াবহ রূপ লাভ করবে। কোপেনহেগেনে অনুষ্ঠিত বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলনের প্রাপ্তি যাই হোক না কেন, ভবিষ্যতে এ দুর্যোগ মোকাবিলার জন্য এখন থেকেই আমাদের সচেতন হতে হবে, এখনই গ্রহণ করতে হবে উপযুক্ত প্রস্তুতি।

1 Comments

Post a Comment
Previous Post Next Post