↬ যুবসমাজের অবক্ষয়
↬ তরুণদের অবক্ষয়
↬ তরুণদের বিপথগামিতা
↬ বিক্ষুব্ধ তরুণসমাজ
ভূমিকা :
এ বয়স জেনো ভীরু, কাপুরুষ নয়
পথ চলতে এ বয়স যায় না থেমে
এ বয়সে তাই নেই কোনো সংশয়-
এ দেশের বুকে আঠারো আসুক নেমে।
(আঠারো বছর বয়স- সুকান্ত ভট্টাচার্য)
একটি দেশের যুবকদের নিয়েই যুবসমাজ। দেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জনসমষ্টি এই যুবসমাজ। কারণ শিশু, কিশোর বা প্রৌঢ়-বৃদ্ধদের দিয়ে দেশ ও জাতির বৃহত্তর কল্যাণ সাধিত হয় না। দেশের মুক্তি ও উন্নতির জন্য যুবসমাজকে এগিয়ে আসতে হয়। যৌবন-দূত যুবরাই জরাগ্রস্ত পৃথিবীর বুকে নবজীবনের কুসুম ফুটিয়েছে, নতুন দিনের গানে মুখর করেছে, স্বপ্নহীনদের স্বপ্ন দেখিয়েছে, আশাহতদের নতুন দিনের প্রত্যাশায় উদ্দীপ্ত করেছে। যৌবনদীপ্ত যুবসমাজ অফুরন্ত প্রাণশক্তির আধার। সেই শক্তি মানুষের জীবনকে করে গতিশীল ও প্রত্যাশাময়। রুগ্ন, ক্লান্ত, জীর্ণ সমাজকে নতুনভাবে ঢেলে সাজাতে দুর্বার উদ্দীপনা, ক্লান্তিহীন উদ্যম, অপরিসীম ঔদার্য, অফুরন্ত প্রাণচাঞ্চল্য ও অটল সাধনার প্রতীক হয়ে এগিয়ে আসে যুবসমাজ। তারা বিপন্ন মানবতার পাশে এসে দাঁড়ায় সেবাব্রতী ভূমিকা নিয়ে। যুগে যুগে দেশমাতৃকার মুক্তি ও আন্দোলন-সংগ্রামে যুবসমাজের অবদান ও মহান আত্মত্যাগ চির উন্নত, শাশ্বত ও কল্যাণকর। তাই যুবসমাজকে হতে হয় সুশিক্ষিত, কর্মনিষ্ঠ, দায়িত্বশীল, সৎ, সাহসী ও মানবিক।
যুবসমাজের অবক্ষয় : ’অবক্ষয়’ শব্দের আভধানিক অর্থ বিনাশ, হানি, ক্ষতি বা ক্ষয়প্রাপ্তি। যুবসমাজের অবক্ষয় মানে যুবসমাজের ক্ষতি বা ধ্বংস। জীবনকে সুন্দর ও কল্যাণের প্রতীক হিসেবে গড়ে তোলার জন্য মানবজীবনে যেসব গুণ থাকা প্রয়োজন, তা যখন লোপ পায় বা নষ্ট হয়ে যায় তখনই জীবনের অবক্ষয় নেমে আসে। Youth & Development গ্রন্থে বলা হয়েছে- The decendence of the youth is due to the environmental reflection bad effects of science & technology, state’s apathy & above all, family’s indiffenence. আমাদের যুবসমাজ আজ বিপথগামী হয়ে দেশ ও জাতিকে অন্ধকারের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। যুবসমাজ আজ দ্বিধাবিভক্ত কর্তব্য-কর্মে, চেতনায়, মননে, শিক্ষায়, সংস্কৃতিতে। তারা নেশার ঘোরে মানবীয় মূল্যবোধ, ব্যক্তিসত্তা হারিয়ে ফেলছে। ভবিষ্যতের স্বপ্ন-ভাবনা, জীবন গঠন এবং সমাজকল্যাণমূলক কর্মকাণ্ডে তাদের অনীহা শুরু হয়েছে। যুবসমাজের এহেন অবস্থায় জাতি আজ শঙ্কিত ও চিন্তিত।
যুবসমাজের অবক্ষয়ের কারণ : যুবসমাজের অবক্ষয় যেমন এক দিনে হয়নি, তেমনি একটি-দুটি কারণেও তা হয়নি। বহুবিধ কারণে যুবসমাজ অবক্ষয়ের দিকে পা বাড়িয়ে প্রায় ধ্বংসের কাছাকাছি পৌঁছে গেছে। নিচে এর কয়েকটি কারণ ব্যাখ্যা করা হলো-
১. নৈতিক মূল্যবোধের অবক্ষয় : নৈতিক মূল্যবোধ হচ্ছে মানুষের নীতিগত আদর্শ, যা মানুষের জীবনব্যবস্থা ও জীবন পদ্ধতিকে সুন্দর ও নির্মল করে, দেশ ও জাতির কল্যাণে কাজ করার মানসিকতাসম্পন্ন মানুষ হিসেবে গড়ে তোলে। নৈতিক মূল্যবোধের সাথে জড়িয়ে আছে সততা, কর্তব্যনিষ্ঠা, শিষ্টাচার, সৌজন্যবোধ, নিয়মানুবর্তিতা, ধৈর্যধারণ, অধ্যবসায় ইত্যদি বিশেষ কতগুলো গুণ। এই গুণগুলোর চর্চার মাধ্যমেই মানুষের নৈতিক মূল্যবোধের উন্মেষ ঘটে। আর নৈতিক মূল্যবোধ মানুষের মানবিকবোধ জাগিয়ে তুলে মানব চরিত্রকে করে সুষমামণ্ডিত। মানুষের আত্মিক, সামাজিক উৎকর্ষ সাধনে নৈতিক মূল্যবোধের বিকল্প নেই। ফলে শিক্ষার অন্যতম প্রধান লক্ষ্য হচ্ছে মানবচিত্তে নৈতিক মূল্যবোধের উৎসারণ ও তার মাধ্যমে মূল্যবোধসম্পন্ন মানুষ গড়ে তোলা। বর্তমান যুবসমাজে এই নৈতিক মূল্যবোধের বিষয়টি অবহেলার বস্তু। কেউ এটাকে গুরুত্ব না দিয়ে নিজের খেয়ালে গা ভাসিয়ে দিচ্ছে। ফলে তাদের মধ্যে নেমে আসছে চরম অবক্ষয়। এ দোষ শুধু তাদের নয়, যুবসমাজের নিয়ন্ত্রণ শক্তিরও। যারা তাদের পরামর্শ দিচ্ছে তারা অনেকেই নৈতিকতাসম্পন্ন, সৎ, নিষ্ঠাবান নয়। ফলে তরুণ সমাজ তাদের কথা শুনে বিভ্রান্ত হচ্ছে। পরীক্ষায় পাস আর ডিগ্রি অর্জনের শিক্ষাতেও যুবসমাজ খুঁজে পাচ্ছে না নৈতিক ও মানবিক মূল্যবোধের সুশিক্ষ।
২. অর্থনৈতিক বিপর্যয় : নৈতিক মূল্যবোধের অবক্ষয়ের কারণে মানুষের মধ্যে লোভ-লালসা, হিংসা, দ্বেষ বাড়ছে। আত্মবুদ্ধি, স্বার্থবুদ্ধিতে মানুষ আত্মকেন্দ্রিক হয়ে পড়ছে। ফলে সামগ্রিকভাবে অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের সৃষ্টি হচ্ছে। অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের কারণে আমাদের নতুন সমাজ নানাভাবে প্রভাবিত হয়ে অবক্ষয়ের দিকে পা বাড়াচ্ছে। অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের পেছনে রাজনৈতিক অস্থিরতার ভূমিকা রয়েছে।
৩. রজনৈতিক অস্থিতিশীলতা : রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা একটি দেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে ব্যাপক প্রভাব ফলে। ধনী-দরিদ্রের বৈষম্য বৃদ্ধিতে, শিক্ষাক্ষেত্রে বিরূপ প্রতিক্রিয়ায়, মানুষের মৌল-মানবিক চাহিদার টানাপড়েনে ঐ দেশের যুবসমাজ বিক্ষিপ্ত হয়ে পড়ে। তাদের চিন্তায় ও চেতনায় অস্থিরতা দেখা দেয়। তারা সিদ্ধান্তহীনতায় পড়ে ঠিক সময়ে ঠিক কাজটি করতে পারে না। এভাবে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা যুবসমাজকে অবক্ষয়ের দিকে ঠেলে দেয়। ১৯৫২ সালের মাতৃভাষা আন্দোলন এবং ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা সংগ্রামে এদেশের যুবসমাজ শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিল। সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করে তারা মাতৃভাষাকে রক্ষা ও মাতৃভূমিকে স্বাধীন করেছিল। কিন্তু তাদের এই শক্তি এখনও দেশ গঠনের কাজে ব্যবহৃত হয়নি। এর প্রধান কারণ রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা বা অস্থিরতা। ঘন ঘন সরকার পরিবর্তন, গণতান্ত্রিক পরিবেশের অনুপস্থিতি, পরমসহিষ্ণুতার অভাব, কালো টাকার দাপট, অবৈধ অস্ত্রের ব্যবহার জাতীয় দাবির প্রতি অনীহা প্রভৃতি আজকের যুবসমাজকে হতাশ ও বিপথগামী করে তুলছে। ফলে তারা আত্মবিকৃত হয়ে নৈতিক অধঃপতনের মধ্য দিয়ে অনৈতিক, অসৎ, সন্ত্রাসের পথে অগ্রসর হচ্ছে।
সমাজে সৎ মানুষের অবমূল্যায়ন : বর্তমানে সৎ ও ভালো মানুষের মূল্য নেই। সমাজে তার সম্মান নেই। কেউ তাকে সমীহ করে না। অফিস-আদালতে তাকে মস্ত বোকা, বদ্ধ উন্মাদ ইত্যাদি বলে কটাক্ষ করা হয়। ফলে সমাজের ভালো মানুষগুলো তাদের নীতি, আদর্শ প্রচার করতে পারে না। সমাজের কল্যাণকর কাজ নিয়েও তারা বেশিদূর অগ্রসর হতে পারে না। আর একদল লোক সমাজ সেবার নামে নিজেদের স্বার্থ হাসিল ও স্বেচ্ছাচারিতার পরিচয় দিয়েও সমাজের সর্বোচ্চ আসন লাভ করে, লোকের কাছে থেকে সম্মানের মুকুট পায়। তরুণ সমাজ অবাক বিস্ময়ে তা প্রত্যক্ষ করে। সমাজবিরোধীর যে সম্মান, যে প্রতিপত্তি তারা প্রত্যক্ষ করে সেখানে একজন জ্ঞানী, সৎ মানুষের মুল্য অতি চুচ্ছ হয়ে ওঠে। সততা সেখানে লাঞ্ছিত ও অসহায় বিবেক সেখানে বর্জিত। এসব কারণে তরুণরা সত্য, ন্যায়, কল্যাণের পথ ছেড়ে অন্ধকার পথে এগিয়ে যায়। আত্মস্বীকৃতি, ক্ষমতা, প্রভাব-প্রতিপত্তির লোভে তারা অবক্ষয়ের দিকে পা বাড়ায়।
অবক্ষয়ের উপাদানের প্রভাব : পরিবেশ মানুষকে সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত করে। চারদিকে অস্থির পরিবেশ যুবসমাজের অবক্ষয়ের অন্যতম কারণ। যুবসমাজকে নিজের স্বার্থে ব্যবহার করছে একশ্রেণির ক্ষমতা ও অর্থলোভী লোক। তাদের কূটবুদ্ধির চালে পড়ে তরুণরা তাদের সম্ভাবনাময় জীবন নষ্ট করছে। স্বার্থবাদীরা যুবাদের নিয়ে নানা রকম অবৈধ কাজ করাচ্ছে, অর্থের লোভ দেখিয়ে তাদেরকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। তরুণরা না চাইতে পেয়ে যাচ্ছে কার্যক্রম পরিচালনার অভয়, অর্থ, গাড়ি, বাড়ি, আশ্রয়, প্রশ্রয় এসব উপাদান যুবসমাজকে ক্রমশ অবক্ষয়ের দিকে ঠেলে দিচ্ছে।
৬. বেকারত্বের প্রভাব : বেকারত্ব একটি দেশের জন্য মারাত্মক অভিশাপ। লেখাপড়া শেষ করে কর্মক্ষম হয়ে যারা কাজের অভাবে বসে থাকে তারাই বেকার। বেকার জীবন নানা রকম হতাশা আর যন্ত্রণায় ভরা। এদেশের প্রায় দুই কোটি শিক্ষিত বেকার রয়েছে। যাদের বয়স ২০ থেকে ৩৫ বছর। উপার্জনের জন্য সামান্য কাজ ও অবলম্বন না পেয়ে তারা অর্থনৈতিক সংকটের মুখোমুখি হয়। দীর্ঘসময় এ অবস্থা চলতে থাকলে বেকারত্বের ক্ষোভ থেকে তারা অন্যায়ের দিকে ধাবিত হয়। তারা খুন, ডাকাতি, ছিনতাই ইত্যাদি নানা অপরাধমূলক জঘন্যতম কাজে লিপ্ত হয়। সুতরাং যুবসমাজের অবক্ষয়ের পেছনে বেকারত্বও বিশেষভাবে দায়ী।
৭. বিভিন্ন বিনোদন মাধ্যমের প্রভাব : সুস্থ বিনোদন মানুষের কল্যাণ করে। ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি সংলগ্ন করে। মানুষের মনবীয় নৈতিকতাবোধ উন্নীত করার ক্ষেত্রেও সুস্থ বিনোদনের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে। সিনেমার চটুল কাহিনিতে অশ্লীল অঙ্গভঙ্গি, অস্লীল নৃত্য-গীত, নায়ক-নায়িকার উদ্দাম প্রণয়চিত্র, খুন-জখম, রাহাজানি-ছিনতাই, ডাকাতি ইত্যাদি যুবসমাজকে অবক্ষয়ের দিকে নিয়ে যায়। তরুণ-তরুণীর ঐসব উদ্ভট ও অবাস্তক জীবনকেই অনেক সময় বাস্তব জীবন বলে ভুল করে এবং সিনেমা জগতের কায়দাকানুন ও পোশাক-আশাক অন্ধভাবে অনুসরণ করতে দিয়ে অপসংস্কৃতির শিকার হয়। টেলিভিশনে কথা ভাষায় নাটক পরিবেশনায়, প্রেমিক-প্রেমিকার সংলাপ ইত্যাদিতে যৌ-নাবেদনকেই গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। খুন, হত্যা, ধর্ষণ ইত্যাদি তথ্যচিত্র এবং সেগুলোর সাথে জড়িতদের যথার্থ শান্তি না হওয়া যুবসমাজকে অপরাধের দিকে টানছে। ফ্যাশন, আধুনিকতা, বিজ্ঞাপনের নামে সর্বত্র চলছে পর্নোগ্রাফি। ফলে যুবসমাজ নৈতিক অবক্ষয়ের দিকে ধাবমান। ব্যক্তিগত কম্পিউটারে ইন্টারনেট ব্যবহার করে পর্নোচিত্র, মুভি দেখছে। সাইবার ক্যাফে বসে সঙ্গী/সঙ্গিনকে নিয়ে পর্নোগ্রফি উপভোগ করছে। অন্যদিকে অশ্লীল পত্রপত্রিকা ও ছবি খুব সহজপ্রাপ্য হওয়ায় তা সহজেই ব্যবহার করছে। ফলে আমাদের যুবসমাজ নৈতিক চরিত্র হারিয়ে অবক্ষয়ের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।
৮. পারিবারিক ভাঙন ও নিঃসঙ্গতা : যুবসমাজের অবক্ষয়ের অন্যতম একটি কারণ পারিবারিক ভাঙন ও নিঃসঙ্গতা। পরিবারের কর্তাব্যক্তিদের মধ্যে বিশেষ করে বাবা-মার সহনশীল আচরণ, প্রেম, ভাব, ভালোবাসার পরিবর্তে অবিশ্বাস ও হিংসাত্মক মনোভাব থাকলে তা সন্তানের ওপর প্রভাব ফেলে। বাবা-মার ঝগড়া-বিবাদে সন্তানের মনে কষ্ট জমা হতে হতে সে বিপথে পা বাড়ায়। পারিবারিক অশান্তি ভুলতে নেশার দিকে ঝুঁকে পড়ে। আবার নিঃসঙ্গতায় যুবসমাজ হতাশা-যন্ত্রণা ভুলতে অপরাধমূলক কাজে জড়িয়ে পড়ে। কেউ জীবনের মূল্য ও মর্যাদা যথার্থভাবে উপলব্ধি করতে না পেরে অন্যায় পথে এগিয়ে যায়। বিবাহবিচ্ছেদ, প্রেম প্রত্যাখ্যান, চাকরিচ্যুতি ইত্যাদি থেকে সৃষ্ট মানসিক সমস্যার কারণে যুবসমাজ অনেক সময় তাদের উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন করতে পারে না। ফলে তারা নানা রকম অপরাধের দিকে ধাবিত হয়। এছাড়া যুবসমাজের অবক্ষয়ের কারণ হিসেবে আমরা দেখি-ধর্মীয় গোঁড়ামি, কুসংস্কার, অসৎ সঙ্গ, নগরজীবনের একঘেয়েমি, নির্মল আনন্দ-বিনোদনের অভাব, অর্থনৈতিক প্রতিবন্ধকতা, অর্থনৈতিক অসচ্ছলতা, মানবিক মূল্যবোধ তৈরির নৈতিক শিক্ষার অভাব ইত্যাদিকে।
যুবসমাজের অবক্ষয় প্রতিকারে উপায় : যুবসমাজকে সুসংগঠিত করে সত্য ও ন্যায়ের পথে পরিচালিত করতে হলে তাদের মধ্যে নীতিজ্ঞান সচেতনতা জাগিয়ে তুলতে হবে। কারণ যুবরাই দেশের উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ এবং জাতির কর্ণধার। কাজেই তাদের অবক্ষয়ের হাত থেকে বাঁচাতে সচেতন মহলকে আন্তরিকতা নিয়ে কাজ করতে হবে। যুবসমাজের অবক্ষয় রোধ ও প্রতিকারের জন্য আমরা নিম্নরূপ পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারি। যথা-
১. মূল্যবোধ জাগ্রতকরণ : যুবসমাজকে অবক্ষয়ের পথ থেকে ফিরিয়ে আনতে তাদের মধ্যে মানবিক মূল্যবোধ জাগ্রত করতে হবে। মূল্যবোধ জাগ্রত হলে তারা ভালো-মন্দ বুঝতে পারবে। তাহলে তারা আর অসহিষ্ণু, অমানবিক হয়ে উঠবে না। অন্যের মতামতকে গুরুত্ব দিয়ে বিচার-বিশ্লেষণ করতে শিখবে। মূল্যবোধের জাগরণ ঘটলে অবক্ষয় রোধ হবে এবং যুবসমাজ ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা পাবে।
২. রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা অর্জন : একটি দেশের যুবসমাজের অবক্ষয় রোধকল্পে রাজনৈতিক স্থিতিশীরতা অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ। রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার কারণে বেশিরভাগ উন্নয়ন পরিকল্পনা বাস্তবায়ন হয় না। ফলে অর্থনীতির ওপর চাপ বাড়ে। অর্থনৈতিক টানাপড়েনে যুবসমাজ দারুণভাবে প্রবাবিত হয়। তারা নানা অপরাধমুলক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে যায়। দেশের রাজনৈতিক স্থিতিশীরতা অর্জিত হলে অবক্ষয় অনেকাংশে রোধ হবে; তরুণ সমাজ সৃষ্টিশীল কাজে আত্মনিয়োগ করার সুযোগ পাবে।
৩. আদর্শবান ব্যক্তির মূল্য-মর্যাদা বৃদ্ধি : সমাজে আদর্শবান সৎলোকের মূল্য ও মর্যাদার দিকটি যুবসমাজের ওপর প্রভাব ফেলে। তাই তাদের সামাজিক মূল্য বাড়াতে হবে। অসৎ ও অন্যায়কারীকে বয়কট করতে হবে। নৈতিকতা, কল্যাণকর জ্ঞানকে কাজে লাগাতে হবে। অন্যায়কারী সুচতুর ব্যক্তির মুখোশ খুলে দিতে হবে। তাহলে যুবসমাজ পেশিশক্তি, মিথ্যা ও অন্যায়ের পথ পরিহার করে নৈতিকতাবোধে উন্নীতি হবে।
৪. কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা : বেকারত্বের অভিশাপ ঘোচাতে যুবসমাজ নৈতিকতা পরিহার করে অপরাধের দিকে ধাবিত হয়। তাই তাদের যোগ্যতা অনুসারে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে হবে। দেশে প্রায় দুই কোটি বেকার রয়েছে। এদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা না করতে পারলে অবক্ষয় রোধ করা কোনোক্রমেই সম্ভব নয়। কারণ বেকারত্ব তাদের সমস্ত শুভ চিন্তার অন্তরায় হিসেবে কাজ করে। বেকারত্বের হতাশা-যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেলে তারা অন্যায় পথ থেকে সরে আসবে। কাজেই বেকারদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করে তাদের অবক্ষয়ের হাত থেকে রক্ষা করতে হবে।
৫. অপসংস্কৃতির আগ্রাসন রোধ : যুবসমাজকে সংস্কৃতিবান করে গড়ে তুলতে পারলে তারা নির্মল আনন্দ-বিনোদনের প্রতি আকৃষ্ট হবে এবং অশ্লীল নাচ, গান, প্রণয়কাহিনি কিংবা পর্নোগ্রাফির প্রতি আকর্ষণ হারাবে। এগুলোর জন্য বিদেশি অপসংস্কৃতির আগ্রাসন রোধে সরকার এবং সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সজাগ ও সচেতন হবে হবে। যুবসমাজকে আমাদের ইতিহাস ও ঐতিহ্য সংলগ্ন করতে হবে। হাজার বছরের পুরনো বাঙালি সংস্কৃতির প্রতি তাদের অনুরাগী করতে পারলে তারা বিজাতীয় অপসংস্কৃতি পরিহার করবে। তাতে অপসংস্কৃতির আগ্রাসন যুবসমাজের অবক্ষয় রোধ হবে।
৬. সুস্থ বিনোদনের ব্যবস্থা : শরীরের জন্য যেমন খাদ্যের প্রয়োজন তেমনি মনের জন্য প্রয়োজন বিনোদন। সুস্থ বিনোদন মনকে সুন্দর করে ও আনন্দে ভরিয়ে দেয়। সুন্দর মনের আনন্দ উচ্ছলতায় কোনো ব্যক্তি অন্যায়ের পথে পা বাড়ায় না। কাজেই সুস্থ বিনোদন হিসেবে টেলিভিশনে অশ্লীলতাবর্জিত অনুষ্ঠান, সিনেমা, নাটক ইত্যাদি প্রচার করতে হবে। প্রেক্ষাগৃহে অশ্লীল নৃত্য, সংলাপ এবং বাস্তবতাবর্জিত কাহিনিহীন ছবির পরিবর্তে সুস্থ ধারার ছবি প্রদর্শন করতে হবে। ধর্মীয় মূল্যবোধে আঘাত হানে এমন সব বিষয় থেকে দূরে থাকতে হবে। কুরুচিপূর্ণ আপত্তিকর পোশাক পরিহার করার জন্য যুবসমাজকে সচেতন ও অনুপ্রাণিত করতে হবে।
৭. সমাজকল্যাণমূলক কাজের প্রসার : যুবসমাজকে সমাজকল্যাণমূলক কাজে উৎসাহিত করতে হবে। তাহলে তারা অপরাধপ্রবণ হয়ে ওঠার সময় ও সুযোগ কম পাবে। যুবকদের দ্বারা স্বেচ্ছাশ্রমের ভিত্তিতে নানা রকম সমাজকল্যাণমূলক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করা যেতে পারে। বিভিন্ন মৌসুমে বিভিন্ন কাজের প্রশিক্ষণ দিয়ে তাদের কাজে লাগানো যায়। যেমন- বৃক্ষরোপ অভিযান, অধিক খাদ্য ফলাও কর্মসূচি, শিশু ও নারী শিক্ষার প্রসার, প্রাথমিক চিকিৎসা সচেতনতা বৃদ্ধি ইত্যাদি। এই বিষয়ে দেশি-বিদেশি এনজিওগুলোর এগিয়ে আসতে হবে। তাহলে যুবসমাজ অবক্ষয়ের হাত থেকে অনেকাংশে রক্ষা পাবে।
৮. পারিবারিক ভাঙন রোধ : পারিবারিক কারণে যেন একজন যুকব বা যুবতি অপরাধপ্রবণ বা আত্মবিকৃতির পথে অগ্রসর না হয় সেদিকে সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে। পরিবারের দায়িত্ব হবে তার সন্তানটির বা পরিবারের তরুণটির কোনো ক্ষতি না হয় বা তারা ক্ষতির কারণ হয় এমন কাজ থেকে বিরত রাখা। একান্ত ব্যক্তিগত জীবনে ডুবে না থেকে বাবা-মাকে খেয়াল রাখতে হবে তার সন্তানটি শারীরিক ও মানসিকভাবে সুস্থ আছে কি না। সন্তানটির জীবনের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য সম্পর্কেও তাদের সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে। তরুণ বয়সী ছেলেমেয়েদের প্রতি বন্ধুর মতো আচরণ করতে হবে।
উপসংহার : যুবসমাজ একটি দেশের সবচেয়ে বড় চালিকাশক্তি। এ শক্তির অবক্ষয় রোধ করতে না পারলে দেশ অচল হয়ে পড়বে। বর্তমানে বেকারত্ব বিজাতীয় অপসংস্কৃতির আগ্রাসন, আকাশ সংস্কৃতির প্রভাব, রাজনৈতিক অস্থিরিতা প্রভৃতি কারণে এদেশের যুবসমাজ দিশেহারা। তারা হতাশাগ্রস্ত হয়ে বিভিন্ন নেশার দিকে ঝুঁকে পড়ছে। তাদের এহেন অবক্ষয় থেকে বাঁচাতে হবে। না-হলে জাতির ভবিষ্যৎ অচিরেই তলিয়ে যাবে অন্ধকারের অতল গভীরে। তাই যেকোনো মূল্যে এদেশের যুবসমাজকে অবক্ষয়ের হাত থেকে রক্ষা করতে হবে। আর তা করতে পারলে আমরা একটি সমৃদ্ধ জাতি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে পারব।
Thankyou
ReplyDeleteদয়া করে,যুব সমাজের নৈতিক অবক্ষয় উল্লেখ করে সংবাদপত্রে প্রকাশ উপযোগী প্রতিবেদন টা দিবেন।
ReplyDeleteGood
ReplyDeleteবিদ্যালয়ে পড়ুয়া শিক্ষার্থীদের অবক্ষয়ের কারন ও প্রভাব রচনা টি দিবেন প্লিজ
ReplyDelete