চিরসুখীজন ভ্রমে কি কখন
ব্যথিত বেদন বুঝিতে কি পারে?
কি যাতনা বিষে
বুঝিবে সে কিসে
বুঝিবে সে কিসে
কভু আশীবিশে দংশেনি যারে?
মূলভাব : যারা সবসময় সুখে শান্তিতে থাকে, দুঃখ কষ্ট তাদের নাগালের বাইরে
তারা কি করে অন্যের ব্যথা বুঝবে।
সম্প্রসারিত-ভাব : ঐশ্বর্য ও বিলাসব্যসনে যে মানুষ কালাতিপাত করে সে কখনও
আর্তমানবের দুঃখযন্ত্রণা অনুভব করে না। দুঃখের অভিজ্ঞতা দিয়ে দুঃখ বুঝতে হয়। যে
মানুষকে কখনও সাপে কাটে নি, সে মানুষ সর্পবিষে তীব্রতা একেবারেই উপলব্ধি করতে
পারে না। বস্তুত জীবনে যে কোন দিন দঃখের জ্বালা অনুভব করেন তার পক্ষে ব্যাথতের
বেদনা উপলব্ধি করা সহজ নয়। কি নিদারুণ মর্মজ্বালা যে একটি বুভুক্ষু ভিখারী নিজের
অন্তরের মধ্যে অনুভব করছে, বিলাস জীবনে লালিত ধনীর দুলাল তা উপলব্ধি করতে পারে না
এবং তা পারে না বলেই একমুষ্টি অন্নপ্রার্থী ভিখারীর দলকে সকরুণ নয়নে তার সুন্দর
গৃহদ্বার থেকে লাঞ্ছিত হয়ে ফিরে যেতে হয়। এতে আশ্চর্য হওয়ার কিছুই নেই। এটাই
নিয়ম। একজন যুবকের পক্ষে বৃদ্ধের অসহায়ত্ব বুঝা দুষ্কর। উল্লসিত মানুষের কাছে
শোকের কথা তাৎপর্যহীন। এ জাতীয় লোকের কাছে থেকে সমবেদনা আশা করারও বাতুলতা। অপরের
দুঃখে যার হৃদয় কাতর নয়, সে কখনও অশ্রু বিসর্জন করবে না।
তাই বলা যায়, যাকে সাপে কাটেনি সে কি করে সাপের বিষ অনুভব করবে।
একই ভাবসম্প্রসারণ অন্য বই থেকেও সংগ্রহ করে দেয়া হলো
চিরসুখী জন ভ্রমে কি কখন, ব্যথিত বেদন বুঝিতে কি
পারে? কি যাতনা বিষে বুঝিবে সে কিসে, কভু আশীবিষে দংশেনি যারে।
ভাব-সম্প্রসারণ : ব্যথিতের কষ্ট কেবল ভুক্তভােগীই বুঝতে পারে, অন্য কেউ নয়। যে
ব্যক্তি চিরকাল ধরে সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যে দিনযাপন করে সে কোনােদিনই দুঃখের জ্বালা
বুঝতে পারে না। ইংরেজিতে একটা প্রবাদ আছে-
"A wearer knows where the shoes pinches."
অর্থাৎ “যে জুতাে পরেছে, সেই কেবল জানে কোথায় পেরেক বিধছে।” তেমনি একমাত্র
ভুক্তভােগীরাই অপর ভুক্তভােগীর দুঃখ-বেদনা বুঝতে পারে। যে ব্যক্তি চিরকাল ধরে
সম্পদের মধ্যে লালিত হয়ে সুখী জীবন যাপন করে এসেছে সে কখনাে দুঃখীর দুঃখ ও
বেদনা বুঝতে পারে না। অনুরূপভাবে যাকে কখনাে সাপে কাটেনি সে কখনাে সাপের বিষের
যাতনা অনুভব করতে পারে না। সুখ ও দুঃখ সম্পূর্ণ বিপরীত প্রকৃতির হলেও জীবনে সুখ
ও দুঃখ দুটিই আছে। সুখী ব্যক্তি অনেক সময় কল্পনাপ্রবণ হন, তখন তিনি দুঃখীর
দুঃখে হয়তাে সমবেদনার ভাব পােষণ করতে পারেন। কিন্তু সে দুঃখের পরিমাণ কত ও তার
উৎস কোথায় তা অনুভব করার ক্ষমতা তার নেই। কেউ দুঃখ অতিক্রম করে সুখ পায়। আবার
কেউ সুখ হারিয়ে দুঃখের সাগরে গিয়ে পড়ে। কেউ আবার চিরকাল সুখী জীবন যাপন করে
থাকে। যারা দুঃখকে অতিক্রম করে সুখ পায় ও সুখকে হারিয়ে দুঃখের সাগরে পড়ে
তাদের পক্ষে সুখ এবং দুঃখের যুগপৎ অনুভব সম্ভব। কিন্তু যারা জীবনভর সুখী অথবা
দুঃখী জীবন যাপন করছে, তাদের পক্ষে অন্যের দুঃখ বা সুখ অনুভব করা সম্ভব নয়।
চলমান জীবনে আমরা লক্ষ করে থাকি, অর্থগর্বী মানুষেরা যেখানে পথের পাশের অন্ধ
আতুরের কাতর আহ্বান উপেক্ষা করে চলে যান সেখানে অতি সাধারণ পথিক, মুটে মজুর বা
নিম্নশ্রেণির কর্মজীবীরা তার আহ্বানে সাড়া দিয়ে থাকে। কেননা জীবন যাপনের দিক
থেকে এদের মধ্যে পার্থক্য কম। দুঃখী ব্যক্তির হাহুতাশ অর্থগর্বীর অন্তরকে
কখনাে বিদ্ধ করে না। যে ব্যক্তিকে কোনােদিন সাপে দংশন করেনি সে ব্যক্তি কখনাে
সাপের দংশনের জ্বালা বুঝতে পারে না।
কাজেই কোনাে দুঃখী অপর একজন দুঃখী ও দরিদ্র ব্যক্তির দুঃখ জ্বালা কেবল অনুভব
করতে পারে, সুখী ব্যক্তি তা পারে না। তাই আমরা দেখি যে, বিদ্যাসাগর বাল্যকাল
থেকে শুরু করে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত মানুষের দুঃখ-দারিদ্র মােচনে, অভাব-অনটন
ও ক্ষুধার জ্বালা নিবারণে অকাতরে নিজেকে বিলিয়ে দিয়েছেন। সমবেদনা ও
সহানুভূতিবােধ ছাড়া বাস্তবিকই অপরের দুঃখ-দুর্দশা বােঝাও যায় না, তা মােচনও
করা যায় না। দুঃখী ব্যক্তির দুঃখ-জ্বালা অনুভব করার ক্ষমতা একমাত্র দুঃখী
ব্যক্তিরই আছে। সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের মধ্যে জীবন যাপনকারী ব্যক্তি তার
বিন্দুমাত্র অনুভব করতে পারে না।