তেলা মাথায় তেল দেয়া মনুষ্য জাতির রোগ
মূলভাব : প্রকৃতির রাজ্যে মানুষে মানুষে কোন ভেদাভেদ না থাকলেও মানবসমাজে বিরাজ করছে অর্থনৈতিক ভেদাভেদ ও বৈষম্য। একদিকে ভূমি ও সম্পদের মালিক শাসক, শোষক ধনিক শ্ৰেণী, অন্যদিকে ভূমিহীন, সম্পদহীন শাসিত, শোষিত সর্বহারা। একদিকে ভোগ সুখ ও বিলাস বৈভবের প্রাচুর্য, অন্যদিকে রিক্ত নিঃস্ব মানুষের চরম দারিদ্র্য। এ বৈষম্য ও ব্যবধানের রন্ধ্রপথেই সমাজ জীবনে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ধনিক, তোষণ নীতির জয় জয় কার।
সম্প্রসারিত-ভাব : মানুষ তার বিপুল শ্রম ও বিস্ময়কর মেধার সাহায্যে প্রকৃতিকে কাজে লাগিয়ে উৎপাদন করে চলেছে বিপুল সম্পদ। সমাজের শ্রমজীবী মানুষের শ্রমে এ সম্পদ উৎপাদিত হলেও সমাজে বৈষম্য সৃষ্টি করে শাসন ও শোষণের মাধ্যমে মুষ্টিমেয় এক শ্রেণীর মানুষ সে বিপুল সম্পদের অধিকারী হয়েছে। তারা বিলাসব্যসনে গা ভাসিয়ে যখন আনন্দে মাতোয়ারা তখন উৎপাদিত সম্পদের উচ্ছিষ্ট অবশেষ নিয়ে বৃহত্তর জনগোষ্ঠী দিন কাটায় নিদারুণ দুঃখ কষ্টে। এ দুঃখ, পীড়িত, দরিদ্র, ভাগ্যহত মানুষ মানবসমাজে সহানুভূতি ও সেবার পাত্র হলেও তাদের দিকে তাকাবার লোকের খুব অভাব। বরং এক শ্রেণীর লোক বিত্তবান ও ক্ষমতাধরদের প্রতি নতজানু হয়ে তাদের স্তাবকতায় থাকে সদাব্যস্ত। বিত্তবান ক্ষমতাশালীদের দৈনন্দিন প্রয়োজন সম্পূর্ণ মিটে যাওয়া সত্ত্বেও স্তাবকদের দল তাদের হাতে নানা উপহারের উপাচার পৌঁছে দিতে সদা ব্যগ্র । ধনী ও ক্ষমতাবানদের মন জুড়িয়ে চলার এ প্রবণতা হীনমন্যতার সামিল। এ শ্রেণীর লোক বিত্তবানদের তোয়াজ করতে গিয়ে সমস্ত বিচার বিবেচনা ভুলে যায়। তাদের মানসিকতার মূল কথা ব্যক্ত সেই বাংলা প্রবাদে; ‘ধনীর মাথায় ধর ছাতি, নির্ধনের মাথায় মার লাথি।' ধনীর খোশামোদি করতে গিয়ে দরিদ্র আত্মীয় পরিজনের দিকে তাকানোর সময় এদের হয় না। শুধু তাই নয়, এ সমাজে ধনীই ধনীকে কাছে টানে, ধনীই ধনীর উপকারে হাত বাড়িয়ে দেয়। ধনী অতিথি সগৌরবে সমাদৃত হন, দরিদ্র অতিথি পান নীরব অবজ্ঞা। সমাজে এ মানসিকতার কারণে গরিব নিরন্নের দল বরাবরই থাকে বঞ্চিত ও উপেক্ষিত। এ এক সামাজিক ব্যাধি।
আর তাই এ ব্যাধির মূল সমাজ জীবনের গভীরে প্রোথিত। মানুষের স্বার্থান্বেষী মানসিকতা এ হীনম্মন্যতাবোধ লালনের জন্য দায়ী। সমাজে শোষণের অবসান ঘটলে, সমবণ্টন ও সামাজিক ন্যায় প্রতিষ্ঠিত হলেই বঞ্চিত দরিদ্র মানুষের জীবনে মঙ্গল সুনিশ্চিত হবে এবং মাথায় তেল দেয়ার রোগ থেকে মানবসমাজ চিরতরে মুক্তি পাবে।
এই ভাবসম্প্রসারণটি অন্য বই থেকেও সংগ্রহ করে দেয়া হলো
ভাব-সম্প্রসারণ : কোন এক সুদূর অতীতে যখন সমাজ সংগঠিত হয়েছিল, তখন সেখানে সবচেয়ে বড় হয়ে দেখা দিয়েছিল বলবানের হাত থেকে আর্ত ও দুর্বলকে রক্ষা করার প্রতিশ্রুতি। পরস্পরের সহযোগিতার মধ্য দিয়ে মানুষ নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছে। পরবর্তীকালে মানব-সমাজে সৃষ্টি হয়েছে শ্রেণীবিভাজন; সৃষ্টি হয়েছে ভূস্বামী-ভূমিহীন, পুঁজিপতি-শ্রমিক শ্রেণীর। সম্পদ করায়ত্ব হয়েছে ভূস্বামী ও পুঁজিপতিদের হাতে। ফলে একশ্রেণীর মানুষ বিত্তশালী হয়ে উঠেছেন এবং অপর এক শ্রেণী ক্রমেই রিক্ত ও নিঃস্ব মানুষগুলোর দিকে সমাজের কেউই তাকায় না। মানুষ প্রকৃতিগতভাবেই স্বার্থপর ও তোষামুদে। ফলে স্বার্থ উদ্ধারের জন্যে সুবিধাবাদী মানুষ প্রতিপত্তিশালীদের অনুগত হয়, ধনিক শ্রেণীদেরকে খুশি করার জন্যে বিভিন্ন উপহার, উপটৌকন, ঘুষ দিয়ে তুষ্ট করতে চায়। ধনীর খোশামুদি করতে গিয়ে দরিদ্র আত্মীয়-পরিজনের দিকে তাকানোর তার সময় থাকে না। ধনীরাও তার গোত্রের লোকদেরকেই সমাদর করে, গরিবরা বরাবরই বঞ্চিত ও উপেক্ষিত হয়। সমাজের বিধি ব্যবস্থার মধ্যেও ধনিক শ্রেণীদের আরো পাইয়ে দেয়ার সব রকম ব্যবস্থা থাকে। এভাবে তেলা মাথায় তেল দেওয়া সমাজের নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে।