অদৃষ্টেরে শুধালেম, ‘চিরদিন পিছে
অমোঘ নিষ্ঠুর বলে কে মোরে ঠেলিছে?
সে কহিল, ‘ফিরে দেখো।’ দেখিলাম থামি,
সম্মুখে ঠেলিছে মোরে পশ্চাতের আমি।
মূলভাব : অদৃষ্টবাসীদের ধারণা, মানুষের দৈনন্দিন জীবন ও মানবভাগ্যকে নিয়ন্ত্রণ করছে এক আমোঘ ও অপ্রতিরোধ্য শক্তি। নিয়তি বা অদৃষ্ট নামে পরিচিত এক শক্তির হাতে মানুষ যেন খেলার পুতুল। তাই মানুষ সুখ, শান্তি, সাফল্য ও সমৃদ্ধির জন্য যতই চেষ্টা করুক না কেন, অদৃষ্ট প্রতিকূল হলে তার সব চেষ্টাই ব্যর্থ হয়ে যায়। এ অদৃষ্টবাদীরা আসলেই দুর্বল, উদ্যমহীন ও কর্মভীরু। এদের আত্মবিশ্বাস নেই, নেই নিজের শক্তির উপর অবিচল আস্থা।
সম্প্রসারিত-ভাব : এ জগৎ সংসারে প্রতিটি মানুষের অগ্রযাত্রা নির্ভর করে তার সচেতন ও সক্রিয় কর্মপ্রয়াসের উপর। কর্মজীবনে প্রতিটি মানুষই নিজেদের সফল চেষ্টা, সাধনা ও শ্রমে রচনা করেছেন নিজেদের সৌভাগ্য। বস্তুত নিয়তি, বৈশক্তি বা অদৃষ্ট মানুষের জীবনধারাকে নিয়ন্ত্রণ করে না। মানুষের কর্মধারাই গড়ে তোলে তার জীবনকে। মানুষ নিজেই তার নিজের জীবনের প্রকৃত রূপকার। ভবিষ্যৎ জীবনকে সহজ, সুন্দর, সুখকর ও আনন্দময় করতে হলে মানুষকে বর্তমান মুহূর্তকে কাজে লাগাতে হয়। সঠিক শ্রম ও সাধনায় রচনা করতে হয় ভবিষ্যৎ জীবনের ভিত্তি। কালের অমোঘ নিয়মে বর্তমান পরিণত হয় অতীতে। আর বর্তমানের কর্ম কালের ভাণ্ডারে সঞ্চিত হয় সম্পদ হিসেবে। অতীতের ভাণ্ডারে সঞ্চিত কাজের প্রকৃতির উপর নির্ভর করেই রচিত হয় মানুষের বর্তমান ও ভবিষ্যৎ। সে কাজ যদি ভালো হয়, তবে তার ফলও হয় ভালো। কর্মমুখর অতীত রচনা করে সুন্দর বর্তমান ও উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ, কর্মহীন অতীত জন্ম দেয় অন্ধকারাচ্ছন্ন ভবিষ্যতের। সনিষ্ঠ শ্রম সাধনা জীবনকে করে তোলে সফল। আর কর্মবিমুখ লোকের আলস্যের পরিণামে অনিবার্যভাবে আসে ব্যর্থতা ও হতাশা। এক কথায় মানুষের আগত কর্মফলই আসলে তার বর্তমান ও ভবিষ্যৎ জীবনের চলিকা শক্তি।
তাই নিজেদের জীবনের ব্যর্থতার দায় অদৃষ্টের উপর চাপিয়ে হায়হুতাশ না করে প্রত্যেকেরই উচিত আত্মশক্তিতে বলীয়ান হয়ে নিজেদের ভবিষ্যৎ নির্মাণে সচেষ্ট ও ব্রতী হওয়া।
এই ভাবসম্প্রসারণটি অন্য বই থেকেও সংগ্রহ করে দেয়া হলো
ভাব-সম্প্রসারণ : আজ যা বর্তমান কাল তা অতীত। অতীতের ওপরই দাঁড়িয়ে আছে বর্তমানের জীবন, সভ্যতা, সংস্কৃতি। আগামী দিনোার জন্যেই অতীত অনন্ত প্রেরণার উৎস। তাই, অতীতকে ছোট করে দেখার বা অস্বীকার করার কোন অবকাশ নেই। মানবজীবনে অতীতের প্রভাব সুদূরপ্রসারী।
মহাকাল অনাদি, অনন্ত এবং নিরবচ্ছিন্ন। তাকে ক্ষুদ্র বা খণ্ড করে দেখলে সত্য দর্শন হয় না। কিন্তু সাধারণ মানুষ মহাকালের নিরবচ্ছিন্ন গতি উপলব্ধি করতে সক্ষম নয় বিধায় অখণ্ড কালপ্রবাহকে অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ- এ তিনটি ভাগে ভাগ করে দেখে। মানুষ বর্তমান কালের স্বাক্ষী, অনাগত ভবিষ্যৎ তার কাছে এক বিরাট প্রশ্নবোধক চিহ্ন। আবার যে কাল লোকচক্ষুর অন্তরালে বিলীন হয়ে গেছে সে সম্পর্কেও মানুষ নিস্ক্রিয়। অতীত যেন ঘুমিয়ে থাকা শিশুটির মতো। জীবনের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ধারাবাহিক অংশ যা একদিন বর্তমান ছিল, মহাকালের ঘূর্ণাবর্তে তা-ই অতীতে পরিণত হয়। এভাবেই চলেছে কালচক্রের বিবর্তন। জীবনপথে ফেলে আসা দিনগুলোই অতীত। সেখানে যা কিছু ঘটেছে তা আজ চোখের আড়ালে চলে গেছে। সেজন্যে অতীতকে অনেকে মৃত বলে বিবেচনা করে এবং বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ নিয়ে ব্যস্ত থাকে। আসলে অতীত ভুলে যাওয়ার নয়। কারণ অতীত থেকেই বর্তমানের সৃষ্টি। অতীত বিরাট মহীরুহের ন্যায় কর্ম, জ্ঞান ও কৃষ্টি নিয়ে মানুষের ওপর ধীর-মন্থর গতিতে তার কাজ করে যাচ্ছে। অতীতকে নির্ভর করেই গড়ে উঠছে বর্তমান সভ্যতা। ইতিহাসের শিক্ষা মানুষকে সঠিক পথ চলার নির্দেশনা দেয়। তাই বর্তমান সভ্যতা অতীতের উত্তরাধিকার। এ উত্তরাধিকার ভবিষ্যতের মধ্যে বর্তাবেই। অতীত হল নীরব কর্মী, বর্তমানের ন্যায় মুখর নয়। তার সাধনা নীরব। অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যতের জননী। অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ নিয়েই মানবের অখণ্ড সাধনা। ভবিষ্যৎ জীবনকে সুন্দর ও সুখময় করার জন্যে বর্তমানের প্রতিটি মুহূর্তকে কাজে লাগাতে হবে। এই বর্তমানই একসময় অতীত হয়ে জীবনের কর্মভাণ্ডারে সঞ্চিত হবে। আর অতীতের সঞ্চিত কর্মভাণ্ডারের উপর নির্ভর করে রচিত হয় মানুষের বর্তমান ও ভবিষ্যৎ।
যার অতীত নেই সে মৃত। অতীত মানব-জীবনের অবিচ্ছেদ্য অধ্যায়। অতীত নীরবে মানুষের বর্তমান ও ভবিষ্যৎ জীবনের ওপর তার প্রভাব রাখে। তাই অতীতকে ভুললে চলবে না।