আকর্ষণ গুণে প্রেম এক করে তোলে
শক্তি শুধু বেঁচে রাখে শিকলে শিকলে।
মূলভাব : ভালোবাসা একটা বিমূর্ত প্রতীক, বিনা সুতোর বন্ধন যা কেবল ভালোবাসা দ্বারাই জয় করা যায়। শক্তি দিয়ে অর্জন করতে গেলে তা হারিয়ে যায়।
সম্প্রসারিত-ভাব : প্রত্যেক জিনিসের এক একটা রূপ বা বৈশিষ্ট্য আছে, যা সে পরিবেশে টিকে থাকে। রূপ, রস, গন্ধ নিয়ে টিকে থাকে। ভালোবাসা একটা বিমূর্ত জিনিস যার জন্য প্রয়োজনপ্রীতি, প্রেম, ভালোবাসা ও আকর্ষণ। শক্তি দিয়ে তা ধরাছোঁয়া যায় না। ভালোবাসা পেতে হলে অবশ্যই অন্যদেরকে ভালোবাসতে হবে এবং ভালোবাসার পাশাপাশি যে বেদনা, লাঞ্ছনা আছে তা গ্রহণের মনমানসিকতা থাকতে হবে। কাটা বাদ দিয়ে যেমন ফুল নেওয়া যায় না, অন্ধকার ছাড়া যেমন আলো দেখা যায় না তেমনি দুঃখ, লাঞ্ছনা, বেদনাকে পরিহার করে শুধু ভালোবাসা পেতে চাইলে, জোর আদায় করতে চাইলে তা বরং চরম নিবুর্দ্ধিতা ছাড়া আর কিছুই নয়। সাথে সাথে ভালোবাসাকে হারাতে হয়। যে মাটিতে রস আছে, উর্বরতা আছে সেখানে ফুল গাছ গজায়, অথচ মরুভূমি বা পাথরে জীবন্ত ফুলগাছ রোপণ করলেও তা বাঁচে না। আবার মৃদ্যুমন্দ বাতাস যেমন ফুলকে দোলা দেয়, তেমনি ফুল থেকে সুরভি নেয়। পক্ষান্তরে, ঝড়ো বাতাস পারে না ফুলের সুবাস নিতে, বাতাসের শক্তিতে ফুলটাকে পারে শুধু ধ্বংস করে দিতে তবুও হার মানে না শক্তির কাছে। তেমনি দেখা যায়, ভালোবাসা দিয়ে উড়ন্ত কবুতরকে হাতের কাছে পাওয়া যায় অথচ টিয়া পাখিকে সোনার খাঁচায় বন্দি রেখে সুখাদ্য পরিবেশন, করলেও সময় বা সুযোগ পেলেই এটি উড়ে যায়। তাই তো ইতিহাসের পাতায় দেখা যায় ভালোবাসা দিয়েই কালে কালে জয় করেছে রাখাল ছেলে রাজকন্যার হৃদয়, হযরত মোহাম্মদ (স) সমগ্র আরববাসীদের। পক্ষান্তরে, যখনই ভালোবাসার পরিবর্তে শক্তি দিয়ে কাউকে বাধতে চেয়েছে সে আপন থাকলেও ঘোর শত্রুতে পরিণত হয়েছে। তাই হয়ত মনীষী আপেক্ষ করে বলেছেন, ‘বন্ধুকের নল দিয়ে সমস্ত বিশ্বকে শাসন করা যায়, কিন্তু একটি মানুষেরও মন জয় করা যায় না।’
তাই আমাদের উচিত যার যেমন অবস্থা তাকে তেমনভাবেই গ্রহণ করা। অন্যথায় প্রাপ্য জিনিসও হারাতে হয়। জোর ধরে রাখা ঠিক নয়, অর্থ্যৎ, জোর করে অধিকার আদায় করা যায় না।
এই ভাবসম্প্রসারণটি অন্য বই থেকেও সংগ্রহ করে দেয়া হলো
মূলভাব : পৃথিবীতে প্রেম হচ্ছে সবচেয়ে মধুর রোমাঞ্চকর অনুভূতি। প্রেমের স্পর্শে মানুষের মনের ইতিবাচক পরিবর্তন ঘটে। কিন্তু পক্টর বলে মানুষের মনের কোনো পরিবর্তন হয় না। তা ক্ষণিকের জন্য শুধু মানুষকে একস্থানে বেঁধেই রাখতে পারে।
সম্প্রসারিত ভাব : প্রেমকে পৃথিবীর সবচেয়ে পবিত্র অনুভূতির আখ্যা দেয়া হয়েছে। প্রেম হয় নর-নারীর মধ্যে, যা ভবিষৎকালের জন্য সন্দর এক পৃথিবী নির্মাণ করে। সংগীত, চিত্রকলা, অভিনয়, গান শোনা, কবিতা পড়া বা খেলাধুলা করা সবকিছুর সঙ্গেই মানুষের প্রেম হতে পারে। এ ধরনের প্রেম উদ্দিষ্ট বিষয়ের সঙ্গে ব্যক্তির সম্পর্ক আরো গাঢ় করে তোলে। ঈশ্বরপ্রেমও প্রেমের চমৎকার এক রূপ। এই প্রেমে ভক্ত আবিষ্ট হলে তার বাহ্যিক চাওয়া-পাওয়া বলে আর কিছু থাকে না। সে শুধু ঈশ্বরের সান্নিধ্যলাভের জন্য বিভোর হয়ে থাকে। আমরা শ্রীচৈতন্য দেবকে ঈশ্বরপ্রেমে লীন হয়ে জীবন বিসর্জন দিতে দেখেছি। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও তাঁর কবিতায় জীবনদেবতার প্রেমে লীন হয়ে তাঁকে খুঁজেছেন চিরকাল। তবে নরনারীর মধ্যকার আত্মিক প্রেমই প্রেমের সবচেয়ে দুরন্ত প্রকাশকে সামনে আনে। আত্মিক টানেই তারা পরস্পরের সন্নিকটে থাকে এবং সকল বাধাকে উপেক্ষা করে নিজেদের এক মেরুতে মিলিত করে। প্রেমের এই বন্ধনে কোনো পেশিশক্তি থাকে না; থাকে শুধু আত্মিক টান। অপরদিকে শক্তির প্রয়োগ মানুষের জীবনে কোনো ইতিবাচক পরিবর্তন আনে না। সাধারণভাবে সবল ব্যক্তি দুর্বলের ওপর শক্তি প্রয়োগ করে; তাকে বাধ্য করে যেকোনো অন্যায় সিদ্ধান্ত মেনে নিতে প্রয়োজনে কারাগারে নিক্ষেপ করে এবং হাত-পায়ে শেকল পরিয়ে দেয়। এখানে মনের কোনো বন্ধন নেই, আছে পেশিশক্তির উলম্ফন। দুজন অথবা বহুজনকেই এভাবে শেকল দিয়ে বেঁধে রাখা যেতে পারে। কিন্তু তাতে মনের উৎকর্ষ প্রকাশ পায় না; প্রকাশ পায় বর্বরতা ও পেশিদম্ভ। প্রেমে মনের যে বন্ধন আমরা দেখি পেশিশক্তিতে সে বন্ধন কখনোই গড়ে তোলা সম্ভব নয়; কিংবা অদৃশ্য ওই বন্ধনের যে শক্তি রয়েছে শেকলের বন্ধন সে শক্তি কোনোভাবেই আয়ত্ত করতে পারে না। প্রেমের আত্মিক বন্ধন সবসময় শেকলের বন্ধনের কাছে জয়ী হয়।
মন্তব্য : প্রেমের বন্ধন অদৃশ্য; কিন্তু তার মতো শক্তি বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের কোনো বন্ধনে নেই। অপরদিকে শেকলের বন্ধন দৃশ্যমান; মানুষের দেহকে তা আবদ্ধ করলেও মনকে আবদ্ধ করতে পারে না। তাই শেকলের শক্তি পেশিশক্তিকে প্রকাশ করলেও প্রেমের শক্তির কাছে নতজানু হয়।