দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া
ঘর হতে শুধু দুই পা ফেলিয়া
একটি ধানের শীষের ওপরে
একটি শিশির বিন্দু
মূলভাব : অজানাকে জানার এবং অধরাকে ধরার আকাঙ্ক্ষা মানুষের চিরন্তন প্রবৃত্তি।
সম্প্রসারিত-ভাব : প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের সাথে আমাদের কখনও পরিচয় হয় নি তার প্রতি সব সময়ই আমরা এক অপার কৌহূহল, দুর্বার আকর্ষণ ও অদম্য স্পৃহা লালন করি। ফলে মানসিক উৎকণ্ঠাকে প্রশ্রয় দিয়ে ও বহু কষ্ট এবং ত্যাগ স্বীকার এবং প্রচুর অর্থ ব্যয় করে আমরা সুদূরের উদ্দেশ্যে পাড়ি দিই। কিন্তু এ মনোভাব অসম্পূর্ণ ও খণ্ডিত। কেননা, এত শ্রম, ক্লেশ স্বীকার করেও মানুষ আত্মিক আনন্দ লাভ করে না। তাই সর্বপ্রকার পূর্বধারণা বর্জিত হয়ে ও নিরপেক্ষভাবে মূল্যায়ন করলে দেখা যায় যে, আনন্দ ও তৃপ্তির জগত মানুষকে তার নিজের মধ্যেই আবিষ্কার, নির্মাণ ও লালন করতে হয়। আমাদের পরিচিত পরিবেশের মধ্যেই এমন অনেক অসামান্য ও অনন্য সাধারণ সৌন্দর্যে মহিমান্বিত বস্তু ও এলাকা রয়েছে যেগুলোর সিংহ দুয়ার আমাদের সামনে অবারিত হয় নি। চাতকের মত সতৃষ্ণ হয়ে উঠলে সে পিপাসা বাস্তবে মেটে না। কল্পনাকে প্রশ্রয় দিয়ে সুদূরের উদ্দেশ্যে ছুটে গেলে গভীর অতৃপ্তিই মানুষের অনিবার্য পুরস্কার হয়। সে মুহূর্তে তার স্বদেশকে মনে পড়ে। নিজস্ব ভূগোল ও ইতিহাসই তার কাছে আরাধ্য বলে মনে হয়। দৃষ্টান্তরূপে বাংলা সাহিত্যের আধুনিকতার পুরোধাপুরুষ কবি মাইকেল মধুসূদন দত্তকে স্মরণ করা যায়। দুরন্ত যৌবনে প্রবল উচ্চাশা ও গভীর মোহের বশবর্তী হয়ে তিনি স্বদেশ ছেড়ে ইউরোপ গমন করেছিলেন। নিজস্ব ভাষা, সংস্কৃতি, ইতিহাস, ঐতিহ্য এমনকি পিতৃপুরুষের যুগান্তকাল আচরিত ধর্ম পর্যন্ত তাকে আকৃষ্ট করতে পারেনি। সবকিছুই তিনি জীর্ণ বস্ত্রের মত পরিত্যাগ করেছিলেন। কিন্তু সুদূর ফরাসি দেশের নির্বান্ধব পরিবেশে কাল যাপন করতে গিয়ে তার মোহমুক্তি ঘটে। তিনি নব চেতনার সন্ধান পান। অনুতপ্ত কবি অতঃপর তার স্বদেশেই প্রত্যাবর্তন করেন। তার এ মানস প্রত্যাবর্তনই ভাষা পেয়েছে তার বিখ্যাত সনেট কপোতাক্ষ নদে। যে নিসর্গের অশ্রুষায় মানুষের জন্ম, বিকাশ, পরিণতি ও বিলয়, সে ভূভাগই তার কাছে পরম প্রিয়, মায়ের মতই আপন। আমাদের জন্মভূমিই সব সৌন্দর্যের আশ্রয়। এ ধানক্ষেত, এ বালুচর আমাদের আজন্মের ঠিকানা। এর শোভা ও সৌন্দর্য বিমণ্ডিত জগতকে জানলে ও চিনলে আমরা যেমন অপার আত্মিক আনন্দ বোধ করি, তেমনি এ সব পরিত্যাগের মাঝে অন্তরের দহন অনুভব করি। জন্মভূমি অগ্রাহ্য করার মত নির্বুদ্ধিতা আর কিছু নেই। স্বদেশের গভীরে শিকড়ায়িত হয়ে যে আনন্দ লাভ করা যায় তার কোন বিকল্প নেই।
তাই মানবাত্ম জন্মভূমির মৃত্তিকারসে শিকড়ায়িত হয়েই পূর্ণতা লাভ করে। জন্মভূমিই মানুষের চিরকালীন ঠিকানা ও সর্বপ্রকার আনন্দের অফুরন্ত উৎস।