রচনা : বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

↬ আমার প্রিয় কবি : রবিঠাকুর

↬ কবিশ্রেষ্ঠ রবীন্দ্রনাথ


ভূমিকা : কবিশ্রেষ্ঠ রবীন্দ্রনাথ এক বিস্ময়কর প্রতিভা। তিনি পৃথিবীর সর্বকালের সেরা কবিদের একজন। কেবল কবি হিসেবেই নয়, কিংবা তিনি শুধু ভাষা-সাধকই নন, নন কবিশ্রেষ্ঠ। তিনি চিন্তাবিদ, দার্শনিক। তিনি মনুষ্যত্বের সাধক। অন্যায়-অবিচারের বলিষ্ঠ-প্রতিবাদ। তিনি সুপ্তিমগ্ন জাতির স্বপ্নভঙ্গের গান। জড়তাগ্রস্ত জীবনের গতির ছন্দ। তিনি দেশব্রতীর সঠিক পথের নির্দেশ। ভাবুকের বৈচিত্র্যসমৃদ্ধ ভাবজগতের সন্ধান। নৈরাশ্য-পীড়িতকে শোনালেন নবজীবনের গান। জাতির কণ্ঠে দিলেন গণসঙ্গীত। মুখে দিলেন নবযুগের ভাষা। মানব-জীবনের এমন কোন ক্ষেত্র নেই, এমন কোন চিন্তা নেই, এমন কোন ভাব নেই যেখানে তিনি বিচরণ করেন নি। প্রতিভার এমন সর্বতোমুখিতা, এমন গভীরতা, এমন ব্যাপ্তি যথার্থই বিস্ময়কর। তিনি খণ্ডকালের হয়েও তিনি সর্বকালের। বিশেষ দেশের হয়েও সব দেশেই তাঁর সাদর প্রতিষ্ঠা। তিনিই বাংলাভাষাকে বিশ্বের দরবারে দিয়েছেন মর্যাদার আসন। এই ভাষাতেই অমর সাহিত্য রচনা করেছেন তিনি। এই ভাষাতেই আমরা কথা বলি। রবীন্দ্রনাথ তাই আমাদের গর্ব। তিনি দেশ ও জাতির আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতীক। 

জন্ম ও পটভূমি : কোন প্রতিভার আবির্ভাবই বিচ্ছিন্ন কিছু নয়। দেশ ও সমাজের বহমানতার সঙ্গেই তাঁর গোপন-গভীর রহস্য-বন্ধন। যুগের অনিবার্য দাবিতেই সেই মহৎ প্রতিভার শুভ জন্ম। উনিশ শতকের প্রথম ও দ্বিতীয় অর্ধে বাংলা সাহিত্যে-সমাজে এলো এক প্রাণ-সমৃদ্ধ নতুন দিনের জোয়ার। এলেন নবযুগের পথিকের দল। সেই বরণীয় মনীষীদের কর্ষণায় রচিত হল ভাবী প্রতিভার উর্বর ভূমি। জোড়াসাঁকোর ঠাকুরপরিবার তখন শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতির অন্যতম পীঠস্থান, আধুনিকতার প্রাণকেন্দ্র জাতীয়তাবোধের উন্মেষ-ক্ষেত্র। প্রাচ্য-প্রতীচ্যের যুগল ভাবধারায় পুষ্ট, স্বাতন্ত্র্য-উজ্জ্বল এই পরিবার। এই পরিবারেই ১২৬৮ বঙ্গাব্দের ২৫ বৈশাখ (ইং ১৮৬১-র ৭ মে), জন্ম নিলেন এক বিস্ময়কর প্রতিভা। সেই প্রতিভার নাম রবীন্দ্রনাথ। 

শিক্ষা : ঠাকুরপরিবারের উন্নত পরিবেশেই শুরু হল তাঁর বিদ্যাচর্চা। ছ-বছর বয়সে ভর্তি হলেন ওরিয়েন্টাল সেমিনারিতে। কিছুদিন পরেই বিদ্যালয়ের পঠন-পাঠনের যান্ত্রিকতায়, পরিবেশের নিষ্প্রাণতায় শিশু-মন ক্ষুদ্ধ হল। বছরখানেক পরেই ওরিয়েন্টাল সেমিনারি ছেড়ে দিলেন। ভর্তি হলেন নর্মাল স্কুলে। সেখান থেকে গেলেন বেঙ্গল একাডেমিতে। এ সময় তাঁর উপনয়ন হয়। পিতার সঙ্গে গেলেন বোলপুর। সেখান থেকে ডালহৌসি পাহাড়। প্রকৃতিকে দুচোখ ভরে দেখলেন। এসময় স্বয়ং মহর্ষি আকাশের গ্রহতারা দেখিয়ে পুত্রকে সৌরলোক সম্বন্ধে শিক্ষা দিতেন। হিমালয় থেকে ফিরে আবার সেই বেঙ্গল একাডেমি। কিন্তু বিদ্যালয়ের গতানুগতিকতা তাঁকে বাঁধতে পারল না। বেঙ্গল একাডেমি ছেড়ে গেলেন সেন্ট জেভিয়ার্স স্কুলে। সেখানেও ঠাঁই হল না। এবার প্রবাসের হাতছানি। ১৮৭৮-এর সেপ্টেম্বর পাড়ি দিলেন বিলেতে। সেখানে পাবলিক স্কুলে ভর্তি হলেন। কিছুদিন পরে সেখান থেকে গেলেন লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ে। দেড় বছর পরে স্বদেশে প্রত্যাবর্তন। ব্যারিস্টারি পড়ার উদ্দেশ্যে আবার একবার বিলেতের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেছিলেন। কিন্তু মাদ্রাজ থেকে ফিরে এলেন। এর ফলে তাঁর কপালে জোটে নি স্কুল-কলেজের গতানুগতিক বিদ্যা সত্য, কিন্তু বিশ্ব-বিদ্যার সকল দুয়ার তাঁর সামনে উন্মুক্ত হয়ে গিয়েছিল। 

কাব্যচর্চা : ঠাকুরপরিবারের সৃষ্টিশীল পরিমণ্ডলেই রবীন্দ্রনাথের কাব্যচর্চার শুরু। বড়দের কাছ থেকে পেতেন উৎসাহ। নতুন বউঠান কাদম্বরী দেবী তাঁকে দিতেন প্রেরণা। ‘হিন্দুমেলা’, ‘বিদ্বজ্জন সভা’য় তিনি কবিতা পাঠ করেছেন। তের বছর বয়সে ‘তত্ত্ববোধিনী’ পত্রিকায় প্রকাশিত হল তাঁর প্রথম কবিতা। এবার কবি-প্রাণে সৃষ্টির পুবালী হাওয়া। নববসন্তের সৃষ্টি-প্রাচুর্যে ভরে ওঠে তার মনের সাজি। তিনি লিখলেন ‘বনফুল’। প্রকাশিত হল ‘কবি-কাহিনী’। তের থেকে আঠার বছর বয়স পর্যন্ত তাঁর রচিত কবিতাসম্ভার নিয়ে বেরোলো ‘শৈশব সঙ্গীত’। ষোল সতের বছর বয়সে লিখলেন ‘ভানুসিংহ ঠাকুরের পদাবলি’। উত্তর কালের কবি-শ্রেষ্ঠর এ হল নেপথ্য-প্রস্তুতি-পর্ব। 

সাহিত্য-সাধনা : এবার তাঁর সাহিত্য-সাধনার নবপর্যায়। সৃষ্টি-প্রাচুর্যে ভরে উঠল তাঁর কাব্যের সোনার তরী। যৌবনের উচ্ছল গতি-তরঙ্গে খুলে গেল কাব্যের উৎস-মুখ। মানুষের হৃদয়-কন্দরে সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনার গভীর-গম্ভীর অনুভূতিতে যে নিত্য লীলা,তাকেই তিনি রূপময় করে তুললেন। প্রেম-প্রকৃতি-সৌন্দর্য-স্বদেশ-কে ঘিরে কবি-ভাবনা হল উচ্ছসিত, বন্ধনহারা। ‘সন্ধ্যাসঙ্গীত’ থেকে ‘কড়ি ও কোমল’ পর্যন্ত এক বিশেষ পর্ব। ‘সন্ধ্যাসঙ্গীতে’ রোমান্টিক কবি-মন বেদনায় ব্যাকুল। ‘প্রভাতসঙ্গীতে’ সেই বেদনা-মুক্তির উল্লাস। শুরু হল এক মহৎ প্রতিভার দীর্ঘ পথ-পরিক্রমা। ‘মানসী’ কাব্যেই শোনা গেল দেহাতীত প্রেমচেতনার স্পষ্ট সুর। একদিকে প্রকৃতির ভুবন-ভোলানো রূপের ঐশ্বর্যে, অন্যদিকে মানুষের জীবনধারার বিচিত্র কলতানে কবি-হৃদয় পূর্ণ হয়ে উঠল। ‘চিত্রা’য় কবি শুনলেন জীবনদেবতার অলক্ষ্য পদধ্বনি। ‘চৈতালী’ থেকে ‘কল্পনা’ পর্যন্ত আবার অন্য সুর। ‘নৈবেদ্য’, ‘খেয়া’, ’গীতাঞ্জলি’, ‘গীতিমাল্য’‘গীতালি’ রবীন্দ্র কবি-কবি জীবনের এক বিশেষ অধ্যায়। এখানে তাঁর অধ্যাত্ম-আকুতি পূর্ণতা লাভ করল। কবি মেতেছেন অরূপ সাধনায়। সীমা পেতে চায় অসীমের মাঝে মুক্তি। কিন্তু সেই অসীমের সাধনায় তিনি বন্দি থাকলেন না। আবার বলাকার পাখায় পেলেন মর্ত্য জীবনের ঘ্রাণ। ‘বলাকা’, ‘পলাতকা’, ’পূরবী’‘মহুয়া’ এই পর্বের রচনা। এখানে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে মর্ত্যপ্রীতি, গতিতত্ত্ব আর যৌবনস্তুতি। ‘পূরবী’তে বিগত যৌবনের স্মৃতি-রোমন্থনের বিষণ্নতা। ‘মহুয়া’ দ্বিতীয় যৌবনের ‘মায়ালোকের কাব্য’ এরপর ‘পরিশেষ’ থেকে ‘শেষ লেখা’ পর্যন্ত পরিক্রমার শেষ পর্যায়। মৃত্যুর দ্বারপ্রান্ত থেকে ফিরে আসার অভিজ্ঞতা। ‘সেঁজুতি’, ‘আকাশ প্রদীপ’, ‘নবজাতক’, ‘সানাই’, ‘রোগশয্যায়’, ‘জন্মদিনে’, ‘শেষলেখা’য় কবির পরিণত মনের জিজ্ঞাসা। শুধু কবিতা নয়, নাটক-প্রবন্ধ-উপন্যাস-ছোটগল্প-সমালোচনা-রসরচনা-বিজ্ঞান-ব্যাকরণ-শিশু-সাহিত্য-সঙ্গীত-ভ্রমণকাহিনী লিখেছেন। তাঁর লোকোত্তর প্রতিভার ছোঁয়াতেই বাংলাভাষা ও সাহিত্যের এত বৈভব। এত প্রাচুর্য। ১৯১৩ সালে ‘গীতাঞ্জলি’ কাব্যের জন্যে পেলেন বিশ্বের শ্রেষ্ঠ সম্মান, ‘নোবেল পুরস্কার’। তিনি হলেন বিশ্বনন্দিত কবি। গানের জগতেও আনলেন নতুন ধারা। কথা ও সুরের সমন্বয়ে সঙ্গীতেও রবীন্দ্রনাথ এক বিরল ব্যক্তিত্ব। 

রবীন্দ্র সংগীত : সংগীতে ছিল তাঁর বিশেষ পারদর্শিতা। তিনি নিজের গানে নিজেই সুর সংযোজন করতেন। এর ফলে তাঁর গানের একটি বিশেষ ধারা সৃষ্টি হয়। তাঁর সংগীতের সংখ্যা ছিল যেমন বিপুল তেমনি বৈচিত্র্যময়। তাঁর রচিত সংগীত ‘রবীন্দ্র সংগীত’ নামে পরিচিত। আবৃত্তি ও অভিনয়েও তাঁর প্রতিভা ছিল অসামান্য। তিনি তাঁর রচিত নাটকে বিশিষ্ট ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে মঞ্চ অভিনয়ে নতুন ধারা সৃষ্টি করে গেছেন। সংগীত রচনা ও অভিনয়ে অংশগ্রহণ ছাড়াও তিনি পরিণত বয়সে চিত্রাঙ্কনে বিশেষ পারদর্শিতার স্বাক্ষর রেখে গেছেন। 

সমাজ ও স্বদেশ : রবীন্দ্রনাথ শুধু স্বপ্নলোকেই বিচরণ করেন নি। নিরুদ্দেশ সৌন্দর্যের পথেই যে কবির নিরন্তর পরিক্রমা, তাও নয়। সমকালীন বহু ঘটনাই তাঁর মনে ঝড় তুলেছে। যেখানেই দেখেছেন প্রবলের উদ্ধত উন্মত্ত বর্বরতা, সেখানেই তিনি প্রতিবাদ মুখর। রাজনীতির সঙ্গে তাঁর প্রত্যক্ষ যোগ ছিল না। তবু মূঢ়-ম্লান-মূক নতশির মুখে প্রতিবাদের ভাষা দিয়েছেন। দেশপ্রেমের উষ্ণ অনুরাগে অনুপ্রাণিত করেছেন। জালিয়ানওয়ালাবাগে ইংরেজের পাশবিক হত্যাকাণ্ডের তীব্র প্রতিবাদ করলেন। পরিত্যাগ করলেন ইংরেজের দেওয়া রাজকীয় খেতাব। সোচ্চার হয়েছেন বাংলার তরুণ বিপ্লবীদের ওপর ইংরেজের চণ্ডনীতির বিরুদ্ধে। সমকালীন অনেক রাজনৈতিক ক্রিয়াকলাপই তিনি সমর্থন করেন নি। কিন্তু তাঁর রাজনৈতিক উপলব্ধির গভীরতা, দূরদর্শিতার অভ্রান্ত স্বাক্ষর রেখে গেছেন বহু রচনায়। 

গঠনমূলক কাজে রবীন্দ্রনাথ : রবীন্দ্রনাথ শুধু কবিশ্রেষ্ঠই নন। সাংগঠনিক কাজেও তিনি ছিলেন সমান দক্ষ। শান্তিনিকেতনে প্রতিষ্ঠা করলেন একটি আদর্শ শিক্ষাকেন্দ্র। সেখানে তিনি শিক্ষাবিদ্। প্রকৃতির উদার প্রাঙ্গণে শিক্ষার্থী পাবে যান্ত্রিক নিরানন্দ শিক্ষার হাত থেকে মুক্তির আনন্দ। কালক্রমে সেখানে প্রতিষ্ঠিত হল ‘বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়’। এ যেন নবজীবন সাধনারই এক তপোবন। বিশ্বের সকল মানুষ, সকল মহান মতের একত্রীকরণের এক বরণীয় সাধনভূমি। বিশ্বভারতীর অনুতিদূরে গড়ে তুললেন ‘শ্রীনিকেতন’। কৃষকদের শিক্ষা, চাষের কাজে উৎসাহ-দান, কুটির-শিল্পের-উন্নতিবিধান, এই হল প্রতিষ্ঠানের উদ্দেশ্য। 

বিশ্ব ভ্রমণ : রবীন্দ্রনাথ বিশ্বের বহু দেশ ভ্রমণ করে বিশাল বৈচিত্র্যময় অভিজ্ঞতা অর্জন করেন। তিনি চীন, জাপান, ইন্দোনেশিয়া, আমেরিকা, ইউরোপের বহু দেশ, পারস্য, রাশিয়া প্রভৃতি দেশ ভ্রমণ করে তথায় উপমহাদেশের মহিমা, গৌরব ও মর্যাদা বৃদ্ধি করেন। বিশ্ব ভ্রমণের দ্বারা তিনি বিশ্বে বাংলা ভাষার প্রতি বিশ্বের শ্রদ্ধাশীল দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। ভ্রমণের ফলে তিনি বিশ্বের সকল দেশেই স্বীকৃত হয়েছেন বিশ্বকবিরূপে। 

উপসংহার : রবীন্দ্রনাথ ছিলেন অনন্ত জীবন, চিরজীবী মানবাত্মা ও প্রকৃতির চিরন্তন সৌন্দর্যের কবি। রবীন্দ্রনাথের দানের ঐশ্বর্যে ভরে আছে বাঙালির প্রাণ। তাঁকে নিয়ে আমাদের গৌরবের অন্ত নেই। ১৩৪৮ বঙ্গাব্দের ২২ শ্রাবণের (ইং ৭ আগস্ট, ১৯৪১) ঘনঘোর বাদল দিনে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। তিনি চলে গেলেন। কিন্তু দেশ ও জাতির কাছে রেখে গেলেন অফুরান ঐশ্বর্য ভাণ্ডার। তিনি মহাকবি, মহাপুরুষ। তিনি ছিলেন মনুষ্যত্বের সাধক। সুন্দরের আরাধনা করতে গিয়ে তিনি মানবতাকে বিসর্জন দেননি। বিস্মৃত হননি স্বদেশ ও সমাজকে। বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী এ কবি আমাদের সবার প্রিয় কবি, প্রিয় সাহিত্যিক।

3 Comments

Post a Comment
Previous Post Next Post