রচনা : বনভোজন

↬ একটি বনভোজনের অভিজ্ঞতা


ভূমিকা : মানুষ সীমাবদ্ধ গণ্ডি থেকে বেরিয়ে অজানাকে জানতে, অচেনাকে চিনতে আগ্রহী। মানুষ অসীম আগ্রহ অনন্ত উৎকণ্ঠা নিয়ে নৈসর্গিক দৃশ্যকে অবলোকন করার জন্য এদেশ থেকে অন্যদেশে ছুটে বেড়ায়। বনভোজন আনন্দের উৎস হলেও এটি শারীরিক, মানসিক ও শিক্ষণীয় ক্ষেত্রে ব্যাপক ভূমিকা পালন করে। বহুদিন ধরে শহরে বসবাস করছি। শহরের গতানুগতিক একঘেঁয়ে জীবনে অস্বস্তি লাগছিল। তাই একটু আনন্দ, একটু অবসর বিনোদনের জন্য আমাদের সবার মন চঞ্চল হয়ে উঠছিল। এমনি এক সময়ে আমাদের শ্রেণিশিক্ষক জনাব বশির আহমেদ প্রস্তাব রাখলেন প্রতিবছরের ন্যায় এবারও আমরা বার্ষিক পরীক্ষার পর বনভোজনে যাব। এ সংবাদে আমরা সবাই আনন্দে আত্মহারা হলাম। 

সময় ও স্থান নির্ধারণ : শীত মৌসুম বনভোজনে যাওয়ার একটি সুন্দর সময়। যেহেতু আমরা বার্ষিক পরীক্ষার পর বনভোজনে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেই, সেহেতু আমরা শীতকালেই বনভোজনে যাই। আমরা অনেক ভেবেচিন্তে স্থান নির্বাচন করি মধুপুরের ভাওয়ালর গড়। 

প্রস্তুতি : এবার আয়োজনের পালা। চাঁদা তোলা, বাজারের তালিকা তৈরি করা, বাস ঠিক করা সবকিছুই আমরা কয়েকজন বন্ধু মিলে সম্পন্ন করলাম। সবারই খুব উৎসাহ ছিল, তাই আয়োজন করতে বেশি বেগ পেতে হয় নি। আমাদের সঙ্গে চারজন শিক্ষকও বনভোজনে যাবেন। 

যাত্রা : অবশেষে বনভোজনের নির্দিষ্ট দিন এলো। আমরা তিনটি বাস ভাড়া করি। সকাল ৭টায় আমরা সকল ছাত্র-ছাত্রী স্কুল ক্যাম্পাসে উপস্থিত হলাম। বাসের আসন আগে থেকেই ঠিক করা ছিল। যে যার আসনে গিয়ে বসলাম। ৮টায় আমাদের যাত্রা শুরু হলো। এক্ষেত্রে সমস্ত কিছু তত্ত্বাবধানের দায়িত্ব ছিল আমাদের শ্রেণি শিক্ষক বশির সাহেবের ওপর। ভাওয়ালের কথা আমরা আগেই শুনেছিলাম। বইয়ের পাতায় পড়েছিলাম। কিন্তু আজ বাস্তবে দেখব, সেজন্য এক অজানা আনন্দে মন ভরে উঠল। সেখানে একটি জাতীয় পার্কের পিকনিক স্পটে আমরা যাব। 

বাস চলতে লাগল। শহর ছেড়ে আমরা বড় প্রশস্ত সড়কে উঠলাম। শীতের সকাল চারদিকে মিষ্টি রোদ ছড়ানো। রাস্তার দু’ধারে সবুজ বৃক্ষরাজি যেন আমাদের অভিনন্দন জানাচ্ছে। দুপাশের মনোমুগ্ধকর দৃশ্য দেখতে তন্ময় হয়ে পড়েছিলাম। হঠাৎ কোলাহলে সম্বিৎ ফিরে দেখি আমরা ভাওয়ালে চলে এসেছি। আর কিছুক্ষণ চলার পর বাস নির্দিষ্ট গন্তব্যে গিয়ে থামল। তখন সময় সাড়ে নয়টা। আমরা একে একে সবাই বাস থেকে নামলাম। 

উপস্থিতি : আমরা সর্বমোট ১৫০ জন ছাত্র-ছাত্রী বনভোজনে গিয়েছিলাম। বাস থেকে নেমে আমরা ঝটপট নাস্তা সেরে নিলাম। তারপর আমরা কয়েকজন রান্নার কাজে লেগে গেলাম। এক্ষেত্রে শিক্ষকগণ আমাদের সাহায্য করলেন। বাকিরা কেউ এদিক-ওদিক ঘুরতে লাগল। কেউ গান গাইতে শুরু করল। বিধি-নিষেধের কোনো বালাই নেই এখানে। 

আমাদের রান্নার সবকিছু আগে থেকেই ঠিক করা ছিল। তাই অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই রান্নার কাজ শেষ হলো। তারপর সবাই একসঙ্গে খেতে বসলাম। হৈ-চৈ করে খুশি মনে সবাই খাবার পর্ব শেষ করলাম। এরপর সবাই ঘুরতে লাগলাম। কেউ কেউ ক্যামেরা নিয়ে এসেছিল। সবাই মজা করে ছবি তুললাম। তারপর গানের আসর। গান যাই হোক না কেন আনন্দ ছিল প্রচুর। কয়েকজন নাচ-গানে মেতে উঠল, কেউ কেউ বলল চমৎকার রসালো গল্প। 

উপসংহার : আনন্দের মাঝে ডুবেছিলাম সবাই। আস্তে আস্তে বিকেল হলো। ফিরতে হবে। আবার সবাই বসে উঠলাম। একটি আনন্দমুখর ছুটির দিন এমনিভাবে কাটল। এ আনন্দ আমাদের প্রেরণা দিবে আগামী দিনের কাজের জন্য। সবচেয়ে মজার কথা হলো, এটা আমার জীবনের প্রথম কোনো বনভোজন যেটা বাইরে অনুষ্ঠিত হলো। তাই এর মজার স্মৃতি আমি কোনোদিনই ভুলব না।


[ একই রচনা আরেকটি বই থেকে সংগ্রহ করে দেয়া হলো ]


জীবন অনেকটা বয়ে চলে নদীর মতো। নদীতে যেমন জোয়ার আছে, ভাটা আছে, বর্ষায় দুকূল ছাপিয়ে সব কিছু ভাসিয়ে নিয়ে যাওয়া আছে, জীবনেও তেমনি আছে সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনা, হাসি-কান্না। প্রাত্যহিক প্রয়োজনের ছক বাঁধা জীবন প্রায়শই একঘেয়ে লাগে। মাঝে মঝে হাঁপিয়ে উঠি। মন চাইছিল অন্য কিছু করি। একদিন অফ পিরিয়ডে তাই সবাই মিলে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললাম বনভোজনে যাব। সবার এক কথা, বনভোজনটা যেন বনের মধ্যেই হয়। 

কোথায় যাব- সেই সিদ্ধান্ত নেবার জন্যে এক বিকেলে সবাই একসাথে মিলিত হলাম। প্রায় একঘণ্টা শুধু চিৎকার-চেঁচামেচিই হলো। সোমা যদি বলে রাঙামাটি তো শাওন বলে কাপ্তাই। শায়লা আর বর্ণাতো দূরে কোথাও যেতেই রাজি না। শেষমেষ সর্বসম্মতিক্রমে স্পট ঠিক হলো সীতাকুণ্ড। দিনে গিয়ে দিনেই ফেরা হবে। 

খাবারের মেনু কী হবে সে প্রসঙ্গ উঠতেই বিপ্লব নড়েচড়ে বসল। এতোক্ষণ সে কোনো কথাই বলে নি। এই নিয়ে একচোট হাসি। অধিকাংশ প্যাকেট লাঞ্চ নেবার পক্ষে, রান্নার ঝক্কিতে যেতে রাজি না তারা। আমি নিজেও। তবে আমার অন্য মন বলছে, বনভোজনে এসে যদি তৈরি খাবারই খেলাম তবে আর কেমন বনভোজন! ঠিক হলো, ওখানে গিয়েই রান্না হবে। মেয়েরা প্রতিবাদী ঘোষণা দিল, রান্নাবান্নায় তারা নেই, ও কাজটি করতে হবে ছেলেদেরকে। আমরা রাজি হলাম। 

চাঁদার হার ধরা হল ২০০ টাকা। সামনে অনেক কাজ। চাঁদা সংগ্রহ, বাস ঠিক করা, বাজার করা, হাঁড়ি-পাতিলের ব্যবস্থা করা, মাইক্রোফোন, সাউন্ডবক্স ইত্যাদি ইত্যাদি। খিচুড়ি, ডিম আর মুরগির মাংস রান্না হবে। সঙ্গে সালাদ, কোক। সকালের নাশতার জন্যে বার্গার আর কলা। সবাইকে যার যার দায়িত্ব ভাগ করে দেয়া হল। এক শুক্রবার সকালে দুটো মাঝারি সাইজের বাসে চেপে আমরা বায়ান্ন জন রওনা দিলাম সীতাকুণ্ডের পথে। 

ঠিক হয়েছিল রওনা দেব সাতটায়। আমরা ছেলেরা সবাই সময়মতো এসে হাজির, কিন্তু মেয়েদের পাত্তা নেই। সেজেগুজে মেয়েরা যখন এল তখন ঘড়ির কাঁটা আটটা ছুঁই ছুঁই। এসেই ওদের খবরদারি শুরু হয়ে গেল। বাস ছাড়ল পৌনে আটটায়। খিদের পেট চোঁ চোঁ করছে। কেউই সকালে কিছু খায় নি। তাই মাঝখানে ছোটখাট একটা হোটেলের সামনে বাস থামিয়ে সঙ্গে আনা বার্গার আর কলা খেলাম। সাথে হোটেলের বিস্বাদ চা। দেখা গেল, যারা কখনো চা খেত না তারাও আজ মহানন্দে চা খাচ্ছে। অল্প সময়ে যাত্রা বিরতি দিয়ে আবার বাস ছাড়ল। 

আমাদের বাসে তুমুল হৈচৈ আর গান হচ্ছিল। যাত্রা বিরতিতে তাই আরেক বাসের অনেকেই আমাদেরটায় চলে এলো। আমরা সীতাকুণ্ডে পৌঁছলাম পৌনে দশটায়। একটা ছোটখাট পাহাড়ের পাশে জঙ্গলের মতো। পাশে সবুজ মাঠ। নাম না জানা বিশাল কয়েকটা গাছও চোখে পড়ল। ইশ! এতো চমৎকার জায়গা। মনে হচ্ছে, আমাদের জন্যেই যেন তৈরি করা। 

বড় একটা গাছের নিচে চুলা বানানোর প্রস্তুতি চলছে। একদল বসে গেছে মাইক্রোফোন নিয়ে। মজার মজার কৌতুক, গান ইত্যাদি চলছে। একদল বেরিয়ে পড়ল লাকড়ি সংগ্রহে। দেখা গেল, এত অল্প লাকড়ি দিয়ে এক হাড়ি পানিও গরম করা যাবে না। মিনহাজ, রিপন আর রনি গেল বাজারে, লাকড়ি কিনতে। গেল তো গেল, ওদের আর আসার নাম নেই। এদিকে সোমা পেঁয়াজ কাটতে গিয়ে হাত কেটে ফেলল। ভাগ্যিস মুরগিগুলো টুকরো করে এনেছিলাম। লাকড়িওয়ালাদের খুঁজতে আমি গেলাম বাজারে। পথেই ওদের দেখা পেয়ে গেলাম। লাকড়ি নিয়ে বেচারাদের দুর্গতি দেখে আমি তো হেসেই বাঁচি নে। 

স্পটে গিয়ে দেখি কুড়িয়ে আনা খড়কুটো দিয়ে খিচুড়ি রান্নার প্রচেষ্টা চলছে। হেড কুক আমাদের বিপ্লব আর সহকারী শাওন। খানিকটা দূরে একদল মেতেছে গানে। সেই দলে গিয়ে একটু বসতেই বিপ্লব চেঁচাল- লবণ আনা হয় নি। সুতরাং আবার দৌড়াতে হল বাজারে। এবার গেল কমল আর সজীব। স্বপ্না আর চৈতীও ওদের পিছু নিল। 

রান্না শেষ হতে হতে ঘড়িতে সাড়ে তিনটা। পেটে তখন ছুঁচোর নাচন চলছে। বনভোজন সম্পর্কে এমন অনেক শুনেছি যে, রান্নায় হয়তো ঝাল বেশি নয়তো লবণ পড়ে নি। কিন্তু আমাদের রান্নাটা ভীষণ মজার হয়েছিল। খোলা আকাশের নিচে বসে খাচ্ছি আমরা। উড়ে এসে জুড়ে বসেছে কাকের দল। সবার মনে ভয়- এই বুঝি কাক তার কর্মটি সেরে ফেলে খাবারের প্লেটে। অবশেষে ভালোয় ভালোয় খাবার পর্ব শেষ হল। একটা সমস্যা অবশ্য হয়েছিল। খাওয়া দাওয়া শেষ হবার পর দেখা গেল সালাদের জন্যে আনা শসা, গাজর থলেতেই রয়ে গেছে। আমাদের খাদক বিপ্লবেরও তা মনে পড়ে নি। 

খাওয়ার পর্ব শেষ হতেই আমরা বেরিয়ে পড়লাম এলাকাটা ঘুরে দেখার জন্যে। কাছের পাহাড়টায় উঠলাম। মেয়েরা শাড়ি পরে এসেছে। পাহাড়ে উঠতে গিয়ে অবস্থা কেরাসিন। অগত্যা আমাদেরও বেশি দূর ওঠা হল না। সবাই নিচে নেমে এলাম তারপর গান নিয়ে খেলা চলল, কুইজ প্রতিযোগিতা হল, হল র‌্যাফেল ড্র। ‘ছেলে বনাম মেয়ে’ একটা বিতর্ক প্রতিযোগিতাও হয়ে গেল। আসলে কোনো কিছুতেই আমাদের স্থিরতা ছিল না। এটা ছেড়ে ওটা, ওটা ছেড়ে সেটা। একরকম বিকেল গড়িয়ে গেল। সূর্যটা লালচে সোনালি রঙের জামা পরে পাহাড়ের আড়ালে চলে গেল। একটু পরেই পাখিরা ঘরে ফিরতে শুরু করবে। আমাদেরও ফিরতে হবে। সবাই আবার বসে চাপলাম। 

ফেরার পথে তেমন হৈচৈ হলো না। কিছুটা ক্লান্তি, কিছুটা এমন আনন্দঘন দিন ফেলে আসার কষ্ট- তাই সবাই একটু চুপচাপ। খুব অল্প সময়েই যেন পথটুকু ফুরিয়ে গেল। তারপর যে যার বাড়িতে। সেই পিকনিক স্পট, নাম না জানা পাহাড় আর অপূর্ব সুন্দর দৃশ্যাবলি পড়ে রইল পেছনে, স্মৃতিরা সঙ্গী হল কেবল।

15 Comments

  1. রচনা।। সমাজ জীবনে মেলার প্রয়োজনীয়তা
    Please upload

    ReplyDelete
  2. এই লেখাটি আমার খুব পছন্দ হয়েছে।

    ReplyDelete
  3. Khub bhalo legeche Kintu lengthy...

    ReplyDelete
  4. Khub sundor lekha hoeche😍🤩😄

    ReplyDelete
  5. লেখাটা আমার হেভি কাজে লেগেছে।।। অসাধারণ লেখা এবং লেখককে আমার তরফ থেকে আন্তরিক অভিনন্দন এবং শুভেচ্ছা জানাই

    ReplyDelete
Post a Comment
Previous Post Next Post