“শ্রম বিনা শ্রী হয় না” – উপনিষদ
সভ্যতার আদিতে যখন প্রতিকূল পরিবেশ ও বিরুদ্ধ প্রকৃতি মানুষের অস্তিত্বকে করে তুলেছিল বিভিষীকাময়, সেদিন মানুষ তার আপন শ্রম দ্বারা বিশ্বের সকল শক্তিকে পরাভূত করে আশরাফুল মাখলুকাতরূপে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়েছেন, মানবজীবনে শ্রমের গুরুত্ব সর্বাধিক। বাংলাদেশের মানুষ পরিশ্রমী। কঠোর শ্রমের বিনিময়ে এদেশের বেশিরভাগ মানুষ জীবিকা নির্বাহ করে, এদেশে রয়েছে নানা পেশার মানুষ। কোনো কোনো পেশার মানুষ কায়িক শ্রম বা দৈহিক পরিশ্রম করে নানা কাজ করেন, তাদের শ্রমজীবী মানুষ বলা হয়।
বাঁচার জন্য আমাদের সবাইকে কম-বেশি পরিশ্রম করতে হয়। এদিক থেকে আমরা সবাই শ্রমজীবী মানুষ। কিন্তু সমাজে সবরকম মানুষ একরকম কাজ করেন না। শিক্ষা-দীক্ষা ও পরিবেশগত নানা করণে মানুষ নানা পেশার সঙ্গে জড়িত। সেজন্য পেশা ও শ্রমের ওপর ভিত্তি করে শ্রমকে দুই ভাগে ভাগ করা যায়। যেমন :
(১) শারীরিক শ্রম বা কায়িক শ্রম এবং
(২) মানসিক শ্রম।
এই উভয় প্রকার শ্রমের গুরুত্বই অপরিসীম।
শিক্ষক, বৈজ্ঞানিক, দার্শনিক, প্রকৌশলী, সাহিত্যিক, চিকিৎসক, রাজনীতিবিদ, অর্থনীতিবিদ, সমাজতত্ত্ববিদ ও শিল্পীর পরিশ্রম মূলত মানসিক। তবে তাদের এই মানসিক শ্রমকে বাস্তবে রূপায়িত করতে গিয়ে তারা কায়িক শ্রমও করে থাকেন।
জগতের সকল জীবকেই বেঁচে থাকার জন্য কম-বেশি শারীরিক ও মানসিক শ্রম দিতে হয়। মানসিক শ্রম একটা কাজের উদয় করে আর শারীরিক শ্রম তা সমাধা করে। চাষি, শ্রমিক, কুলি-মজুর এরা শরীরের ঘাম ঝরিয়ে, রোদে পুড়ে, বৃষ্টিতে ভিজে মাঠে ফসল ফলান, কল-কারখানায় কাজ করেন, ব্যবসায়ী ব্যবসায়-বাণিজ্যের কাজে শ্রম দেয়। এক এক পেশার মানুষের কাজের ধরন এক এক রকম, তারা সবাই তাদের নিজ নিজ ক্ষেত্রে শারীরিক ও মানসিক শ্রম দেন।
সাধারণত শ্রমজীবী মানুষকেই শ্রমিক বলা হয়। আমাদের দেশে নানাধরনের শ্রমজীবী মানুষ আছেন। যেমন: কৃষক, তাঁতি, জেলে, কামার, কুমোর, দর্জি, নাপিত, মুচি, কুলি, মাঝি, রিক্সাচালক, রাজমিস্ত্রি, কাঠমিস্ত্রি, বিদ্যুৎমিস্ত্রি, গার্মেন্টস কর্মী, বিভিন্ন কল-কারখানার শ্রমিক ইত্যাদি।
কৃষিপ্রধান এ দেশে সবচেয়ে বেশি সংখ্যায় আছে কৃষক শ্রমিক বা চাষি। তাদের শ্রমে আমরা পাই নানারকম ফসল। কৃষকের গুণে সোনালি ধানের গন্ধে ভরে ওঠে বাংলার গৃহ আর প্রান্তর। আমরা অধিকাংশ বাঙালিই কৃষকের সন্তান। আমাদের প্রত্যেকেরই শেকড় প্রোথিত রয়েছে কোনো না কোনো কৃষক পরিবারের সঙ্গে। কৃষকই এ দেশের প্রাণ, আমাদের সবারই উচিত তাদের শ্রদ্ধা করা।
তাঁতি কাপড় তৈরি করেন। মানুষের মৌলিক চাহিদার মধ্যে অন্যতম হলো কাপড়। কাপড় ছাড়া আমরা সভ্য সমাজের কল্পনা করতে পারি না। দেহে আচ্ছাদন বা কাপড় জড়িয়েই মানুষ তার আদিমতা থেকে মুক্তি পেয়েছে। বাংলাদেশ নদীমাতৃক দেশ। দেহের শিরা-উপশিরার মতো ছড়িয়ে আছে হাজারো নদী। নদীকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠেছে জীবিকা, চলাচল, পরিবহন, কৃষ্টি-শিল্প, সভ্যতা, আচার আচরণ, ব্যবহারিক জীবনের সবকিছুই। আর এসব কিছু নির্ভর করছে নদীভিত্তিক শ্রমজীবী মানুষের ওপর। নদীকে কেন্দ্র করে এদেশের লক্ষ লক্ষ শ্রমিক নানা পেশায় জড়িয়ে আছে। জেলে মাছ ধরেন, মাঝি নৌকা বেয়ে খেয়া পারাপার করেন, এসবসহ নদীকে কেন্দ্র করে অনেক মানুষের জীবিকা গড়ে ওঠেছে।
এ ছাড়া এ দেশে রয়েছে কামার, যারা আমাদের নিত্য ব্যবহার্য লোহার জিনিস যেমন: দা, বটি, ছুরি ইত্যাদি বানান, কুমোর মাটির তৈরি জিনিস বানান। তাছাড়া কুলি মালামাল বহন করেন। রিক্সাচালক রিক্সা চালান। রাজমিস্ত্রি দালান তৈরি করেন, কাঠমিস্ত্রি আসবাবপত্র তৈরি করিন। বিভিন্ন কল-কারখানায় বিভিন্ন ধরনের শ্রমিক তাদের শ্রম দিয়ে আমাদের প্রয়োজনীয় জিনিস তৈরি করেন। যেমন: গার্মেন্টস শ্রমিক গার্মেন্টস-এ কাজ করেন। এ পেশায় রয়েছে লক্ষ-লক্ষ শ্রমিক। আমাদের দেশের রপ্তানি আয়ের বড় অংশই আসে গার্মেন্টস শিল্পের মাধ্যমে। দেশের উন্নয়নে এর রয়েছে বিরাট ভূমিকা।
আমরা যদি একটু চিন্তা করি, তবে বুঝতে পারি সমাজে সুস্থ-সুন্দর জীবনযাপনের জন্য আমরা শ্রমজীবীদের ওপর নির্ভরশীল। সকল কাজেরই রয়েছে সমান গুরুত্ব। দেশের উন্নতিতে রয়েছে তাদের কায়িক শ্রমের ভূমিকা। তাদের শ্রমের কারণেই সমাজ ও রাষ্ট্র তাদের কার্যক্রম সুষ্ঠুভাবে চালাতে পারে। প্রতিদিনই আমাদের প্রায় সকল প্রয়োজনে তাদের ওপর নির্ভর করতে হয়। এ জন্যই বিখ্যাত মনীষী কালাইল বলেছেন, “আমি মাত্র দুটি লোককে সম্মান করি। প্রথমত আমার সম্মানের পাত্র ঐ কৃষক ও শ্রমশিল্পী যিনি অক্লান্ত পরিশ্রম করে অন্ন-বস্ত্রের সংস্থান করছেন, মানুষ হয়ে মানুষের মতো জীবনযাপন করেছেন ‘ঐ যে আত্মতৃপ্ত পাণ্ডুর বদনমণ্ডল, ঐ যে ধূলি-ধূসর দেহ। এটিই আমার শ্রদ্ধার যোগ্য, আর দ্বিতীয়ত আমার সম্মানের পাত্র তিনি, যিনি আত্মোন্নতি সাধন করতে নিযুক্ত আছেন। - এ দু’ব্যক্তিই আমার ভক্তিভাজন”
আমরা দৈনন্দিন জীবনে শ্রমজীবী মানুষের সেবা লাভ করি, তাঁদের ছাড়া চলতে পারি না। তাই তাদের কাজকে ছোট করে দেখার অবকাশ নেই। এমনকি তাঁদের কাজকে ছোট করে দেখা নির্বুদ্ধিতার পরিচয়। প্রকৃতপক্ষে এটাই সত্য যে, আমরা সবাই শ্রমসৈনিক। তাই সকল শ্রমজীবী মানুষের মর্যাদা সমান। আমরা সবাই তাদের শ্রমের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হব।