↬ বাংলাদেশে গ্রীন জব / Green Jobs in Bangladesh
ভূমিকা : টেকসই উন্নয়ন এবং জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত সমস্যা মোকাবিলায় অধিকাংশ দেশই জাতীয় পর্যায়ে কর্মসূচি গ্রহণ কর্মসংস্থান ও শ্রমবাজার নীতি প্রণয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে বলে ক্রমশ সচেতনতা সৃষ্টি হচ্ছে। আর এ কারণে ‘গ্রীন জব’ ধারণাটি বিশ্বে অপরিহার্য হিসেবে দেখা দিয়েছে।
গ্রীন জব : গ্রীন জব বা পরিবেশবান্ধব শ্রম বলতে এমন কর্মসংস্থানকে বুঝায় যা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে পরিবেশগত বিপর্যয় কমিয়ে সহনীয় মাত্রায় নিয়ে আসে এবং পেশাগত নিরাপত্তা ও স্বাস্থ্যসম্মত পরিবেশ নিশ্চিত করে। এছাড়া গ্রীন জব জ্বালানি ও কাঁচামালের সাশ্রয়ী ব্যবহার, পরিবেশবান্ধব অর্থনীতি সৃষ্টি, জীববৈচিত্র্য রক্ষা, ইকোসিস্টেমকে পুনরুদ্ধার, শিল্পবর্জ্য হ্রাস, পানি ও বায়ুদূষণ রোধ করতে পারে।
গ্রীন জবের প্রথম ধারণা : গ্রীন জব ধারণাটি একেবারেই নতুন। গত এপ্রিল মাসে জাপানে নিগাতা শহরে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা আয়োজিত এশিয়া প্রশান্ত মহাসাগরীয় দেশগুলোর সম্মেলনে গ্রীন জব ধারণাটি প্রথম গৃহীত হয়। বাংলাদেশের শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় গ্রীন জব সম্বন্ধে সচেতনতা সৃষ্টিসহ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য স্টক হোল্ডারদের (সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের) সাথে আলোচনা শুরু করেছে। এক্ষেত্রে সমস্যা ও সম্ভাবনা চিহ্নিতকরণ ও পর্যালোচনার মাধ্যমে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণের বিষয়ে স্টক হোল্ডারদের মধ্যে উৎসাহব্যঞ্জক সাড়া পাওয়া যাচ্ছে।
গ্রীন জব আইন : সামাজিক দায়বদ্ধতার অংশ হিসেবে ভোক্তা ও নীতিনির্ধারক মহলের অত্যধিক চাপের কারণে পরিবেশ রক্ষা, কলকারখানার কর্মপরিবেশ উন্নতকরণ, নিরাপদ ও পরিবেশবান্ধব বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, কলকারখানা থেকে নির্গত দূষিত পানি ব্যবস্থাপনা ইত্যাদি বেসরকারি খাতে খুবই গুরুত্ব পাচ্ছে। উদাহরণস্বরূপ টেক্সটাইল গার্মেন্টস, চামড়াজাত দ্রব্য এবং অন্যান্য কারখানা বর্জ্য ব্যবস্থাপনা প্লান্ট স্থাপন করতে আইনগতভাবে বাধ্য। বাংলাদেশে গ্রীন জবের অবস্থা বুঝার জন্য শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা এবং ওয়েস্ট কনসার্ন (Waste Concern) যৌথভাবে কিছু প্রতিষ্ঠান/প্রজেক্ট/কর্মসূচীকে চিহ্নিত করেছে। বাংলাদেশ ব্যুরো অব স্ট্যাটিসটিক্স (বিবিএস) লেবার ফোর্স সার্ভে ২০০৫-০৬ অনুসারে বাংলাদেশে কর্মরত শ্রমিক ৪ কোটি ৭৪ লক্ষ যার মধ্যে ২,০১,৭৬৭ জনের কর্মসংস্থান গ্রিন জবের আওতায় যা মোট শ্রমিকের মাত্র ০.৪২%।
গ্রীন জবের সম্ভাবনাময় সেক্টরগুলো হলো-
যানবাহন শিল্প : জ্বালানি হিসেবে রূপান্তরিত প্রাকৃতিক গ্যাস (সিএনজি) ব্যবহৃত হওয়ায় পাবলিক যানবাহনের ব্যয় এবং বায়ুদূষণ কমেছে। এছাড়া সিএনজিচালিত যানবাহন থেকে গ্রীন হাউজ গ্যাস কম নির্গত হয়। গবেষণায় দেখা গেছে সিএনজিচালিত যানবাহনে পেট্রোলচালিত যানবাহনের চেয়ে ১০-২০% কার্বন-ডাই-অক্সাইড, ২৫% পর্যন্ত নাইট্রোস অক্সাইড এবং ৮০% কার্বন মনোঅক্সাইড, নন মিথেন হয়।
কৃষি ও বন বিভাগ : কাজী ও কাজী টি এস্টেট লি. ওরগ্যানিক চা উৎপাদন করছে। চা বাগানটি পঞ্চগড় জেলার তেঁতুলিয়ায় অবস্থিত। এখানে কীটপতঙ্গ নিয়ন্ত্রণ, আগাছা দমন ও জমির উর্বরতা রক্ষায় স্বাস্থ্যসম্মত পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়। পূর্বে অব্যবহৃত কৃষি জমিতে বর্তমানে প্রতিবছর ২৩০ টন চা উৎপাদিত হচ্ছে। এক্ষেত্রে ৭২৫ জনের পরিবেশবান্ধব কর্মসংস্থান হয়েছে।
বর্জ্য ব্যবস্থাপনা : ‘বর্জ্যই সম্পদ’ এই স্লোগানকে সামনে রেখে গবেষণা প্রতিষ্ঠান ওয়েস্ট কনসার্ন ১৯৯৫ সালে যাত্রা শুরু করে। এটি দেশের ২৬টি শহরে কমপোস্ট বা বর্জ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ প্লান্ট স্থাপন করেছে। শ্রীলংকা ও ভিয়েতনামেও এ মডেল অনুসরণ করা হচ্ছে। কিয়োটো প্রটোকলের গ্রীন ডেভেলপমেন্ট ম্যাকানিজম ব্যবহার করে সম্প্রতি ওয়েস্ট কনসার্ন ও ডাচ ওয়েস্ট রিসাইক্লিং কোম্পানি যৌথভাবে ঢাকা শহরের চতুর্দিকে কিছুসংখ্যক কমপোস্ট প্লান্ট স্থাপনের কাজ শুরু করেছে। প্রতিদিন ৭০০ টন ধারণ ক্ষমতাসম্পন্ন হয় এ প্লান্টের কাজ ২০০৯ সালে শেষ হয়েছে। এতে ঢাকা শহরের জৈব বর্জ্য দিয়ে পরিবেশবান্ধব কমপোস্ট উৎপাদন করা।
প্লাস্টিক রিসাইক্লিং ইন্ডাস্ট্রি : বাংলাদেশে প্রায় ২৯৯৭টি প্লাস্টিক ইন্ডাস্ট্রি আছে। প্লাস্টিক রিসাইক্লিং ইন্ডাস্ট্রি প্রতিবছর প্রায় ২,৪৪,৮৩৩ টন ব্যবহৃত প্লাস্টিক সামগ্রী প্রক্রিয়াজাতকরণ করে প্লাস্টিক তৈরির রেজিনের চাহিদার প্রায় ৫৫৫% পূরণ করে। ফলে বিদেশি মুদ্রা সাশ্রয় হয়। প্লাস্টিক সামগ্রী দ্বারা জমি ভরাট হয় না বারং এ খাত ২২,২৯২ জন দরিদ্র মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে।
বিদ্যুৎ, গ্যাস ও পানি : ‘গ্রামীণ শক্তি’ পল্লি এলাকায় বায়োগ্যাস ও সৌর জ্বালানির ব্যবহার জনপ্রিয় করে তুলেছে। এ পরিবেশবান্ধব কর্মসূচি জ্বালানির চাহিদা পূরণ করেছে। এ খাতে কিছুসংখ্যক লোকের কর্মসংস্থান হচ্ছে। এছাড়া রহিম আফরোজ সোলার অ্যান্ড আরএসএফ, ড্রিমস পাওয়ার লিমিটেড, বিসিএসআইআর, এনার্জিপ্যাক ইত্যাদি প্রতিষ্ঠান সৌর ও নবায়নযোগ্য শক্তি পরিবেশবান্ধব ব্যবহারের মাধ্যমে বিদ্যুৎ, গ্যাস ইত্যাদির চাহিদা পূরণ করছে।
উপসংহার : বাংলাদেশে গ্রীন জব বিদ্যমান থাকলেও এ বিষয়ে সচেতনতা ও স্পষ্ট ধারণার অভাব রয়েছে। আমাদের দেশে কোনো কোনো ক্ষেত্রে গ্রিন জবের সুযোগ আছে, কীভাবে বর্তমান কর্মসংস্থানকে পরিবেশবান্ধব করা যায়- সে বিষয়ে আলোচনার জন্য শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে সম্প্রতি ঢাকার হোটেল সোনারগাঁ-এ কর্মশালা অনুষ্ঠিত হয়। আমরা আশা করতে পারি অল্প সময়ের মধ্যে বাংলাদেশে গ্রিন জব-এর নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হবে।