কৃষিপ্রধান আমাদের এই দেশের বেশিরভাগ লোকই গ্রামে বাস করে। দৈনন্দিন চাহিদা মেটানোর জন্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি ক্রয়-বিক্রয়ের উদ্দেশ্যে গ্রামবাসী নির্দিষ্ট দিনে যে স্থানে মিলিত হয়, তাকে বলে হাট। একে বাদ দিয়ে গ্রামের লোকদের জীবনযাত্রা, গ্রামের লোকদের অর্থনৈতিক কার্যক্রম চিন্তা করাও সম্ভব নয়।
যেসব জায়গায় প্রতিদিন দোকান বসে এবং বেচাকেনার জন্য লোকসমাগম হয়, সেসব জায়গাকে বলে বাজার। কিন্তু যেখানে সপ্তাহে দু-একদিন কেনাবেচা হয় সেসব জায়গাকে বলে হাট। হাটেই জিনিসপত্র বেশি আসে এবং ক্রেতা-বিক্রেতার সমাগম বেশি ঘটে। হাটের জন্য সপ্তাহে একটি বা দু’টি দিন নির্দিষ্ট থাকে। ওই দিন বা হাটে দিনে দূরে-দূরান্ত থেকে নৌকায়, গাড়িতে, স্টিমারে, রেলে বিপুল পণ্যসম্ভার নিয়ে বিক্রেতারা হাটে এসে সমবেত হয়। হাটে বিকিকিনিও বাজার হতে বেশি হয়। তাই হাট-বাজার আর গ্রাম্যহাট এক নয়। তবে অঞ্চলভেদে অনেকে হাটকে বাজার এবং বাজারকে হাট বলে। তাই হাট-বাজার শব্দটি প্রায় একই অর্থে ব্যবহৃত হয়। কয়েকটি গ্রাম নিয়ে একটি হাটের অস্তিত্ব। সাধারণত যে স্থানের সঙ্গে শহরের বা অন্যান্য বড় বাজারের এবং গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় রাস্তা-ঘাট কিংবা নদীপথে যোগাযোগ, যাতায়ত এবং মাল পরিবহনের সুবিধা আছে, সেসব স্থানে হাট বসে। অনেকসময় চৌরাস্তার কাছে, বড় বটগাছের নিচে, নদীর তীরে বা খোলা ময়দানে হাট বসে। সাধারণত বড় বড় হাট-বাজার নদীর তীরেই অবস্থিত। কারণ নদীমাতৃক এ দেশের নদীপথেই মালপত্র আনা-নেয়ার সুবিধা বেশি। গ্রামের হাটে সাধারণত দুই প্রকারের দোকান ঘর দেখা যায়। কিছু দোকান স্থায়ী, কিছু অস্থায়ী। অস্থায়ী দোকানগুলো সাধারণত খোলা জায়গায় বসে। হাটে কেনাবেচার সুবিধার জন্য হাটের এক এক অংশ এক এক ধরনের পণ্য বিক্রির জন্য নির্ধারিত। জিনিসপত্র বিক্রয়ের দোকানগুলো সাথে সারিবদ্ধ। একদিকে কাঁচাবাজার যেখানে শাকসবজি, পান-সুপারি, গুড়-তামাক ইত্যাদি থাকে। মাছ বাজার, হাঁস-মুরগির বাজার থাকে অন্যদিকে। আর একদিকে থাকে পেঁয়াজ-মরিচ, ডাল-লবণ ইত্যাদি শুকনো জিনিস। তা ছাড়া কামার-কুমোর-ছুতোরের তৈরি জিনিসপত্র, কাপড়ের দোকান, ফার্মেসি ইত্যাদি দোকানের সঙ্গে হোটেল ও চায়ের দোকান দেখা যায়। কোনো কোনো হাটে গরু-ছাগল কেনাবেচার ব্যবস্থা থাকে।
হাটের বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো হাটে সব ধরনের পণ্যসামগ্রীর সমাবেশ ঘটে। এসব পণ্যসামগ্রী কিছুটা কম দামে ক্রেতারা কিনতে পারে। একদিকে প্রচুর লোকসমাগমের কারণে হাট হয়ে ওঠে সরগরম; অন্যদিকে বিচিত্র পোশাকে বিভিন্ন ফেরিওয়ালার হাকডাক, কেউবা মাইকে ভাষণ দিয়ে, কেউ রেকর্ড বা হারমোনিয়াম বাজিয়ে নানা ধরনের পণ্যসামগ্রী বিক্রি করে। সময় যত গড়ায় হাটে ততই ভিড় বাড়তে থাকে। ক্রেতা-বিক্রেতার দর কষাকষির কলরবে মুখর হয়ে যায় পুরো হাট। ফলে হাট হয়ে ওঠে লোকমুখর ও জমজমাট। সন্ধ্যা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে হাট ভাঙতে শুরু করে। ক্রেতারা ব্যাগভর্তি পণ্যসামগ্রী নিয়ে বাড়ি ফিরতে শুরু করে আর বিক্রেতারা ফিরে মনের আনন্দে পকেটভর্তি টাকা নিয়ে। ক্রমেই জনশূন্য হয়ে হাট হয়ে পড়ে নিথর-নিস্তব্ধ। হাটের চত্বরে এখানে-সেখানে পড়ে থাকে ছড়ানো-ছিটানো কাগজপত্র, শাকসবজির উচ্চিষ্ট অংশ আর ভাঙা হাড়ি-কলসি।
গ্রামের মানুষের জীবনে হাটের প্রয়োজন খুব বেশি। গ্রামের বাজারে প্রয়োজনীয় জিনিস স্বল্প পরিমাণে পাওয়া গেলেও সব জিনিস পাওয়া যায় না। সব ধরনের পণ্যসামগ্রী পাওয়ার জন্য গ্রামের লোকেরা হাটের জন্য অপেক্ষা করে। গ্রামবাসীরা নিজেদের উৎপাদিত জিনিসপত্র হাটে সরাসরি বিক্রি করতে পারে। বিক্রয়লব্দ টাকা দিয়ে সে তার প্রয়োজনীয় জিনিস ক্রয় করতে পারে। গ্রামের হাটের সুযোগ না থাকলে তাদের শহর হতে তা কিনতে হতো। এদিক হতে তাদের অনেক শ্রম, সময় ও টাকা বেঁচে যায়। গ্রামের অর্থনৈতিক জীবনের সঙ্গে হাটের একটি যোগাযোগ আছে। দেশে উৎপাদিত পণ্যের বিদেশে রপ্তানির ক্ষেত্রেও সমগ্র প্রক্রিয়ার মাধ্যমস্থল হিসেবে গ্রাম্যহাটের একটি বিশেষ ভূমিকা আছে।
গ্রাম্যহাট শুধু পণ্য ক্রয়-বিক্রয়ের কেন্দ্র নয়; কর্মব্যস্ত গ্রামীণ জীবনে পারস্পরিক ভাব বিনিময় ও নীতির অপূর্ব এক মিলন স্থল। দূর-দূরান্ত থেকে এখানে প্রত্যহ লোকজন বাজারে আসে বলে তাদের পরস্পরের জন্য দেখা সাক্ষাত হয় ও প্রীতি বিনিময়ের সুযোগ ঘটে। এজন্য গ্রাম্য হাট পল্লী জীবনের এক উপযুক্ত যোগাযোগ কেন্দ্র। গ্রামের জনজীবনে গ্রাম্য হাটের গুরুত্ব অপরিসীম।
আরো দেখুন :