↬ আর্সেনিক মুক্ত বাংলাদেশ
ভূমিকা : পানি দূষণ অগ্রসরমান সভ্যতার আর এক অভিশাপ। পৃথিবীর সমুদ্র নদ-নদী, পুকুর, খালবিল ইত্যাদির জল নানাভাবে দূষিত হচ্ছে। ভারী ধাতু, হ্যালোজেন নিষিক্ত হাইড্রোকার্বন, কার্বন-ডাইঅক্সাইড, পেট্রোলিয়াম, কৃত্রিম তেজস্ক্রিয়তা, সর্বোপরি সংলগ্ন শহরের নির্গম নালী বেয়ে আসা দূষিত তরল, আবর্জনা এগুলোই হল সমুদ্র দূষণের কারণ। পানির উৎস হিসেবে যেসব নদীর পানি ব্যবহৃত হয়, কোনো কোনো সময় সেসবের মধ্যে প্রায় শতকরা ৫০ ভাগ পর্যন্ত দূষিত তরল পদার্থ বা পরিত্যক্ত পানি থাকে। বিশুদ্ধ পানির অন্য নাম জীবন। কিন্তু সেই পানিতে বিষক্রিয়ায় আজ বাংলাদেশ শঙ্কিত। কারণ বাংলাদেশের ভূগর্ভস্থ পানিতে ব্যাপক আর্সেনিক দূষণ ঘটেছে এবং তা জনস্বাস্থ্যের জন্যে মারাত্মক হুমকি বলে বিবেচিত হচ্ছে।
দেশের অনেক এলাকা এখন আর্সেনিক বিষের কবলে। মাত্র ৩০ বছর আগেই অগভীর নলকূপ ছিল গ্রামাঞ্চলের মানুষের জন্য এক আর্শীবাদ। আজ সেই অনেক নলকূপের পানিতেই ভয়াবহ বিষ আর্সেনিক। জেনে-না জেনে অনেকে সেই বিষাক্ত পানি পান করে ধীরে ধীরে বিষাক্রান্ত হয়ে পড়েছেন। আর্সেনিক বিষাক্রান্ত রোগীর জন্য কোনো ওষুধ নেই। সীমিত সমীক্ষায় এ পর্যন্ত সারা দেশে আর্সেনিক বিষে আক্রান্ত প্রায় ১০ হাজার রোগী শনাক্ত করা গেছে। বাস্তব চিত্র আরো ভয়াবহ।
আর্সেনিক ও আর্সেনিক দূষণ কী? : আর্সেনিক হল ধূসর আভাযুক্ত সাদা রং বিশিষ্ট ভঙ্গুর প্রকৃতির একটি অর্ধধাতু বা উপধাতু। এটির রাসায়নিক সংকেত As, আণবিক সংখ্যা ৩৩, আণবিক ভর ৭৪.৯২। প্রকৃতিতে আর্সেনিক যৌগ আকারে প্রচুর পরিমাণে পাওয়া যায়। অর্ধপরিবাহি বা সেমিকন্ডাকটর, শংকর ধাতু ও ঝালাইকারক তৈরিতে আর্সেনিক বহুল পরিমাণে ব্যবহৃত হয়। প্রকৃতির আর্সেনিক অধিকাংশ ক্ষেত্রেই জনস্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর নয়। তবে সাম্প্রতিক কালে মনুষ্যসৃষ্ট কার্যাবলি অধিকমাত্রায় বেড়ে যাওয়ায় পরিবেশে আর্সেনিকের ঘনত্ব বৃদ্ধি পেয়েছে এবং পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলের বাতাস, মাটি ও পানি আর্সেনিক দূষিত হয়ে বিবিধ প্রকার মারাত্মক স্বাস্থ্য সমস্যার সৃষ্টি করছে। আর্সেনিক ও আর্সেনিক যৌগ মানব কল্যাণে বিভিন্নভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে, তবে নির্দিষ্ট পরিমাণের বেশি হলে এটি মারাত্মক ঘাতকে পরিণত হয়। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার (WHO) রিপোর্ট অনুযায়ী বাংলাদেশের খাবার পানিতে আর্সেনিকের গ্রহণীয় মাত্রা হলো ০.০৫ মি গ্রাম/লিটার। অতএব, মৃত্যুপথ নির্দেশক এ আর্সেনিক ভয়াবহতা থেকে আমাদের সচেতন থাকতে হবে।
আর্সেনিকের উৎস : মানবদেহ, সমুদ্র এবং মৃত্তিকায় সামান্য পরিমাণ আর্সেনিক বিদ্যমান। মাটির উপরিভাগের তুলনায় মাটির অভ্যন্তরে আর্সেনিকের পরিমাণ বেশি। মাটির নিচে পাথরের একটি স্তর রয়েছে এবং এতে ফাইরাইটস Fes2 নামে একটি যৌগ রয়েছে। এই যৌগটি আর্সেনিককে পাথরের সাথে ধরে রাখে। শিলামণ্ডলে এবং ভূত্বকে আর্সেনিকের পরিমাণ সবচেয়ে বেশি। এখানে প্রায় ৫.১০ – ৮ শতাংশ এবং পাথরের উল্কাপিন্ডে এর পরিমাণ ২.১০ – ৩ শতাংশ। আর্সেনিক অক্সাইড, আর্সেনিক সালফাইড, আর্সেনিক হলুদ ফালফাইড এবং আর্সেনাইড হচ্ছে আর্সেনিকের মূল উৎস। মাটির অভ্যন্তরে ভূরাসায়নিক বিক্রিয়ায় আর্সেনিক নিজস্ব আস্তানা থেকে বেরিয়ে আসে এবং পানিতে দ্রবীভূত হয়ে নলকূপ বা পাম্পের সাহায্যে উঠে আসছে পৃথিবীর উপরিভাগে।
বাংলাদেশে আর্সেনিকের বিস্তরণ বা দূষণ পরিস্থিতি : আর্সেনিক দূষণ বর্তমানে বাংলাদেশের অত্যন্ত মারাত্মক পরিবেশ দূষণ। ১৯৯৬ এর জুন-জুলাই মাসে পাবনা জেলার ঈশ্বদীর রূপপুর গ্রামে একটি স্বাস্থ্য ক্যাম্পে পরিচালনা করতে গিয়ে ঢাকার কমিউনিটি হাসপাতালের ডাক্তাররা বেশ কয়েকজন আর্সেনিক রোগী শনাক্ত করেন এবং কারণ অনুসন্ধান করতে গিয়ে সেখানকার ভূ-গর্ভস্থ পানিতে আর্সেনিকের মাত্রাধিক্য শনাক্ত করা হয়। এরপর সারা দেশের প্রায় দেড় হাজার টিউবওয়েলের পানি পরীক্ষা করে ৪১টি জেলার ৪৫ শতাংশ পানিতে আর্সেনিকের অস্তিত্ব ধরা পড়ে। ১৯৯৯-এ প্রকাশিত একটি তথ্য থেকে জানা যায়, বাংলাদেশে প্রায় সাড়ে সাত হাজার রোগী আর্সেনিক ক্যান্সারে আক্রান্ত এবং প্রকৃত সংখ্যা কয়েক লাখ বলে অনুমান করা হয়। তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশের প্রায় তিন কোটি আর্সেনিক আক্রান্ত লোকসহ প্রায় সাড়ে সাত কোটি মানুষ বর্তমানে আর্সেনিক ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। বিভিন্ন জরিপ থেকে অনুমান করা হয় যে, বাংলাদেশের ৬৪টি জেলার মধ্যে প্রায় ৫২টি জেলার ৫ কোটি মানুষ আর্সেনিকজনিত সমস্যার ঝুঁকির সম্মুখীন এবং এক হিসাবে বর্তমানে দেশে আর্সেনিকজনিত রোগের ঘটনার সংখ্যা প্রায় ৪০ লক্ষ। বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি বা সর্বোচ্চ দূষণযুক্ত জেলাগুলো হচ্ছে : চাঁদপুর (৯০%), মন্সিগঞ্জ (৮৩%), গোপালগঞ্জ (৭৯%), মাদারীপুর (৬৯%), নোয়াখালী (৬৯%), সাতক্ষিরা (৬৭%), কুমিল্লা (৬৫%) ও বাগেরহাট (৬০%)। সবচেয়ে কম দূষণযুক্ত জেলাগুলো হচ্ছে : ঠাকুরগাঁও, পঞ্চগড়, নীলফামারী, নাটোর, লালমনিরহাট, পটুয়াখালী ও বরগুনা। এসব জেলার কোথাও ভূগর্ভস্থ পানিতে আর্সেনিকের পরিমাণ সহনসীমা অতিক্রম করে নি। অতএব, মৃত্যুপথ নির্দেশক এ আর্সেনিকের ভয়াবহতা থেকে আমাদের দ্রুত পরিত্রাণ উপায় বের করতে হবে।
আর্সেনিকের বিষক্রিয়ার লক্ষণ ও প্রতিকারের উপায় : বাংলাদেশে আর্সেনিকের স্বাভাবিক মাত্রা প্রতি লিটারে ০.০৫ মিলিগ্রাম। এর চেয়ে বেশি মাত্রায় আর্সেনিক মেশানো পানি দীর্ঘদিন যাবত পান করলে দু’বছর কিংবা তার অধিক সময়ে এর লক্ষণ দেখা যেতে পারে। আর্সেনিক কেবল ক্যান্সারের মতো ভয়াবহ প্রাণঘাতি রোগই সৃষ্টি করছে না, সামাজিক জীবনেও তৈরি করছে ভয়াবহ বিপর্যয়। ভেঙে দিচ্ছে বিয়ে-ঘর সংসার। অনেক স্থানেই অনেকটা একঘরে হয়ে যাচ্ছে আর্সেনিক আক্রান্ত রোগী। আর্সেনিক আক্রান্ত শিশু স্কুলে গিয়ে সামাজিক প্রতিকূলতার মুখে পড়ছে। আর্সেনিক ছোঁয়াচে নয়। অথচ সেই ভুলেই তৈরি হচ্ছে এসব ভয়াবহ সামাজিক বিপর্যয়। আর্সেনিকে আক্রান্ত রোগকে বলা হয় আর্সেনিকোসিস। আর্সেনিক বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত ব্যক্তির শরীরে যেসব লক্ষণ দেখা যায় তা নিম্নরূপ :
১। শরীর বা হাতের তালুতে বাদামী ছাপ পড়তে পারে।
২। সাধারণত বুকে, পিঠে কিংবা বাহুতে স্পটেড পিগমেনটেশন দেখা যেতে পারে। যা পরবর্তীতে ত্বকের ক্যান্সারে রূপ নিতে পারে।
৩। অনেক রোগীর লিউকোমেলানোসিস, সাদা এবং কালো দাগ পাশাপাশি থাকে।
৪। আক্রান্ত রোগীর জিহ্বা, মাঢ়ি, ঠোঁট ইত্যাদিতে মিউকাস মেমব্রেন মেলানোসিসও হতে পারে।
৫। কারও কারও হাত-পায়ের চামড়া পুরু হয়ে যায়, আঙুল বেঁকে যায় এবং অসাঢ় হয়ে যায়। এছাড়া পায়ের আঙুলের মাথায় পঁচন ধরতে পারে।
৬। খাদ্য হজমে বিঘ্ন ঘটে এবং এর ফলে পেটে ব্যাথা, অরুচি, বমি বমিভাব থেকে ডায়রিয়া পর্যন্ত হতে পারে।
৭। মানুষের রক্তে শ্বেত ও লোহিত কণিকার উৎপাদন কমে যেতে পারে।
৮। হৃদযন্ত্রের ক্রিয়ায় অস্বাভাবিকতা তৈরি হতে পারে।
৯। রক্ত নালিকা ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। হাতে ও পায়ে গরম সুচ ফুটানোর মতো অনুভূতি হতে পারে।
১০। গর্ভাবস্থায় মানব ভ্রুণের ক্ষতি হতে পারে।
প্রতিকারের উপায় : আর্সেনিক বিষক্রিয়ায় সঠিক চিকিৎসা পদ্ধতি আজও আবিষ্কৃত হয় নি। বিজ্ঞানীরা দেখেছেন ভূগর্ভে ২৫ মিটার থেকে ১২০ মিটার গভীরতায় মূলত আর্সেনিক দূষণ ঘটছে। কিন্তু স্থান বিশেষে ১০০ মিটার থেকে ২০০ মিটার গভীরতার মধ্যেও পানিবাহী পলিস্তরে আর্সেনিক দূষণের অস্তিত্ব নেই। সে জন্যে আর্সেনিক দূষণমুক্ত পানি সরবরাহের ক্ষেত্রে প্রধান পদক্ষেপ হবে ২৫ থেকে ১২০ মিটার গভীরতায় অবস্থিত পলিস্তর থেকে নলকূপের মাধ্যমে পানি উত্তোলন পুরোপুরি নিষিদ্ধ ঘোষণা করা। বাংলাদেশকে আর্সেনিক দূষণ হতে মুক্তির উদ্দেশ্যে কয়েকটি সুপারিশ নিচে উল্লেখ করা হল :
১। জাতীয় প্রতিষ্ঠান বা প্রচার মাধ্যমে আর্সেনিক সমস্যার ব্যাপারে জনগণকে সচেতন করার জন্য প্রচারাভিযান চালানো।
২। আর্সেনিক পরীক্ষার প্রয়োজনীয় জ্ঞান ও যন্ত্রপাতির ব্যবস্থা করে আর্সেনিক দূষণের সম্ভাব্য এলাকা চিহ্নিতকরণ ও পরীক্ষা করে জনগণকে সচেতন করা।
৩। পানিকে আর্সেনিক মুক্ত করার জন্য পর্যাপ্ত বিশুদ্ধ পানি প্লান্ট স্থাপন।
৪। গ্রামে গ্রামে বালি-শোধিত জলাধার (Sand Pond Filter) সৃষ্টি করা।
৫। গার্হস্থ ফিল্টার, কমিউনিটি ভিত্তিক আর্সেনিক বিশোধন প্লান্ট, গভীরতর নলকূপ স্থাপন।
৬। আর্সেনিক কবলিত গ্রামে সমবায়ের মাধ্যমে আর্সেনিক দূষণমুক্ত নলকূপ বসিয়ে বিশুদ্ধ পানি সরবরাহের ব্যবস্থা করা।
৭। বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ করে খাবার পানি হিসেবে ব্যবহার করা। বাংলাদেশে সারাবছর গড়ে প্রায় ২,০০০ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়। এ বৃষ্টির পানি জলাধারে ধরে রেখে সারা বছর ব্যবহার করা যায়। ইতোমধ্যে থাইল্যান্ডে এ ধরনের পারিবারিক পানি সংরক্ষণাগারে পানি ধরে বছরের প্রায় দশ মাস ব্যবহার করছে।
৮। আর্সেনিক কবলিত এলাকায় বোরো ধানের চাষ না করে রবি ও খরিপ চাষাবাদ করলে আর্সেনিক দূষণ কম হবে।
উপসংহার : আর্সেনিক দূষণ বর্তমান বিশ্ব কিংবা বাংলাদেশের জন্য তেমন কোনো উদ্বেগের বিষয় না হলেও এর গুরুত্ব আদৌ কম নয়। কেননা, বর্তমান হারে পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হতে থাকলে এবং ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার কারণে পানির উপর চাপ অব্যাহত থাকলে হয়ত এ বিষয়টি অবশ্যই অদূর ভবিষ্যতে মারাত্মক আকার ধারণ করবে এবং তা দেশের জনসমষ্টির স্বাস্থ্যের জন্য হুমকির কারণ হয়ে দাঁড়াবে। তাই অবিলম্বে আর্সেনিক দূষণ রোধে সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা প্রয়োজন।
খুব ভালো পোস্ট,ধন্যবাদ
ReplyDelete