রচনা : ডেঙ্গুজ্বর : কারণ ও প্রতিকার

↬ ডেঙ্গুজ্বরের কারণ, লক্ষণ ও প্রতিকার


ডেঙ্গু জ্বর একটি এডিস মশাবাহিত ডেঙ্গু ভাইরাস জনিত গ্রীষ্মমণ্ডলীয় রোগ। এডিস মশার কামড়ের মাধ্যমে ভাইরাস সংক্রমণের তিন থেকে পনেরো দিনের মধ্যে সচরাচর ডেঙ্গু জ্বরের উপসর্গগুলো দেখা দেয়। উপসর্গগুলির মাঝে রয়েছে জ্বর, মাথাব্যথা, বমি, পেশিতে ও গাঁটে ব্যাথা এবং গাত্রচর্মে ফুসকুড়ি। দুই থেকে সাত দিনের মাঝে সাধারণত ডেঙ্গু রোগী আরোগ্য লাভ করে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে রোগটি মারাত্মক রক্তক্ষরী রূপ নিতে পারে যাকে ডেঙ্গু রক্তক্ষরী জ্বর (ডেঙ্গু হেমোরেজিক ফিভার) বলা হয়। এর ফলে রক্তপাত হয়, রক্ত অনুচক্রিকার মাত্রা কমে যায় এবং রক্ত প্লাজমার নিঃস্বরণ ঘটে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে কখনো বা ডেঙ্গু শক সিন্ড্রোম দেখা দেয়। ডেঙ্গু শক ডিন্ড্রোমে রক্তচাপ বিপজ্জনকভাবে কমে যায়। কয়েক প্রজাতির এডিস মশকী (স্ত্রী মশা) ডেঙ্গু ভাইরাসের প্রধান বাহক। যেগুলোর মধ্যে এডিস ইজিপ্টি মশাকী প্রধানতম। ভাইরাসটির পাঁচটি সেরোটাইপ পাওয়া যায়।

ভাইরাসটির একটি সেরোটাইপ সংক্রমণ করলে সেই সেরোটাইপের বিরুদ্ধে রোগী আজীবন প্রতিরোধী ক্ষমতা অর্জন করে, কিন্তু ভিন্ন সেরোটাইপের বিরুদ্ধে সাময়িক প্রতিরোধী ক্ষমতা অর্জন করে। পরবর্তীতে ভিন্ন সেরোটাইপের ডেঙ্গু ভাইরাস সংক্রমিত হলে রোগীর মারাত্মক জটিলতা দেখা দিতে পারে। কয়েক ধরনের টেস্টের মাধ্যমে, যেমন- ভাইরাসটি বা এর আরএনএ প্রতিরোধী এন্টিবডির উপস্থিতি দেখেও ডেঙ্গু জ্বর নির্ণয় করা যায়। ডেঙ্গু জ্বর প্রতিরোধী টিকা কয়েকটি দেশে অনুমোদিত হয়েছে তবে এই টিকা শুধু একবার সংক্রমিত হয়েছে এমন ব্যক্তির ক্ষেত্রে কার্যকর। মূলত এডিস মশার কামড় এড়িয়ে চলাই ডেঙ্গু প্রতিরোধের প্রধান উপায়। তাই মশার আবাসস্থল ধ্বংস করে মশার বংশবিস্তার প্রতিরোধ করতে হবে। এ জন্য এডিস মশার বংশবিস্তারের উপযোগী বিভিন্ন আধারে, যেমন- কাপ, টব, টায়ার, ডাবের খোলস, গর্ত, ছাদ ইত্যাদিতে আটকে থাকা পানি অপসারণ করতে হবে।

এশিয়া, দক্ষিণ আমেরিকা ও অন্যান্য মহাদেশের ১১০টির অধিক দেশে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব হয়। প্রতি বছর পাঁচ থেকে পঞ্চাশ কোটি মানুষ ডেঙ্গুতে সংক্রমিত হয় এবং তাদের মাঝে দশ থেকে বিশ হাজারের মতো মারা যায়। ১৭৭৯ সালে ডেঙ্গুর প্রথম উল্লেখ পাওয়া যায়। বিংশ শতকের প্রথমভাগে ডেঙ্গুর ভাইরাইস উৎস ও সংক্রমণ বিশদভাবে জানা যায়। মশক নিধনই বর্তমানে ডেঙ্গু প্রতিরোধের প্রধান উপায়। সরাসরি ডেঙ্গু ভাইরাসকে লক্ষ্য করে ওষুধ উদ্ভাবনের গবেষণা চলমান রয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বিশটি অবহেলিত গ্রীষ্মমণ্ডলীয় রোগের একটি হিসেবে ডেঙ্গু চিহ্নিত করেছে।

ডেঙ্গুর পরীক্ষা কখন করাবেন : ডেঙ্গু জ্বরে যখন অনেকে আক্রান্ত হয়। চারদিকে ডেঙ্গু-আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। তখন জ্বর হোক বা না হোক, অনেকেই হাসপাতালে ছুটে পরীক্ষার জন্য। নিজেই পরীক্ষা করান। পরীক্ষার ফলাফল পেয়ে কেউ আবার বিভ্রান্ত হয়ে পড়েন। ডেঙ্গু পরীক্ষার ব্যাপারে একটু জাা থাকা ভালো।

প্রথমত : জ্বর হলেই চিকিৎসকের পরামর্শ নিন। যেকোনো জ্বরই যে ডেঙ্গু, তা-ও নয়।

দ্বিতীয়ত : ডেঙ্গু জ্বরে প্রথম দিন থেকে পরবর্তী ১০ দিন পর্যন্ত বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষায় ফলাফল ভিন্ন ভিন্ন হতে পারে। কাজেই নিজে নিজে পরীক্ষা করালে বিভ্রান্তি দেখা দিতে পারে। এ ব্যাপারে চিকিৎসককে সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্য করতে ঠিক কবে প্রথম জ্বর এসেছিল, মনে রাখুন।

তৃতীয়ত : ডেঙ্গু এনএস১ নেগেটিভ হলেই যে ডেঙ্গু হয়নি, তা শতভাগ নিশ্চিত করে বলা কঠিন। লক্ষণ, উপসর্গ ও অন্যান্য পরীক্ষার ফলাফলের উপসর্গ ও অন্যান্য পরীক্ষার ফলাফলের ভিত্তিতে দিদ্ধান্ত নিতে হবে।

চতুর্থত : ডেঙ্গুর অ্যান্টিজেন বা অ্যান্টিবড়ির সঙ্গে অন্যান্য অনেক পরীক্ষা আছে, যা গুরুত্বপূর্ণ।

ডেঙ্গু জ্বর হলে কি খাবেন : ডেঙ্গু সংক্রমণের সঙ্গে লড়াই করার জন্য রোগীদের সঠিক খাবার খাওয়ার মাধ্যমে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা আরও উন্নত করতে হবে। রোগীদের এবং তাদের পরিবারের উচিত ডেঙ্গু জ্বরের সময় এবং পরে ডায়েট সম্পর্কে যত্ন নেওয়া উচিত যা সুস্থ করতে এবং পুনরুদ্ধারে সহায়তা করে। আমাদের মনে রাখতে হবে ভিটামিন এবং পুষ্টি সমৃদ্ধ খাবার এই ভাইরাসের বিরুদ্ধে প্রতিরোধমূলক কাজ করবে।

ডায়েটে যা রাখা উচিত : সহজে হজমযোগ্য খাদ্য যেমন সিদ্ধ খাবার, সবুজ শাকসবজি, কলা, আপেল, স্যুপ, দই এবঙ ভেষজ চা। ইলেক্ট্রোলাইট পুনরুদ্ধার করতে এবং ডিহাইড্রেশন প্রতিরোধ করতে প্রচুর তরল যেমন তাজা ফলের রস ডাবের পানি, ওরাল রিহাইড্রেশন সলিউশন (ওআরএস) খাওয়া উচিত। ভিটামিন সি যুক্ত খাবার গ্রহণ ডেঙ্গুজ্বরের প্রাকৃতিক নিরাময় হিসেবে কাজ করে। কারণ এটি দ্রুত নিরাময় এবং পুনরুদ্ধারের জন্য অ্যান্টিবডিগুলোকে উৎসাহ দেয়। যেমন, আমড়া, পেঁপে এবং কমলার রস। খাদ্য বা প্লাটিলেট গণনা এবং রক্তের গণনা ডালিমের রস বা কালো আঙুরের রস, সবুজ শাকসবজি (সিদ্ধ), তাজা ফলমূল বৃদ্ধি করে। তৈলাক্ত খাবার এড়িয়ে চলতে হবে। ডেঙ্গুর অন্যতম প্রধান আক্রান্ত ব্যক্তি স্যাচুরেটেড ফ্যাটযুক্ত বায়ুযুক্ত পানীয় এড়ানো উচিত, কাঁচা শাকসবজি একেবারেই খাবেন না।

ডায়াবেটিস ও ডেঙ্গু : সব বয়সের নারী-পুরুষই ডেঙ্গুর ঝুঁকি রয়েছে। তবে ডায়াবেটিক, কিডনি ফেইলিওর, হার্ট ফেইলিওর ইত্যাদি রোগীদের জন্য ডেঙ্গু বেশ ঝুঁকিপূর্ণ। বাংলাদেশে এক কোটির বেশি মানুষ ডায়াবেটিসে ভুগছে। এদের মধ্যে কমপক্ষে ৩০ শতাংশ কিডনি রোগে আক্রান্ত। ডায়াবেটিক রোগীদের গ্লুকোজের কারণে রক্তের ঘনত্ব বেড়ে যায়, শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায়, পানিশূন্যতার ঝুঁকি বৃদ্ধি পায়। বিশেষ করে যাদের ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে নেই (রক্তের গ্লুকোজ কাঙ্খিত মাত্রার চেয়ে বেশি), তদের ডেঙ্গু হলে ক্ষতির তীব্রতা বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। অন্য অনেক জ্বরেও রক্তের প্লাটিলেট কমে যেতে পারে; কিন্তু ডায়াবেটিক রোগীরা ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হলে তাদের রক্তের প্লাটিলেট দ্রুতই কমতে থাকে। পাশাপাশি দেহের ভেতর ও বাইরে রক্তক্ষরণের আশঙ্কা বাড়ে। ডায়াবেটিক রোগীদের ক্ষেত্রে একটু বেশি সতর্ক থাকতে হবে। ডায়াবেটিক রোগীরা ডেঙ্গু আক্রান্ত হলে শুরু থেকেই চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া অথবা হাসপাতালে ভর্তি করানো উচিত।

হৃদরোগীদের ডেঙ্গু সতর্কতা : বয়স্ক রোগীদের মধ্যে যারা হৃদরোগ, কিডনি রোগ, ডায়াবেটিক, ক্যান্সার, ব্রঙ্কাইটিস, স্ট্রোক ইত্যাদি রোগে আক্রান্ত, তাদের ঝুঁকি সর্বাধিক হৃদরোগীদের কারও ডেঙ্গু হলে বিশেষ সতর্ক হয়ে চিকিৎসা নিতে হবে।

মশারা বেশি কামড়ায় যাদের :
গর্ভবতী নারী : গর্ভবতী নারীরা অন্য নারীদের চেয়ে গড়ে ২১ শতাংশ বেশি কার্বন ডাই-অক্সাইড নিঃস্বরণ করেন। বিশেষ করে গর্ভাবস্থার তিন মাসের সময় নারীরা বেশি কার্বন ডাই-অক্সাইড বাতাসে ছাড়েন। এই ঘটনা মশাকে বেশি আকৃষ্ট করে তাঁদের কামড়াতে।

বেশি ঘুম যাদের : সাধারণত তাপমাত্রা বেশি থাকলে দেহ থেকে ঘাম বের হয়। মানুষের দেহের ঘামের সঙ্গে বের হওয়া ‘ল্যাকটিক এসিডে’র গন্ধ মশাদের বেশ প্রিয়।

‘ও’ গ্রুপের রক্ত : মশাকে আকর্ষণের ক্ষেত্রে রক্তের গ্রুপ ভূমিকা রাখে। ‘ও’ পজিটিভ এবং ’ও’ নেগেটিভ গ্রুপের রক্তে বিশেষ ধরনের গন্ধ থাকে, যা মশাকে বেশ আকৃষ্ট করে।

পোশাকের রং : গাঢ় কোনো রং যেমন- লাল, নীল জাতীয় পোশাক মশাদের বেশি পছন্দ।

জিনগত : কোনো কোনো মানুষের দেহ স্বাভাবিকভাবেই মশা প্রতিরোধক থাকে। সেটা জিনগত কারণেই হয়। এ জন্য মশা কাউকে বেশি কামড়ায় আর কাউকে কম কামড়ায়।

ডেঙ্গু-প্লাটিলেট আতঙ্ক : ডেঙ্গুজ্বরে সাধারণত প্লাটিলেট কমে যায়। Simple Dengue Fever (জটিলতাহীন ডেঙ্গু) প্লাটিলেট ১,৫০,০০০-এর নিচে কমে আসে। কিন্তু Dengue Hemorrhagic Fever (Stage-1) প্লাটিলেট ১,০০,০০০-এর নিচে নেমে আসে। অনেক সময় দেখা যায় প্লাটিলেট Count কমতে কমতে ১০,০০০ এমনকি ৫,০০০-এর নিচে নেমে আসে। সাধারণত প্লাটিলেট Count জ্বরের ৩-৬ দিনের ভিতর কমতে থাকে এবং ৬ দিন পর আবার বাড়তে থাকে। বাড়তে বাড়তে ৯-১০ দিনের মাথায় স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসে। প্লাটিলেট কমে যাওয়াটা মানুষের মাঝে আতঙ্কের সৃষ্টি করে।

মানুষ রক্ত দেওয়ার জন্য ছোটাছুটি শুরু করে এবং ডাক্তারের কাছে পীড়াপীড়ি শুরু করে। এমতাবস্থায় অন্য কোনো কারণে রোগী মারা গেলে রোগীর আত্মীয়স্বজন মনে করেন প্লাটিলেট কমে গেছে বলে রোগী মারা গেছেন। ডেঙ্গুর ব্যপারে এই ধারণা মোটেই ঠিক নয়। রোগীর প্লাটিলেট ৫,০০০-এর নিচে হলেও আপনি শান্ত থাকুন। শুধু প্লাটিলেট কমার কারণে রক্তক্ষরণ হয় না। আপনার রোগী যে হাসপাতালে ভর্তি আছে তার ওপর আস্থা রাখুন। আপনার রোগীর শিরাপথে যে পানীয় দেওয়া হচ্ছে এটাই হচ্ছে ওই অবস্থায় ডেঙ্গু রোগীদের যথাযথ চিকিৎসা। তবে ডেঙ্গুতে তখনই রোগীর অবস্থা অত্যধিক জটিলতা বা মারা যাওয়ার আশঙ্কা থাকে যখন- যদি রোগী ডেঙ্গু নিয়ে অবহেলা করে, দৌড়াদৌড়ি করে, অফিস-আদালতে যায়, ব্যবসা-বাণিজ্যে যায় অর্থাৎ বিশ্রাম না নেয়। যথাসময়ে ডাক্তারের কাছে না যায়, হাসপাতালে না যায়। যথাযথভাবে শিরায় পানীয় না নেয়। উপযুক্ত চিকিৎসার অভাবে যখন শক সিন্ড্রোম শুরু হয়। ডেঙ্গু যখন হৃৎপিন্ড আঘাত হানে। যখন ব্রেনে আঘাত হানে। তাই এ বিষয়ে অবহেলা না করে আমাদের যথেষ্ট সচেতন ও যত্নবান হতে হবে।

কীভাবে মশা নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম সফল হতে পারে : সিটি কর্পোরেশনের চলমান ব্যবস্থায় সফলভাবে মশা নিধন সম্ভব নয়। মশা একটা ছোট পতঙ্গ, এর দমনপদ্ধতি হতে হবে বিজ্ঞানসম্মত। এ সমস্যা পৃথিবীর অনেক দেশে আছে। কোনো দেশে এই সমস্যা আমাদের চেয়ে অনেক বেশি প্রকট। সেজন্য বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে মশা দমনের নানা বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতি উদ্ভাবিত হচ্ছে। উন্নত প্রস্তুতিসমৃদ্ধ নতুন নতুন ফাঁদ আবিষ্কার করা হচ্ছে। আমাদেরও উন্নত প্রযুক্তি ও বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতি কাজে লাগাতে হবে। প্রচলিত দমন পদ্ধতির আধুনিকায়ন করতে হবে। সফলভাবে মশা ও মশাবাহিত রোগ দমন করতে ইনটিগ্রেটেড মসকিটো ম্যানেজমেন্ট (আইএমএম) ব্যবস্থায় একটি পৃথক মশা নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করা যেতে পারে। এর মূল কাজ হবে-
১. মশা নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম নিয়মিতভাবে চালানো
২. সফল নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রমের জন্য প্রয়োজনীয় গবেষণা করা এবং
৩. জনসচেতনা বাড়ানোর পদক্ষেপ নেওয়া।

কোনো মৌসুমেই অবহেলা করা চলবে না। বিশেষ করে জনসচেতনতায় গুরুত্ব আরোপ করতে হবে। আমরা যদি সবাই মিলে সচেতন হই তবেই কেবল এই জাতীয় মহামারী থেকে অতিদ্রুত মুক্তি পেতে পারি। জনসচেতনতা সৃষ্টি না করা গেলে কোন একটি সংস্থার পক্ষে এটা সমূলে উৎপাটন করা সম্ভব নয়।

পৃথিবীতে মশাবাহিত অনেক রোগ রয়েছে। তার মধ্যে ডেঙ্গু জ্বর দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে অন্যতম একটি রোগ। আতঙ্ক নয়, চাই সম্মিলিত প্রতিরোধ। সিটি কর্পোরেশন ও বিভিন্ন সংস্থার পাশাপাশি সম্মিলিতভাবে সবাই নিজ নিজ স্থান থেকে প্রেচেষ্টা চালালে হবে। স্কুল, কলেজ, অফিস ও কারখানাসহ বাড়ির আশেপাশে পরিষ্কার এবং কোনো স্থানে পানি যেন না জমে থাকে সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে।


[ একই রচনা আরেকটি বই থেকে সংগ্রহ করে দেয়া হলো: ]


ভূমিকা : যান্ত্রিক সভ্যতা বিশ্বমানবকে দিয়েছে ভোগসুখের অঢেল প্রাচুর্য। ভোগ্যসম্পদে আর বিলাস-ব্যসনে গা ভাসিয়ে দিয়ে মানুষ হয়েছে সৌভাগ্যগর্বে গর্বিত। কোনো সভ্যতাই মানুষকে দেয় নি অবিমিশ্র সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য, শান্তি ও সুস্থিরতা। বর্তমান একবিংশ শতাব্দীর যান্ত্রিক সভ্যতা আর ব্যতিক্রম নয়। সেও আমাদের জীবনে প্রসারিত করেছে বহুবিধ সংকটের কালোছায়া। তার মধ্যে ভয়াবহ পরিবেশদূষণ অন্যতম। এই পরিবেশদূষণের ফলেই আজকের দিনে আমাদের নোংরা পরিবেশে জন্ম নিয়েছে এক ভয়াবহ আতঙ্কময় জীবাণু বহনকারী ক্ষুদ্র পতঙ্গ এডিস মশা যার দংশনে মানুষ ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত হচ্ছে। ক্রমবর্ধমান এই ডেঙ্গুজ্বরের প্রাদুর্ভাবের সারা দেশের মানুষ আজ দুশ্চিন্তিত, প্রতিকারের চিন্তায় উদ্‌ভ্রান্ত, এ নিয়ে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে কত আলোচনা, কত বৈঠক, কত সমাবেশ। তাই আমাদের পারিপার্শ্বিক পরিবেশকে কীভাবে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রেখে এডিস মশার হাত থেকে তথা ডেঙ্গু জ্বরের প্রাদুর্ভাব থেকে রক্ষা পেতে পারি তার ব্যবস্থা করতে হবে।

ডেঙ্গুজ্বর কেন হয়? : ডেঙ্গুজ্বর একটি ডেঙ্গু-ভাইরাসঘটিত সংক্রামক রোগ। সাধারণত মানুষের আবাসস্থলের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট দিনেরবেলায় দংশনকারী Aedes aegypti মশা এসব ভাইরাসের বাহক। কোন কোন অঞ্চলে অন্যান্য প্রজাতি Aedes albopictus, Aedes polynesiensis মশাও সংক্রমণ ঘটায়। রোগীকে দংশনের দুই সপ্তাহ পর মশা সংক্রমণক্ষম হয়ে ওঠে এবং গোটা জীবনই সংক্রমণশীল থাকে।

রোগের লক্ষণ :
১। জ্বর হওয়া : ডেঙ্গুজ্বর ডেঙ্গু-ভাইরাসের সংক্রমণ উপসর্গবিহীন থেকে নানারকমের উপসর্গযুক্ত হতে পারে, এমনকি তাতে মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে। সচরাচর দৃষ্ট ডেঙ্গুজ্বর, যাকে প্রায়ই ক্লাসিক্যাল ডেঙ্গু বলা হয়, সেটি একটি তীব্র ধরনের জ্বর যাতে হঠাৎ জ্বর হওয়া ছাড়াও থাকে মাথার সামনে ব্যথা, চক্ষুগোলকে ব্যথা, বমনেচ্ছা, বমি এবং লাল ফুসকুড়ি। প্রায়ই চোখে প্রদাহ এবং মারাত্মক পিঠব্যথা দেখা দেয়। এসব লক্ষণ ৫-৭ দিন স্থায়ী হয় এবং রোগী আরও কিছুদিন ক্লান্তি বোধ করে এবং এরপর সেরে ওঠে।

২। রক্তক্ষরা ডেঙ্গুজ্বর : দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার প্রধানত শিশুদের একটি রোগ। রক্তক্ষরা ডেঙ্গু হলো ডেঙ্গুর একটি মারাত্মক ধরন। রক্তক্ষরা ডেঙ্গুজ্বরের লক্ষণগুলো বয়স নির্বিশেষে সকলের ক্ষেত্রেই অভিন্ন। এই ডেঙ্গুজ্বরের শুরুতে হঠাৎ দেহের তাপ বেড়ে যায় (৩৮০-৪০০ সে.) এবং ২-৭ দিন পর্যন্ত চলে। এতে মাথা ব্যথা, ক্রমাগত জ্বর, দুর্বলতা এবং অস্থিসন্ধি ও মাংসপেশীর তীব্র ব্যথা। শ্বাসযন্ত্রের ঊর্ধ্বাংশের সংক্রমণসহ রোগটি হালকাভাবে শুরু হলেও আচমকা শক ও ত্বকের অভ্যন্তরে রক্তক্ষরণ ও কান দিয়ে রক্তক্ষরণ শুরু হয়ে যায়।

৩। ডেঙ্গু-শক সিনড্রম : এটি রক্তক্ষরা ডেঙ্গুরই আরেকটি রকমফের, তাতে সঙ্কুচিত নাড়িচাপ, নিম্ন রক্তচাপ অথবা সুস্পষ্ট শকসহ রক্তসঞ্চালনের বৈকাল্য তৈরি করে। দেহের বাইরে থেকে যকৃৎ স্পর্শ করা যায় ও নরম হয়ে ওঠে। কদাচিৎ জন্ডিস হয়ে যায়, অব্যাহত পেট ব্যথা, থেকে থেকে বমি, অস্থিরতা বা অবসন্নতা এবং হঠাৎ জ্বর ছেড়ে ঘামসহ শরীর ঠাণ্ডা হওয়া ও দেহ সম্পূর্ণ নেতিয়ে পড়া এই রোগের লক্ষণ।

রোগ সংক্রমণ : Aedes aegypti মশা জনবসতির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট থেকেই বংশবৃদ্ধি করে। এদের লার্ভা বেশিরভাগই পরিত্যক্ত টায়ার, বালতি, ফেলে দেওয়া নারিকেলের খোল, ফুলদানি, ফুলের টবের নিচের থালায় জমে থাকা পানিতে, এমন কি জমে থাকা গাছের গর্তে এবং এ ধরনের অন্যান্য প্রাকৃতিক স্থানে বড় হয়। পূর্ণবয়স্ক মশা সাধারণত ঘরের ভিতর অন্ধকার জায়গায় আলমারি, বিছানা বা খাটের তলায় থাকতে পারে। এই প্রজাতি দিনেরবেলায় বেশি সক্রিয় থাকে, বেশিরভাগ কামড়ের ঘটনা ঘটে সকালের প্রথম দিকে বা বিকালের শেষে। কোন আক্রান্ত লোকের রক্ত খেয়ে থাকলেই মশা সংক্রমিত হয় এবং ১০-১২ দিনের নির্ধারিত উপ্তিকাল যাপনের পর সংক্রমণ ক্ষমতা অর্জন করে। মশা সংক্রমণক্ষম হয়ে ওঠলে লোকের শরীর থেকে রক্ত শোষণের সময় এমনকি ত্বকে শুঁড় ঢুকালেও ডেঙ্গু সংক্রমণ ঘটতে পারে।

ডেঙ্গু বাহক নিয়ন্ত্রণ : ডেঙ্গুর বিরুদ্ধে কার্যকর কোনো ঔষধ বা প্রতিষেধক নেই। দেহের রোগপ্রতিরোধ ব্যবস্থাই কেবল রোগের বিরুদ্ধে লড়তে পারে। সাধারণত ক্লাসিক্যাল ডেঙ্গুর বিরুদ্ধেই দেহের রোগ প্রতিরোধে সামর্থ্য থাকে, কিন্তু রক্তক্ষরা ডেঙ্গুতে বেশিরভাগ রোগীই মারা যায়। তাই মশার বিরুদ্ধেই নিয়ন্ত্রণ পরিচালিত হওয়া আবশ্যক। বাংলাদেশে ডেঙ্গু মশা নিয়ন্ত্রণের উল্লেখযোগ্য কার্যক্রম নেই। বাংলাদেশে কোনো কোনো শহরে মশা নিয়ন্ত্রণের কার্যক্রম থাকলেও এডিস মশার বিরুদ্ধে নয়। এই জাতের মশা নিয়ন্ত্রণের জন্য বিশেষ উদ্যোগ প্রয়োজন। এগুলি যেহেতু পানিভরা পাত্রে বৃদ্ধি পায়, তাই যত্রতত্র কীটনাশক ছড়িয়ে কোন সুফল পাওয়া যাবে না। ঘরের চারদিকে স্প্রে করা অথবা খুব সকালে বা সন্ধ্যার শেষে ঘরে বিষ ধোঁয়া বা এরাসোল দিলে দিনেরবেলা দংশনকারী এডিস মশা কিছুটা নিয়ন্ত্রণ করা যেতে পারে।

উপসংহার : মশার বংশবৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণ সহজসাধ্য নয়। সাধারণত নিয়ন্ত্রণের জন্য সবাইকে মশা বৃদ্ধির অকুস্থল যেমন পরিত্যাক্ত পাত্র, টায়ার, ডাবের খোসা ইত্যাদি সরিয়ে ফেলতে হবে এবং বাসস্থানের আশপাশ থেকে জমা পানি নিষ্কাশন করতে হবে। বস্তুত কার্যকর ও টেকসই নিবারণ ব্যবস্থার জন্য ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রমে অবশ্যই স্থানীয় জনগণের সম্পৃক্তি আবশ্যক।

9 Comments

  1. why cant this be copied? But a really ggod essay, I appreciate it.

    ReplyDelete
  2. It's really help me
    Thanks for published it

    ReplyDelete
  3. This essay has varieties of words that have helped me in enriching my vocabulary. I appreciate this work a lot.

    ReplyDelete
  4. perfect paragraph I like it and it is very helpful for me

    ReplyDelete
Post a Comment
Previous Post Next Post