রথযাত্রা লোকারণ্য মহা ধূমধাম
ভক্তেরা লুটায়ে পথে করিছে প্রণাম;
পথ ভাবে, ‘আমি দেব’, রথ ভাবে, ‘আমি’
মূর্তি ভাবে, ‘আমি দেব’ হাসে অন্তর্যামী।
ভাব-সম্প্রসারণ : মানুষের ভক্তি অভিষিক্ত অন্তরলোক ব্যতীত অন্য কোথাও ভক্তিভাজন ভগবানের অস্তিত্ব নেই। কিন্তু সাড়ম্বর লোকাচারে সাধারণ মানুষ এমনই নিমগ্ন যে, এ পরম সত্যটি তারা অনেক সময় উপলব্ধি করতে ব্যর্থ হয়।
জগন্নাথের রথযাত্রার উৎসব উপলক্ষে ভক্তেরা যখন ভগবানের উদ্দেশ্যে প্রণতি জ্ঞাপন করে তখন লোকে-লোকারণ্য সুসজ্জিত পথ ভাবে সে-ই বুঝি দেবতা। জগন্নাথের বাহন সুসজ্জিত রথ ভাবে সে-ই বুঝি দেবতা, আর উপরে বসে জগন্নাথের মূর্তি ভাবে সেই দেবতা। কিন্তু ভক্তদের এই ভক্তি কার উদ্দেশ্যে? পথ, রথ ও মূর্তি কে তার আরাধ্য? প্রকৃতপক্ষে এগুলো দেব-আরাধনার উপকরণ। উপকরণ বাহ্যিক বস্তু- উপলক্ষমাত্র। ভজন-পুজন, আরাধনার লক্ষ্য যিনি, তিনি দেবতা। মজার কথা আড়ম্বরসর্বস্ব ধর্মানুষ্ঠানে লক্ষ্যের চেয়ে উপলক্ষ বড়ো হয়ে দাঁড়ায়। আরাধ্য দেবতাকে ভুলে তার পূজা-উপাচারকে নিয়ে অহেতু মাতামাতি হয়; সেজন্য পথ, রথ, মূর্তির উদ্দেশ্যে ভক্তের প্রণামের ঘটা। কবির কৌতুককর রসিকতায় পথ, রথ, মূর্তিরা নিজেদের ঈশ্বর বলে ভাবে। এসব দেখে অন্তর্যামী অলক্ষ্যে থেকে হাসেন।
প্রকৃতপক্ষে ঈশ্বরের অবস্থিতি ভক্তের অন্তর্লোকে। তিনি অসীম, তিনি অরূপ। তাঁকে সীমার মধ্যে বাঁধতে, তাঁকে রূপের আধারে রূপময় করতে সুদূর যুগাতীত কাল থেকে ভক্তের চেষ্টার বিরাম নেই। ভক্তপ্রাণের মাধুরী দিয়ে রচিত হয়েছে তাঁর মূর্তি-দেউলে দেউলে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে দেব-বিগ্রহ। কালক্রমে উপচারের প্রাধান্যে, মন্ত্রে-তন্ত্রের আধিক্যে, যাগে-যজ্ঞে, বাদ্যি-বাজনার আড়ম্বরে আচ্ছন্ন হয়েছে দেবতার অস্তিত্ব। আরাধনার উপকরণ হয়েছে আরাধ্য দেবতাবিশেষ, দেবতা থেকেছেন অবহেলিত, উপেক্ষিত। উপকরণের প্রতি অত্যাসক্তি ভক্তের সত্য-উপলব্ধির অন্তরায়। বাহ্যিক আড়ম্বরশূণ্য হয়ে ঈশ্বর-অনুধ্যানে কৃতনিষ্ঠ হলে, ভক্তপ্রাণের প্রকৃত শ্রদ্ধার্ঘ নিবেদিত হবে ভক্তবৎসল ঈশ্বরের পদপ্রান্তে। তখন লক্ষ্যকে পিছনে ফেলে উপলক্ষ প্রধান হবে না, লক্ষ্যই হবে মুখ্য।
শুধু লোকাচার বা আনুষ্ঠানিকতাই ধর্মের অজ্ঞ নয়। সর্বান্তকরণে বিধাতাকে স্মরণ করলেই তাঁর সন্ধান পাওয়া যায়। কারণ, মানবের ভক্তি-অভিসিঞ্চিত হৃদয়ই তাঁর অধিষ্ঠিত ভূমি।
এই ভাবসম্প্রসারণটি অন্য বই থেকেও সংগ্রহ করে দেয়া হলো
দেবতার নামে এই পৃথিবীতে যে কত অপদেবতা সৃষ্টি হয়েছে, তার ইয়ত্তা নেই। মানুষ তার স্বাভাবিক ঈশ্বর-প্রীতির প্রেরণায় যুগে যুগে দেবতার উদ্দেশ্যে রচনা করেছে পূজার অর্ঘ্য। কিন্তু সেই অর্ঘ্য দেবতার কাছে পৌঁছায়নি। পথিমধ্যে তা লোভী, ভণ্ড অপদেবতার হাতে গিয়ে পড়েছে। এভাবে বিশ্বের সহজ সরল মানুষগুলোকে প্রতারণা করে সেই অপদেবতার দল নিজেরাই মর্তের দেবতার আসন গ্রহণের জন্য লিপ্ত হয় নানা নির্লজ্জ চক্রান্তে। দেবতার জন্য উৎসর্গীকৃত শ্রদ্ধাভক্তির নৈবেদ্য সেই ধর্মতণ্ডের দল মধ্য পথ হতে ছিনিয়ে নিয়ে আত্মসাৎ করে। ফলে একদিকে ভক্তের ভক্তির অর্ঘ্য দেবতার পদতলে পৌঁছে দেয়ার প্রতিশ্রুতি ভেঙ্গে তারা বিশ্বের সহজ সরল মানুষগুলোর সাথে করে প্রতারণা, অন্যদিকে দেবতার ধন নিজেরাই আত্মসাৎ করে তারা আশাতিরিক্তভাবে ধনী ও বিত্তশালী হয়ে উঠে। এভাবে পৃথিবীর ইতিহাসে যাজক শক্তির আবির্ভাব হয়। কিন্তু একদিন মানুষের জ্ঞানচক্ষুর উন্মেষ হবে। সেদিন দেবতার সম্মুখের অপদেবতার কদর্য ছায়ামূর্তিগুলো অপসারিত হবে। সত্যের উজ্জ্বল আলোয় উদ্ভাসিত হয়ে উঠবে ঈশ্বরের জ্যোতির্ময় প্রকাশ।