↬ শিক্ষাবিস্তারে গ্রন্থাগারের ভূমিকা
↬ পাবলিক লাইব্রেরি
↬ গ্রন্থাগারের প্রয়োজনীয়তা
↬ গ্রন্থাগার ও শিক্ষাবিস্তার
↬ মানব সভ্যতা ও গ্রন্থাগার
ভূমিকা : গ্রন্থাগারে বন্দি থাকে মানুষের চিন্তা-ভাবনা ও ধ্যান-ধারণা। সেখানে পুঁথির লেখায় মানুষকে চিরঞ্জীব করে এবং যুগ-যুগান্তরের চিন্তাকে বন্দি করে রাখে। এটা মানুষের বন্দনার প্রয়াস। মানুষ এখানে সুখী ও তৃপ্ত। পুঁথির অমূল্য উপকরণগুলো এই সুখ ও তৃপ্তির হিংহদ্বার সূচনা করে। মানুষ তাই বিভিন্ন পুঁথি এবং বই সংগ্রহ করে গ্রন্থাগার প্রতিষ্ঠা করে। এ গ্রন্থাগার গঠনের মধ্য দিয়ে সে তার অমৃত পিপাসাকে উদ্বুদ্ধ করে। রবীন্দ্রনাথের ভাষায় “মহাসমুদ্রের শত বৎসরের কল্লোল কেহ যদি এমন করিয়া বাঁধিয়া রাখিতে পারিত যেন সে ঘুমন্ত শিশুটির মতো চুপ করিয়া থাকিত। তবে সেই নীরব মাহশব্দের সহিত এই কারাগারের তুলনা হইত। এখানে ভাষা চুপ করিয়া আছে, প্রবাহ স্থির হইয়া আছে, মানবাত্মার অমর আলোক কালো অক্ষরের শৃঙ্খলে কাগজের কারাগারে বাঁধা পড়িয়া আছে।”
গ্রন্থাগার কী? : শিক্ষান্বেষী মানুষের কাছে গ্রন্থাগার এক চির-কাঙ্ক্ষিত জ্ঞান-তীর্থ, সেখানে সে তার মুক্তির সন্ধান পায়। খুঁজে পায় এক দুর্লভ ঐশ্বর্যের খনি। গ্রন্থাগারেই পাঠক সভ্যতার এক শাশ্বত ধারার স্পর্শ পায়, অনুভব করে মহাসমুদ্রের শত শত বছরের হৃদয় কল্লোল, শুনতে পায় জগতের এক মহা ঐকতান ধ্বনি। দেশে দেশে হৃদয়ে রচিত হয় অতীত-বর্তমান-ভবিষ্যতের সেতুবন্ধন। তাই রবীন্দ্রনাথ বলেছেন- ‘বিদ্যুৎকে মানুষ লোহার তার দিয়ে বাঁধিয়াছে, কিন্তু কে জানিত মানুষ শব্দকে নিঃশব্দের মধ্যে বাঁধিতে পারিবে! কে জানিত সংগীতকে, হৃদয়ের আশাকে, জাগ্রত আত্মার আনন্দ ধ্বনিকে, আকাশের দৈববাণীকে সে কাগজে মুড়িয়া রাখিবে! কে জানিত মানুষ অতীতকে বর্তমানে বন্দী করিবে? অতল-স্পর্শ কালসমুদ্রের ওপর কেবল এক-একখানি বই দিয়া সাঁকো বাঁধিয়া দিবে।’
গ্রন্থাগারের উদ্ভব : সভ্যতার ক্রমবিকাশের মত গ্রন্থাগারেরও রয়েছে এক ক্রমবিবর্তনের ইতিহাস। ধারণা করা হয় প্রাচীন রোমেই সর্বসাধারণের জন্যে প্রথম গ্রন্থাগার স্থাপিত হয়েছিল। এর আগেও গ্রন্থাগারের অস্তিত্বের প্রমাণ পাওয়া গেছে। ব্যবিলনের ভূগর্ভ খনন করে আবিষ্কৃত-হয়েছে সাড়ে চার হাজার বছরের পূর্বেকার একে গ্রন্থাগার। সন্ধান মিলেছে খ্রিস্টপূর্ব ছ’শ বছর আগের আসিরিয়ার রাজা আসুরবানিপালের নিজস্ব গ্রন্থাগারের সঞ্চিত পোড়ামাটির গ্রন্থ। খ্রিস্টপূর্ব চার’শ বছর আগে আলেকজান্দ্রিয়ায় ছিল গ্রিক শাসনকর্তা প্রথম টলেমি প্রতিষ্ঠিত প্রাচীনকালের বৃহত্তম গ্রন্থাগার। লাইব্রেরির প্রথম ধারণা দেন রোমান সম্রাট জুলিয়াস সিজার। তিনি যাকে দায়িত্ব দিলেন সেই মার্কাস ভালো একজন সুলেখক ছিলেন। তিনি লাইব্রেরির ওপর রচনা করেন একটি গ্রবেষণা-গ্রন্থ। পরবর্তী পাঁচ বছরের মধ্যেই তৈরি হয় লাইব্রেরি কিন্তু বন্ধু ব্রুটাসের হাতে নিহত হওয়ায় সিজার সেই লাইব্রেরি দেখে যেতে পারেন নি।
অথচ মধ্যযুগের সব বিজেতা জাতিই বিজিতের ধর্ম ও সংস্কৃতিকে ধ্বংস করার এক উন্মাদ মানসিকতায় ভুগতেন। মুসলমান আক্রমণের শুরু থেকেই তাদের লক্ষ্য ছিল অমূল্য গ্রন্থাগারের ধ্বংসসাধন। তাদের হিংস্রতার আগুনে ভস্মীভূত হয় হাজার হাজার বছরের সংগৃহীত দুর্লভ সম্পদ, মানুষের সাধনার অক্ষয় কীর্তি অজস্র গ্রন্থ-সম্ভার। আলেকজান্দ্রিয়ার সুবিশাল গ্রন্থাগার চেঙ্গিস খাঁর আক্রমণে বিধ্বস্ত হল। ধ্বংস হল বাগদাদ সেকেন্দ্রিয়ার গ্রন্থাগার। আজও চলছে ধ্বংসের উন্মত্ততা। এই তো সেদিন মাত্র বর্বর-আমেরিকাবাসী অন্যায়ভাবে ইরাক আক্রমণ করে ধ্বংস করলো তাঁদের প্রাচীন ইতিহাস, ঐতিহ্য ও মূল্যবান গ্রন্থাগার। মানুষ হারালো এক মহৎ উত্তরাধিকার।
গ্রন্থাগারের বৈশিষ্ট্য : গ্রন্থাগার ভাবের মিলন-সেতু। গ্রন্থাগার অতীত-বর্তমান-ভবিষ্যতের যোগ-মিলনের অক্ষর-নির্মিত সেতু। নদীর স্রোতের মত জ্ঞান-প্রবাহ দেশ-দেশান্তর ও যুগ-যুগান্তরের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে চলে। এক হৃদয়ের ভাবরাশি নিঃশব্দে প্রবাহিত হয়ে যায় হৃদয়ান্তরে। গ্রন্থাগার তাই জ্ঞানান্বেষী কোটি কোটি মানুষের নীরব আলাপনের পবিত্র বিদ্যাপীঠ। এখানে চিন্তাবিদ পায় তাঁর নানামুখী চিন্তার খোরাক এবং নানা দুরূহ জিজ্ঞাসার উত্তর, ভাবুক পায় ভাব রসের সন্ধান। হৃদয় ও মনের ক্ষুণ্নিবৃত্তির এক বিপুল আয়োজন কোথাও খুঁজে পাওয়া যাবে না। তাই গ্রন্থাগার ভাব-তৃষিত ও জ্ঞানপিপাসু সহস্র চিত্তের তৃপ্তি-সরোবর। রবীন্দ্রনাথ তাঁর চব্বিশ বছর বয়সে লেখা ‘লাইব্রেরী’ প্রবন্ধে বলেছেন, ‘লাইব্রেরীর মধ্যে আমরা সহস্র পথের চৌমাথার উপরে দাঁড়াইয়া আছি। কোনো পথ অনন্ত সমুদ্রে গিয়াছে, কোনো পথ অনন্ত শিখরে উঠিয়াছে, কোনো পথ মানবহৃদয়ের অতলস্পর্শে নামিয়াছে। যে যেদিকে ধাবমান হও, কোথাও বাধা পাইবে না। মানুষ আপনার পরিত্রাণকে এতটুকু জায়গার মধ্যে বাঁধিয়া রাখিয়াছে।’
গ্রন্থাগারের সুবিধা : অনন্ত বিশ্বের জ্ঞানরাজি এবং তার ভাবরাশিও অফুরন্ত। বিচিত্র ভাব ও চিন্তার বিষয়ে রচিত হয়েছে কত গ্রন্থসম্ভার। কোনো একজন ব্যক্তির পক্ষে সেই সব গ্রন্থ সংগ্রহ করা সম্ভব নয়। গ্রন্থাগার বহু মানুষের যৌথ প্রতিষ্ঠান। সেখানে বহু প্রয়াসের সংগৃহীত বহু গ্রন্থ পাঠের সুযোগ ঘটে। এছাড়া, গ্রন্থাগার থেকে আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা নিজ নিজ অভিরুচি অনুসারে যে কোনো বিষয়ে গ্রন্থ সংগ্রহ করে পাঠ করতে পারে।
গ্রন্থাগারের প্রকারভেদ : গ্রন্থাগার বলতে বিভিন্ন ধরনের গ্রন্থের সংগ্রহশালা বুঝায়। এ সংগ্রহ ব্যক্তিগত হতে পারে, আবার জনসাধারণ বা রাষ্ট্রেরও হতে পারে। ব্যক্তিগত সংগ্রহে বিশেষ ধরনের গ্রন্থের প্রতি পক্ষপাতিত্ব থাকা স্বাভাবিক। কারণ গ্রন্থ নির্বাচনে ব্যক্তিবিশেষের বহুজনের পছন্দ-অপছন্দকে গুরুত্ব দিতে হয়। তাই সেখানে গ্রন্থের বৈচিত্র্য যেমন সংখ্যাও তেমনি বেশি।
গ্রন্থাগারের বিভাজন : পৃথিবীর অনেক উন্নত দেশের তুলনায় আমাদের দেশে সাধারণ গ্রন্থাগারের সংখ্যা নগণ্য। তবে স্বাধীন দেশে এ শ্রেণীর জনহিতকর প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা যে বেড়েছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। বর্তমানে বিভিন্ন জেলা শহরে নতুন পুরাতন সাধারণ গ্রন্থাগার দেখা যায়। এছাড়া সমাজের বিভিন্ন ক্লাব ও জনহিতকর সংস্থা এ ব্যাপারে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে থাকে। অন্যদিকে, রয়েছে স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় গ্রন্থাগার সভ্যসংখ্যা এসব জায়গায় সীমাবদ্ধ। শুধুমাত্র বিদ্যার্থী, শিক্ষক ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অশিক্ষক কর্মচারীরাই এগুলো ব্যবহারের সুযোগ পেয়ে থাকে। অফিস-আদালত এবং কারখানা ইত্যাদির ক্ষেত্রেও গ্রন্থাগার ব্যবহারের সুযোগ সেসব জায়গায় কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে সীমিত।
অতীত ও বর্তমানের বিখ্যাত গ্রন্থাগার : প্রাচীন যুগের বিখ্যাত গ্রন্থাগারের মধ্যে মিশরের আলেকজান্দ্রিয়া জাদুঘর বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। মুসলিম বিশ্বে কর্দোভা, দামেস্ক ও বাগদাদেও বেশ কিছু গ্রন্থাগার ছিল। বর্তমানে পৃথিবীর বিখ্যাত গ্রন্থাগারগুলোর মধ্যে ব্রিটেনের ব্রিটিশ মিউজিয়াম, ফ্রান্সের বিবলিওথিক ন্যাশনাল লাইব্রেরি, মস্কোর লেনিন লাইব্রেরি, আমেরিকার লাইব্রেরি অব কংগ্রেস, কলকাতার ন্যাশনাল লাইব্রেরি উল্লেখযোগ্য।
গ্রন্থাগারের প্রয়োজনীয়তা : আমাদের স্বাধীন দেশে শিক্ষার প্রসারের সাথে সাথে গ্রন্থাগারের প্রয়োজনীয়তা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। মানুষ ক্রমে উপলদ্ধি করছে, খাদ্যই সব নয়, মনেরও খাদ্য দরকার। গ্রন্থাগার পারে ক্লান্ত, বুভুক্ষু মানুষের মনকে প্রফুল্ল করতে, তাকে পছন্দমাফিক জিনিসের সন্ধান দিয়ে তার মনের খোরাক জাগাতে। এদিকে দেহের খাদ্যের বেলায় যেমন জনে জনে পার্থক্য ও রুচিভেদ, মনের খাদ্যের বেলায় অনুরূপ। কেউ কবিতার বই পড়তে ভালোবাসেন, আবার কেউবা গল্প-উপন্যাস, কেউ নাটক পেলে অন্যকিছু চান না, কেউ কেউ আবার ভ্রমণকাহিনী ভালোবাসেন। এছাড়া, কারো প্রিয় দর্শন, কারো-বা ইতিহাস, কেউ খোঁজেন লোকপ্রশাসন-বিষয়ক বই, আবার কেউ কেউ পদার্থ, রসায়ন ও প্রাণিবিজ্ঞান। কেউ কেউ দেশের ইতিহাস, অর্থনীতি, সমাজনীতি ইত্যাদি সম্পর্কে নতুন তথ্য খুঁজে বের করবেন বলে অনুসন্ধিৎসু। তাঁরা দলিল-দস্তাবেজ, বিবর্ণ প্রাচীন পুঁথি এবং অতীত যুগের পত্রিকা ইত্যাদি থেকে বের করেন নিজের চাহিদার খোরাক। তাই গ্রন্থাগারের নানাবিধ প্রয়োজনীয়তায় সমাজের মানুষ নানাভাবে উপকৃত হয়ে থাকে। তবে সুষ্ঠুভাবে গ্রন্থ সংগ্রহ অতি-দুরূহ কাজ। প্রতিদিন দেশ-বিদেশে হাজার হাজার নতুন গ্রন্থ প্রকাশিত হচ্ছে। গ্রন্থাগারের সঙ্গতি ও প্রয়োজনের দিকে লক্ষ্য রেখে উৎকৃষ্ট গ্রন্থকেই সংগ্রহের জন্য নির্বাচন করা শ্রেয়। আবার শুধুমাত্র সংগ্রহ করলেই গ্রন্থাগারের দায়িত্ব শেষ হয় না, সংগৃহীত গ্রন্থগুলো যাতে সযত্নে থাকে সেদিকেও লক্ষ্য রাখা বাঞ্ছনীয়। নানাবিধ পোকার উপদ্রবে, প্রাকৃতিক বাধা-বিপত্তিতে এবং অসৎ পাঠক ও গ্রন্থাগার কর্মীদের দায়িত্বজ্ঞানহীনতায় অনেক সময় বহু উৎকৃষ্ট গ্রন্থ বিনষ্ট হয়। ঐ সব সংগৃহীত গ্রন্থগুলো দেশ ও জাতির অমূল্য সম্পদ, গ্রন্থাগারের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সকলেরই এই কথা মনে রাখা উচিত।
বাংলাদেশে গ্রন্থাগার : বাংলাদেশে ১৯৫৩ সালে ঢাকায় প্রতিষ্ঠিত হয় কেন্দ্রীয় পাবলিক লাইব্রেরি। এই লাইব্রেরির সহযোগিতায় শতাধিক সরকারি ও বেসরকারি গ্রন্থাগার দেশের বিভিন্ন স্থানে পরিচালিত হচ্ছে। বিদেশি দূতাবাসের অনুকূল্যে আমাদের দেশে যেসব লাইব্রেরি পরিচালিত হচ্ছে সেগুলোর মধ্যে ব্রিটিশ কাউন্সিল লাইব্রেরি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এছাড়া আমাদের দেশে সরকারি গ্রন্থাগারের সংখ্যা ৬৮ টি, বেসরকারি গ্রন্থাগারের সংখ্যা ৮৮৩ টি, গণ-উন্নয়ন পাঠাগারের পরিচালনায় রয়েছে ২৭টি গ্রন্থাগার।
উপসংহার : বর্তমানে জ্ঞান-বিজ্ঞানে উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে গ্রন্থাগারের জনপ্রিয়তা ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে। পৃথিবীর বিভিন্ন অগ্রসর ও উন্নয়নশীল দেশে গড়ে উঠেছে নানা ধরনের গ্রন্থাগার। আমাদের বাংলাদেশ এর ব্যতিক্রম নয়। স্বাধীনতা প্রাপ্তির পর এ দেশের গ্রন্থাগারের সংখ্যা অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। শিক্ষিত জনসাধারণের মধ্যে গ্রন্থাগার সম্পর্কে নতুন আগ্রহের সৃষ্টি হয়েছে। আমাদের দেশের পাবলিক লাইব্রেরি, বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র, বাংলা একাডেমী গ্রন্থাগার জনগণের গ্রন্থপাঠের প্রয়োজন মেটাচ্ছে।
পাঠাগারের প্রয়োজনীয়তা রচনাটা দিলে ভাল হত। আমি এইট এ পড়ি। এই রচনাটা খুব দরকার। আর ছাত্রজিবনের দাইত্ত ও কর্তব্য রচনাটা ও খুব দরকার।
ReplyDeleteপাঠাগারের প্রয়োজনীয়তা আর গ্রন্থাগারের প্রয়োজীয়তা একই
Deleteআমিও একমত
Deleteআমি�� ও
ReplyDelete