রচনা : মিতব্যয়িতা

ভূমিকা : অপ্রয়োজনে অপরিমিত ব্যয় করে এমন কিছু লোক সব সমাজেই চোখে পড়ে। এদের জীবনে প্রায়ই এমন দিন আসে যখন সবকিছু খুইয়ে সামান্য অনুকম্পার প্রত্যাশায় এদের অন্যের দ্বারস্থ হতে হয়। এদের মতো দুর্ভাগা আর কে আছে? হয়তো এদের কথা মনে রেখেই কবি মাইকেল মধুসূদন লিখেছিলেন, ‘যৌবনে অন্যায় ব্যায়ে বয়সে কাঙালি।’ আর মানুষের জীবনের এই অনভিপ্রেত অভিজ্ঞতার কথা ভেবেই মানুষ পেয়েছে আয়ের সঙ্গে সংগতি রেখে সামঞ্জস্যপূর্ণ ব্যয় করার জীবনবোধ। আর তা অভিব্যক্তি পেয়েছে মিতব্যয়িতা শব্দটির মধ্যে। Cut your coat according to your clothes. -এই সুভাষিতের মর্মবাণীই যে মিতব্যয়িতা তা স্পষ্ট করে বলার দরকার পড়ে না।

বিশ্বপ্রকৃতি ও মিতব্যয়িতা : প্রকৃতির রাজ্যে এক ধরনের মিতব্যয়িতার ধারা আমরা প্রত্যক্ষ করি। যখনই কোনো কিছু মাত্রা অতিক্রম করে তখন প্রকৃতিতে ভারসাম্য নষ্ট হয় কিংবা বিপর্যয় দেখা দেয়। সূর্যের তাপ অতিরিক্ত হলে শ্যামল নিসর্গ পুড়ে খাক হয়ে যেত, পৃথিবী হয়ে যেত মরুময়। বাতাসের প্রবাহ মাত্রাতিরিক্ত হলে সৃষ্টি হয় ঝড়, জীবন হয়ে পড়ে বিপর্যস্ত। স্বাভাবিক বৃষ্টি প্রকৃতিকে ফুল, ফল, ফসলে ভরিয়ে দেয়। কিন্তু প্রবল বৃষ্টিপাত সবকিছু ভাসিয়ে নিয়ে যায়, বন্যা নিয়ে আসে ক্ষয়ক্ষতি। এভাবে বিশ্বপ্রকৃতিও আমাদের পরিমিত ব্যয়ের শিক্ষাই দেয়।

মিতব্যয়িতা ও সঞ্চয় : জীবিকার তাগিদে মানুষকে পরিশ্রম করতে হয়। সম্পদ ও অর্থ উপার্জন করতে হয়। ভবিষ্যতের কথা ভেবে মানুষ অর্জিত সম্পদের একটা অংশ সঞ্চয় করে। সব মানুষের উপার্জিত অর্থ ও সম্পদের পরিমাণ এক রকম হয় না। মানুষে মানুষে, পরিবারে পরিবারে, দেশে দেশে মানুষের অর্জিত ও সঞ্চিত সম্পদের মধ্যে পার্থক্যও দেখা যায়। সব ক্ষেত্রেই মানুষকে ব্যয় করতে হয় তার অর্জিত আয় ও সঞ্চিত সম্পদের পরিমাণ বিবেচনায় নিয়ে। মিতব্যয়ী ব্যক্তি তার আয়ের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে ব্যয় করেন। অপরিমিত ব্যয় কিংবা অযথা অপচয় তাঁর স্বভাবধর্ম নয়। তিনি ভোগবিলাসী জীবন পরিহার করে চলেন। তাঁর ব্যয়-পরিকল্পনায় ভবিষ্যতের নিশ্চয়তার দিকটা গুরুত্ব পায়। ব্যয় সংকোচন করে উপযুক্ত সঞ্চয়ের মাধ্যমে তিনি এই নিশ্চয়তা বিধান করেন। সঞ্চিত সম্পদই আপদকালে তাঁকে রক্ষা করে।

মিতব্যয়িতা ও কার্পণ্য : মিতব্যয়িতার অর্থ কৃপণতা নয়। কৃপণ লোক সবসময় নিজের ধন আঁকড়ে ধরে রাখেন। নিজের বা অন্যের প্রয়োজনে সে ধন কাজে লাগে না। পক্ষান্তরে মিতব্যয়ী তার সম্পদকে যেমন নিজের প্রয়োজনে কাজে লাগান তেমনি অন্যের বিপদের সময়েও তার সঞ্চয় কাজে লাগাতে দ্বিধা করেন না। অহেতুক ভোগ-বিলাস, অযথা অপচয়, সম্পদের অপব্যবহারেই তাঁর আপত্তি। এককথায় কার্পণ্য ও অপব্যয়ের মাঝামাঝি যৌক্তিক ব্যয়ের বৈশিষ্ট্যই মিতব্যয়িতা।

অমিতব্যয়ীর পরিণাম : অমিতব্যয়ী মানুষ মাত্রই চরিত্র-বৈশিষ্ট্যে অসংযমী ধরনের। বিলাসী ও পরিভোগপ্রবণ জীবন-যাপন তার স্বভাবে পরিণত হয়। কষ্টসহিষ্ণু না হয়ে সে হয় আরামপ্রিয়। চরিত্রের দিক থেকেও সে হয়ে ওঠে অসংযমী। নিজের সুখভোগই তার একমাত্র কাম্য হয়ে দাঁড়ায়। এজন্যে অন্যায় ও অনৈতিক কাজ করতেও তার সামান্যতম দ্বিধা হয় না। অতিরিক্ত ব্যয় করতে গিয়ে অতিরিক্ত পাওয়ার লোভ তাকে অত্যাচারী করে তোলে। অন্যের অধিকার হরণে তার বিবেক-দংশন হয় না। নৈতিকতা ও আদর্শ হারিয়ে সে হয়ে উঠতে পারে মানবরূপী পশু। এজন্যেই পবিত্র হাদিসে বলা হয়েছে- ‘অপচয়কারী শয়তানের ভাই।’ অমিতব্যয়িতার পরিণামের প্রতি ইঙ্গিত করে কবি বলেছেন :
যে জন দিবসে                  মনের হরষে
জ্বালায় মোমের বাতি
আশু গৃহে তার দেখিবে না আর
নিশিথে প্রদীপ বাতি।

আমাদের সমাজেও অমিতব্যয়িতার অনেক দৃষ্টান্ত দেখা যায়। অপচয় করে সম্পদ নষ্ট করে একসময় কপর্দকহীন হয়ে পথে বসেছে- এমন উদাহরণ সমাজে বিরল নয়।

মিতব্যয়িতা ও সাম্প্রতিক বাংলাদেশ : সাম্প্রতিককালে বাংলাদেশে এক শ্রেণীর হঠাৎ-বড়লোকের সৃষ্টি হয়েছে যারা সমাজে মিতব্যয়িতার আদর্শকে তছনছ করে দিচ্ছে এবং পরিণামে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎকে বিপন্ন করে তুলছে। এই শ্রেণীর লোক ঘুষ, দুর্নীতি, ঋণখেলাপি, মাস্তানি, চাঁদাবাজি ইত্যাদি অবৈধ পন্থায় বিপুল কালো টাকার মালিক হয়েছে। ভোগ-লালসাই তাদের জীবনের পরম ব্রত হয়ে দাঁড়িয়েছে। টাকার গরমে এরা ধরাকে সরা জ্ঞান করে। সীমাহীন লোভ-লালসা দ্বারা চালিত হয়ে তারা অন্যায় ও গর্হিত পন্থায় রাষ্ট্রীয় সম্পদ ও অর্থ লুটেপুটে খাচ্ছে। অর্থের দাপটে সর্বত্র দখলদারির রাজত্ব কায়েম করতে চাইছে। ফলে জাতীয় জীবনে মিতব্যয়িতার আদর্শ হচ্ছে ভূলুণ্ঠিত। জাতীয় উন্নতি ও অগ্রগতির পথে অন্তরায় সৃষ্টি হচ্ছে। জাতির তরুণ প্রজন্মের মন-মানসিকতার ওপর পড়ছে নেতিবাচক প্রভাব।

উপসংহার : মিতব্যয়িতার সঙ্গে রয়েছে মানব চরিত্রের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। অপচয়, অমিতব্যয় মানুষকে উচ্ছৃঙ্খল মরে। মিতব্যয়ী স্বভাব মানুষকে করে তোলে সৎ, সংযত ও উন্নত চরিত্রের অধিকারী। মিতব্যয়িতার সঙ্গে বিবেক-বুদ্ধি ও বিবেচনাবোধেরও ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। তাই ব্যক্তিগত উন্নতি ও চারিত্রিক সমুন্নতির জন্যে যেমন মিতব্যয়ী হওয়া প্রয়োজন তেমনি জাতীয় অগ্রগতি ও জাতীয় চরিত্রও মিতব্যয়িতার ওপর নির্ভরশীল। মিতব্যয়ী হয়ে আমাদের জাতীয় সম্পদের সদ্ব্যবহার করা প্রয়োজন। দারিদ্র্য বিমোচনে ও অর্থনৈতিক উন্নয়নে চাই জাতীয় সম্পদের সুপরিকল্পিত ও সুষ্ঠু ব্যবহার। অমিতব্যয়ী ও পরিভোগপ্রবণ মানসিকতা যদি জাতিকে আচ্ছন্ন করে ফেলে তবে জাতি যে এক আসন্ন সংকটের পথে এগিয়ে যাবে তাতে সন্দেহ নেই।


আরো দেখুন :
রচনা : ছাত্রজীবন / দেশ ও জাতি গঠনে ছাত্র সমাজের ভূমিকা
রচনা : ছাত্রজীবনে ত্যাগ ও সততার অনুশীলন
রচনা : শিষ্টাচার
রচনা : দয়া
রচনা : মহত্ত্ব
রচনা : সৎসঙ্গ
রচনা : মনুষ্যত্ব
রচনা : দেশভ্রমণ
Post a Comment (0)
Previous Post Next Post