যে ফুল না ফুটিতে ঝরেছে ধরণীতে,
যে নদী মরুপথে হারালো ধারা,
জানি হে জানি তাও হয় নি হারা।
ভাব-সম্প্রসারণ : বিশ্বজগতে নিরন্তর চলেছে বাঙাগড়ার নিত্য ঘটনা। তাতে নিয়তই চোখে পড়ে অপূর্ণতা, ব্যর্থতা, ধ্বংস ও মৃত্যুর নানা টুকরো ছবি। এই দেখাই চূড়ান্ত সত্য নয়। সৃষ্টির রহস্যলোকের গভীর তলে অপূর্ণতা সদাই পূর্ণতা-অভিমুখী, ব্যর্থতা সাফল্যের। ধ্বংসের পেছনে কাজ করে সৃষ্টির প্রেরণা, মৃত্যুর আড়ালে মুখর হয় জীবনের ছবি। ব্যর্থতা ও অপূর্ণতা বিশাল বিশ্বসত্তার পূর্ণতার ইঙ্গিতবাহী।
এই পৃথিবী জন্ম ও মৃত্যু, সৃষ্টি ও ধ্বংসের নিত্য লীলাভূমি। এই জন্ম ও মৃত্যু, সৃষ্টি ও ধ্বংস যদি যথাযোগ্য সময়ের ব্যবধানে হয় তবে তা আমাদের কাছে অস্বাভাবিক মনে হয় না। পক্ষান্তরে অকালমৃত্যু ও অকাল ধ্বংসে আমরা বিচলিত হই, হাহাকার করে উঠি। কিন্তু এ জগতে অকাল ঝরে যাওয়া ফুল ব্যর্থ নয়, তৃষিত মরুর বুকে নিঃশেষিত নদীস্রোতও ব্যর্থ নয়। এদের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অবদান বিশ্বলীলার ইঙ্গিত। ব্যর্থতা ও অপূর্ণতার মধ্য দিয়ে সাফল্য ও পূর্ণতার ইঙ্গিতবহী। বাস্তব জগতে মানুষের অনেক ইচ্ছা, আকাঙ্ক্ষা ও স্বপ্ন অপূর্ণ থেকে যায়, সাফল্যের মুখ দেখে না। মহত্তর কাব্য রচনার যে স্বপ্ন দেখেন কবি তা হয়ত পূরণ হয় না। বিজ্ঞানীর কোনো মহৎ আবিষ্কারের সম্ভাবনা সাফল্যজনক পরিণতি লাভের সুযোগ পায় না। এই সব ব্যর্থতা আমাদের মধ্যে হতাশা আনে। কিন্তু এ ব্যর্থতা সাময়িক। আপাতদৃষ্টিতে ব্যর্থতা মনে হলেও এর অন্তরালে থাকে নতুন প্রচেষ্টা, নতুন উদ্যোগ ও নতুন সাধনায় সফলতা লাভের ইঙ্গিত। তা মহাকাশের ধারায় ভবিষ্যৎ সাফল্য ও সার্থকতার পথে একটি পদক্ষেপ মাত্র। বস্তুত, সার্বিকভাবে দেখলে দেখা যাবে, পৃথিবীতে কোনো কিছুর ধ্বংস নেই, বিনাশ নেই। আপাতদৃষ্টিতে যা ধ্বংস বা মৃত্যু, তা ধ্বংসের প্রেক্ষাপটে অন্য আর এক বস্তুতে রূপান্তর মাত্র। যে ফুল না ফুটতে ঝরে যায় তা ফুল হিসেবে সার্থকতা লাভ করতে না পারলেও একেবারে নিঃশেষ হয়ে যায় না। তার অবিনাশী রূপান্তরিত সত্তা মিশে যায় মাটিতে, মাটিকে দেয় শক্তি। যে নদী মরুপথে শুকিয়ে যায়, তা নদীর রূপ হারায় বটে, কিন্তু তার জলকণা বালুর তলে জমে জমে একদিন হয়ত মরুদ্যান রচনা করে, না হয় মেঘ হয়ে বৃষ্টির সম্ভাবনা নিয়ে আকাশে ভাসে। তাই পূর্ণতা ও ব্যর্থতা আপাতদৃষ্টিতে ব্যর্থ বলে মনে হলেও চূড়ান্ত বিচারে একেবারে মূল্যহীন নয়। রবীন্দ্রনাথের সুভাষণে আমরা এই কথারই প্রতিধ্বনি পাই : ‘জীবনের ধন কিছুই যাবে না ফেলা।’