রচনা : চলচ্চিত্র ও তার ভূমিকা

↬ সমাজজীবনে চলচ্চিত্রের প্রভাব

↬ শিক্ষা-বিস্তারে চলচ্চিত্র

↬ চলচ্চিত্রের ভালোমন্দ


ভূমিকা : মানবসভ্যতার এক বিস্ময়কর আবিষ্কার চলচ্চিত্র। তা আধুনিক কালের অত্যনতম সেরা শিল্পমাধ্যম ও গণমাধ্যম। আলোছায়ার খেলায়, ধ্বনিময় বর্ণিল কারুকার্যে জীবনের ভাব-ভাবনার চলমান অভিব্যক্তি প্রকাশের এই মাধ্যমটি প্রেক্ষাগৃহের রূপালি পর্দা থেকে শুরু করে টিভি ও কম্পিউটারের রূপালি পর্দায় এখন মানুষের সবচেয়ে আকর্ষণীয় মাধ্যম। মানুষের ব্যক্তিমনে এবং সমাজজীবনে এ মাধ্যমটির প্রভাব বিস্তারের ক্ষমতা অসাধারণ এবং বর্তমানে তা সমাজজীবনে শিক্ষা ও সংস্কৃতির অন্যতম সেরা ধারক ও বাহক হিসেবে সমাদৃত। পৃথিবীর সব দেশের সব মানুষের কাছে এর জনপ্রিয়তা ক্রমেই বাড়ছে এবং এটি গণযোগাযোগের শক্তিশালী মাধ্যম হিসেবে ইতিমধ্যেই স্বীকৃতি অর্জন করেছে। সর্বস্তরের মানুষের জীবনে প্রভাব বিস্তারের ক্ষেত্রে এর অসামান্য ক্ষমতার ফলে আধুনিক কালে সমাজজীবনে চলচ্চিত্র পালন করছে ব্যাপক ও সুদূরপ্রসারী ভূমিকা। সমাজ-সংগঠনে ও মানুষের জীবনবোধ গড়ে তোলার ক্ষেত্রে চলচ্চিত্রের ভূমিকা প্রসঙ্গে সংগত কারণেই রোজার মেনভেলের মন্তব্য :
“The cinema is only one element which brings some measure of influence to bear on our attitude to life.”

সমাজজীবনে চলচ্চিত্রের ইতিবাচক প্রভাব : অত্যন্ত আকর্ষণীয় ও অন্যতম সেরা বিনোদন মাধ্যম হিসেবে চলচ্চিত্র মানুষের নতুন ধ্যান-ধারণা ও দৃষ্টিভঙ্গি গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনে সক্ষম। রূচিশীল সুস্থ জীবন-পরিবেশ সৃষ্টিতে, মানুষের সৎ ও সুশীল চরিত্র গঠনে, সমাজজীবনে ন্যায়-নীতি প্রতিষ্ঠায় চলচ্চিত্র সহায়ক ভূমিকা পালন করতে পারে। সম্প্রদায়গত বিভেদ, গোষ্ঠীগত হানাহানির ঊর্ধ্বে ঐক্য ও সম্প্রীতির বন্ধন রচনায়ও চলচ্চিত্র হতে পারে প্রণোদনার উৎস। হিংসা-বিদ্বেষের পরিবর্তে সঞ্চারিত করতে পারে সহযোগিতা, সম্মিলন, পরমত সহিষ্ণুতা ও সম্প্রীতির বাণী। নৈতিক-মূল্যবোধভিত্তিক শিক্ষামূলক কাহিনী, তথ্যচিত্র ইত্যাদির মাধ্যমে জনপ্রিয় গণমাধ্যম হিসেবে চলচ্চিত্র সমাজজীবনে অশিক্ষা, পশ্চাৎপদতা ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে জনমানসকে সচেতন করে সমাজ-শিক্ষকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে পারে। জনগণের আশা-আকঙ্ক্ষার রূপায়ণ, তথ্য জ্ঞাপন ও জনচেতনার প্রসারে সহায়ক ভূমিকা রেখে চলচ্চিত্র জাতীয় উন্নয়নেও অবদান রাখতে পারে। জাতীয় সংকট মোকাবেলায়, জাতীয় চেতনার সম্প্রসারণে ও জাতীয় জাগরণ সৃষ্টিতেও চলচ্চিত্র হতে পারে বলিষ্ঠ মাধ্যম। সোভিয়েত দেশে সমাজতান্ত্রিক বিনির্মাণের ক্ষেত্রে জাতীয় উদ্দীপনা ও জাগরণ সৃষ্টিতে চলচ্চিত্রের অসাধারণ ভূমিকা উপলব্ধি করেই লেনিন বলেছিলেন : ‘To us cinema is the most important of all arts.’ এ থেকে জাতীয় জীবনে চলচ্চিত্রের গুরুত্ব ও তাৎপর্য সহজেই অনুধাবন করা যায়।

শিক্ষা সম্প্রসারণে চলচ্চিত্রের ভূমিকা : সাধারণভাবে চলচ্চিত্রের মুখ্য ভূমিকা লোকরঞ্জক হলেও বেতার ও টেলিভিশনের মতো চলচ্চিত্রও শিক্ষাসহায়ক ভূমিকা পালন করতে পারে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষাসহায়ক উপকরণ হিসেবে চলচ্চিত্র আধুনিক শিক্ষা ব্যবস্থায় ইতিমধ্যেই নিজের আসনটি পাকা করে নিয়েছে। আমেরিকা, রাশিয়া, জার্মানি, জাপানসহ বিশ্বের অগ্রসর দেশগুলোতে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্রছাত্রীদের পাঠ্যবই-নির্ভর শিক্ষার পাশাপাশি তথ্যমূলক চলচ্চিত্র প্রদর্শন করা হয়ে থাকে। জীবনী ও বাস্তব ঘটনাভিত্তিক কাহিনীচিত্র, প্রামাণ্য চিত্র, তথ্যচিত্র ইত্যাদির মাধ্যমে পরিপূরক শিক্ষা দেওয়া হয়। এর ফলে সাহিত্য, বিজ্ঞান, ইতিহাস, ভূগোল, দর্শন ইত্যাদি জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় শিক্ষার্থীদের জ্ঞানের প্রসার ঘটে। শিক্ষার্থীর নৈতিক, মানবিক, বিজ্ঞানমনস্ক দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে তোলার ক্ষেত্রে সেগুলো খুবই সহায়ক হয়। এজন্যেই আজকাল বলা হয়, চলচ্চিত্র শিক্ষার অঙ্গ। কিন্তু দুঃখের বিষয়, বাংলাদেশে প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থায় চলচ্চিত্র এখনো শিক্ষার অঙ্গ হয়ে ওঠে নি। গ্রন্থনির্ভর শ্রেণিকক্ষ-কেন্দ্রিক শিক্ষার বাইরে শিক্ষার ক্ষেত্র সম্প্রসারিত না হওয়াই এর মূল কারণ।

চলচ্চিত্রের ক্ষতিকারক দিক : চলচ্চিত্র বিজ্ঞানের এক বিস্ময়কর অবদান হলেও তা বর্তমানে অর্থলিপ্সু নীতিহীন বাণিজ্য সম্রাটদের হাতের ক্রীড়নকে পরিণত হয়েছে। চলচ্চিত্রের মহান ভূমিকাকে হেনস্থা করে তারা চলচ্চিত্রকে পরিণত করেছে বিকৃত রুচি-আশ্রিত পণ্যে। পরিভোগপ্রবণ পুঁজিবাদী সভ্যতা ও বিভিন্ন দেশের লুটেরা ধনিকরা চলচ্চিত্রের বিষয় হিসেবে লালন করছে বিকৃত রুচি, স্থূল যৌনাচার, উৎকট দেহপ্রদর্শন, অশালীন বেশভূষা, অভব্য বেলেল্লাপনা, লোমহর্ষক ঘটনাময় অপরাধ কাহিনী। অর্থ, অস্ত্র, নৈরাজ্য, যৌনতা ও হিংস্রতাকে পুঁজি করে তারা মূল্যবোধের চরম অবক্ষয় ঘটিয়ে তরুণ সমাজকে সংগ্রামী, দেশব্রতী চেতনা থেকে সরিয়ে পরিভোগপ্রবণ সমাজের ক্রীড়নক করে তুলতে চায়। আমাদের দেশে তারুণ্যের মধ্যে সাম্প্রতিককালে যে মারাত্মক অবক্ষয় প্রবণতা প্রকট হয়ে উঠছে পাশ্চাত্যের বাণিজ্যসর্বস্ব, রুচিহীন চলচ্চিত্রের ব্যাপক প্রভাবই এর কারণ বলে অনেকে মনে করেন।

বাংলাদেশের চলচ্চিত্র : দুঃখজনক হলেও সত্য, বাংলাদেশের চলচ্চিত্র শিল্প, শিক্ষা ও জনরুচির বাহন হয়ে উঠতে পারে নি। সার্বিকভাবে সুস্থ বিনোদনের মাধ্যম হিসেবেও তাকে বিবেচনা করা চলে না। কিছু কিছু ব্যতিক্রমধর্মী চলচ্চিত্র বাদ দিলে বাংলাদেশের চলচ্চিত্র সৎ চলচ্চিত্র বিকাশের ধারায় তেমন কোনো অবদান রাখতে পারে নি। অধিকাংশ চলচ্চিত্রই অশ্লীলতা, স্থূলতা ও রুচিশৈথিল্যের শিকার। বেশির ভাগ চলচ্চিত্রই বোম্বের বাণিজ্যিক ছবির নকল। এক কথায় বাংলাদেশের চলচ্চিত্র একটি গণবিচ্ছিন্ন মাধ্যম। জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষা, জাতির ইতিহাস-ঐতিহ্য-সংস্কৃতির সঙ্গে তার যোগ অত্যন্ত ক্ষীণ। অথচ স্বাধীন দেশের বিকাশমান গণমাধ্যম হিসেবে তা জাতির মানস গঠনের, শিক্ষা ও সুস্থ বিনোদনের অসাধারণ হাতিয়ার হওয়ার সম্ভাবনা রাখে।

উপসংহার : আমাদের দেশে চলচ্চিত্রকে জনগণের স্বার্থ, আকাঙ্ক্ষা ও জাতির প্রত্যাশার পরিপূরক করে বিকশিত করা দরকার। এদেশের চলচ্চিত্রের গুণগত উত্তরণ ঘটিয়েই তা করা সম্ভব হতে পারে। স্থূল রুচি লালন করে নয়, অনাবিল আনন্দ দানের সঙ্গে শিক্ষামূলক ও জাতিগঠনমূলক উপাদানের যোজনা করে এবং মানসম্মত শিল্পকর্মের পর্যায়ে নির্মিত করে এদেশের চলচ্চিত্রের নতুন ধারা তৈরি করা দরকার। তাহলে অন্ধ কুসংস্কার, মধ্যযুগীয় চিন্তা-চেতনা, বিজ্ঞান-বিমুখ মনোজড়তায় অনড় সমাজে পরিবর্তন আনা সম্ভব হবে। বর্তমান অস্থিরতা, নৈরাজ্য, মূল্যবোধের অবক্ষয়ের হাত থেকে জাতির উত্তরণের পথনির্দেশ করতে চলচ্চিত্র সহায়ক ভূমিকা পালন করতে পারে। এভাবে জাতিকে শিক্ষিত করার ক্ষেত্রে, নতুন প্রজন্মের মানস গঠনের ক্ষেত্রে চলচ্চিত্র কার্যকর অবদান রাখতে পারবে।

Post a Comment (0)
Previous Post Next Post