↬ লোকসাহিত্য ও জীবন
↬ লােকসাহিত্যের ধারা
↬ বাংলার লােকসাহিত্য
↬ লােকসাহিত্যে বাংলাদেশ
ভূমিকা : লোকসাহিত্য আবহমান বাঙালির সৃজন-লালনের পরিচয়বহ মৌখিক সাহিত্য। তাতে ধরা পড়ে শাশ্বতকালের বাঙালি জনজীবনের অন্তরস্পন্দন, কর্মপ্রবাহের রূপাভাস। চিরায়ত বাংলার লোকসাহিত্যের এক সমৃদ্ধ ঐতিহ্য বহন করছে আমাদের বাংলাদেশ। এর প্রতিটি অঞ্চলই লোকসাহিত্যের বিচিত্র ঐশ্বর্যে সমৃদ্ধ। তাই অনেক বিশ্ববরেণ্য পণ্ডিত ও লোকসংস্কৃতি বিশেষজ্ঞ বাংলাদেশকে লোকসাহিত্যের এক অগ্রগণ্য পীঠস্থানের মর্যাদা দিয়ে আসছেন।
লোকসাহিত্যের সংজ্ঞা : গ্রাম বাংলার সহজ-সরল সাধারণ মানুষের সৃজন ও লালনে গড়ে ওঠা মৌখিক সাহিত্যই হচ্ছে লোকসাহিত্য। সৃজন-বৈশিষ্ট্যের দিক থেকে লোকসাহিত্য সামাজিক সৃষ্টি, কারণ কালপরম্পরায় বহুজনের সংযোজন, সংশোধন ও পরিমার্জনায় গড়ে ওঠে লোকসাহিত্য। এই বিচারে লোকসাহিত্য হলে- ‘collective creation of the folk.’ লোকসাহিত্যের দ্বিতীয় বৈশিষ্ট্য হলো- এর সৃষ্টি যেমন লোকের মুখে মুখে তেমনি প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে এর সম্প্রচার ঘটেছে শ্রুতি পরম্পরায় ও মুখে মুখে। এজন্যে লোকসাহিত্য মৌখিক সাহিত্য- Folk literature simply literature transmitted ‘orally’.
লোকসাহিত্যের শাখা-প্রশাখা : বিষয় ও বৈশিষ্ট্যের দিক থেকে বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো আমাদের দেশের লোকসাহিত্যও নানা শাখা-প্রশাখায় বিভক্ত। তবে মোটামুটিভাবে এগুলোকে ছয়টি সাধারণ শাখায় ভাগ করা যায়। এগুলো হলো : ক. গদ্য আখ্যায়িকা, খ. পদ্য আখ্যায়িকা, গ. লোকসংগীত, ঘ. ছড়া, ঙ. প্রবাদ ও লোকনিরুক্তি, চ. ধাঁধা। এগুলো আবার নানা প্রশাখায় বিভক্ত। ফলে এগুলো যেমন বহুধা বৈচিত্র্যময় তেমনি ব্যাপক ঐশ্বর্যমণ্ডিত। বিষয়-বৈচিত্র্যের সঙ্গে সঙ্গে রস সৃষ্টিতেও বাংলাদেশের লোকসাহিত্য অনুপম সাংস্কৃতিক সম্পদ হয়ে আছে। এগুলো লোকজীবনের বহু বর্ণিল রঙে রাঙানো। এই জনপদের মানুষের যুগ-যুগান্তরের ভাবনা ও আবেগ তাতে পেয়েছে বহুমাত্রিক ব্যঞ্জনা।
ক. গদ্য আখ্যায়িকা : গদ্য আখ্যায়িকার মধ্যে পড়ে পুরাকথা (myth), কিংবদন্তি (legend), লোককাহিনী (folk tale)। পুরাকথায় রয়েছে ধর্মভাবের প্রাধান্য। কিংবদন্তিতে পাই আধ্যাত্মিক সাধন কিংবা ঐতিহাসিক চরিত্রের কথা। মহীপালের গীত, ঈসা খাঁর পালা ইত্যাদি কিংবদন্তির উদাহরণ। লোককাহিনী লোকসাহিত্যের অত্যন্ত সমৃদ্ধি ও ব্যঞ্জনাময় শাখা। বাংলার রূপকথা, ব্রতকথা ও উপকথা এই শাখারই আন্তর্গত। রূপকথায় ভিড় করেছে অজানা দেশের অজানা রাজার কাহিনী, ব্রতকথাগুলোয় ঠাঁই পেয়েছে লৌকিক দেবদেবীর পূজোর ব্রত পালন উপলক্ষে দেবতার মাহাত্ম্য কাহিনী আর নানা ধরনের উপদেশমূলক পশু কাহিনীর সমবায়ে গড়ে উঠেছে উপকথা।
খ. পদ্য আখ্যায়িকা : পদ্য আখ্যায়িকাগুলো গীতিকা, গাথা ও পালাগান নামে পরিচিত। এগুলোর প্রধান ভাগ দুটি : ধর্মীয় আখ্যায়িকা ও লোকায়ত প্রেমের আখ্যায়িকা। ধর্মীয় গীতিকাগুলো উত্তর বাংলার সম্পদ। এগুলো নাথ গীতিকা নামে পরিচিত। সে তুলনায় বাংলাদেশের লোকসাহিত্যের সেরা সম্পদ হচ্ছে প্রেম-নির্ভর গীতিকাগুলো- যা ‘ময়মনসিংহ গীতিকা’ বা ‘পূর্ববঙ্গ গীতিকা’ নামে পরিচিত। এই সব গীতিকায় নারীর প্রেমিক সত্তার যে অভাবনীয় মহিমা প্রকাশিত হয়েছে তা অতুলনীয়।
গ. লোকসংগীত : বাংলাদেশের লোকসাহিত্যের বিশেষ সম্পদ লোকসংগীত বা লোকগীতি। লোকজ জীবনের রোজনামচা সহজ সুরে অনুরণিত হয় লোকগীতিতে। অফুরন্ত লোকগীতির ভাণ্ডার আমাদের বাংলাদেশ। বাউল গান, জারি, সারি, ভাওয়াইয়া, গম্ভীরা ইত্যাদি গান সুদীর্ঘকাল ধরে এদেশে লোকসাহিত্যে ভাণ্ডারকে সমৃদ্ধ করেছে।
ঘ. ছড়া : ছড়া বাংলাদেশের লোকসাহিত্যের অন্যতম প্রধান সম্পদ। ছড়ায় কোনো কাহিনী থাকে না। কল্পনার রঙে আঁকা কোনো বর্ণিল চিত্রই তাতে প্রধান হয়ে ওঠে। এজন্যে অবনীন্দ্রনাথ ছড়াকে তুলনা করেছেন ‘ক্যালিডোস্কোপ’-এর সঙ্গে। বাংলাদেশের ছড়া প্রধানত শিশু-মনের কল্পনার রঙে আঁকা, তাতে রয়েছে এক কোমল-মধুর চিরন্তনতার আবেশ। তার আবেদন চিরকালের। যেমন:
ঘুম পাড়ানি মাসি-পিসি আমার বাড়ি এসো।
সেজ নেই, মাদুর নেই, পুঁটুর চোখে বসো-
বাটা ভরে পান দেব গাল ভরে খেয়ো;
খিড়কি দুয়ার খুলে দেব ফুড়ুৎ করে যেয়ো-
ধ্বনিময়তা ও বর্ণিল চিত্রময়তা বাংলাদেশের ছড়ার অনুপম বৈশিষ্ট্য।
ঙ. প্রবাদ : বৈশিষ্ট্যের দিক থেকে প্রবাদ ছড়ার সঙ্গে অধিকতর ঘনিষ্ঠ। দীর্ঘকালের অভিজ্ঞতাজনিত জীবনচর্যা সীমিত পরিসর বাক্যে সামাজিক সত্য হিসেবে প্রবাদের রূপ নেয়। বাংলা প্রবাদ-প্রবচনের জগৎটি ডাক ও খনার বচনে সমৃদ্ধ। বাংলা প্রবাদের মধ্য দিয়ে সেকালের লোকজীবনকে সহজে স্পর্শ করা যায়।
চ. ধাঁধা : ধাঁধা বাংলাদেশের লোকসাহিত্যের এমন একটি বিষয় যেখানে লোকজীবনের অভিজ্ঞতা প্রশ্নের আকারে বাণীবদ্ধ হয়েছে। ধাঁধা হলো গ্রামীণ সমাজে সাধারণ মানুষের শিক্ষার অন্যতম মাধ্যম। বিয়ের আসরে, প্রতিযোগিতার ক্ষেত্রে, গ্রাম্য মজলিশে, আমোদ-প্রমোদের উপকরণ হিসেবেও ধাঁধার ভূমিকা ছিল আনন্দের ও কৌতূহলের। ধাঁধা এবং তার উত্তর- এ দুই মিলেই ধাঁধা হয় তাৎপর্যপূর্ণ। যেমন :
বন থেকে বেরুল টিয়ে
সোনার টোপর মাথায় দিয়ে।
[আনারস]
এ ধরনের ধাঁধায় বাঙালির লোকজীবনের বুদ্ধিদীপ্ত রসবোধ ও সৌন্দর্যবোধের পরিচয় পাওয়া যায়।
লোকসাহিত্যের আরোও কিছু দিক : বাংলা লোকসাহিত্যের উপাদন হিসেবে মঙ্গলকাব্য ও পাঁচালীর ভূমিকাও উল্লেখযোগ্য। এগুলোর মধ্য দিয়ে গীত হয়েছে বাঙালির জনজীবনের প্রেমমধূর অথবা বেদনাবিধুর জীবনকথা। এ ছাড়াও সেকালে লোকশিক্ষার মাধ্যম হিসেবে যাত্রাগানের প্রচলন ছিল। মধ্যযুগ ও আধুনিক যুগের সন্ধিক্ষণে সৃষ্টি হয়েছে কবিগান, আখড়াই, টপপা ইত্যাদি। রস পরেবেশনে এগুলো তখন পালন করেছে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা।
উপসংহার : বাংলাদেশের লোকসাহিত্যে বাঙালির চিরায়ত জীবনধারার রূপবৈচিত্র্য বাঙ্ময় হয়ে আছে। বাঙালির সমাজ-গঠন, জাতিগত উপাদন, সংস্কৃতির বুনিয়াদ, নৃতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য ও ইতিহাসের নানা মালমশলা ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে লোকসাহিত্যের নানা উপাদনের মধ্যে। বাংলাদেশের লোকসাহিত্য এখনো যেমন আমাদের অনাস্বাদিতপূর্ব সাহিত্য-রস জোগায় তেমনি লোকসাহিত্যের উপাদনকে কাজে লাগিয়ে কালজয়ী যেমন আমাদের অনাস্বাদিতপূর্ব সাহিত্য-রস জোগায় তেমনি লোকসাহিত্যের উপাদানকে কাজে লাগিয়ে কালজয়ী আধুনিক সাহিত্য সৃষ্টি করাও সম্ভব। আধুনিক কালের হাওয়ায় বাঙালির সমাজ-পরিবেশে নতুনত্বের হাওয়া লেগেছে। যান্ত্রিকতা আমাদের আচ্ছন্ন করছে কিন্তু বাংলার লোকসাহিত্য অকৃত্রিম সরলতা ও মাধুর্যের খনি হয়ে আমাদের সদাই হাতছানি দেয়। তার সঙ্গে আমাদের প্রত্যক্ষ যোগ এখন আর নেই। তবু ইচ্ছে করলেই রসমাধুর্যে আমরা আপ্লুত হতে পারি।
একই রচনা অন্য বই থেকেও সংগ্রহ করে দেওয়া হলো
নানান বরণ গাভীরে ভাই একই বরণ দুধ
জগৎ ভরমিয়া দেখলাম একই মায়ের পুত।
– প্রচলিত
ভূমিকা : বাংলা সাহিত্যের অন্যতম বিশিষ্ট অংশ লােকসাহিত্য। বৈচিত্র্যে,
ব্যাপকতায় এবং জীবনের সঙ্গে একাত্মতায় উজ্জ্বল নিদর্শন হিসেবে তা সমাদৃত। কেবল
লােক সাহিত্যের দর্পণেই পাওয়া যায় জাতির হৃদয়ের অন্তরতম পরিচয়। জাতির
যুগ-যুগান্তরের আশা-আকাঙ্ক্ষা, ধ্যানধারণা, কাব্যকল্পনা লােকসাহিত্যের
স্বর্ণরশ্মিতে বিচ্ছুরিত হয়ে অমরত্ব লাভ করে। যুগযুগ ধরে পঞ্চবটীছায়াচ্ছন্ন
গ্রামবাংলা তার লোেক মানবের সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনার অপরূপ পসরা সাজিয়েছে তার
লােকসাহিত্যের সােনার তরীতে। যুগ-যুগান্তরের শত উত্থানপতনের মধ্য দিয়ে পদ্মা,
মেঘনা, মহানন্দা, ইছামতীর স্রোত বেয়ে সেই সােনার তরী এসে ভিড়েছে বর্তমানের
উপকূলে। লােকসাহিত্যেই তার আত্মিক পরিচয় মুদ্রিত। সুপ্রাচীনকাল থেকে
লােকসাহিত্যের বৈচিত্র্যপূর্ণ সৃষ্টি লােকমুখে প্রচলিত হয়ে আসছে এবং পুরাতন
সৃষ্টি হয়েও আধুনিক মানবসমাজে সমাদৃত হচ্ছে।
লােকসাহিত্যের সংজ্ঞা : লােকসাহিত্যের নাম ও সংজ্ঞা সম্পর্কে পণ্ডিতদের
মধ্যে মতানৈক্য রয়েছে। ইংরেজিতে Folklore কথাটা যে ব্যাপক অর্থে গৃহীত হয়েছে,
বাংলায় তা লােকসাহিত্য বললে তাতে পূর্ণাঙ্গ ভাবের যথার্থ প্রকাশ ঘটে না।
Folklore কথাটার অনুবাদ বা প্রতিশব্দ হিসেবে লােকসাহিত্য কথাটাকে
গ্রহণযােগ্য বিবেচনা না করে বিভিন্ন পণ্ডিত লােকবিজ্ঞান, লােকশ্রুতি, ফোকলাের
ইত্যাদি বৈচিত্র্যপূর্ণ নামে চিহ্নিত করার প্রয়াস পেয়েছেন। লােকসাহিত্য বলতে
জনসাধারণের মুখে মুখে প্রচলিত গাথা, কাহিনী, গান, ছড়া, প্রবাদ ইত্যাদি বােঝানাে
হয়। সাধারণত কোনাে সম্প্রদায় বা জনগােষ্ঠীর অলিখিত সাহিত্যই লােকসাহিত্য।
অর্থাৎ জাতীয় সংস্কৃতির যে সকল সাহিত্য গুণসম্পন্ন সৃষ্টি, প্রধানত মৌখিক ধারা
অনুসরণ করে অগ্রসর হয়, তাকে লােকসাহিত্য হিসেবে চিহ্নিত করা যেতে পারে।
বাংলার লােকসাহিত্যের পরিচয় : বাংলাদেশের লােকসাহিত্য বাঙালির হদয়ের
জীবন্ত প্রতিচ্ছবি। তার যাত্রাপাচালি ও কবি গানে, বাউল, ভাটিয়ালী, জারি, সারি,
মুর্শিদী ও কীর্তনের গানে বেঁচে আছে বাঙালির মৃত্যুঞ্জয়ী প্রাণসত্তা।
মঙ্গলকাব্যের ফুল্লরা, খুল্লনা, বেহুলা লখিন্দর, কালুলখ্যা, মেনকা উমা, ময়মনসিংহ
গীতিকার মহুয়া, মলুয়া, লীলা, কঙ্ক, সােনাই, কাজলরেখা— এরা আমাদের প্রাণেরই
প্রতিচ্ছবি। এদের আশ্রয় করে বাঙালি যত কেঁদেছে, তার তুলনা আর কোনাে জাতির
ইতিহাসে নেই। সেই রূপসৃষ্টির অপূর্ব মায়াকাজলে অপরূপ হয়ে উঠেছে তার ব্রতকথা ও
ছেলে ভুলানাে ছড়াগুলাে। যেমন—
“আম পাতা জোড়া জোড়া
মারব চাবুক চড়ব ঘােড়া
ওরে বুবু সরে দাঁড়া
আসছে আমার পাগলা ঘােড়া।
পাগলা ঘােড়া খেপেছে
চাবুক ছুঁড়ে মেরেছে।”
বাংলা লােকসাহিত্যের পৃষ্ঠপােষক যারা : বাংলা লােকসাহিত্যের
পৃষ্ঠপােষকতায় অনেকেরই ভূমিকা স্মরণীয়। রেভারেন্ড লালা বিহারী তেমনি একজন। তিনি
বহু লােককাহিনী, উপকথা সংগ্রহ করে 'Folk Tales of Bangla' নামক বইটি
রচনা করেন। লােকসাহিত্যের সমৃদ্ধিতে উ, দীনেশচন্দ্র সেনের অবদানও বিশেষভাবে
স্মরণীয়। এছাড়াও অধ্যাপক মনসুর উদ্দীন সাহেবের হারামনি, লালন শাহ, হাসন রাজা
প্রমুখের রচিত গান বাংলা লােকসাহিত্যের শ্রেষ্ঠ সম্পদ।
লােকসাহিত্যের শ্রেণিবিভাগ : বাংলার লােকসাহিত্য তার প্রাণগগার মতাে
শতধারায় উৎসারিত। তার বাণীরূপও বহু বিচিত্র। জীবনের বহু বর্ণ ব্যবহারে তা আমাদের
সমাজজীবনকে চিত্রিত করে রেখেছে বহুভাবে বিষয় বৈচিত্র্যের দিক থেকে তাদের
অন্ততঃপক্ষে সাতটি শ্রেণিতে বিভক্ত করা
যায়। যেমন-
১. শিশু সাহিত্য,
২. মেয়েলি ব্রতকথা,
৩, ধর্ম সাহিত্য,
৪. পল্লিসাহিত্য,
৫, ইতিবৃত্তমূলক সাহিত্য,
৬. প্রবচন সাহিত্য ও
৭. ধাঁধাঁ ।
১. শিশু সাহিত্য : বাংলার শিশু সাহিত্য শাখায় পড়ে বাংলার রূপকথা, উপকথা,
ছেলে ভুলানাে ছড়া ও ঘুমপাড়ানি গান, রূপকথা ও উপকৃথা। এর উৎস সমস্ত বাংলাদেশের
মাতৃস্নেহের মধ্যে, নিখিল বঙ্গদেশের সেই পুরাতন গভীরতর স্নেহ হতে এ রূপকথা
উৎসারিত। আর ছেলে ভুলানাে ছড়া এবং ঘুমপাড়ানি গানগুলােকে রবীন্দ্রনাথ তুলনা
করেছেন পরিবর্তনশীল, বিবিধ বর্ণে রঞ্জিত, যদৃচ্ছভাসমান মেঘের সঙ্গে। এ ছড়া ও
গানগুলাে মেঘবারি ধারায় নেমে এসে শিশু শস্যকে প্রাণদান করেছে এবং মেহরসে বিগলিত
হয়ে কল্পনা বৃষ্টিতে উর্বর করে তুলেছে শিশুহৃদয়কে।
২. মেয়েলি ব্রতকথা : বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে মেয়েলি ব্রতের সঙ্গে
সম্পর্কিত কাহিনী অবলম্বনে ব্রতকথা নামে এক ধরনের লােককথার বিকাশ ঘটেছে। এসব
কাহিনীতে যে ধর্মবােধের কথা বলা হয়েছে তাতে মেয়েদের জাগতিক কল্যাণই নিহিত।
বাস্তব জীবনাশ্রিত এই ধর্মবােধ সংবলিত ব্রতকথাগুলাে বাঙালির লােকসমাজের পরিচয়
প্রকাশক। মেয়েলি ব্রতকথাগুলাে লৌকিক দেবদেবী অবলম্বনে রচিত। কিন্তু তাতে কোনাে
পৌরাণিক আদর্শ নেই। বাস্তব জীবনের সংকট থেকে পরিত্রাণের উদ্দেশ্যে মেয়েরা এসব
দেবদেবীর ওপর নির্ভরশীল হয়েছে। ব্ৰতাচারের সঙ্গে সম্পৃক্ত বলে এসব ব্রতকথা
সংকীর্ণ গণ্ডির মধ্যে আবদ্ধ হয়ে পড়েছে। সাহিত্যিক আবেদন এতে অনুপস্থিত। অবশ্য
কবির কাছে ব্রতকথা বাংলার আদিম কাব্য। ঐতিহাসিকদের কাছে তা বঙ্গের গৃহ ও সমাজের
ধর্ম ও কর্মের পুরাতন ইতিহাস। আর মাতৃভক্ত বাঙালির কাছে ব্রতকথা বঙ্গজননীর স্তন
নিঃসৃত প্রথম ক্ষীরধারা। সাবিত্রী ব্রত, সেজুতি ব্ৰত, তুষ তুষালি ব্ৰত,
পুণ্যপুকুর ব্ৰত ইত্যাদি শতসহস্র ব্রত উদ্যাপন এবং তাদের যুগ-যুগান্তর ধরে রচিত
মন্ত্রগুলাের মাধ্যমে যে গার্হস্থ্য শান্তি ও প্রিয়কল্যাণ আকাক্ষা রূপ লাভ করে,
তার তুলনা কোথাও নেই।
৩. ধর্ম সাহিত্য : বাংলার লােকসাহিত্যের একটি শাখা ধর্মের গানে মুখরিত।
বাঙালি হিন্দুসমাজে তেত্রিশ কোটি দেবতার অধিষ্ঠান। সেসব দেবতাকে কেন্দ্র করে গড়ে
উঠেছে তার মঙ্গলকাব্য ও পাঁচালি সাহিত্য মনসামঙ্গল, চণ্ডীমঙ্গল ধর্মমঙ্গল,
অন্নদামঙ্গল, শিবায়ন, শীতলামঙ্গল, গঙ্গামঙ্গল, সত্য নারায়ণের পাঁচালি এবং
লক্ষীর পাঁচালিকে কেন্দ্র করে বাংলার প্রাণের গভীরতম কান্না ব্যক্ত হয়েছে।
তাছাড়া কীর্তন, শ্যামা সঙ্গীত, আগমনী বিজয়ার গান, বাউলগান ইত্যাদি বাঙালি
হৃদয়ের অশুর উৎসমুখ যেন খুলে দিয়েছে।
৪. পল্লিসাহিত্য : বাংলার পল্লিসাহিত্য একেবারে পল্লির মাটি থেকে উদ্ভূত।
তাদের গায়ে লেগে আছে বাংলার মাটির গন্ধ। পল্লির মানুষের হৃদয় ভূমিতেই তাদের
জন্ম। ময়নামতীর গান, মানিকচাদের গান, গােবিন্দচন্দ্রের গীত, মুর্শিদী গান,
সারিগান, জারিগান, ভাটিয়ালী গান, তরজা গান, পূর্ববঙ্গ গীতিকা, টুমু গান
হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে বাঙালির অন্তর থেকে উৎসারিত হয়ে বাঙালির সর্বজনীন
সম্পত্তিতে পরিণত হয়েছে।
৫. ইতিবৃত্তমূলক সাহিত্য : প্রাচীন বাংলার প্রকৃত ইতিবৃত্তমূলক সাহিত্য
নেই। তবে কোনাে কোনাে ঐতিহাসিক কাহিনী কিংবা কোনাে দৈব দুর্ঘটনা বা কোনাে
বিয়ােগান্ত প্রেমকাহিনী অবলম্বন করে গণমানসে। রচিত হতাে লােকসাহিত্য। মৈমনসিংহ
গীতিকা প্রকৃতপক্ষে এধরনের সাহিত্য। মৈমনসিংহ গীতিকার মহুয়া, মলুয়া, সােনাই,
কাজলরেখা বাঙলার হৃদয়ের কোমল স্নিগ্ধ অভিব্যক্তি। এরা বাঙালি হৃদয়ের অশুনিঝরের
উৎসমুখ উন্মুক্ত করে দিয়েছে।
৬. প্রবচন সাহিত্য : বাঙালির গণমানসে যুগ-যুগান্তর ধরে যে জ্ঞানচর্চা
হয়েছে, তা সঞ্জিত হয়েছে তার প্রবচন সাহিত্যের চিরায়ত ভাণ্ডারে। এভাবে দিনের পর
দিন জনগণের বহুমুখী অভিজ্ঞতার সঞ্জয় বাংলার লােকসাহিত্যের প্রান্তরে গুচ্ছ গুচ্ছ
ফসলের আকারে ফলে উঠছে খনার বচন, ডাকের কথা, শুভঙ্করের আর্যা তাছাড়া অজস্র প্রবাদ
বাক্য প্রবচন সাহিত্যের অন্তর্ভুক্ত। এগুলােতে হৃদয় অপেক্ষা মননের স্বাক্ষর বেশি
হলেও তাতে মুদ্রিত বাংলার লােকজীবনের ঘনিষ্ঠ স্পর্শ। ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ
তাঁর ‘পল্লীসাহিত্য’ প্রবন্ধে লিখেছেন,
“প্রবাদ বাক্যে এবং ডাক ও খনার বচনে কত যুগের ভুয়ােদর্শনের পরিপক্ক ফল সম্ভিত
হয়ে আছে, কে তা অস্বীকার করতে পারে? শুধু তাই নয়, জাতির পুরনাে ইতিহাসের অনেক
গােপন কথাও এর মধ্যে খুঁজে পাওয়া যায়।”
নীতিকথা হিসেবেও বাংলাদেশের কৃষক সমাজের কাছে এগুলাের মূল্য কম নয়। যেমন—
“কলা রুয়ে না কেটো পাত,
তাতেই কাপড় তাতেই ভাত।”
“ষােল চাষে মূলা
তার অর্ধেক তুলা
তার অর্ধেক ধান।
বিনা চাষে পান।”
“চিড়া বল পিঠা বল ভাতের মত না,
খালা বল ফুফু বল মায়ের মত না।”
৭. ধাঁধা : ধাঁধা লােকসাহিত্যের অন্যতম প্রাচীন শাখা হিসেবে বিবেচিত।
মাহবুল আলমের ভাষায়,
“রূপকের সাহায্যে এবং জিজ্ঞাসার আকারে কোনাে একটি ভাব সূক্ষ্ম বুদ্ধি ও
চিন্তার অনুশীলনের মাধ্যমে ধাধায় রূপায়িত হয়ে ওঠে। এতে বুদ্ধিবৃত্তি বিকাশের
যে নিদর্শন পাওয়া যায় তাতে তাকে আদিম জাতির সৃষ্টি মনে না করে বুদ্ধিবৃত্তি
সম্পন্ন মানব মনের সৃষ্টি বলে অনুমিত হয়।”
ধাঁধার মাধ্যমে জ্ঞানবুদ্ধির চর্চা হয়ে থাকে। অল্প কয়টি কথায় সাধারণত ছড়া বা
কবিতার আকারে কাউকে কোনাে প্রশ্ন করা হলে তা ধাঁধা হিসেবে বিবেচিত হয়। তখন
প্রশ্নে উদ্দিষ্ট ব্যক্তিকে এর সঠিক উত্তর দিতে হয়। ধাধা জিজ্ঞাসা এবং সেসবের
উত্তরদানের মাধ্যমে প্রকৃতপক্ষে বুদ্ধিবৃত্তির পরিচয় মিলে।
দৈনন্দিন জীবনের বিচিত্র উপকরণ থেকে ধাধার বিষয়বস্তু আহরিত হয়। এক্ষেত্রে
মানবজীবনের বিচিত্র অভিজ্ঞতা ও অনুসন্ধিৎসার পরিচয় প্রকাশ পায়। প্রশ্নকর্তা
নিজে উত্তর গােপন রেখে ধাঁধার মাধ্যমে জবাব আশা করে। জবাব দিতে পারলে পান্ডিত্য
এবং না দিতে পারলে অজ্ঞতা প্রমাণিত হয়। ধাঁধার উত্তরদানে ব্যর্থ হলে তা হাসির
উপকরণ হয়ে ওঠে। ধাঁধার সঙ্গে মানুষের হাস্যরসবােধের সম্পর্ক আছে। ধাঁধার উত্তর
জনশুতিমূলক হয়ে থাকে। সাধারণত উত্তর জানা না থাকলে প্রশ্নকর্তার সম্মুখে বিব্রত
হতে হয়। তবে ধাঁধার মীমাংসা জনশুতিমূলক বলেই তার জবাবদান সম্ভবপর। আগে থেকে জানা
না থাকলে লােকসাহিত্যের ধাঁধার উত্তর বের করা কঠিন। কারণ ধাঁধার মধ্যে বক্তব্য
সাধারণত সংগতিপূর্ণ থাকে না। যেমন—
“একটুখানি পুষুনি কইয়ে ভুর ভুর করে
রাজা আইলে প্রজা আইলে তুইল্যা সেলাম করে।”
এর উত্তর যে ‘হুঁকা’—তা আগে থেকে জানা না থাকলে ধাঁধার বক্তব্য থেকে তা উদ্ধার
করা চলে না।
“বন থেকে বেরুল টিয়ে
সােনার টোপর মাথায় দিয়ে।”
আনারসের সঙ্গে এর তেমন মিল না থাকলেও এর উত্তর আনারস। অনেক সময় ধাধার উত্তরের
সঙ্গে বক্তব্যের অর্থসংগতি খুঁজে পাওয়া যায় না। ধাঁধাগুলাের রূপ একরকম থাকে না।
দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে প্রচলিত থাকার জন্য এর পাঠান্তর ঘটে।
ডক্টর আশুতােষ ভট্টাচার্য বিষয় অনুসারে বাংলা ধাঁধাকে দুটি প্রধান ভাগে বিভক্ত
করেছেন। ভাগগুলাে হচ্ছে—
(ক) প্রকৃতিবিষয়ক এবং
(খ) গার্হস্থ্য জীবনবিষয়ক।
প্রথম শ্রেণির ধাঁধায় কল্পনা ও রসের প্রাচুর্য অনুভব করা যায়; অপরটির মাধ্যমে
বাস্তব জীবনের খুঁটিনাটি
অভিজ্ঞতার পরিচয় ফুটে ওঠে। ধাঁধার লক্ষ্য রসসৃষ্টি; জ্ঞানের অনুশীলন এর লক্ষ্য
নয়। প্রকৃতি বা জীবনে যেখান থেকেই উপকরণ সংগৃহীত হােক না কেন তাতে রসের অভাব ঘটে
না।
উপসংহার : লােকসাহিত্য সাধারণত কোনাে ব্যক্তিবিশেষের একক সৃষ্টি নয়, তা
সংহত সমাজের সামগ্রিক সৃষ্টি। সংহত সমাজ বলতে সে সমাজকে বােঝায় যার অন্তর্ভুক্ত
মানবগােষ্ঠী পারস্পরিক নির্ভরশীলতার ভেতর দিয়ে চিরাচরিত প্রথার নিজস্ব বৈশিষ্ট্য
অক্ষুন্ন রেখে চলে। লােকসাহিত্যের সমাজ বিচিত্র সাংস্কৃতিক উপকরণে সমৃদ্ধ হয়ে
সাহিত্য সৃষ্টির সহায়ক হয়। তাই লােকসাহিত্য আমাদের মূল্যবান সম্পদ।