মার্চের দিনগুলি

রচনা : জীবনের লক্ষ্য ও পাঠক্রম নির্বাচন

ভূমিকা : লক্ষ্যহীন জীবন হাল ভাঙা নৌকোর মতো। সে জীবন হয়ে পড়ে অনিশ্চিত। জীবনে সফল হতে হলে সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য নিয়ে ছেলেবেলা থেকেই জীবনকে সে লক্ষ্য অর্জনের জন্যে প্রস্তুত করে নিতে হয়। মানুষের কর্মজীবন বিকশিত হতে পারে বিচিত্র পথে। জ্ঞান-বিজ্ঞানের সাধনা, চিকিৎসা-সেবা দান, শিল্প-কলকারখানা স্থাপন, ব্যবসা-বাণিজ্যের মাধ্যমে দেশের অর্থনীতিতে ভূমিকা পালন- নানা ভাবে মানুষ কর্মজীবনে ভূমিকা রাখতে পারে। পেশা হিসেবে কেউ বেছে নিতে পারে সরকারি চাকরি, কেউ হতে পারে আইনজ্ঞ, কেউ হতে পারে প্রকৌশলী, কারও বা পছন্দ হতে পারে উন্নয়ন কর্মী হওয়া। কেউ বা ব্রতী হতে পারে শিক্ষকতায়, কেউ বা বেছে নিতে পারে রাজনৈতিক কর্মজীবন। যে যাই হতে চাক না কেন বৃত্তি নির্বাচন অনেকাংশেই শারীরিক সামর্থ্য, শিক্ষাগত যোগ্যতা ও মান, ব্যক্তিগত পছন্দ-অপছন্দ ও আর্থিক স্বচ্ছলতা ইত্যাদির ওপর নির্ভরশীল। অনেক ক্ষেত্রে বিশেষ বৃত্তি বা পেশা গ্রহণের জন্যে সুনির্ধারিত পাঠক্রম অধ্যয়ন করতে হয়। সেজন্যে জীবনের লক্ষ্য ঠিক করে সেই অনুযায়ী পাঠক্রম নির্বাচনের প্রয়োজন হয়।

পাঠক্রমের প্রধান প্রধান ভাগ : আমাদের দেশে উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে পাঠক্রমের নানা বৈচিত্র্য থাকলেও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে সাধারণ শিক্ষা পাঠক্রমকে মূলত তিনটি শাখায় বিভক্ত করা হয়েছে। এগুলো হলো :
১. বিজ্ঞান শাখা,
২. মানবিক শাখা ও
৩. ব্যবসায় শিক্ষা শাখা
এই শাখাগুলোর অন্তর্গত এমন অনেক শাখা উপশাখা ভিত্তিক বিষয় রয়েছে যেগুলোর কোনো একটির অধ্যয়ন ও গবেষণার পরিসর অনেক বিশাল এবং সেগুলোকে কেন্দ্র করে উচ্চতর শিক্ষার ব্যাপক পাঠক্রম গড়ে ওঠেছে।

পাঠক্রম নির্বাচনে বিবেচ্য দিক : পাঠক্রম নির্বাচনে মানস প্রবণতা ও ইচ্ছার বিশেষ গুরুত্ব থাকে। যে গণিতে ভয় পায় তার পক্ষে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির জটিল বিষয় অধ্যয়ন স্বাচ্ছন্দ্যকর ও ফলপ্রসূ হয় না। যে সাহিত্যে আগ্রহী তাকে ব্যবসা-বাণিজ্যের বিষয় পড়তে বাধ্য করা হলে তাতে সে আগ্রহ নাও পেতে পারে। তাই যার যে বিষয়ে অধ্যয়ন করার সুযোগ সবার হয় না। অনেক বিষয় আছে যেগুলো অধ্যয়নে কর্মজীবনে প্রতিষ্ঠা ও অর্থাগম দুইইহয়। কিংবা এমন অনেক বিষয় আছে যেগুলোর জন্যে প্রচুর তীক্ষ্ন মেধা ও পড়াশোনা প্রয়োজন হয়। যেমন প্রকৌশল বিজ্ঞান, চিকিৎসা বিজ্ঞানের কোনো শাখায় অধ্যয়ন করার জন্যে ছাত্রছাত্রীদের কেবল মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় অসাধারণ ভালো ফলাফল করলেই চলে না, প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায়ও কৃতিত্ব প্রদর্শন করতে হয়। যে সমস্ত বিষয় বা শাখায় অধ্যয়নের ক্ষেত্রে আসন সংখ্যা সীমিত সেখানে মেধার ক্রম অনুসারে নির্ধারিত আসনগুলোতেই ভর্তির সুযোগ থাকে। ফলে ইচ্ছা ও মেধা থাকলেও সুযোগের সীমাবদ্ধতার কারণেও অনেক সময় রুচি ও ইচ্ছা অনুযায়ী বিষয়ে অধ্যয়নের সুযোগ হয় না। তাই কোনো বিষয়ে উচ্চ শিক্ষা নিতে হলে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায় থেকেই ঘনিষ্ঠ অধ্যয়ন প্রয়োজন হয়।

এমন অনেক বিষয় আছে যেগুলো অর্থকরী হয়ত নয় কিন্তু তার গুরুত্ব কোনো অংশেই কম নয়। যেমন, সাহিত্য ও চারুকলা পঠনপাঠনে পাওয়া যায় প্রচুর আনন্দ। এতে থাকে কল্পনা ও সৃজনের অসীম বিস্তার। আবার ইতিহাস, লোকসংস্কৃতি, সমাজতত্ত্ব, অর্থনীতি, দর্শন ইত্যাদি বিষয় কেবল ঐ নির্দিষ্ট বিষয়ের মধ্যেই সীমিত থাকে না। এগুলোর একটির সঙ্গে অনেক বিষয়ের অবিচ্ছেদ্য সম্পর্কই এদের ব্যাপক গুরুত্ব ও আকর্ষণের কারণ।

জীবিকার সঙ্গে পাঠক্রমের সম্পর্ক : জীবিকার সঙ্গে পাঠক্রমের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ক্রমেই বাড়ছে। চিকিৎসা বিজ্ঞানে অধ্যয়ন না করে কারো পক্ষে ডাক্তার হওয়া সম্ভব নয়। কম্পিউটার বিজ্ঞানী হতে হলে তাকে পদার্থ-বিজ্ঞান, গণিত, পরিসংখ্যান ও কম্পিউটার বিষয়ে না পড়লে চলে না। কিন্তু সাহিত্য বিষয়ে প্রাতিষ্ঠানিক ডিগ্রি নিলেও অনেকে জীবনে সাহিত্যিক হতে পারেন না, বড়জোর সাহিত্যের শিক্ষক বা অধ্যাপক হতে পারেন। অন্য দিকে রাজনীতিতে পেশা হিসেবে নিতে হলে রাষ্ট্রতত্ত্ব বা আইন বিষয়ে পড়াশোনা হলে ভাল, কিন্তু সেসব অধ্যয়ন না করলে তিনি যে রাজনীতিবিদ হতে পারবেন না এমন নয়। বাংলাদেশে এখন রাজনীতিকে যারা পেশা হিসেবে নিচ্ছেন তাদের অনেকেই আসছেন নানা বিদ্যাক্ষেত্র থেকে। এদের কেউ প্রাক্তন আমলা, কেউ সেনা নায়ক বা সেনা অফিসার, কেউ ব্যবসায়ী। এর ফলে রাজনৈতিক ক্ষেত্রে দেশ পরিচালনায় সমস্যা হচ্ছে। আইন, সংবিধান, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক, অর্থনীতি, লোকপ্রশাসন, সামাজিক মনস্তত্ত্ব, সমাজতত্ত্ব বিষয়ে যাদের ব্যাপক অধ্যয়ন আছে রাজনীতিক অঙ্গনে প্রকৃত পক্ষে তারাই দিতে পারেন উপযুক্ত নেতৃত্ব। দুঃখের বিষয়, এসব বিষয়ে সামান্য পড়ালেখা নেই অথচ কেবল অর্থবিত্ত বা দাপটের জোরে রাজনীতির অঙ্গনে ক্ষমতার অধিকারী হয়েছেন কেউ কেউ। এর ফল দেশ ও জাতির জন্যে শুভ হচ্ছে না।

লক্ষ্য অনুযায়ী পাঠক্রম নির্বাচনের সমস্যা : বর্তমানে দেশে শিক্ষার চেয়ে ডিগ্রি পাওয়ার নেশা বেড়ে গেছে। অন্যদিকে উচ্চ শিক্ষার ক্ষেত্রে প্রসারিত হলেও সুযোগ সেই অনুপাতে বাড়ছে না। ফলে শিক্ষার্থীদের মানসপ্রবণতা অনুযায়ী ইচ্ছা মতো পেশা বাছাই করা সম্ভব হচ্ছে না। যে পড়তে চায় পদার্থবিদ্যা তাকে হয়ত বাধ্য হয়ে নিতে হচ্ছে পরিসংখ্যান। যে পড়তে চায় অর্থনীতি তাকে হয়ত পড়তে হচ্ছে ইতিহাস। আবার যে বিষয়ে কেউ ডিগ্রি পাচ্ছে সে বিষয়ে পেশাগত কর্মের ক্ষেত্রে বিস্তৃত না হওয়ায় কর্মজীবনে লক্ষ্যবিচ্যুতি ঘটছে নিজের অনিচ্ছায়। যে হয়ত কীটতত্ত্ববিদ হওয়ার আশায় লেখাপড়া করেছিল তাকে কাজ করতে হচ্ছে পুলিশ বিভাগে। দেশে শিক্ষাক্ষেত্রে বাস্তব শিক্ষানীতি ও শিক্ষা পরিকল্পনা না থাকাই এর কারণ।

দেশের চাহিদা ও পাঠক্রম নির্বাচন : বাংলাদেশ সম্পদশালী দেশ নয়। তাছাড়া জনসংখ্যাও বিপুল। দেশে বর্তমানে স্নাতক ডিগ্রিধারী শিক্ষিত বেকার বা প্রায় বেকারের সংখ্যা ৭০ শতাংশ। তাই দেশের সম্পদকে কাজে লাগানোর ব্যাপক পরিকল্পনা এবং কর্মসংস্থানের সম্ভাবনার সঙ্গে সংগতি রেখেই পেশা নির্বাচন করা উচিত। বিশেষজ্ঞগণ দেশে সাধারণ শিক্ষার চেয়ে বৃত্তিমূলক শিক্ষাকেই বেশি গুরুত্ব দিচ্ছেন। এই পথেই ব্যাপক কর্মসংস্থান ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন নিশ্চিত হবে বলে তাদের ধারণা। তাই পাঠক্রম নির্বাচনের ক্ষেত্রে জাতীয় প্রয়োজন ও কর্মসংস্থানের দিকটিও বিশেষ বিবেচনায় রাখা দরকার।

উপসংহার : বাংলাদেশে তরুণ সমাজের সামনে সঠিক বৃত্তি নির্বাচনের সমস্যা একটা বড়ো সমস্যা। রুচি, মেধা, শিক্ষা ও যোগ্যতা অনুযায়ী বৃত্তি বা লক্ষ্য বাছাইয়ের কোনো ব্যবস্থা না থাকায় অনেক শিক্ষার্থীই সঠিক পাঠক্রম নির্বাচন করতে ব্যর্থ হচ্ছে। ফলে তাদের শিক্ষা হচ্ছে দুর্বল। অনেকে সাধারণ শিক্ষা বেছে নিয়ে কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে সফল হচ্ছে না। তাদের জীবনে নেমে আসছে বেকারত্ব বা ছদ্ম বেকারত্বের অভিশাপ। ফলে পুঞ্জীভূত হচ্ছে হতাশা। বর্তমানে দেশে বৃত্তি ও লক্ষ্য নির্বাচনের ক্ষেত্র সম্প্রসারিত হয়েছে। কারিগরি শিক্ষা, কৃষি শিক্ষা, কুটিরশিল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বৃত্তিমূলক শিক্ষা, এমনকি খেলাধুলা, সাংবাদিকতা, চারুকলা ইত্যাদি ক্ষেত্রেও লেখাপড়ার সুযোগ ক্রমেই সম্প্রসারিত হচ্ছে। এসব বিষয় সম্পর্কে জেনে, পাঠক্রম বাছাই করে নিষ্ঠার সঙ্গে নিজেকে প্রস্তুত করলে জীবনে যেমন সাফল্য আসবে তেমনি দেশ ও জাতি উপকৃত হবে।

1 Comments

  1. আমার জীবনের লক্ষ্য আইপিএস
    এটা লাগবে

    ReplyDelete
Post a Comment
Previous Post Next Post