মার্চের দিনগুলি

রচনা : জঙ্গিবাদ দমনে বাংলাদেশ পুলিশের ভূমিকা

বর্তমান বিশ্বে একটি আলোটিত বিষয় সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ। সারা বিশ্ব আজ কেঁপে উঠেছে জঙ্গিবাদের হামলায়। অরক্ষিত ও সহজেই লক্ষ্যভূক্ত করা যায় এমন মানুষের ওপর জঙ্গি হামলা দিন দিন বেড়েই চলেছে। বিশ্বের কোনো জাতিই এ হামলা থেকে মুক্ত নয়। জঙ্গিবাদের নামে এ যুদ্ধ-বিগ্রহ, হত্যা-হানাহানি বা ধ্বংসাত্মক কর্মকণ্ড কখনোই বিশ্ব মানবতার জন্য কাম্য নয়। জঙ্গিবাদ এভাবে চলতে থাকলে তা একসময় গোটা বিশ্বকে গ্রাস করে ফেলবে। তাই সকলকে এক হয়ে জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে কাজ করতে হবে। জঙ্গির কালো থাবা থেকে দেশ ও বিশ্বকে বাঁচাতে হবে। 

জঙ্গি কী বা করা? : জঙ্গ একটি ফার্সি শব্দ। উর্দু আর ফার্সিতে জঙ্গ লড়াই বা যুদ্ধ অর্থে ব্যবহার হয়। জঙ্গ অর্থ যুদ্ধ আর জঙ্গি মানে যোদ্ধা, লড়াকু। ফার্সি আর উর্দুকে জঙ্গি একটি সম্মাতি শব্দ। যারা অন্যায় অত্যাচার আর জুলুম নির্যাতনের বিপক্ষে এবং ন্যায়ের পক্ষে বঞ্চিতদের অধিকার আদায়ের জন্য সশস্ত্র সংগ্রাম করে তাদের সম্মানের চোখে দেখা হয় এবং জঙ্গি বলে আখ্যায়িত করা হয়। বর্তমানে জঙ্গি শব্দের অপব্যবহার করছে কিছু বিপথগামী মানুষ। তারা ইসলামকে ব্যবহার করে শত শত নিরীহ মানুষের জীবন ধ্বংস করছে। এরা সভ্য জগতের মানুষ হয়ে জঙ্গলে বসবাসকারী জংলি মানুষের ন্যায় আচরণ করছে। ফলে জঙ্গি শব্দটি আজ আতঙ্কে পরিণত হয়েছে। 

জঙ্গিবাদের কার্যক্রম : জঙ্গি কার্যক্রম এককভাবে কিংবা দলীয়ভাবে পরিচালিত হতে পারে। জঙ্গিরা বিশেষ উদ্দেশ্য পূরণে তাদের সংগঠন প্রণীত ধর্মীয় বা রাজনৈতিক ধারণা বা দর্শন সমাজ বা রাষ্ট্রীয় জীবনে প্রবর্তন করতে চায়। এ লক্ষ্যে তারা তাদের ধারণা প্রচারের জন্য লিফলেট, পোস্টার, পুস্তিকা ব্যবহারসহ বিভিন্ন কৌশল ব্যবহার করে। অনেক সময় তাদের দ্বারা সংঘটিত হত্যাযজ্ঞ বা ধ্বংসাত্মক কাজে প্রচার মাধ্যমে স্বীকারোক্তিমূলকভাবে প্রকাশ করে। তথ্যপ্রযুক্তির আধুনিক প্রচার যেমন- ই-মেইল, মোবাইল, ফেসবুক, টুইটার প্রভৃতি ব্যবহার করে তারা তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করে। জঙ্গিদের ধারণা তারা সঠিক পথে পরিচালিত হচ্ছে, তারা সবসময়ই একরোখা মনোভাব পোষণ করে। জঙ্গিরা নিজেদের অবস্থানকে বাস্তবায়ন করার জন্য নানা ধরনের অপকর্মে লিপ্ত হয়। তাদের মত বা মতাদর্শ প্রতিষ্ঠা করতে তারা পরিবার, সমাজ বা রাষ্ট্রের বিরুদ্ধেও অবস্থান নেয়। 

বাংলাদেশে উল্লেখযোগ্য কিছু জঙ্গি হামলা : একনজরে বাংলাদেশের উল্লেখযোগ্য কিছু জঙ্গি হামলার তথ্য নিচের তালিকায় তুলে ধরা হলো :

যশোরে উদীচী শিল্প গোষ্ঠী

১৯৯৯ সালের ৭ মার্চ

নিহত-১০, আহত-১০৬


রমনা পার্কের বটমূল, রমনা

২০০১ সালের ১৪ এপ্রিল

নিহত-১০, আহত-১০০+


ময়মনসিংহের ৩টি সিনেমা হলে

২০০২ সালের ৭ ডিসেম্বর

নিহত-১৮, আহত-৩০০ 


ঢাকার বঙ্গবন্ধু এভিনিউ

২০০৪ সালের ২১ আগস্ট

নিহত-২৩, আহত-৫০০+


সারাদেশে সিরিজ বোমা হামলা

২০০৫ সালের ১৭ আগস্ট 


নেত্রকোনায় উদীচী কার্যালয়ে

২০০৬ সালের ৮ ডিসেম্বর

নিহত-৮, আহত-৪৮ 


গুলশানের হলি আর্টিজেন স্প্যানিশ রেস্তোরাঁ 

২০১৬ সালের ৭ জুলাই

নিহত-২৮, আহত-৫০


শোলাকিয়া, কিশোরগঞ্জ

২০১৬ সালের ৭ জুলাই

নিহত-৩, আহত-একাধিক

জঙ্গিবাদ দমনে পুলিশের ভূমিকা : বাংলাদেশ পুলিশ বাহিনী দেশের আইন শৃঙ্খলা রক্ষা, জনগণের জানমাল ও সম্পদের নিরাপত্তা বিধান, অপরাধ প্রতিরোধ ও দমনে প্রধান ভূমিকা পালন করে থাকে। বিশেষ করে গত এক দশকে জঙ্গিবাদ দমন এবং নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশ পুলিশ দক্ষতার পরিচয় দিয়েছে। দেশে জঙ্গিবাদ দমনে বাংলাদেশ পুলিশের বীরত্ব এবং সাফল্য সারা বিশ্বের কাছে সুনাম অর্জন করেছে। সম্প্রতি বাংলাদেশ পুলিশ হলি আর্টিজেন রেস্তোরাঁ, শোলাকিয়া ঈদগাহ ময়দান, রাজধানীর কল্যাণপুর, আশকোনা, সিলেটের আতিয়া মহল, মৌলভীবাজার টঙ্গী, নারায়ণগঞ্জ, চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড ইত্যাদি জায়গায় জঙ্গিবাদ দমনে সফল হয়েছে। পুলিশ সদস্যরা তাদের উদ্ভাবনী ক্ষমতা আর পেশাদারিত্ব দিয়ে জঙ্গিবাদ মোকাবিলায় প্রতিনিয়ত সৃজনশীলতার পরিচয় দিচ্ছেন। জঙ্গি ও অপরাধ দমনে বাংলাদেশ পুলিশের সমর্থনে দেশের বিভিন্ন স্থানে জনসমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়েছে, যা এ বাহিনীর প্রতি সাধারণ মানুষের আস্থার নিদর্শন। ঘুষ-দুর্নীতির কারণে একসময়ে অভিযুক্ত এ বাহিনী তার পেশাদারিত্ব আর জনগণের প্রতি দায়িত্ববোধের পরিচয় দিয়ে জনগণের গর্বের বাহিনীতে পরিণত হয়েছে। জঙ্গিবাদ দমনে বাংলাদেশ পুলিশের ভূমিকা নিচে আলোচনা করা হলো : 

১. এসটিজি প্রতিষ্ঠা : জঙ্গিবাদ দমনে স্পেশাল টাস্কফোর্স গ্রুপ (এসটিজি) নামে পুলিশের নতুন একটি ইউনিট গঠন করেছে পুলিশ সদর দপ্তর। এ ইউটিন সারা দেশে জঙ্গিবাদ দমনে কাজ করে যাচ্ছে। পুলিশ সদর দপ্তরের কর্মকর্তারা বলেছেন, এসটিজি রংপুরে জাপানি নাগরিক কুনিও হোশি হত্যার রহস্য উদ্ঘাটন, দেশের বিভিন্ন স্থানে হামলায় জড়িত জঙ্গিদের গ্রেপ্তার এবং বিশিষ্ট ব্যক্তিদের হুমকিদাতা জঙ্গিদের গ্রেপ্তারে পুলিশের সংশ্লিষ্ট বিভাগকে সহায়তা করেছে। 

২. সিটিটিসি প্রতিষ্ঠা : সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ দমনে জিরো টলারেন্স নীতি অনুসরণ করে বাংলাদেশ পুলিশ ২০১৬ সালে কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিট (সিটিটিসি) গঠন করেছে। পুলিশের এ ইউনিট সারা দেশে জঙ্গিবাদ দমনে বিশেষ ভূমিকা পালন করছে। সাম্প্রতিক সময়ে পুলিশের এ বিশেষ শাখা জঙ্গিবাদ দমনে বেশ কিছু অপারেশনে সফল হয়েছে। 

৩. অ্যান্টি টেরোরিজম ইউনিট প্রতিষ্ঠা : সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ দমনে বাংলাদেশ পুলিশ ২০১৭ সালে অ্যান্টি টেরোরিজম ইউনিট নামে বিশেষ শাখা গঠন করে। পুলিশের এ ইউনিট সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ দমনে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। বিভিন্ন অপরাধ দমনেও পুলিশের এ শাখা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। 

৪. বাংলাদেশ পুলিশের প্রস্তাব : জননিরাপত্তা ও আইনশৃঙ্খলাবিষয়ক এক মতবিনিময় সভায় পুলিশের পক্ষ থেকে জঙ্গিবাদ দমনে প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের সমন্বয়ে জঙ্গিবাদবিরোধী কমিটি গঠনসহ বারটি প্রস্তাব দেয়া হয়। প্রস্তাবগুলো নিম্নরূপ : 
  • প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের সমন্বয়ে জঙ্গিবাদবিরোধী কমিটি থাকতে হবে। 
  • খেলাধুলা, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড, বিতর্ক প্রতিযোগিতার মতো সহশিক্ষা কার্যক্রম জোরদার করতে হবে। 
  • শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের যেসব স্থানে জঙ্গিবাদ নিয়ে বৈঠক হতে পারে, সে জায়গাগুলো চিহ্নিত করে নজরদারি বাড়াতে হবে। 
  • মসজিদে বা নামাজের স্থানে শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা বেশিক্ষণ অবস্থান করতে পারবেন না। 
  • শিক্ষার্থীরা অনিয়মিত হলে অবশ্যই অভিভাবকদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে হবে। 
  • লাইব্রেরিতে জঙ্গিবাদের কোনো বই-পুস্তক থাকলে তা পুড়িয়ে ফেলতে হবে। 
  • সন্ত্রাসবাদবিরোধী কর্মসূচিতে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের অংশ নিতে হবে। 
  • একাডেমিক কার্যক্রমেও জঙ্গিবাদবিরোধী বিষয় থাকতে হবে। 
  • নিয়মিতভাবে বাঙালি সাংস্কৃতিক চর্চা থাকতে হবে। 
  • যৌক্তিক কারণ ছাড়া কোনো শিক্ষার্থী অনুপস্থিত থাকলে পুলিশকে জানাতে হবে। 
  • অপরাধে জড়িত বলে সন্দেহ হলেই কাউন্সিলিংয়ের আওতায় আনতে হবে। 
  • শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সন্ত্রাসবাদবিরোধী গবেষণা করতে হবে। 
পরিশেষে বলা যায় যে, জঙ্গিবাদ দমনে বাংলাদেশ পুলিশ যে বারটি প্রস্তাব রেখেছে, তা সঠিকভাবে পালন করলে জঙ্গিবাদ দমন করা সম্ভব। জঙ্গি কর্মতৎপরতার কারণে একটি দেশের উন্নয়ন কর্মকাণ্ড ব্যাহত হতে পারে। তাছাড়া জঙ্গি কার্যক্রম আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে নানা প্রতিকূলতা সৃষ্টি করতে পারে। কাজেই জঙ্গিবাদকে জাতীয় সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করে পুলিশের পাশাপাশি জাতি, ধর্ম নির্বিশেষে সবাইকে এক সঙ্গে কাজ করতে হবে।

2 Comments

  1. সুন্দর আর্টিকেল

    ReplyDelete
  2. সুন্দর এবং প্রয়োজনীয়...

    ReplyDelete
Post a Comment
Previous Post Next Post