ভূমিকা : প্রবাসী শ্রমিক, রেমিট্যান্স ও বাংলাদেশের অর্থনীতি একই যোগসূত্রে গাঁথা। কারণ বৈদেশিক কর্মসংস্থান এবং প্রবাসীদের প্রেরিত অর্থ বেকার সমস্যা, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বৃদ্ধিসহ দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে ব্যাপক অবদান রাখছে। বিশ্বের বহু দেশে ছড়িয়ে আছে বাংলাদেশী শ্রমিক। বিশেষ করে আরব রাষ্ট্রসমূহে ও মধ্যপ্রাচ্যে। সাম্প্রতিক সময়ে আরব বিশ্বের অস্থিতিশীল রাজনীতি আর ভয়াবহ ভূমিকম্প ও সুনামির পর জাপানে পারমাণবিক সংকট বাংলাদেশের অর্থনীতিতে নেতিবাজক প্রভাব ফেলেছে। সংকুচিত হয়ে আসছে দেশের অর্থনীতির প্রাণ ভোমরা রেমিট্যান্স প্রবাহ। আরব দেশগুলোর বর্তমান পরিস্থিতির কারণে প্রায় লক্ষাধিক জনশক্তি দেশে ফিরে আসার পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। ফলে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে তাদের রেমিট্যান্স। ২০০৮ সালে শুরু হওয়া অর্থনৈতিক মন্দার রেশ কাটতে না কাটতে বিশ্ব অর্থনীতির নতুন এ সংকটে বাংলাদেশ ও বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলোর রেমিট্যান্স-নির্ভর অর্থনীতি এখন হুমকির সুখে পড়েছে।
বাংলাদেশের শ্রমবাজার : বিশ্বের অনেক দেশেই বাংলাদেশের শ্রমশক্তি রয়েছে। প্রতিবছর উল্লেখযোগ্য সংখ্যক বাংলাদেশি কাজের জন্য মধ্যপ্রাচ্যসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে গমন করে থাকে। তবে বাংলাদেশের প্রবাসী জনশক্তির অধিকাংশই সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, মালয়েশিয়া, কুয়েত, ওমান ও সিঙ্গাপুরে কর্মরত। এছাড়া বাহরাইন, লিবিয়া, কাতার, জর্ডান, লেবানন, ব্রুনাই, দক্ষিণ কোরিয়া, মরিসাস, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, আয়ারল্যান্ড ও ইতালিসহ অন্যান্য দেশেও বাংলাদেশি শ্রমশক্তি কর্মরত রয়েছে।
বাংলাদেশের রেমিট্যান্স চিত্র : ১৯৭৬ সালে সর্বপ্রথম জনশক্তি রফতানির মাধ্যমে দেশে রেমিট্যান্স প্রবাহ শুরু হয়। ঐ বছর মোট রেমিট্যান্স প্রাপ্তির পরিমাণ ছিল ৩৫.৮৫ কোটি টাকা। এরপর প্রতিবছরই উত্থান-পতনের মধ্য দিয়ে দেশের রেমিট্যান্স প্রবাহ ক্রমান্বয়ে এগিয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের মতে ২০১৭ – ২০১৮ অর্থবছরের দেশের রেমিট্যান্স প্রাপ্তির পরিমাণ ১৪.৯৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। রেমিট্যান্সের সিংহভাগ আসে মধ্যপ্রাচ্যের দেশসমূহ থেকে। এক্ষেত্রে কয়েক বছর যাবত এককভাবে সৌদি আরবের পরই আরব আমিরাতের অবস্থান। তৃতীয় অবস্থানে যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বব্যাংকের মাইগ্রেশন অ্যান্ড রেমিট্যান্সের ফ্যাক্ট বুক-২০১১ অনুযায়ী, ২০১০ সালে রেমিট্যান্স অর্জনে নিম্ন আয়ের দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান শীর্ষে যার পারিমাণ প্রায় ১১০০ কোটি ডলার এবং দক্ষিণ এশিয়ায় রেমিট্যান্স অর্জনে ভারতের পরই বাংলাদেশের অবস্থান।
আরব, মধ্যপ্রাচ্য সংকট ও বাংলাদেশের রেমিট্যান্স প্রবাহ : আরব বিশ্বজুড়ে এখন রাজনৈতিক সুনামি চলছে। সেই সুনামি আঘাত হানছে উত্তর আফ্রিকার মুসলিম দেশগুলোতে। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে এরই মধ্যে দেখা দিয়েছে ভয়াবহ রাজনৈতিক সংকট। আন্দোলনের ভয়ে তটস্থ আলজেরিয়া, জর্ডান, ইয়েমেন, মরক্কো, বাহরাইন, এমনকি সৌদি আরবও। প্রবাসী আয়ের শতকরা ৬০ শতাংশের বেশি আসে মধ্যপ্রাচ্যের দেশসমূহ থেকে। যেমন ২০১৭ – ২০১৮ অর্থবছরে প্রেরিত অর্থের পরিমাণ (মিলিয়ন মার্কিন ডলারে) ছিল সৌদি আরবের ২৫৯১.৫৮, আরব আমিরাত ২৪২৯.৯৬, কাতার ৮৪৪.০৬, ওমান ৯৫৮.১৯, বাহরাইন ৫৪১.৬২, কুয়েত ১১৯৯.৭০, মালয়েশিয়া ১১০৭.২১, যুক্তরাষ্ট্র ১৯৯৭.৪৯, সিঙ্গাপুর ৩৩০.১৬, যুক্তরাজ্য ১১০৬.০১ এবং অন্যান্য ৯৬৫.৩৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় শ্রমবাজার সৌদি আরব এবং মালয়েশিয়া। দুটি দেশেই জনশক্তি রফতানি বন্ধ ছিল। বর্তমানে এই বৃহৎ শ্রমবাজার চালু হয়েছে। যা বাংলাদেশের রেমিট্যান্স প্রবাহকে আরও গতিশীল করবে।
শ্রমবাজার সংকট, সম্ভাবনা ও করণীয় : দেশের সবচেয়ে বেশি বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের সেরা মাধ্যম জনশক্তি রফতানি বা প্রবাসী আয়। কিন্তু ক্রমবর্ধমান শ্রমবাজার সংকটহেতু জনশক্তি রফতানিতে ধ্বংস দেশের রেমিট্যান্স প্রবাহকে প্রতিনিয়তই স্থবির করে তুলছে। প্রায় তিন বছর ধরে জনশক্তি রফতানির নিম্নমুখী প্রবণতা রয়েছে। বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দা, বিদেশে মানুষরূপী অমানুষদের পদচারণ ও অপতৎপরতায় বাংলাদেশিদের ভাবমূর্তি সংকট, দক্ষ শ্রমিকের অভাব এবং বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশের জনশক্তি রফতানি বন্ধ হয়ে যাওয়া এবং কূটনৈতিক তৎপরতার অভাবসহ নানাবিধ কারণ এর পেছনে জড়িত। সাম্প্রতিক সময়ে লিবিয়া এবং মধ্যপ্রাচ্য ও আরব বিশ্বে রাজনৈতিক সংকটে রিক্ত নিঃস্ব হয়ে প্রবাসী শ্রমিকদের দেশে ফিরে আসার প্রবণতায় দেশের রেমিট্যান্স প্রবাহ যোগ করেছে সংকটের নতুন মাত্রা। ফলে দক্ষিণ এশিয়ার দ্বিতীয় বৃহত্তম প্রবাসী আয় বা রেমিট্যান্স অর্জনকারী দেশ হয়েও হুমকির মুখে দাঁড়িয়ে বাংলাদেশ। অথচ জাতীয় অর্থনীতিতে অসামান্য অবদান রাখা এ বৃহৎ খাতটির স্থবিরতা দূর করা প্রয়োজন সবার আগে। এক্ষেত্রে যথেষ্ট সুযোগও রয়েছে বাংলাদেশের। মধ্যপ্রাচ্যের শ্রমবাজারে চাহিদার ভাটা পড়লেও পূর্ব এশিয়াসহ বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলের অর্থনৈতিকভাবে অনেক এগিয়ে যাওয়া দেশগুলোতে দক্ষ ও অদক্ষ জনবলের ব্যাপক ঘাটতি রয়েছে। এসব অঞ্চলে বাংলাদেশের জনশক্তি রফতানিকে সহায়তা দিয়ে মধ্যপ্রাচ্যে শ্রমবাজারের যে ধাক্কা লেগেছে তা পূরণ করা সম্ভব। এছাড়া আফ্রিকা মহাদেশ ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলোতে জনশক্তি রফতানির সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে। এক্ষেত্রে নতুন করে শ্রমবাজার পাওয়ার উজ্জ্বল সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে বাংলাদেশের সামনে। এখন প্রয়োজন দ্রুত কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ। ২০২২ সালে বিশ্বকাপ ফুটবলের আয়োজক দেশ কাতারে নির্মাণ শিল্পে বাংলাদেশিদের কাজ পাওয়ার সুযোগ রয়েছে। সামগ্রিকভাবে সংকটময় পরিস্থিতিতে দেশের জনশক্তি রফতানি বৃদ্ধির মাধ্যমে প্রবাসী আয়ের ঊর্ধ্বমুখী গ্রাফ ধরে রাখার যথেষ্ট সম্ভাবনা বিদ্যমান বাংলাদেশের সামনে। এক্ষেত্রে এ সম্ভাবনাকে কাজে লাগানোর পাশাপাশি বিদেশে বাংলাদেশের বন্ধ হয়ে যাওয়া শ্রমবাজার উন্মুক্ত করার জন্য জোর কূটনৈতিক প্রচেষ্টা ও কার্যকরী উদ্যোগ গ্রহণ জরুরি।
উপসংহার : উপরোক্ত আলোচনার প্রেক্ষিতে বলা যায় যে, বাংলাদেশের শ্রম বাজার এক বিশাল সম্ভাবনাময় খাত। এ খাত থেকে বাংলাদেশ প্রতিবছর প্রচুর রেমিট্যান্স পেয়ে থাকে, যা বাংলাদেশের অর্থনীতিতে ব্যাপক অবদান রাখে। তাই বাংলাদেশের শ্রমবাজারের সমস্যাসমূহ চিহ্নিত করে তা সমাধানের আশু ব্যবস্থা গ্রহণ করা জরুরি।