↬ জ্বালানি সংকট ও বিকল্প শক্তি
↬ শক্তি : বিভিন্ন উৎস
↬ জ্বালানি সংকট ও নিরসনে নানান ভাবনা
ভূমিকা : ১৬ মার্চ ২০১৮ জাতিসংঘের উন্নয়ননীতি সংক্রান্ত কমিটি (CDP) কর্তৃক বাংলাদেশ আনুষ্ঠানিকভাবে স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উত্তরণের সকল মানদণ্ড পূরণের স্বীকৃতি লাভ করে। ২০২১ সালে বাংলাদেশকে মধ্যম আয়ের দেশ উন্নীত করার পরিকল্পনা হয়েছে সরকারের। এ লক্ষ্য অর্জনের জন্য দেশের অর্থনীতিকে আরও এগিয়ে নেয়ার কোনো বিকল্প নেই। প্রতি বছর বাংলাদেশে প্রায় ২২ লাখ তরুণ শ্রম বাজারে আসছে। দেশে কর্মসংস্থান বৃদ্ধি জনগণের জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন, দারিদ্র্য বিমোচন, মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি, অবকাঠামোগত উন্নয়নে সবার আগে প্রয়োজন সরকারি ও বেসরকারি খাতে ব্যাপক হারে বিনিয়োগ বৃদ্ধি। দেশে বিনিয়োগ বৃদ্ধি এবং অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি অব্যাহত রাখতে সবার আগে প্রয়োজন জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। দেশে বর্তমানে জ্বালানি সংকট বিদ্যমান থাকলেও সরকার সফলতার সাথে এ সংকট মোকাবেলা করে জ্বালানি নিরাপত্তা বিধানে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছে। জ্বালানি সংকট নিরসনে সরকার স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি বিভিন্ন পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে।
জ্বালানি নিরাপত্তা ও বিশ্ব : জ্বালানি নিরাপত্তার সাথে অর্থনীতি সম্পর্কিত। উন্নত বিশ্বের দেশগুলো জ্বালানি নিরাপত্তার জন্য বহু বছর ধরে কাজ করছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাস ও আলাস্কায় জ্বালানি তেলের বিশাল ভাণ্ডার থাকা সত্ত্বেও তারা জ্বালানি তেলের জন্য মেক্সিকো, কানাডা, ভেনিজুয়েলা, মধ্যপ্রাচ্য এবং অন্যান্য তেলসমৃদ্ধ দেশের উপর নির্ভর করছে। ইউরোপের দেশগুলো রাশিয়ার প্রাকৃতিক গ্যাসের উপর নির্ভর করছে। এছাড়াও জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য বর্তমানে বিশ্বের অধিকাংশ দেশ নবায়নযোগ্য শক্তির দিকে ঝুঁকছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর পরাশক্তিগুলো নিজেদের জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে তেলসমৃদ্ধ দেশগুলোতে নানা ধরনের কূটকৌশল প্রয়োগ করছে। তাই জ্বালানি নিরাপত্তার বিষয়টি বিশ্বব্যাপী বর্তমান সময়ে একটি আলোচিত বিষয়।
বাংলাদেশে জ্বালানি নিরাপত্তার পত্তন : সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙ্গালি, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭৫ সালের ৯ আগস্ট বিদেশি তেল কোম্পানি ‘শেল ওয়েল’ হতে ৫টি গ্যাসক্ষেত্র (তিতাস, হবিগঞ্জ, রশিদপুর, কৈলাশটিলা ও বাখরাবাদ) ক্রয় করে এগুলোর উপর রাষ্ট্রীয় মালিকানা প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৭৫ সালের ১৪ মার্চ The ESSO Undertakings Acquisition Ordinance, 1975 এর মাধ্যমে বাংলাদেশে অবস্থিত যুক্তরাষ্ট্রের ESSO Eastern Inc.-কে সরকারিভাবে গ্রহণ করে জ্বালানি তেল মজুদ, সরবরাহ ও বিতরণে যুগান্তকারী পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। জাতির পিতার এ অবিস্মরণীয় ও দূরদর্শী সিদ্ধান্তের ফলে দেশে জ্বালানি নিরাপত্তার গোড়াপত্তন ঘটে। যেই যুগান্তকারী ও দূরদর্শী সিদ্ধান্তের ধারাবাহিকতায় বর্তমান সরকার ঘোষিত রূপকল্প-২০২১ (মধ্যম আয়ের দেশ) ও রূপকল্প-২০৪১ (উন্নত দেশের মর্যাদা) অর্জনে জ্বালানির চাহিদা পূরণ নিশ্চিত করতে জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগ এবং এর আওতাধীন প্রতিষ্ঠানসমূহ নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বর্তমান সরকার এক দশকে অব্যাহতভাবে মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি উচ্চপ্রবৃদ্ধি এবং আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের সকল ক্ষেত্রে নব দিগন্তের সূচনা করেছে। জিডিপির প্রবৃদ্ধির হার এখন ৮.১৩ শতাংশ। এসব কিছু অর্জনের পেছনে ক্রমবর্ধমান জ্বালানি চাহিদা পূরণ ও নিরবচ্ছিন্ন জ্বালানি সরবরাহ নিয়ামক হিসেবে কাজ করেছে।
জ্বালানি নিরাপত্তায় সরকারের গৃহীত পদক্ষেপ : বাংলাদেশে ক্রমবর্ধমান জ্বালানি তেলের চাহিদা পূরণ ও জ্বালানি নিরাপত্তার লক্ষ্যে বর্তমান সরকার নানাবিধ প্রকল্প গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করে যাচ্ছে। সরকারের এ অভীষ্ঠ লক্ষ্য অর্জনে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন দপ্তর, অধিদপ্তর এবং বিভিন্ন ইনস্টিটিউট কাজ করে যাচ্ছে। এছাড়া সরকার জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য ২০১৫ সালে ‘জ্বালানি নিরাপত্তা তহবিল’ গঠন করেছে।
প্রাকৃতিক গ্যাস : বাংলাদেশের অন্যতম জ্বালানি সম্পদ হলো প্রাকৃতিক গ্যাস। দেশের বিদ্যুৎ উৎপাদন, সার-কারখানা, শিল্প প্রতিষ্ঠান, বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান, সিএনজি এবং গৃহস্থালির কাজে প্রচুর পরিমাণে প্রাকৃতিক গ্যাস ব্যবহৃত হচ্ছে। বর্তমানে প্রাকৃতিক গ্যাস দেশের মোট বাণিজ্যিক জ্বালানি ব্যবহারের প্রায় ৭১ শতাংশ পূরণ করে। দেশে এখন আবিষ্কৃত গ্যাস ক্ষেত্রের সংখ্যা ২৭টি। পেট্রোবাংলা কর্তৃক সর্বশেষ প্রাক্কলন অনুযায়ী দেশে মোট গ্যাস মজুদের পরিমাণ ৩৯.৮ ট্রিলিয়ন ঘনফুট এবং উত্তোলনযোগ্য মজুদের পরিমাণ ২৭.৮১ ট্রিলিয়ন ঘনফুট। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে বাংলাদেশে গ্যাস উৎপাদিত হয়েছে ৯৬৮.৭ বিলিয়ন ঘনফুট (অর্থনৈতিক সমীক্ষা ২০১৯)। দেশের ক্রমবর্ধমান বিদ্যুৎ চাহিদার সাথে প্রাকৃতিক গ্যাসের চাহিদাও বৃদ্ধি পাচ্ছে। গ্যাস সঞ্চালন ক্ষমতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে হবিগঞ্জ জেলার মুচাই ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার আশুগঞ্জ এবং টাঙ্গাইল জেলার এলেঙ্গাতে গ্যাস কম্প্রেসর স্টেশন স্থাপন করা হয়েছে। ২০২১ সালের মধ্যে বিভিন্ন গ্যাসক্ষেত্রে ৩১টি উন্নয়ন কূপ খনন, ২২টি কূপের ওয়ার্কওভার এবং ৫৯টি অনুসন্ধান কূপ খননের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন কার্যক্রম চলছে। বর্তমানে অগভীর সমুদ্রের ৩টি ব্লকে এবং গভীর সমুদ্রের ১টি ব্লকে ৫টি আন্তর্জাতিক তেল কোম্পানি একক ও যৌথভাবে দেশে তেল গ্যাস অনুসন্ধানে নিয়োজিত রয়েছে। দেশে তেল, গ্যাসের ক্রমবর্ধমান চাহিদা পূরণের লক্ষ্যে বর্তমান সরকার গ্যাসের দৈনিক উৎপাদন ২,৭৪৪ মিলিয়ন ঘনফুট হতে ২,৭৫০ মিলিয়ন ঘনফুটে উন্নীত করেছে। ৮৬২ কিমি গ্যাস সঞ্চালন পাইপ লাইন নতুন নির্মিত হয়েছে। বর্তমানে বাংলাদেশে বছরে আট লাখ টন এলপিজি ব্যবহৃত হচ্ছে। আগামী ২০২০ সালের মধ্যে ৭০ শতাংশ আবাসিক গ্যাসের চাহিদা এলপিজি দিয়ে মেটানোর পরিকল্পনা রয়েছে সরকারের।
এলএনজি আমদানি : ভবিষ্যতে বিনিয়োগ বৃদ্ধির কারণে প্রাকৃতিক গ্যাসের চাহিদা ও সরবরাহের পার্থক্য আরও বেশি হবে। এ প্রেক্ষাপটে বর্তমান সরকার দেশীয় প্রাকৃতিক গ্যাসের বিকল্প হিসেবে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস আমদানি করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে। সরকার রূপকল্প-২০২১ ও রূপকল্প-২০৪১ এবং এসডিজির লক্ষ্যমাত্রা অর্জন এবং সপ্তম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা বাস্তবায়নে ও জিডিপির প্রবৃদ্ধির ধারাবাহিকতা নিশ্চিত করতে জিটুজি ভিত্তিতে এলএনজি আমদানি করছে। এলএনসি আমদানির লক্ষ্যে ইতোমধ্যে মহেশখালীতে দৈনিক প্রায় ১০০০ মিলিয়ন ঘনফুট ক্ষমতাসম্পন্ন দুটি ভাসমান সংরক্ষণাগার ও পুনঃগ্যাসায়ন ইউনিট স্থাপন করা হয়েছে, যার মাধ্যমে দৈনিক প্রায় ৬৫০ মিলিয়ন ঘনফুট এলএনজি জাতীয় গ্রিডে যুক্ত হচ্ছে।
কয়লা : দেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের রংপুরের খালাশপীর, দিনাজপুরের বড়পুকুরিয়া, ফুলবাড়ি ও দীঘিপাড়ায় এবং বগুড়ায় জামালগঞ্জে মোট ৫টি কয়লাক্ষেত্র আবিষ্কৃত হয়েছে। এসব কয়লাক্ষেত্রে কয়লার মোট মজুদের পরিমাণ ৭,৯৬২ মিলিয়ন টন। মজুদকৃত কয়লা থেকে ডিসেম্বর ২০১৮ পর্যন্ত আনুমানিক ১০.৪০ মিলিয়ন টন কয়লা উত্তোলন করা হয়। সুষ্ঠু পরিকল্পনার মাধ্যমে কয়লাক্ষেত্রসমূহ থেকে কয়লা উত্তোলন করা গেলে তা বিদ্যুৎ উৎপাদনে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখবে। ফলে ভবিষ্যতে প্রাকৃতিক গ্যাসের উপর নির্ভরতা কমে আসবে। সে বিবেচনাতেই বড়পুকুরিয়া কয়লা খনি থেকে কয়লা উত্তোলন করে তা বড়পুকুরিয়া বিদ্যুৎকেন্দ্রে সরবরাহ করা হচ্ছে।
জ্বালানি তেল : বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশন (বিপিসি) জ্বালানি তেল আমদানি, অভ্যন্তরীণ সংগ্রহ, মজুদ ও বিপণন কার্যক্রম পরিচালনা করে। বর্তমানে দেশে জ্বালানি তেলের মজুদ প্রায় ১৩.২৭ লক্ষ মেট্রিক টন। ২০০৯-২০০১৮ সময়ে দেশের অর্থনীতির চালিকাশক্তি তরল জ্বালানি সুষ্ঠু নিরবচ্ছিন্নভাবে সরবরাহ নিশ্চিত করা হয়েছে। ফলে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলেও জ্বালানি তেল সরবরাহে কোনো সংকট বা প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হয়নি। দেশের উত্তর-পূর্ব অঞ্চলে প্রাপ্ত গ্যাস কনডেনসেট সমৃদ্ধ হওয়ায় এ অঞ্চলের অধিকাংশ গ্যাসক্ষেত্রে শুরু থেকেই ফ্রাকসনেশন প্লান্টে কনডেনসেট প্রক্রিয়াকরণ করে পেট্রোল, ডিজেল ও কেরোসিন জাতীয় পেট্রোলিয়াম পদার্থ উৎপাদন করা হচ্ছে। পেট্রোবাংলার সাথে চুক্তিবদ্ধ বিভিন্ন কোম্পানির মাধ্যমে ২০১৭-১৮ (মার্চ পর্যন্ত) অর্থবছরে ৬৬,১৮০ ব্যারেল পেট্রোল, ২,৬২,৭৭৩ ব্যারেল ডিজেল, ৫৭,৫৬২ ব্যারেল কেরোসিন এবং ৪,১৩৭ ব্যারেল এলপিজি উৎপাদন করা হয়েয়ে।
জ্বালানি তেল আমদানির উৎস বহুমুখী করার লক্ষ্যে বর্তমানে ৫০ শতাংশ তেল জিটুজি ভিত্তিতে ১১টি দেশ থেকে এবং ৫০ শতাংশ তেল টেন্ডারের মাধ্যমে ক্রয় করা হচ্ছে। দেশের জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণে চট্টগ্রামের ইস্টার্ন রিফাইনারির একটি নতুন ইউনিট স্থাপনের পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে সরকার। গভীর সমুদ্র থেকে সরাসরি পাইপ লাইনের মাধ্যমে দ্রুত, সহজ, নিরাপদ ও ব্যয় সাশ্রয়ীভাবে শোধিত ও অপরিশোধিত জ্বালানি তেল খালাসের জন্য সরকার কুতুবদিয়ার নিকট Single Point Moorning with Double Pipeline (SPM) স্থাপনের প্রকল্প গ্রহণ করেছে। চট্টগ্রাম থেকে ঢাকা পর্যন্ত জ্বালানি তেল পরিবহনের জন্য পাইপ লাইন নির্মাণের কাজ চলছে। এছাড়াও উড়োজাহাজের জ্বালানি তেল পরিবহনের জন্য পিতলগঞ্জ হতে কুর্মিটোলা এভিয়েশন ভিপো পর্যন্ত জেট ফুয়েল পাইপ লাইন নির্মাণ করা হচ্ছে।
নবায়নযোগ্য জ্বালানি : জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ৭.৮% অর্জনের জন্য সরকার ২০২০ সালের মধ্যে মোট উৎপাদিত বিদ্যুতের ১০% নবায়নযোগ্য জ্বালানি থেকে উৎপাদনের লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে। ১৯৬২ সালে চট্টগ্রামের কাপ্তাইয়ে কর্ণফুলী নদীর উপর দেশের প্রথম পানি বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহার শুরু হয়।
নবায়নযোগ্য জ্বালানি থেকে পরিবেশবান্ধব বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য সরকার ‘নবায়নযোগ্য জ্বালানি নীতিমালা’ প্রণয়ন করেছে। এ নীতিমালা ২০০৯ সাল থেকে কার্যকর হয়েছে। নবায়নযোগ্য জ্বালানি কার্যক্রম পরিচালন, পরিকল্পনা প্রণয়ন, বাস্তবায়ন, সম্প্রসারণ এবং এ সংক্রান্ত কার্যক্রম তদারকির জন্য সরকার Sustainable and Renewable Energy Development Authority (SREDA) গঠন করেছে। নবায়নযোগ্য জ্বালানি প্রকল্প বাস্তবায়নকারী এবং বিনিয়োগকারীদের সরকার বিভিন্ন প্রকার প্রণোদনা প্রদান করছে।
সরকারি আর্থিক প্রতিষ্ঠান যেমন-
বাংলাদেশ ব্যাংক, ইডকল এবং বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকের মাধ্যমে অর্থায়ন কার্যক্রম সম্প্রসারণ করা হয়েছে।
নবায়নযোগ্য জ্বালানি থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ্যে পাবনার রূপপুরে নির্মিতব্য রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত একটি খাত। এ বিদ্যুৎ প্রকল্পের মাধ্যমে ২০২৩ সালে ১,২০০ মেগাওয়াট এবং ২০২৪ সালে আরও ১,২০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে সরবরাহ করা সম্ভব হবে।
উপসংহার : মানুষের জীবন ধারণের জন্য খাদ্য, পানি, বায়ু, আবাসন যেমন অপরিহার্য তেমনি বিদ্যুৎ ও জ্বালানিও অপরিহার্য। যে কোনো দেশের অর্থনীতি সরাসরি জ্বালানি নিরাপত্তার উপর নির্ভরশীল। জ্বালানি নিরাপত্তার উপর বিনিয়োগ পরিস্থিতি নির্ভর করে। জ্বালানি নিরাপত্তার অভাবে কোনো দেশে কাঙ্ক্ষিত বিনিয়োগ হয় না। ফলে অর্থনীতি ভঙ্গুর হয়ে পড়ে। পর্যাপ্ত কর্মসংস্থান সৃষ্টি না হওয়ায় জনগণ বেকার হয়ে পড়ে। তাই বর্তমান সরকার রূপকল্প ২০২১, টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা এবং রূপকল্প ২০৪১ বাস্তবায়নের জন্য জ্বালানি নিরাপত্তার ওপর সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব প্রদান করছে।
[ একই রচনা আরেকটি বই থেকে সংগ্রহ করে দেয়া হলো ]
ভূমিকা : বাংলাদেশের মত অনুন্নত দেশসহ, বিশ্বজুড়েই চলেছে এক ভয়াবহ জ্বালানি-সংকট, তথা শক্তি সংকট। শক্তিই মানব সভ্যতার অগ্রগতির কেন্দ্রবিন্দু। মানুষের সমস্ত সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য, সমৃদ্ধির মূলে শক্তির অবদান অতুলনীয়। শক্তির ওপরই নির্ভর করছে মানব সভ্যতার অস্তিত্ব। শক্তির উৎস বা জ্বালানি নিয়ে মানুষের ভাবনার অন্ত নেই, কারণ প্রকৃতি প্রদত্ত শক্তির উৎস ক্রমাগত ব্যবহারে যত সংকুচিত হয়ে আসছে, ভবিষ্যতের জ্বালানি-সংকটের দুশ্চিন্তা মানুষকে তত ভাবিয়ে তুলছে, তাই বিভিন্ন রাষ্ট্রের মধ্যে শক্তি-উৎসকে ঘিরে চলছে দরকষাকষি ও রেষারেষি।
জ্বালানির উৎস : শক্তি এমনই একটি জিনিস যার বিনাশ নেই, যা সৃষ্টিও করা যায় না। কেবল ঘটানো যায় শক্তির রূপান্তর। প্রকৃতপক্ষে জড়ই শক্তি। আজ পর্যন্ত যত প্রকার শক্তি মানুষের করায়ত্ত হয়েছে তা সম্ভব হয়েছে জড় পদার্থকে নির্দিষ্ট শক্তিতে রূপান্তরিত করার কলাকৌশলের মধ্যস্ততায়। শক্তির উৎস বিবিধ। তাদের মধ্যে আমাদের কাছে অতি পরিচিত হচ্ছে কয়লা, টেট্রোলিয়াম, প্রাকৃতিক গ্যাস প্রভৃতি। এগুলো আমাদের কাছে জ্বালানি বলেও গণ্য। তাছাড়া পানি, সূর্যরশ্মি, জ্বালানি কাঠ, প্রাণী-বিষ্ঠা, পাওয়ার অ্যালকোহল, বাতাস, সমুদ্রের জল প্রভৃতিও অন্যান্য শক্তির-উৎস।
জ্বালানি সংকটের কারণ : কেন এই জ্বালানি সংকট? আমরা জানি, কয়লা ও গ্যাস অন্যতম জ্বালানি-উৎস। শিল্পে, পরিবহনে, রান্নার কাজে প্রচুর কয়লা ও গ্যাস ব্যবহৃত হয়। এছাড়া বিভিন্ন গ্যাস অপচয় হয় প্রচুর পরিমাণে। সামান্য একটা দেয়াশলাইর কাঠি বাঁচাতে অপরিণামদর্শী জনগণ গ্যাসের চুলা জ্বালিয়ে রাখে ঘণ্টার পর ঘণ্টা। এতে বিপুল পরিমাণ গ্যাসের অপচয় হয়। এভাবে ব্যয়ের হার অব্যাহত থাকলে এবং অপচয় রোধ করা সম্ভব না হলে কয়েক দশক পরেই কয়লা ও গ্যাস হবে অতীত ইতিহাসের বস্তু। কারণ ব্যয়ের সাথে পাল্লা দিয়ে সৃষ্টির ক্ষমতা মানুষের আদৌ নেই, তাই ক্রমশ ঘনীভূত হচ্ছে জ্বালানি-সংকট। প্রকৃতির সীমিত সঞ্চয়ের ব্যয়জনিত ঘাটতি পূরণের অক্ষমতাই মানুষকে শক্তি-উৎস সম্পর্কে চিন্তান্বিত করছে সর্বাধিক।
বিবিধ বিকল্প শক্তির উৎস : জ্বালানি-সংকটের ভয়াবহতা থেকে পরিত্রাণের উদ্দেশ্যে বিশ্বজুড়ে চলেছে বিকল্প শক্তি-উৎসের সন্ধান। এ নিয়ে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক শক্তি সম্মেলনে বিশ্বের বিজ্ঞানীরা সংকট সমাধানের উদ্দেশ্যে পারস্পরিক সহযোগিতার ওপর গুরুত্ব নিয়ে চৌদ্দটি বিকল্প শক্তি উৎসের কথা বলেছেন। সেগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল সৌরশক্তি, বায়ুশক্তি, পরমাণুশক্তি, জোয়ার-ভাটা থেকে প্রাপ্ত শক্তি, ভূ-তাপীয় শক্তি, সাগরের তাপীয় শক্তি, গোবল গ্যাস-প্রভৃতি। আমাদের মত গরিব দেশের পক্ষে ভূ-তাপীয় শক্তি, পরমাণু শক্তি, তরঙ্গ শক্তি, জোয়ার-ভাটা থেকে প্রাপ্ত শক্তির উৎসগুলো থেকে শক্তি সৃষ্টি সম্ভবপর নয়, কারণ তা অত্যন্ত ব্যয়বহুল। সৌরশক্তি, বায়ুশক্তি, জ্বালানি বোষ, স্বল্প উচ্চতার হেড, গোবর গ্যাস প্রভৃতি শক্তি-উৎসগুলো অপেক্ষাকৃত কম ব্যয়সাধ্য এবং এগুলোর ওপর দৃষ্টি নিবন্ধ করলে দেশ উপকৃত হবে।
সৌরশক্তি : প্রথমেই উল্লেখ করতে হয় সৌরশক্তির। মৌসুমি বায়ুর প্রবাহে জুনের মাঝামাঝি সময় থেকে সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত বর্ষণের প্রকোপ থাকলেও বছরের অবশিষ্ট দিনগুলো প্রায়ই মেঘমুক্ত রৌদ্রকরোজ্জ্বল থাকে। সুতরাং, সূর্যরশ্মি অফুরন্ত এবং জ্বালানির অভাব ঘোচাতে সূর্যরশ্মি বিশেষভাবে সাহায্য করতে পারে। সোলার সেল বা সৌরকোষের মাধ্যমে সূর্যরশ্মি তাড়িৎশক্তিতে রূপান্তরিত হয়ে ব্যবহারপযোগী হতে পারে। তাছাড়া সূর্যের আলো সোলার কুকারের মাধ্যমে রান্নার কাজে সাহায্য করে জ্বালানি সরবরাহে সহায়ক হতে পারে।
বায়ুশক্তি : আদিম মানুষ যে বাতাসকে ভয় পেতে, সভ্যতার বিকাশের সাথে সে বাতাসকে শক্তি হিসেবে ব্যবহার করে মানুষ কাজে লাগাতে শিখল। চার-পাঁচটা পাখার সাহায্যে তৈরি চক্রকে প্রবাহিত বাতাসের মুখোমুখি ধরে ঘূর্ণায়মান চক্রের দণ্ডের সঙ্গে বিশেষ কৌশলে দড়ি বেঁধে কুয়ো থেকে জল তুলে চাষ-আবাদ করতে লাগল। পরে আখ মাড়াই, গম ভাঙানো, ধান কাটা নানান কাজে বায়ুশক্তির ব্যবহার ব্যাপকতা পেল। এই হাওয়া কল বা বায়ু-যন্ত্র, যার ইংরেজি নাম ‘উইন্ড মিল’ পৃথিবীর বহু দেশেই, বিশেষ করে যারা সারা বছর একই দিকে থেকে প্রবাহিত বায়ু-স্রোতের ভিতর বাস করে, তারা বৃহত্তর কাজে লাগিয়ে শক্তির বিকল্প বিসেবে ব্যবহার করছে।
অন্যান্য শক্তি-উৎস : ভূ-তাপীয় শক্তিও জ্বালানির বিকল্প উৎসরূপে ব্যবহার্য। পৃথিবীর অভ্যন্তরভাগ খুবই উত্তপ্ত। অনেক সময় প্রস্রবণের জলের থেকে বেরিয়ে আসে উত্তপ্ত ম্যাগমা। ফলে এই জল থেকে পাওয়া যায় প্রচুর তাপশক্তি। এরই নাম ভূ-তাপীয় শক্তি। ভূ-তাপীয় শক্তিকে সরাসরি রূপান্তরিত করে পাওয়া যায় বিদ্যুৎশক্তি। এদেশে গোবর গ্যাস প্রকল্প খুবই জনপ্রিয়। গোবরের যোগান এই প্রকল্পের কাঁচামাল। ঘরে আলো জ্বালাতে ও রান্নার জ্বালানি হিসেবে গোবর গ্যাস খুবই উপযোগী। জলবিদ্যুৎশক্তি ও পরমাণুশক্তির ব্যবহার ও আধুনিক মানুষের কাছে সুপরিচিত।
উপসংহার : প্রচলিত শক্তি উৎসগুলোর ক্ষীয়মাণ সংকোচন নতুন নতুন উৎস সন্ধানে প্রয়াসী মানুষকে দুশ্চর গবেষণায় করেছে ধ্যানস্থ। কথায় বলে প্রয়োজনের তাগিদই আবিষ্কারের দ্বার দেয় খুলে। নিরন্তর শ্রম, সাধনা ও নিরলস গবেষণা ভবিষ্যতে এমন কোনো অফুরান শক্তি-উৎসের সিংহদ্বার হয়ত মানুষের কাছে উদ্ঘাটিত করবে যখন জ্বালানি-সংকটের দুশ্চিন্তা তাকে আর এমন করে উদ্ভ্রান্ত ও বিব্রত করবে না।