রহস্যময় কামরূপ কামাখ্যা নিয়ে কিছু কথা

কামরূপ 

কামরূপ জনপদ ব্রহ্মপুত্র উপত্যকা এবং তৎসংলগ্ন এলাকার সমন্বয়ে গঠিত ছিল। প্রাচীনকালে এর নাম ছিল প্রাগজ্যোতিষ। বর্মণ রাজবংশ, মলেচ্ছা রাজবংশ এবং পাল রাজবংশ দ্বাদশ শতাব্দী পর্যন্ত রাজ্যটি শাসন করে। এরপর কিনা খেন রাজবংশের শাসনামলে রাজধানী আরও পশ্চিমে সরিয়ে নিয়ে যায় এবং রাজ্যের নামকরণ করে কামতা রাজ্য। কামরূপ জনপদের নাম আজও আসামের কামরূপ জেলার মধ্য দিয়ে বেঁচে আছে। 

নামকরণ 

‘কামরূপ’ শব্দটি অস্ট্রিক শব্দ ‘কামরূ’ বা ‘কামরূত’ থেকে এসেছে। সাঁওতালি ভাষায় এটি তাৎপর্যহীন দেবতার নাম, যার দ্বারা যাদুবিদ্যা ও জ্যোতির্বিদ্যা বোঝায়। অসমাীয় গবেষক বি. কে. কাকাতীর মতানুসারে, এ শব্দ নতুন ধর্মীয় প্রথা মাতৃদেভী কামাখ্যার উপাসনার প্রতি ইঙ্গিত দেয়। তিনি আরও মন করেন যে, কামাখ্যা শব্দটি অস্ট্রিক শব্দ যা পুরানো খেমার শব্দ ‘কামোই’ (দৈত্য), চাম শব্দ ‘কামত’ (প্রেত), খাসী শব্দ, ‘কামেৎ’ (মরদেহ), সাঁওতালি ভাষার কামিন (সমাধি) অথবা কোমৌচ (মরদেহ) শব্দ থেকে এসেছে। আরেকটি ব্যাখ্যানুযায়ী কামক্ষ বা কামল্খীর সংস্কৃতায়িত গঠন হলো কামাখ্যা। এটি প্রাচীন আসামের মঙ্গোলীয় উপজাতির একটি দেবী। কামরূপ শব্দের উৎস সম্পর্কে অবশ্য একটি লোকপ্রিয় উপাখ্যানের সূত্র নির্দেশ করা হয়। সূত্রটি গোপথ ব্রাহ্মণে বর্ণিত দেবতা শিবের অগ্নি দৃষ্টিতে ধ্বংসপ্রাপ্ত কামদেবের কামরূপ পুনর্জন্মের গল্প নির্দেশ করে। কালিকাপুরাণ অনুসারেও কামাখ্যা শব্দের উৎপত্তি কামরূপ সীমানার মধ্যে সতীর জননেন্দ্রিয় পতিত হওয়ার সাথে জড়িত। 

অবস্থান ও সীমা 

পুরাণ এবং তন্ত্র সাহিত্যে কামরূপ বা প্রাগজ্যোতিষ-কামরূপের সীমানা সুস্পষ্টভাবে উল্লিখিত হয়েছে। ‘কালিকাপুরাণে’ এর অবস্থান কারতোয়া নদীর পূর্বে ত্রিভুজাকৃতি বলা হয়েছে, যার দৈর্ঘ্য ১০০ যোজন ও প্রস্থ ৩০ যোজন (১ যোজন = ১২.৩ কিমি) এবং এর পূর্বদিকে দিক্কারবাসিনী (আধুনিক দিকরাই নদী) পরিবেষ্টিত ছিল। অন্যদিকে ‘যোগিনী তন্ত্র’ পুরো কামরূপকে ‘রত্নপীঠ’, ‘ভদ্রপীঠ’, ‘সৌমর পীঠ’ এবং ‘কামপীঠ’ নামে বিভক্ত করেছে এবং এর সীমানা উত্তর দিকে কাঞ্জ পাহাড়, পূর্ব দিকে পবিত্র নদী দীক্ষু (সাদিয়ায় আধুনিক দিবাং), পশ্চিমে করতোয়া এবং দক্ষিণ দিকে লক্ষ (আধুনিক লখ্যা) ও ব্রহ্মপুত্র নদের মিলিত প্রবাহকে নির্দেশ করেছে। এটা সত্য যে, প্রতিবেশী শক্তিসমূহের সংঘাতের ফলে করতোয়া নদীর সন্নিহিত পশ্চিম সীমানার পরিবর্তন ঘটেছে। 

এক সময় কামরূপ রাজ্যে বর্তমান ব্রহ্মপুত্র উপত্যকা, ভুটান, কোচবিহার বা কুচবিহার, রংপুর এং বেশ কিছু সুন্নিহিত অঞ্চল অন্তর্ভুক্ত ছিল। সীমানার এ পরিবর্তনের সাথে মহাভারতে (স্ত্রীপর্ব) বর্ণিত ঘটনার সামঞ্জস্য লক্ষ্য করা যায়। মহাভারতের বর্ণনানুযায়ী প্রাগজ্যোতিষের রাজা ভগদত্ত তার সৈন্যদল নিয়ে করুক্ষেত্রের যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। সৈন্যদলটি সঙ্গোলীয় (‘কিরাত, চীনা’ এবং ‘পুর্বসাগরবাসী’) বা ইন্দো-মঙ্গোলীয় (বোড়ো, তিব্বতীয়, ভুটানি ইত্যাগি) মানবগোষ্ঠী নিয়ে গঠিত ছিল। বর্তমানে কামরূপের অবস্থান বলতে ভারতের আসাম ও মেঘালয় রাজ্য এবং বাংলাদেশের রংপুর ও সিলেট বিভাগের অংশ বোঝায়। 

রাজধানী 

প্রাচীনকালে কামরূপের রাজধানী ছিল প্রাগজ্যোতিষ। এরপর রাজধানী ছিল হারুপেশ্বরা, হডপেশ্বর ও দুর্জয়ে। 

প্রাচীনযুগে কামরূপ 

কামরূপের প্রাচীন ভূমিতে বিভিন্ন মানবগোষ্ঠীর বসতি শুরু হয় খ্রিস্টের জন্মেরও দুশত বছর পূর্ব থেকে। ঐতিহাসিক যুগে একদিকে রাজা ও রাজবংশের উদ্ভব ঘটে এবং তাদের পৃষ্ঠপোষকতায় ব্রাহ্মণ যাজকদের পুনর্বাসনের মাধ্যমে একটি যাজক শ্রেণির আবির্ভাব ঘটে। অন্যদিকে কৃষি-দাস ও রাজ পরিবারের নিম্নশ্রেণির লোকদের সমন্বয়ে গড়ে ওঠে কৃষকশ্রেণি। বর্মণ রাজবংশ, মলেচ্ছা রাজবংশ এবং পাল রাজবংশ এ তিনটি রাজবংশ কামরূপ শাসন করেছিল। 

বর্মণ রাজবংশ : বর্মণ বংশের প্রথম রাজা পুশ্যবর্মণের (৩৫০-৩৭৪ খ্রিস্টাব্দ) মাধ্যমে কামরূপে বর্মণ রাজবংশের শাসন শুরু হয়। রাজা পুশ্যবর্মণ প্রাগজ্যোতিষপুরের নতুন নামকরণ করেন কামরূপ। কামরূপের ভৌম রাজাদের মধ্যে সবচাইতে ঘটনাবহুল ছিলেন ভাস্কর বর্মণ (৬০০-৬৫০ খ্রিস্টাব্দ) তার সময় কামরূপের রাজধানী ছিল প্রাগজ্যোতিষ। নিধিনপুরে (বর্তমানে বাংলাদেশের সিলেট) প্রাপ্ত ভাস্কর বর্মণের শিলালিপি হতে ষষ্ঠ থেকে সপ্তম শতকে রাজ্যের অস্তিত্বের প্রমাণ মেলে। এ তাম্রলিপি ভুটিবর্মণের ধ্বংসপ্রাপ্ত লিপিকে স্থলাভিষিক্ত করে। 

মলেচ্ছা রাজবংশ : ভাস্কর বর্মণের কোনো উত্তরাধিকারী না থাকায় তার মৃত্যুর পর রাজ্যে দীর্ঘসময়ের অভ্যন্তরীণ কলহ এবং রাজনৈতিক বিবাদের পর আদিবাসী গোষ্ঠী মলেচ্ছার (৬৫৫-৬৭০ খ্রিস্টাব্দ) অধীনে চলে যায় শাসন ক্ষমতা। এ বংশের রাজধানী ছিল হডপেশ্বর, যা বর্তমানে আসামের তেজপুরে অবস্থিত। এ রাজবংশের সর্বশেষ শাসক ছিলেন ত্যাগসিংহ (৮৯০-৯০০ খ্রিস্টাব্দ)। 

পাল রাজবংশ : ত্যাগসিংহের কোনো উত্তরাধিকারী না থাকায় তার মৃত্যুর পর ভৌম পরিবারের ব্রহ্মপাল (৯০০-৯২০ খ্রিস্টাব্দ) কামরূপের রাজা হিসেবে মনোনীত হন। তিনি রাজ্যের রাজধানী হডপেশ্বর হতে সরিয়ে বর্তমান গোহাটির নিকটবর্তী রতনপাল নির্মিত দুর্জয়ে নিয়ে যান। ১১০০ খ্রিস্টাব্দে গৌড়ের রাজা রামপাল কামরূপ রাজ্যের পশ্চিম অংশ দখল করেন। তবে গৌড়রাজা রামপাল খুব বেশি সময় কামরূপ রাজ্য ধরে রাখতে পারেননি। তারপর রাজা তিঙ্গ্যাদেব ১১১০ থেকে ১১২৬ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত স্বাধীনভাবে কামরূপ শাসন করেন। 

আধুনিক কামরূপ 

মধ্যযুগে বাংলার সুলতান ও মোগল সুবাদারগণ বহুবার আসাম ও কামরূপ দখলের প্রয়াস চালায়। এ ব্যাপারে ইলিয়াস শাহ হোসেন শাহ ও মীরজুমলা এর প্রচেষ্টার কথা উল্লেখ করা যায়। কিন্তু এসব প্রচেষ্টার ফলে অর্জিত বিজয় থেকে কোন স্থায়ী সম্পর্ক স্থাপিত হয়নি। রাজ্যটি ত্রয়োদশ শতাব্দীর মধ্যে সম্পূর্ণরূপে ভেঙে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাজ্যে পরিণত হয় এবং এগুলোর মধ্য হতেই এ রাজ্যের উত্তরসূরি হিসেবে পশ্চিমে কামতা রাজ্য এবং পূর্বে অহোম রাজ্যের উত্থান ঘটে। ১৫৮১ সালে কামতা রাজ্যের তদানীন্তন শাসক নারায়ণ তাঁর রাজ্যকে দুই ভাগ করেন এবং শঙ্কোশ নদীর পশ্চিম অংশ নিজে রেখে পূর্ব অংশ তার ভাইয়ের ছেলে চিলারায়কে উপঢৌকন দেন। বর্তমান আসাম-পশ্চিমবঙ্গ সীমানার মধ্যে এ বিভাজনের গভীর ছাপ লক্ষ করা যায়। নারায়ণের শাসনামলের পর ১৬০২ সাল থেকে পূর্বকোচ রাজ্য বারংবার মোগলদের আক্রমণের শিকার হয় এবং ১৬১৫ সালে এটি মোগল এবং অহোম সাম্রাজ্যের যুদ্ধক্ষেত্রে পরিণত হয় যা কিনা সপ্তদশ শতাব্দী পর্যন্ত চলতে থাকে। উল্লেখ্য ১২২৮ সালে অহোম রাজা চুকাফা ব্রহ্মপুত্র উপত্যকায় প্রথম প্রবেশ করে অহোম রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। ব্রিটিশ কর্মকর্তা ক্যাপ্টেন ওয়েলসের বিশেষ দূত গিগার এনসাইসউড ও ড. জন পিটার বাউডি আসামের অভ্যন্তরে বাণিজ্যিক কার্যক্রম শুরু করার জন্য ২৮ ফেব্রুয়ারি ১৭৯৩ অহোম রাজা গৌনিনাথ সিংহের সাথে একটি চুক্তি সম্পাদন করেন। ব্রিটিশ প্রতিনিধির বাণিজ্যিক কার্যক্রমের উদ্যোগ অব্যাহত থাকে। ১৮১৭, ১৭১৯ ও ১৮২১ সালে আসাম দখলের পর বর্মীরা ১৮২২ থেকে ১৮২৬ সাল পর্যন্ত আসাম শাসন করে। ভারতের ব্রিটিশ গভর্নর জেনারেল লর্ড আমহার্স্ট বর্মী দখলদারদের বিরুদ্ধে পাল্টা অভিযানের ঘোষণা দেন। বর্মীরা আসাম দখলে রেখে ব্রিটিশ নিয়ন্ত্রিত অঞ্চলও অধিকারের চেষ্টা চালায়। ২৪ ফেব্রুয়ারি ১৮২৬ আসামে বর্মীদের পরাজিত ও বিতাড়িত করার পর ব্রিটিশ সরকার বর্মী জেনারেলের সাথে ইয়াদুঁবু চুক্তি স্বাক্ষর করে এবং তারপর আসামে সব ধরনের সুখ-সমৃদ্ধি এবং শান্তি ‘সর্বোপরি জনগণের ইচ্ছা অনুযায়ী একটি সরকার গঠনের’ প্রতিশ্রুতি দিয়ে ব্রিটিশরা কামরূপসহ আসাম দখল করে। 

১৮৩৮ সালে সমগ্র আসামকে ব্রিটিশ উপনিবেশভুক্ত করা হয়। ১৮৭৪ সালে আসামকে একজন চীফ কমিশনারের অধীনে ন্যস্ত করা হয়। ১৯০৫ সালে পূর্ববঙ্গ ও আসাম নামে গঠিত নতুন প্রদেশের সাথে যুক্ত হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত এ ব্যবস্থা বহাল ছিল।


রহস্যময় স্থান কামরূপ কামাখ্যা

কামরূপ কামাখ্যার রহস্যেভরা আখ্যানের কথা শুনেননি এমন লোক খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। এক সময় এ জায়গায় কেউ গেলে আর ফিরে আসত না। হাজার বছরের রহস্যময় স্থান কামরূপ কামাখ্যা। এখনো জাদুবিদ্যা সাধনার জন্য বেছে নেয়া হয় কামাখ্যা মন্দিরকেই। কামরূপ কামাখ্যার আশপাশের অরণ্য আর নর্জন পথে নাকি ঘুরে বেড়ায় ভালো-মন্দ আত্মারা। ছোট্ট দুটি শব্দ ‘কামরূপ কামাখ্যা’। আর এ দুটি শব্দের মধ্যেই লুকানো তাবৎ রহস্য, রোমাঞ্চ আর গল্পকথা। এ উপমহাদেশ তো বটেই সমগ্র বিশ্বে কামরূপ কামাখ্যার আশ্চর্যে ভরা আখ্যানের আলাদা কদর রয়েছে। কামরূপ কামাখ্যাকে বলা হয় জাদুটোনা, তন্ত্রমন্দ্রের দেশ। ভারতের আসাম রাজ্যের গুয়াহাটি শহরের পশ্চিমাংশে নীলাচল পর্বতে অবস্থিত এ কামরূপ কামাখ্যা। এখানে রয়েছে সারি সারি পর্বতমালা। এর ঠিক পাশেই ভক্তদের আগ্রহের কেন্দ্র মা কামাখ্যার মন্দির। এ মন্দির চত্বরে ১০টি মহাবিদ্যার মন্দিরও আছে। এ মন্দিরগুলোতে ভুবনেশ্বরী, ভগলামুখী, ছিন্নমস্তা, ত্রিপুরা সুন্দরী, তারা, কালী, ভৈরবী, ভূমাবতী, মাতঙ্গী ও কামলাদেবীর মন্দিরও রয়েছে। এর মধ্যে ত্রিপুরাসুন্দরী, মাতঙ্গী ও কমলা প্রধান মন্দিরে পূজিত হন। তন্ত্রসাধকদের কাছে এ মন্দির বিশেষ তীর্থস্থান। এছাড়া পুণ্যার্থীদের কাছেও এ মন্দিরের গুরুত্ব অনেক। এ মন্দিরে মোট চারটি কক্ষ আছে। একটি গর্ভগৃহ ও তিনটি মণ্ডপ। এগুলোর স্থানীয় নাম- চলন্ত, পঞ্চরত্ন ও নাটমন্দির। গর্ভগৃহটি পঞ্চরথ স্থাপত্যশৈলীতে নির্মিত খোদাইচিত্রও রয়েছে। আর মন্দিরের চূড়াগুলো উল্টো মৌচাকের মতো। গর্ভগৃহটি মূলত ভূগর্ভস্থ একটি গুহা। এখানে কোনো মূর্তি নেই। শুধু একটি পাথরের সরু গর্ত আছে। এ গর্ভগৃহটি ছোট ও অন্ধকারাচ্ছন্ন। সরু খাড়া সিঁড়ি পেরিয়ে এখানে পৌঁছাতে হয়।

ইতিহাস থেকে জানা যায়, বর্তমানে এ মন্দির ভবনটি অহোম রাজাদের রাজত্বকালে নির্মিত। এর মধ্যে প্রাচীন কোচ স্থাপত্যটি সযত্নে রক্ষিত আছে। খ্রিস্টীয় দ্বিতীয় সহস্রাব্দের মাঝামাঝি সময় মন্দিরটি ধ্বংসপ্রাপ্ত হলে, ১৫৬৫ সাল নাগাদ কোচ রাজা চিলরায় মধ্যযুগীয় মন্দিরের স্থাপত্যশৈলী অনুসারে মন্দিরটি পুনরায় সংস্কার করে দেন। এখন যে মৌচাক-আকারের চূড়া দেখা যায় তা নিম্ন আসামে মন্দির স্থাপত্যের একটি অন্যতম বৈশিষ্ট্য।
Post a Comment (0)
Previous Post Next Post