রচনা : মানব সম্পদ উন্নয়নে শিক্ষা

↬ দক্ষ জনশক্তি উন্নয়নে বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা


ভূমিকা : একটি দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের জন্য প্রয়োজনীয় সম্পদগুলোর মধ্যে মানবসম্পদ অন্যতম। মানবসম্পদ আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের জন্য অত্যাবশ্যকীয় মৌলিক উপাদান। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ত্বরান্বিত, টেকসই ও দীর্ঘমেয়াদি করার ক্ষেত্রে দক্ষ মানবসম্পদের ভূমিকা বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। কারণ মানুষের জন্যই উন্নয়ন এবং মানুষই উন্নয়নের অপরিহার্য নিয়ামক। তাই অর্থসম্পদ ও ভৌতসম্পদের প্রাচুর্যতা থাকা সত্ত্বেও যদি মানবসম্পদের দুষ্প্রাপ্যতা থাকে তাহলে সে ক্ষেত্রে উন্নয়নের প্রক্রিয়া ও গতি মন্থর হয়ে পড়ে। বাংলাদেশ বিভিন্ন প্রতিকূল পরিবেশের মধ্যেও মানবসম্পদ উন্নয়নের মাধ্যমে আর্থ-সামাজিক উন্নতি সাধনের জন্য অব্যাহত প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। আর এ লক্ষ্য অর্জনের অন্যতম হাতিয়ার হিসেবে শিক্ষাকে চিহ্নিত করা হয়েছে। 

মানবসম্পদ কী? : মানবসম্পদ বলতে কী বুঝায় সে সম্পর্কে বিশেষজ্ঞগণ তাদের নিজ নিজ দৃষ্টিকোণ থেকে ভিন্ন ভিন্ন মত প্রকাশ করেছেন। বিভিন্ন অর্থনৈতিক সমীক্ষা ও বিশ্লেষণ থেকে দেখা গেছে, কোনো দেশের জাতীয় আয় (GNP) যেমন তার প্রাকৃতিক সম্পদের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত ঠিক তেমনি দেশের মানুষের গুণগত মানের সঙ্গেও সম্পর্কযুক্ত। অর্থাৎ সমাজে বসবাসকারী ব্যক্তিদের ছাড়া সামগ্রিক অর্থনৈতিক উন্নতি কোনো ক্রমেই সম্ভব নয়। সমাজের উন্নয়নে প্রকৃতপক্ষে অর্থ ও বস্তুসম্পদের মতো ব্যবহৃত হচ্ছে মানবসম্পদ। বিশিষ্ট চিন্তাবিদ কার্ল মার্কস মানুষকে তাই মানবীয় মূলধন (Human Capital) হিসেবে বিবেচনা করেছেন। এ মানবীয় মূলধনকে আধুনিক পরিভাষায় মানবসম্পদ (Human Resource) হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে। মানবশক্তি তখনই মানবসম্পদে রূপান্তরিত হয়, যখন তাকে সুপরিকল্পিতভাবে পরিচালনা করা যায়। 

মানবসম্পদ উন্নয়ন কী? : মানবসম্পদ উন্নয়ন হলো জনসম্পদের এমন এক গুণগত পরিবর্তন প্রক্রিয়া যার মাধ্যমে তারা উৎপাদনক্ষম ও দক্ষ জনশক্তি হিবেবে উৎপাদন প্রক্রিয়ায় ক্রমবর্ধিষ্ণুভাবে বলিষ্ঠ অবদান রাখতে পারে এবং মানবীয় শক্তি-সামর্থ্যের সর্বোত্তম বিকাশে সক্ষম হয়ে উঠতে পারে। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (ILO) মানবসম্পদ উন্নয়ন বলতে ব্যক্তিকে কর্মে নিযুক্ত করার সম্ভাবনা বৃদ্ধির প্রক্রিয়াকে বিবেচনা করেছে। বিশ্বব্যাংকের মতে মানবসম্পদ উন্নয়ন হলো কোনো রাষ্ট্রের মানুষের সামগ্রিক বিকাশ প্রক্রিয়ার একটি অংশ, যার মাধ্যমে রাষ্ট্রের সমগ্র জনসংখ্যার কর্মে নিযুক্তির সম্ভাবনা বাড়ানো যায় এবং তার মাধ্যমে সামাজিক অসাম্য দূর করা যায়। 

মানবসম্পদ উন্নয়নের গুরুত্ব : উন্নয়নের মূলে রয়েছে মানুষ। তাই পল্লী উন্নয়ন, প্রাকৃতিক সম্পদ উন্নয়ন, কৃষি উন্নয়ন, শিল্প উন্নয়ন ইত্যাদি ক্ষেত্রে অবদান রাখতে হবে মানুষকেই এবং উন্নয়ন ঘটাবে মানুষ। অতএব দেশে যত রকমের বস্তুসম্পদ এবং সম্ভাবনা থাকুক না কেন যতক্ষণ মানুষ এ সম্পদ আহরণ এবং ব্যবহার উপযোগী করতে না পারবে ততক্ষণ আমরা এ সেবা থেকে বঞ্চিত থাকবো। তাই দেশের জনসংখ্যাকে মানবসম্পদে পরিণত করতে হবে। 

মানবসম্পদ উন্নয়নের উপায় : হার্বিসন এবং মায়ার্স তাদের গবেষণায় মানবসম্পদ উন্নয়নের ৫টি উপায় উল্লেখ করেছেন। যথা : 

১. আনুষ্ঠানিক শিক্ষা : প্রাথমিক শিক্ষা স্তর থেকে শুরু করে বিভিন্ন কাঠামোর মাধ্যমিক শিক্ষা এবং কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় ও উচ্চ পর্যায়ের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিগত শিক্ষাকে বোঝানো হয়েছে। 

২. কর্মকালীন প্রশিক্ষণ : ধারাবাহিক বা উপানুষ্ঠানিক পদ্ধতিতে প্রতিষ্ঠানভিত্তিক বিভিন্ন প্রশিক্ষণ কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করা। 

৩. আত্মউন্নয়ন : যেমন জ্ঞান, দক্ষতা ও সামর্থ্যের উন্নয়ন যা ব্যক্তি তার নিজের চেষ্টায় আনুষ্ঠানিক উপায়ে অথবা দূরশিক্ষণ পদ্ধতিতে অনানুষ্ঠানিক উপায়ে পড়ে বা অন্যের কাছ থেকে শিখে নিজের আগ্রহ ও কৌতূহল অনুযায়ী ব্যাপক গুণমান, দক্ষতা ও যোগ্যতা অর্জনের মাধ্যমে নিজেকে তৈরি করে। 

৪. স্বাস্থ্য উন্নয়ন : উন্নততর চিকিৎসা ব্যবস্থা এবং গণস্বাস্থ্য কার্যক্রমের মাধ্যমে কর্মরত জনগোষ্ঠীর স্বাস্থ্য উন্নয়ন। 

৫. পুষ্টি উন্নয়ন : পুষ্টি মানুষের কর্মদক্ষতা বাড়িয়ে দেয়। ফলে মানুষ অধিক সময় ধরে কাজ করতে পারে এবং তার কর্মজীবন দীর্ঘ হয়। 

মানবসম্পদ উন্নয়নে শিক্ষার গুরুত্ব : মানবসম্পদ উন্নয়ন নিঃসন্দেহে সকল প্রকার উন্নয়নের মূল চাবিকাঠি। আর এ ক্ষেত্রে শিক্ষার গুরুত্ব সর্বাধিক। কারণ শিক্ষাই হলো মানবসম্পদ উন্নয়নের প্রধান উপায়। সর্বজনীন প্রাথমিক শিক্ষা, উচ্চ হারের মাধ্যমিক শিক্ষা এবং সুনির্বাচিত উচ্চশিক্ষা যে দ্রুত প্রবৃদ্ধি অর্জনের হাতিয়ার হিসেবে কাজ করে থাকে সে শিক্ষা আমরা পাই পূর্ব এশিয়ার দেশগুলো থেকে। মানবসম্পদ সঞ্চয়নে শিক্ষা সেখানে এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। আর মানবসম্পদ গঠনের এ প্রক্রিয়া ঐ অঞ্চলে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার বাড়াতে সক্রিয় ভূমিকা পালন করছে বলে প্রায় সকল বিশেষজ্ঞই এক মত। তবে এর পাশাপাশি রাষ্ট্র বস্তুগত অবকাঠামো উন্নয়ন, উপযুক্ত নীতি সমর্থন দিয়ে মানবসম্পদ উন্নয়নের গতিকে আরো সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যে নিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছে। 

শিক্ষা মানবসম্পদ উন্নয়নে বিভিন্নভাবে অবদান রাখে। যেমন- 
১. শিক্ষা পরিবর্তনের আকাঙ্ক্ষা সৃষ্টি করে : শিক্ষা আত্মসচেতনতা বাড়িয়ে দেয় এবং মানুষের মধ্যে পরিবর্তনের আকাঙ্ক্ষা সৃষ্টি করে। শিক্ষা মানুষকে তাদের অভ্যাস, রীতিনীতি এবং সামাজিক অবস্থা ও ব্যবস্থাপনা জানতে সাহায্য করে এবং পরিবর্তনের আকাঙ্ক্ষা তাদের মধ্যে জাগ্রত করে। 

২. নিজের উদ্যোগে জ্ঞানার্জনের পথ সুগম করে : নিরক্ষর ব্যক্তির জ্ঞান আহরণের সুযোগ অত্যন্ত সীমিত। কিন্তু নিরক্ষর ব্যক্তির সাক্ষর হলে নিজের আগ্রহ ও প্রয়োজন মতো বইপত্র, পুস্তিকা ও সংবাদপত্র পড়ে জ্ঞানার্জন করতে পারে এবং নিজের বিবেক ও বুদ্ধি খাটিয়ে নিজের ও পরিবারের উন্নয়ন এবং দেশের উন্নয়নমূলক কাজে অংশগ্রহণ করতে পারে। 

৩. কর্মদক্ষকতা বৃদ্ধিতে সহায়তা করে : একজন সাক্ষরকর্মী নিরক্ষরকর্মীর চেয়ে অধিকতর ‘কর্মদক্ষ’। কারণ সাক্ষর ব্যক্তির চিন্তা ও বিচার বিশ্লেষণ, আত্মমূল্যায়ন ও সংশোধন এবং কর্মজীবনের কর্মসম্পাদন ও কর্মসূচি গ্রহণের ক্ষমতা নিরক্ষর ব্যক্তির চেয়ে অনেক বেশি। তাছাড়া নিজ পেশা সংক্রান্ত পুস্তক-পুস্তিকা পাঠ এবং উচ্চতর প্রশিক্ষণের মাধ্যমেও সাক্ষর ব্যক্তি তার কর্মক্ষমতা বাড়াতে সক্ষম হয়। 

৪. শিক্ষা জীবনযাত্রার মানোন্নয়নে স্পৃহা জাগায় : শিক্ষা মানুষকে আত্মসচেতন করে তোলে এবং স্বাস্থ্যকর ও সুন্দর জীবনযাপনের প্রেরণা যোগায়। জ্ঞানার্জনের মাধ্যমে মানুষ অন্যের পরিবেশকে জানতে পারে। ফলে তারা নিজেকে অন্যের সঙ্গে তুলনা করতে পারে এবং নিজের জীবনযাত্রার মান মূল্যায়ন করে তার সার্বিক মানোন্নয়নের জন্য উদ্যোগী হয়। অন্যদিকে নিরক্ষর মানুষ রোগ, শোক, দরিদ্র্য ইত্যাদিকে ভাগ্যের ফল হিসেবে গ্রহণ করে এবং সমাজে মানবেতরে জীবনযাপন অভ্যস্ত হয়। 

মানবসম্পদ উন্নয়নের জন্য যে ধরনের শিক্ষা দরকার : ১৯৬০-এর দশকে যেখানে দুই এশিয়ার (দক্ষিণ এশিয়া এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া) মাথাপিছু আয় ছিল প্রায় কাছাকাছি, পরবর্তীতে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো তাদের নাগরিকদের মানবসম্পদ উন্নয়নের মাধ্যমে প্রজন্মান্তর সমৃদ্ধি ঘটাতে ব্যর্থ হয়েছে। অন্যদিকে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলো এক্ষেত্রে অনেক এগিয়ে গেছে। বাংলাদেশের বাজেটে শিক্ষাখাতের জন্য বরাদ্দ যাও বা থাকে তা মূলত শিক্ষকদের বেতন ও অবকাঠামো খাতেই ব্যয় করা হয়। শিক্ষাক্রম ও শিক্ষার মানোন্নয়ন, লাইব্রেরির উন্নয়ন ইত্যাদি বাবদ খুব সামান্যই অর্থ বরাদ্দ থাকে। 

বাংলাদেশের মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা যে মানবসম্পদ উন্নয়নের জন্য মোটেই উপযোগী নয় তা বিভিন্ন গবেষণায় ধরা পড়েছে। এসব গবেষণায় ধরা পড়েছে যে প্রাথমিক শিক্ষা পেশা পরিবর্তনের সামান্য সাহায্য করলেও মানবসম্পদ উন্নয়নে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষার তেমন কোনো ভূমিকাই নেই। 

এ অবস্থায় যুগোপযোগী মানবসম্পদ তৈরির লক্ষ্যে আমাদের দেশীয় শিক্ষা ব্যবস্থার উৎকর্ষ অর্জনের জন্য জরুরি দৃষ্টি দেয়া আবশ্যক। 

প্রাথমিক শিক্ষার পরপরই মাধ্যমিক শিক্ষার মান উন্নত করার জন্য বাড়তি গুরুত্ব দিতে হবে। এক্ষেত্রে মাধ্যমিক শিক্ষাক্রমের আমূল পরিবর্তন কাম্য যা জ্ঞান, দক্ষতা, মূল্যবোধ, নৈতিকতা ও মৌলিক উৎকর্ষতাকে উৎসারিত করবে। এ পর্যায়ে প্রযুক্তির ব্যবহার কি করে বাড়ানো যায় সে দিকটাও মাথায় রাখতে হবে। 

বাংলাদেশে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা কিছু অনাকাঙ্ক্ষিত সমস্যায় জর্জরিত। ছাত্ররাজনীতি, সন্ত্রাস, শিক্ষকদের দলীয় রাজনীতিতে সম্পৃক্ততা ইত্যাদি এ ধরনের সমস্যাগুলোর মধ্যে প্রধান। ফলে উচ্চ শিক্ষা তার স্বকীয়তা হারাচ্ছে। তাই ছাত্রছাত্রীদের তথ্যপ্রযুক্তির সাথে অধিকতর অন্তর্ভুক্তি, বিশ্বের উন্নত বিশ্ববিদ্যালয়সমূহ থেকে বিশেষজ্ঞ শিক্ষক এনে বিষয়ভিত্তিক লেকচার প্রদানের ব্যবস্থা, বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরতদের পৃথিবীব্যাপী বিভিন্ন মাল্টিন্যাশনাল প্রতিষ্ঠানসমূহে কাজের সুবিধা সৃষ্টি ইত্যাদি বিভিন্ন সময়োপযোগী পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে আমাদের দেশের উচ্চ শিক্ষার সুনাম পুনঃপ্রতিষ্ঠার চেষ্টা করতে হবে। 

উপসংহার : বর্তমান যুগে যে কোনো দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের জন্য প্রাকৃতিক সম্পদের পাশাপাশি মানবসম্পদের গুরুত্ব অপরিসীম। মানবসম্পদ উন্নয়নই হলো দেশের সার্বিক উন্নয়নের প্রধান হাতিয়ার। আর মানবসম্পদ উন্নয়নের ক্ষেত্রে আধুনিক, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিভিত্তিক এবং যুযোপযোগী শিক্ষাই মুখ্যভূমিকা পালন করে। কিন্তু আমাদের দেশের বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থা নানাবিধ কারণে দেশের বিপুল জনগোষ্ঠীকে দক্ষ মানবসম্পদে পরিণত করার ক্ষেত্রে কার্যকরী ভূমিকা পালনে ব্যর্থ হচ্ছে। তাই মানবসম্পদ উন্নয়নের জন্য প্রথমেই এ দেশের শিক্ষা ব্যবস্থার সার্বিক মানোন্নয়নে সকলকে সচেষ্ট হতে হবে।

1 Comments

  1. মানব সম্পদ নিয়ে আলোচনা করেছেন তা সময়োপযোগী
    ধন্যবাদ ভাইয়া

    ReplyDelete
Post a Comment
Previous Post Next Post