↬ স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী ও অর্থনৈতিক ও সামাজিক পদক্ষেপ
ভূমিকা : বাংলাদেশ ২০২১ সালে তার স্বাধীনতার ৫০ বছর অতিক্রম করবে। ১৯৭১ সালে ৩০ লক্ষ শহীদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত হয় আমাদের স্বাধীনতা। পাকিস্তানি শোষণ থেকে মুক্তি ও এদেশের জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠা করাই ছিল মুক্তিযুদ্ধের প্রধান উদ্দেশ্য। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে স্বাধীনতার ৪৩ বছর পার হওয়ার পরেও স্বাধীনতার স্বপ্ন ও উদ্দেশ্য আজও পূরণ হয়নি। ৯০ দশকের পর থেকে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও গণতান্ত্রিক চর্চার কিছুটা উন্নতি হয়ে আসছিল। কিন্তু কোনো ক্ষমতাসনি দলই দুনির্দিষ্ট কোনো পরিকল্পনা গ্রহণ না করায় অদূর ভবিষ্যতে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক অবস্থা কোন পর্যায়ে পৌঁছাবে তা বুঝা যাচ্ছিল না। ২০০৮ সালে বাংলাদেশের নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ একটি দীর্ঘমেয়াদি সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা সম্বলিত নির্বাচনী ইশতেহার রচনা করেছিল। যেখানে ২০২১ সালে বাংলাদেশকে একটি মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত করার লক্ষ্যে বিভিন্ন মেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণের কথা বলা হয়েছিল। মূলত ২০২১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষে গৃহীত পরিকল্পনাগুলোই ভিশন ২০২১ নাম পরিচিত।
ভিশন-২০২১ কি? : বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ২০০৮ সালে সর্বপ্রথম ‘ভিশন-২০২১’ বা ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ নামটি প্রচার করে। ২০২১ সাল নাগাদ বাংলাদেশকে একটি মধ্যম আয়ের দারিদ্রমুক্ত ও প্রযুক্তি নির্ভর দেশ গঠন করাই ‘ভিশন-২০২১’ বা ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ এর প্রধান লক্ষ্য। এগারো বছর মেয়াদি (২০১০-২০২১) একটি প্রেক্ষিত পরিকল্পনা (Perspective Plan) এবং ষষ্ঠ ও সপ্তম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার উপর ভিত্তি করে এর বাস্তবায়নের মাধ্যমে এ রূপকল্প অর্জিত হবে। উল্লিখিত সময়ে বাংলাদেশ একটি অসাম্প্রদায়িক, প্রগতিশীল ও উদার গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে পরিণত হবে। রূপকল্পের অন্যান্য বিষয়গুলো হলো প্রকৃত অংশীদারিত্বমূলক সহিষ্ণু গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা, সামাজিক ন্যায়বিচারের নিশ্চয়তা, নারীর অধিকার ও সুযোগের সমতা, আইনের শাসন, মানবাধিকার, সুশাসন, দূষণমুক্ত পরিবেশ, সবার জন্য শিক্ষা ও স্বাস্থ্য অধিকার নিশ্চিতকরণ, সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সৃষ্ট বিপর্যয়ের মোকাবিলার সক্ষমতা অর্জন প্রভৃতি। তথ্য প্রযুক্তিতে বিকশিত হয়ে রূপকল্প বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে সেই সময়ে বাংলাদেশ পরিচিতি পাবে ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ নামে।
ভিশন-২০২১ স্বপ্নপূরণে সরকারের গৃহীত সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিকল্পনাসমূহ :
১. শক্তিশালী গণতন্ত্র ও কার্যকর সংসদ : যথাসময়ে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন, কার্যকর সংসদ ও সরকারের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে গণতন্ত্রকে জোড়দার ও শক্তিশালী প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেয়া হবে।
২. রাজনৈতিক কাঠামো, ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ ও ক্ষমতায় জনগণের অংশগ্রহণ : রাজনৈতিক কাঠামোগত বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনয়নের মাধ্যমে স্থানীয় সরকারকে শক্তিশালী করা। যাতে উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডে স্থানীয় সরকারের প্রতিষ্ঠানসমূহ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। তৃণমূল পর্যায়ে সরকারি কর্মকাণ্ডকে জবাবদিহিতামূলক ও প্রতিনিধিত্বমূলক করতে জেলা-উপজেলা পর্যায়ে আত্মনির্ভরশীল স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা হবে।
৩. সুশাসন প্রতিষ্ঠা : আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা করা হবে। সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান ও প্রশাসনকে সরকারের প্রভাবমুক্ত করে স্বাধীন বিচার ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত করা হবে। মেধা, দক্ষতা, জ্যৈষ্ঠতা, সততা অনুযায়ী প্রশাসক ও বিচারকের নিয়োগ ও পদোন্নতি নিশ্চিত হবে।
৪. রাজনৈতিক সংস্কৃতির আদান প্রদান : সন্ত্রাস, দুর্নীতি ও রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহার রোধ করা হবে। রাজনৈতিক দলসমূহের মধ্যে গণতান্ত্রিক চর্চা, রাজনৈতিক দলের তহবিল গঠনে স্বচ্ছতা, শিষ্টাচার ও সহনশীলতা তৈরিতে যথাযথ পদক্ষেপ নেওয়া হবে।
৫. দুর্নীতিমুক্ত সমাজ গঠন : দুর্নীতিকে সমাজ থেকে মুছে ফেলার লক্ষ্যে দুর্নীতি দমন কমিশনকে আরো শক্তিশালী করা হবে। যথাযথ আইনি পদক্ষেপ গ্রহণ, নাগরিক অধিকার সনদ প্রণয়ন, তথ্য অধিকার নিশ্চিতকরণ, ক্ষমতার কিকেন্দ্রীকরণসহ সকল সম্ভাব্য পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে।
৬. নারীর ক্ষমতায়ন ও সমঅধিকার প্রতিষ্ঠা : সামাজিক ও রাজনৈতিক পর্যায়ে নারীদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত এবং নারীদের সমঅধিকার প্রতিষ্ঠায় নারী নীতি-১৯৯৭ কে সংশোধন করা হবে।
অর্থনৈতিক পরিকল্পনাসমূহ :
১. মৌলিক চাহিদা পূরণ : সংবিধানের ১৫নং অনুচ্ছেদ অনুযায়ী নাগরিকদের মৌলিক চাহিদা পূরণ তথা খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের অধিকার নিশ্চিত করা হবে। জিডিপির প্রবৃদ্ধি হার ২০১৩ সালে ৮% এবং ২০২১ সালে ১০% এ উন্নীত করা।
২. জনসংখ্যা ও জনশক্তি : ২০২১ সালে প্রাক্কলিত জনসংখ্যা হবে ১৬৫ মিলিয়ন এবং শ্রমশক্তি হবে ১০৫ মিলিয়ন। শ্রমশক্তির অন্তত ৮৫% কে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া হবে।
৩. দারিদ্র্যের হ্রাস : দারিদ্র্য নিরসনে জাতিসংঘের মিলেনিয়াম উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা ও টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করা হবে। ২০২১ সালে দারিদ্র্যের হার ১৫ শতাংশ নামিয়ে আনা হবে। দারিদ্র্য নির্মূলে সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনি কার্যক্রমকে শক্তিশালী করা হবে।
৪. খাদ্য ও পুষ্টি : খাদ্য ঘাটতি দূর করে বাংলাদেশকে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ দেশ গঠন করা হবে এবং জনসংখ্যার ৮৫% কে পুষ্টির আওতায় আনা হবে।
৫. শিক্ষা ও স্বাস্থ্য : প্রাথমিক শিক্ষায় শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ ১০০ শতাংশে উন্নীত করা হবে। গুণগত শিক্ষা প্রদান, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিনির্ভর শিক্ষা ব্যবস্থা এবং শিক্ষকদের জন্য যথাযথ বেতনস্কেল গঠনের মাধ্যমে শিক্ষার আধুনিকায়ন হবে। অন্যদিকে ২০২১ সালের মধ্যে প্রতিটি নাগরিকের জন্য সর্বনিম্ন ২১২২ কিলোক্যালরি খাদ্য গ্রহণ, সংক্রামক রোগের নির্মূল, প্রাথমিক স্বাস্থ্য সেবা এবং সবার জন্য স্যানিটারি ব্যবস্থা সুবিধার নিশ্চয়তা প্রদান। জীবন আয়ু গড়ে ৭০ বছর এ উন্নীত এবং শিশু ও মাতৃ মৃত্যুহার উল্লেখজনকহারে হ্রাস করা।
৬. শিল্প : দেশের শিল্পায়নের জন্য ২০২১ সালের মধ্যে একটি শক্তিশালী ভিত্তি রচনা। জিডিপিতে শিল্পের অবদান দ্বিগুণ করা। কৃষি এবং শ্রমনিবিড় শিল্পকে গুরুত্ব দেওয়া এবং তথ্যপ্রযুক্তি খাতকে অগ্রাধিকার দেওয়া। দেশী ও বিদেশী বিনিয়োগকে উৎসাহিত করতে যথাযথ বিনিয়োগ নীতি গ্রহণ।
৭. জ্বালানি নিরাপত্তা : দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও শিল্পায়নের গতির তরান্বিতকে নিশ্চিত করতে একটি জ্বালানি নীতি গ্রহণ করা হবে। ২০২১ সালের মধ্যে বিদ্যুৎ উৎপাদন ২০,০০০ মেগাওয়াটে উন্নীত হবে। গ্যাস উৎপাদন ও নতুন গ্যাস ক্ষেত্রের অনুসন্ধান এবং জ্বালানি চাহিদা মেটাতে সম্ভাব্য সকল পদক্ষেপ নেওয়া হবে।
৮. অবকাঠামো উন্নয়ন : সড়ক, রেল, নৌ ও আকাশপথ এবং যোগাযোগ ব্যবস্থাকে আরো সম্প্রসারিত করা হবে। নতুন নতুন ব্রিজ নির্মাণ, পদ্মা ও কর্ণফুলী নদীতে টানেল নির্মাণ, এশিয়ান হাইওয়ে এবং রেলওয়েতে বাংলাদেশকে সম্পৃক্ত করা, বন্দর সুবিধার উন্নয়নসহ গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ করা হবে। ঢাকা শহরের যানজট নিরসনে এখানে মেট্রোরেল ও উড়ালসড়ক নির্মাণ করা হবে।
৯. আবাসন সুবিধা : সবার জন্য আবাসন সুবিধা নিশ্চিত করা হবে। প্রতিটি ইউনিয়ন এবং উপজেলায় গ্রাম এবং শহর কেন্দ্রিক প্রবৃদ্ধি কেন্দ্র (Growth Center) স্থাপন করা হবে।
১০. পরিবেশ : বাংলাদেশকে রক্ষা করতে প্রয়োজনীয় সকল পদক্ষেপ নেয়া হবে, প্রয়োজনে জলবায়ু পরিবর্তন ও বৈশ্বিক উষ্ণতারোধে বিদেশে পরিকল্পিত উপায়ে জমি অধিগ্রহণ হবে। প্রাকৃতিক বিপর্যয় মোকাবিলা, পরিকল্পিত উপায়ে বায়ু দূষণ হ্রাস, বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা এবং শিল্প ও পরিবহন খাতকে পরিবেশ বান্ধব হিসেবে গড়ে তোলার লক্ষ্যে সকল পদক্ষেপ নেওয়া হবে।
উপসংহার : ভিশন-২০২১ বা রূপকল্প-২০২১ বাংলাদেশের উন্নয়নের স্বপ্ন। ভিশন-২০২১ এর লক্ষ্যমাত্রায় পৌঁছাতে আর মাত্র কয়েক বছর বাকি। রূপকল্পের সফলতা ও ব্যর্থতা নিয়ে শুরু হয়েছে ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ। ভিশন-২০২১ এর অধিকাংশ পরিকল্পনা যথাসময়ে বাস্তবায়িত হওয়ার ব্যাপারে সংশয় থাকলেও কয়েকটি দিক থেকে বাংলাদেশ আশাতীত সাফল্য অর্জন করেছে। দারিদ্র্য হ্রাস, শিশু ও মাতৃমৃত্যু হার হ্রাস, প্রাথমিক শিক্ষায় ছাত্র/ছাত্রীদের ঝরে পড়ার হার হ্রাস, নারীর ক্ষমতায়ন ও বিদ্যুৎ উৎপাদনে বাংলাদেশ ব্যাপক সাফল্য দেখিয়েছে। ভিশন-২০২১ এর লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে পরিকল্পনার বাকি বিষয়গুলোর বাস্তবায়ন জরুরি। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী পালনের সাধ্যমে যেন এ দেশের প্রতিটি মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা পায়, দারিদ্র্যমুক্ত ও মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হয় সে লক্ষ্যে বাংলাদেশ সরকার যেন উন্নয়ন কার্যক্রমকে আরো জোরদার করে সেই প্রত্যাশাই ব্যক্ত করি।
বাংগালীজাতির অর্থনৈতিক মুক্তির দলিল
ReplyDelete