বাংলার ইতিহাস এদেশের মানুষের রক্ত দিয়ে রাজপথ রঞ্জিত করার ইতিহাস।
তদানীন্তন পাকিস্তানের ক্ষমতাসীন শাসকগোষ্ঠী শুরু থেকেই পূর্ব বাংলা ও বাংলার মানুষের সঙ্গে বৈরী আচরণ ও ষড়যন্ত্রে মেতে ওঠে। তারা ২৩ বছর ধরে শোষণ-বঞ্চনা, অত্যাচার-নিপীড়ন ও হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে এদেশের মানুষের সবরকম অধিকার কেড়ে নেওয়ার প্রচেষ্টা চালায়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর ৭ই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণে তাই যথার্থভাবেই বাংলার মানুষের রক্তে রাজপথ রঞ্জিত করার ইতিহাসের কথা দৃঢ়কণ্ঠে উচ্চারণ করেছেন। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান স্বাধীনতা লাভ করে। পূর্ব বাংলা পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায়। ক্ষমতসীন গোষ্ঠী গোড়া থেকেই বাংলাকে উপনিবেশ করার ষড়যন্ত্রে তৎপর হয়ে ওঠে। প্রথমে তারা ৫৬ ভাগ মানুষের মুখের ভাষা কেড়ে নিয়ে উর্দু ভাষা চাপিয়ে দিতে চেয়েছিল। কিন্তু এদেশের মাতৃভাষা বাংলাপ্রেমী ছাত্র-জনতা ও সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ-বিক্ষোভ, মিছিল-মিটিংয়ের মাধ্যমে সারা দেশকে ভাষা আন্দোলনে সম্পৃক্ত করে।
১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি সারা দেশে বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষার দাবিতে হরতাল আহ্বান করা হয়। তদানীন্তন সরকার ১৪৪ ধারা জারি করে মিছিল-মিটিং বন্ধ করে দেয়। কিন্তু ছাত্র-জনতা ১৪৪ ধারা ভেঙে মিছিল বের করলে পুলিশ তাদের ওপর নির্বিচারে গুলি চালায়। এতে বরকত, সালাম, রফিক, জব্বার, শফিউরসহ অনেকেরই তাজা রক্তে রাজপথ রঞ্জিত হয়, তাঁরা শহীদ হন। ছাত্র-জনতা সারা দেশ প্রতিবাদ-বিক্ষোভে অচল করে দিলে জালিম সরকার বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে মেনে নিতে বাধ্য হয়। এরপর শিক্ষাব্যবস্থা সংকুচিত করার ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে ১৯৬২ সালে শিক্ষা কমিশন বাতিল করার দাবিতে আন্দোলন শুরু হলে সামরিক সরকার আবারও হত্যাকাণ্ড ঘটায়। এতে শহীদ হন মোস্তফা ওয়াজিউল্লাহ ও বাবুল। তীব্র আন্দোলনের মুখে সামরিক সরকার শিক্ষা কমিশন বাতিল ঘোষণা করে। ১৯৬৬ সালের ৬ দফা, ১৯৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানেও ঘটে পুলিশি নিপীড়ন ও হত্যাকাণ্ড। ১৯৬৯ সালে পুলিশের গুলিতে শহীদ হন আসাদ ও সার্জেন্ট জহুরুল হক। এরপর ১৯৭০-এর নির্বাচনে বাংলার মানুষের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর না করার ষড়যন্ত্রে জালিম পাকিস্তানি সরকার মেতে উঠলে এর প্রতিবাদ ও আন্দোলনের মুখে আবার বাংলার মানুষের রক্তে রাজপথ রঞ্জিত হয়। এদেশের মানুষের রক্তে লাল হয়েছে রাজপথ। ১৯৪৭ থেকে ১৯৭১ সাল- এই ২৩ বছরের ইতিহাস বাংলার মানুষের রক্তে রাজপথ লাল হওয়ার ইতিহাস। তাই তো ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণে বঙ্গবন্ধুর কণ্ঠে উচ্চারিত হয়েছে- বাংলার ইতিহাস এদেশের মানুষের রক্ত দিয়ে রাজপথ রঞ্জিত করার ইতিহাস।
এই ভাবসম্প্রসারণটি অন্য বই থেকেও সংগ্রহ করে দেয়া হলো
মূলভাব : ধ্বংস, মৃত্যু, অশ্রু আর ত্যাগের মহিমায় উজ্জ্বল বাংলার স্বাধীন আঙিনা। পুণ্য রক্তস্রোতের ধারায় লেখা বাংলার অমর ইতিহাস।
সম্প্রসারিত ভাব : শৃঙ্খলে আবদ্ধ বাঙালি জাতি ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ শাসনের জাঁতাকলে নিষ্পেষিত হয়েছে প্রায় দুশো বছর। ১৯৪৭ সালে সেই দুঃশাসনের হাত থেকে উপমহাদেশের মানুষ মুক্তি পেলেও বাঙালির মুক্তি মেলেনি। তাই তো বাংলার আঙিনায় বারবার বিদ্রোহের আগুন জ্বলেছে, রক্তের বন্যা প্রবাহিত হয়েছে। ’৫২-র ভাষা আন্দোলন বাঙালির মুক্তির পথে প্রথম বিজয় এবং বাঙালির সকল আন্দোলনের প্রেরণার শক্তি। ১৯৫৮, ১৯৬৬, ১৯৬৯ সালে পাকিস্তানি সামরিক শাসক বাংলার দুরন্ত ছেলেদের ওপর গুলি চালায়। বার বার রক্তের রঙে বাংলা নেয় ভয়ঙ্কর রূপ। গর্জে ওঠে জনতা, জাগরণের শক্তিকে দমিয়ে রাখতে ব্যর্থ হয় পাকিস্তানি সেনাবাহিনী। স্বাধীনতাকামী সংঘবদ্ধ বাঙালিরা মরিয়া হয়ে ওঠে। যার চূড়ান্ত প্রকাশ দেখা যায় ১৯৭১-এ। বাংলার স্বাধীনতার পথে প্রধান বাধা সৃষ্টিকারী পাকিস্তানি হানাদাররা ১৯৭১-এ চূড়ান্ত আঘাত হানে। কিন্তু সংগ্রামী বাঙালিদের গতিকে রুদ্ধ করতে পারে না। লোখো লাখো মানুষের বুকের রক্তে রঞ্জিত হয় বাংলার মাটি। সৃষ্টি হয় সংগ্রাম পথের এক অবিস্মরণীয় ইতিহাস- ‘স্বাধীনতা’।
মন্তব্য : এক সাগর রক্তের বিনিময়ে বাঙালি অর্জন করে স্বাধীন ভূখণ্ড আর সবুজ লালের চেতনা-মিশ্রিত পতাকা। এভাবেই রক্তের পথ পাড়ি দিয়ে বাঙালি জাতি অর্জন করে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ।