রচনা : বাংলাদেশের প্রাচীন স্থাপত্য : মসজিদ ও মন্দির

মসজিদ

ভূমিকা : পৃথিবীর বিভিন্ন ধর্মীয় গোষ্ঠীর মতো মুসলমানদের একটি নিজস্ব স্বাতন্ত্র্য ও বৈশিষ্ট্যপূর্ণ প্রার্থনাগার রয়েছে। পবিত্র কোরআন শরীফে বলা হয়েছে, “হে আমার বান্দাগণ, নামাজ কায়েম কর এবং যাকাত দান কর।” এই নামাজ একটি ব্যক্তিগত প্রয়াস এবং মুসলমানগণের বিশেষ দিন; যেমন- ঈদ-উল-ফিতর ও ঈদ-উল-আজহা এবং জুম্মার দিন ছাড়া এককভাবে নামাজ আদায় করে থাকেন। মক্কা থেকে মদীনায় হিজরত করার পর রাসূলে কমীম হযরত মুহম্মদ (স) তাঁর সাহাবীদের সাথে একত্রে নামাজ আদায় করতেন এবং এভাবেই মসজিদের উৎপত্তি হয়। মসজিদ কথাটির উৎপত্তি হয়েছে মূল শব্দ ‘সাজাদা’ থেকে। ‘সাজাদা’ অর্থ সিজদার স্থান; অর্থাৎ সাধারণ অর্থে যেখানে সিজদা দেয়া হয় সেই জায়গাকে মসজিদ বলা হয়। 

প্রথম নির্মিত মসজিদ : সর্বপ্রথম মসজিদ নির্মিত হয় মদীনায় ৬২২ খ্রিস্টাব্দে। মহানবী হযরত মুহম্মদ (স) একটি জমি ক্রয় করে সাহাবীদের উক্ত জমিতে ইসলামের প্রথম মসজিদ নির্মাণ করেন। এই মসজিদের আয়তন, দৈর্ঘ্য ও প্রস্থে ১০০ হাত এবং চারদিকে ৭ হাত পরিমাণ একটি উঁচু প্রাচীর দ্বারা বেষ্টিত। মদীনা-মসজিদের বিশেষত্ব হচ্ছে যে, এর পূর্ব-প্রাচীরের দক্ষিণপ্রান্তে নবীজীর স্ত্রীদের জন্য প্রথমে দু’টি এবং পরে আরও সাতটি কুঠরী নির্মিত হয়। ৬ থেকে ৭ হাত পরিমাণ দৈর্ঘ্য ও প্রস্থবিশিষ্ট এসব কুঠরীগুলো ‘হুজরা’ নামে পরিচিত। অতি-সাধারণ, অনাড়ম্বর এবং কারুকার্যবিহীন মদিনা-মসজিদটি যুগ যুগ ধরে সম্প্রসারিত হয়েছে। 

বিভিন্ন সময়ে কারুকার্যমণ্ডিত (মসজিদ) স্থাপত্যের নিদর্শন : 
(১) উত্তর আফ্রিকায় কায়রোয়ান মসজিদটি বর্তমানে বিশাল ও কারুকার্যমণ্ডিত যা নবম শতাব্দীতে প্রতিষ্ঠিত আগলাবিদ রাজবংশের কীর্তি। 

(২) মসজিদের ক্রমবিবর্তনের ইতিহাসে যে দু’টি ইমারত বিশেষ অবদান রেখেছে তা হচ্ছে ‘মসজিদ আল্-আক্‌সা’ এবং দামেস্কের ‘জা’মী’ মসজিদ। ৬৪১-৪২ খ্রিস্টাব্দে জেরুজালেমে নির্মিত ‘বায়কাত-আল-মুকাদ্দেসে’ নির্মিত হয়। এই পবিত্র এলাকায় মুসলিম স্থাপত্যের অনন্যসাধারণ সৌধ, কুব্বাত আস-সাখরা নামে পরিচিতকালের স্বাক্ষর বহন করে আছে। ‘স্থাপত্যশৈলী’ অলঙ্কার ও সৃজনশীল রীতির উদ্ভাবনে এই ইমারতটি মুসলিম স্থাপত্য-কলায় অসামান্য অবদান রেখেছে। 

(৩) খলিফা আল-ওয়ালিদের জামে মসজিদটি ধর্মীয় গুরুত্ব বিচারে মুসলিম জগতে মক্কা, মদিনা ও জেরুজালেমের পরেই চতুর্থ স্থান অধিকার করে রেখেছে। মুসলিম ঐতিহাসিকগণ এই ইমারতের স্থাপত্যশৈলী এবং অলঙ্করণের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেছেন। এর খিলানগুলো গোলাকার অশ্বনালাকৃতি ও উপরে-নিচে দুই সারিতে নির্মিত। সাদা মার্বেলের ব্যবহারে ঢালু ছাদ, কারুকার্যমণ্ডিত কাঠের মিহরাব, গম্বুজ, জালির জানালা, বিশাল চত্বর, এর তিন পাশে রিওয়াক মসজিদটিকে বৈশিষ্ট্য দান করেছে। মুকাদ্দাসীর মতে, অলঙ্করণের দিক থেকে দামেস্কের মসজিদ বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ মসজিদ এবং মসজিদ-স্থাপত্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ ইমারত। মোজাইক, দেয়াল চিত্র, মার্বেলের জালি, কাঠের নকসা, শিলালিপি স্টাকো ছাড়াও সাদা মার্বেল, কারিন্থিয়াম স্তম্ভশীর্ষ (ক্যাপিটাল) বাইজানটাইন কীর্তির পরিচায়ক। 

(৪) মসজিদ-স্থাপত্য তথা মসজিদ রীতিতে কর্ডোভার মসজিদ একটি বিস্ময়কর অবদান। অসংখ্য স্তম্ভরাজি, বিভিন্ন ধরনের খিলানের সমাহার ভল্ট ও গম্বুজ, মিহরাব, মিনার, মিমবারের ব্যবহার এই মসজিদটিকে সমৃদ্ধ করেছে। নীল গোলাপী কালো, ধূসর রঙের মার্বেল ও গ্রানাইটের তৈরি স্তম্ভরাজি; গোল, পেচাঁনো ও শিরাল ধরনের স্তম্ভ; তিন, পাঁচ ও বহু খাঁজবিশিষ্ট খিলানের সাথে সাথে অশ্বনালাকৃতি, কৌণিক এবং অর্ধ-গোলাকার খিলানের প্রয়োগ চালাছাদ, লতাপাতা, জ্যামিতিক নক্সা এবং কুফী ও নসখ রীতিতে উৎকীর্ণ শিলালিপি কর্ডোভা মসজিদকে অনিন্দ্যসুন্দর ইমারতে পরিণত করেছে। 

(৫) আব্বাসীয় স্থাপত্য-কীর্তির স্বাক্ষর বহন করে রয়েছে সামারায় ৮৪৭ খ্রিস্টাব্দে খলিফা আল-মুতাওয়াকিকল কর্তৃক নির্মিত জামে মসজিদটি। এই মসজিদটি পৃথিবীর সর্ববৃহৎ মসজিদ হিসেবে পরিচিত। জিয়াদাসহ এর পরিমাফ ৩৮০০০ বর্গগজ। প্রায় এক কোটি পঞ্চাশ লক্ষ দিরহাম ব্যয়ে নির্মিত এই মসজিদটি আয়তাকার এবং প্রাচীর বেষ্টিত। 

(৬) তৈমুরী যুগের আকর্ষণীয় মসজিদ হচ্ছে বিবি খানমের মসজিদ (১৪০৫-৬ খ্রি.)। তৈমুরী স্থাপত্যরীতি প্রকৃত বিকাশ ঘটেছে সমরকন্দের বিবি খানমের মসজিদ ও মাদ্রাসায়, হিরাতের গাওহর শাদের সমাধি, তাব্রিজের নাল মসজিদ এবং হিরাতের গাওহর শাদের মসজিদে। মুসলিম স্থপত্যের সর্বপ্রথম দ্বি-গম্বুজের ব্যবহার শুরু হয় এই সময়ে। পরবর্তীকালে তুসে আমীর তৈমুরের সমাধি, দিল্লির হুমায়ুনের সমাধি এবং আগ্রার তাজমহলে প্রতিফলিত হয়। 

(৭) ভারতীয় উপমহাদেশে সর্বপ্রথম মসজিদ নির্মিত হয় করাচি থেকে ৪০ মাইল অদূরে বামবোর নামক স্থানে। প্রত্নতাত্ত্বিকদের মতে, প্রাচীন হিন্দু রাজ্যের রাজধানী দিবাল-ই বর্তমানের বামবোর। সম্পূর্ণ ইটের নির্মিত নতুন ভিত্তিভূমিতে প্রতিষ্ঠিত বামবোর এবং মনসুরার মসজিদের সঙ্গে এর যথেষ্ট সাদৃশ্য রয়েছে। ভারতীয় উপমহাদেশে মসজিদ স্থাপত্যের প্রকৃত বিকাশ ঘটেছে দ্বাদশ শতাব্দীতে দাস বংশ প্রতিষ্ঠার পর। কুতুবউদ্দিন আইবক দিল্লিতে কুয়াত-উল-ইসলাম এবং আজমীরে আড়াই-দি-কা-ঝোপড়া মসজিদ নির্মাণ করে মসজিদ-স্থাপত্যের সূচনা করেন। 

(৮) খিলজী স্থাপত্যে অলঙ্করণে অসংখ্য মসজিদ নির্মিত হয়েছে তুঘলক যুগেও। বিশেষভাবে উল্লেখ্য ১৩৭৫ খ্রিষ্টাব্দে নির্মিত ওয়ালিরাবাদের শাহ আলেমের দরগা সংলগ্ন মসজিদ ও বেগমপুরী মসজিদ ও ১৩৭৬ খ্রীস্টাব্দে তৈরি কালি মসজিদ এবং চতুর্দশ শতাব্দীর খিরকী মসজিদ। 

(৯) দিল্লির সুলতানি আমলের পতনের পর সমগ্র ভারতীয় উপমহাদেশের বিভিন্ন প্রদেশে আঞ্চলিক স্থাপত্যরীতির উদ্ভব হয়; বিশেষভাবে উল্লেখ্য বাংলাদেশ (১৩৩৮-১৫৩৮ খ্রি.), গুজরাট (১৪০০-১৫৭২ খ্রি.), বেগমপরী (১৩৬০-১৪০০ খ্রি.), গুলবার্গা (১৩৪৭-১৪২২ খ্রি.), বিদর (১৪২২-১৫১২ খ্রি.) এবং মালব (১৪০৫-১৫৬৯ খ্রি.) রীতি। 

(১০) সুলতানি আমলে বাংলাদেশের স্থাপত্যরীতি বিশেষভাবে তাৎপর্যপূর্ণ। ইলিয়াস শাহ বংশই সর্বপ্রথম এই কৃতিত্বের দাবিদার। ‘সুলতান-ই-বাঙ্গাল’ নামে পরিচিত শামসউদ্দিন ইলিয়াস শাহ কারুকার্যমণ্ডিত মসজিদ, দুর্গ ও তোরণ তৈরি করে কৃতিত্বের পরিচয় দেন যা আজও পশ্চিমবঙ্গের পাণ্ডুয়ায় দেখা যায়। 

(১১) গিয়াসুদ্দিন আযম শাহের আমলে সাহিত্য, সংস্কৃতি ও স্থাপত্যের বিকাশ ঘটে এবং চীনা পর্যটকদের বর্ণনায় তাঁর রাজত্বের সমৃদ্ধির কথা উল্লেখ আছে। 

(১২) হোসেন শাহী স্থাপত্যরীতি উদ্ভাবক বহন করে। গৌড়, সোনারগাঁ, বর্ধমানের মঙ্গলকোট, মালদার মৌলানাতলী, মালদার শহর ও দেওতালা, মুর্শিদাবাদ, পাবনার নবগ্রাম, ঢাকার আশরাফপুর, হুগলীর সাতগাঁও ও সন্তোষপুর প্রভৃতি এলাকা থেকে অসংখ্য শিলালিপি উদ্ধার করা হয়েছে, যার মধ্যে বেশিরভাগই মসজিদ নির্মাণের স্বাক্ষর বহন করে। 

(১৩) সুলতানি আমলের মসজিদসমূহ -ঢাকা, বিন্ত বিবির মসজিদ (১৪৫৭ খ্রি.) বাগেরহাট (খুলনা) ষাট গম্বুজ মসজিদ (১৪৫৯ খ্রি.), দরসবাড়ি ও রাজবিবি মসজিদ-মাদ্রাসা (১৪৭৯ খ্রি.), রামপাল (ঢাকা), বাবা আদমের মসজিদ (১৪৮৩ খ্রি.), হাটহাজারী (চট্টগ্রাম) মসজিদ (পঞ্চম শতাব্দী, কসবা ও মসজিদ বাড়ি (বরিশাল) মসজিদ (পঞ্চম শতাব্দী), ধনচক (ফিরোজপুর, চাঁপাইনবাবগঞ্জ) মসজিদ (পঞ্চম শতাব্দী), মসজিদ কুড়ের (খুলনা) মসজিদ, বাগেরহাট খানজাহান মসজিদ, সিঙরা মসজিদ, বিবি বেগিনীর মসজিদ, চুনাখোলা মসজিদ, রণবিজয়পুর মসজিদ, শাহজাদপুর (পাবনা) মসজিদ, মুয়াজ্জেমপুর (ঢাকা) মসজিদ, দেবীকোট (দিনাজপুর) রুকুন খানের মসজিদ, গোয়ালদি (সোনারগাঁ) মসজিদ, বন্দর (নারায়ণগঞ্জ) বাবা সালেহেরন মসজিদ, বাঘা (রাজশাহী) মসজিদ, নভগ্রাম (পাবনা) মসজিদ, সুরা (দিনাজপুর) মসজিদ, পাথরাইল (ফরিদপুর) মসজিদ, শৈলকূপা (যশোহর) মসজিদ, শেরপুর (বগুড়া) খেরুয়া ও খন্দকারতোলা মসজিদ, বড় গোয়ালী (কুমিল্লা) মসজিদ, অষ্ট্রগ্রাম (ময়মনসিংহ) কতুব শাহের মসজিদ, আটিয়া (টাঙ্গাইল) মসজিদ, ঢাকার চুরিহাট্রা মসজিদ, চকবাজারের জামে মসজিদ, হাজী খাওয়াজা শাহবাজের মসজিদ, মালিক আম্বরের মসজিদ, আল্লাকুরীর মসজিদ, সাতগম্বুজ মসজিদ, লালবাগ দুর্গ মসজিদ, সিতারা বেগম মসজিদ, তারা মসজিদ, কসাইটুলী মসজিদ, বায়তুল মুকাররম মসজিদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় জামে মসজিদ, স্থাপত্যকীর্তির অমর নিদর্শন। এগারসিন্ধু, শাহ মুহম্মদের মসজিদ, রাজশাহীর শাহ নিয়াম উল্লাহ ওয়ালীর মসজিদ, গুরাই (ময়মনসিংহ) মসজিদ, মহাস্থানগড় (বগুড়া) ফারুকশিয়ারের মসজিদ, সোনারগাঁ, মগরাপাড়া মসজিদ, চট্টগ্রাম, বায়জিদ বোস্তামীর মসজিদ, শ্রীহট্ট, শাহজালালের দরগাহ মসজিদ ইত্যাদি স্থাপত্যের অপূর্ব নিদর্শন। 

মন্দির

ভূমিকা : দেবালয় বা দেবালতন অথবা মন্দির প্রতিষ্ঠার সাথে সমাজ, সংস্কৃতি ও সভ্যতার সুগভীর সম্পর্ক রয়েছে। দেবতার পরিকল্পনায় হিন্দুদের আধ্যাত্মিক মূল্যবোধের সাথে ব্যবহারিক মূল্যবোধের সমন্বয় সাধিত হয়েছে। শিল্প ও সংস্কৃতিকে যদি কোনো সুগভীর জাতীয় চৈতন্যের বাহ্যিক প্রকাশ হিসেবে গ্রহণ করা হয়, তাহলে দেবালয় নির্মাণ ছিল কোনো এক যুগের হিন্দুদের আধ্যাত্মিক চিন্তা ও ব্যবহারিক মূল্যবোধের প্রধান বিষয়। সমাজের বিবর্তনের ও পরিবর্তনের সাথে মন্দিরের শিল্পনৈপুণ্য, গঠন, অলঙ্করণ ও উপযোগিতার বিষয়টি অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। 

প্রকৃতপক্ষে, হিন্দুদের মূর্তিপূজা প্রকারান্তরে প্রতীক উপাসনা। এই পূজা উপলক্ষে আচার-অনুষ্ঠানের মধ্যে রয়েছে পার্থিব জীবনে উন্নয়নের প্রতীকধর্মী বিশ্বাস। হিন্দুদের এই প্রতীক উপাসনা সূচনা হয়েছিল সুপ্রাচীন কালে। কালক্রমে উপাসনাগার নির্মিত হয়েছে পূজা ও পূজনীয় বস্তুকে কেন্দ্র করে। 

সাধারণত মন্দির, শ্রীমন্দির, রত্নমন্দির, দেউল, দেবায়তন, দেবঘর, দেবস্থান, দেহার ও গৃহম শব্দসমূহ বা নামসমূহ দেবতার অধিষ্ঠিত স্থানকে বুঝায় এবং এসব নামকরণই বহুল প্রচলিত। কিন্তু মৎস্যপুরাণে বলা হয়েছে যে দেবগৃহ বা দেবঘর বলতে অন্তরীক্ষে কোনো মহাজ্ঞানীর আসন বোঝায়, যিনি তপোবনে দেবত্বপ্রাপ্ত হয়েছেন। খালিসপুর তাম্রশাসন, বিষ্ণপুর ও বাঁকুড়ার মালেশ্বর শিবমন্দিরে উৎকীর্ণ লিপিতে দেবকুলকে ঈশ্বরের আলয় হিসেবে গ্রহণ করার পক্ষে মত প্রকাশ করে। কিন্তু বিষ্ণু ধর্মোত্তর গ্রন্থে দেবকুলকে সারিবদ্ধ ভবনের কোণে নির্মিত অপেক্ষাকৃত ছোট মন্দির হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে। অন্যদিকে, কবি অঙ্কন মুকুন্দরাম ‘চণ্ডীমঙ্গল কাব্যে’ দেবকুল ও সুরকুলকে ‘মন্দির’ হিসেবে দেখিয়েছেন। 

মন্দির-স্থাপত্য ও ভাস্কর্যের ধারা : বাংলাদেশের মন্দির-স্থাপত্য ও ভাস্কর্যের ধারাকে তিন ভাগে ভাগ করা যায়, যথা-হিন্দু যুগ, মুসলমান যুগ ও ইংরেজ যুগ। 

(১) সমসাময়িক বিভিন্ন প্রাচীন লিপি, চিত্র ও সাহিত্য গ্রন্থ থেকে হিন্দু যুগের মন্দির নির্মাণের ধারা সম্পর্কে জানা যায়। প্রাচীন বাংলায় মোটামুটি চার ধরনের মন্দির নির্মাণ করা হত। এই চারটি রীতি হল- ভদ্র বা পীড়া দেউল, রেখ বা শিখর দেউল, স্তূপশীর্ষ পীড়া বা ভদ্র দেউল এবং শিখরশীর্ষ পীড়া বা ভদ্র দেউল। 

(২) মুসলমান শাসনামলে (বাংলার বিভিন্ন প্রকারের মন্দির সম্পর্কে স্থাপত্য রীতি অনুযায়ী পাঁচ ভাগে ভাগ করা যায়; যথা- রেখ দেউল, চালা দেউল, বাংলার মন্দির রত্ন মন্দির এবং শিকরযুক্ত অষ্টকোণ মন্দির। 

(৩) ইংরেজ যুগে বাংলাদেশের মন্দির স্থাপত্যে ইউরোপীয় প্রভাবের প্রতিফলন লক্ষ্য করা যায়। বিদেশি ভাবধারার মিশ্রণে মন্দির গঠন পরিবর্তন ও অলঙ্করণের বিস্তৃতিলাভ করে। মন্দির-গাত্রের চিত্রে নীল চাষ, পর্তুগীজ জলদস্যু ও মেমসাহেব পর্যন্ত স্থান পেয়েছে। বাংলাদেশে এসব মন্দিরসমূহের প্রত্যেকটি ধারার অবস্থান বর্তমানে নেই। মন্দির-স্থাপত্য ও ভাস্কর্যের নিদর্শন নিচে উল্লেখ করা হল : 

(ক) দোচালা বা বাংলা-রীতির মন্দির : বাংলাদেশের মন্দির-স্থাপত্যের একটা উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হল যে, পশ্চিমবঙ্গের তুলনায় এখানে দোচালা বা বাংলা-রীতির মন্দিরের আধিক্য। ‘দোচালা’ বা দুই চাল আকৃতির মন্দির বাংলাদেশের যশোর, খুলনা, ফরিদপুর ও পাবনা জেলায় উল্লেখযোগ্য পরিমাণে রয়েছে। বাংলা-রীতির মন্দির গ্রামবাংলার সাধারণ গৃহের অনুকরণে নির্মিত। এসব মন্দিরের নির্মাণ কৌশল, শিল্প ও অলঙ্করণে গ্রামবাংলার সাধারণ রূপ সুস্পষ্টভাবে প্রকাশিত। 

(খ) নবরত্ন ও পঞ্চরত্ন মন্দির : বাংলাদেশের মন্দির-স্থাপত্যের আর একটি ধারা হল বিরাট শিখর বা রত্ন নমুনার মন্দির। রত্নশৈলীর মন্দির নির্মাণ প্রকৃতপক্ষে এক প্রতিভাদীপ্ত সৃষ্টি। রত্নমন্দির নির্মিত হয় মন্দিরের অনাবৃত উপর-চূড়া প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে। বাংলাদেশের রত্ন-মন্দিরগুলোর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে পাবনার ‘হাতি কুমরুলের মন্দির’। বাংলার সুবাদার মুর্শীদকুলী খানের শাসনামলে মুর্শিদাবাদের নায়েব দেওয়ান রামনাথ ভাদুড়ী এই মন্দিরটি নির্মাণ করেন। এই জেলারই শাহজাদপুরের পোতাজিয়া গ্রামের নবরত্ন মন্দিরের ইমারত ভিন্ন কৌশলের এবং এর অলঙ্করণে ছিল পদ্মফুল ও জ্যামিতিক নকশা। 

অষ্টকোণ মন্দির : বাংলাদেশের ‘অষ্টকোণী’ বা ‘আটকোণা’ মন্দিরের সর্বপ্রাচীন উদাহরণ হল ১৭০৩ সনে সীতারাম রায় নির্মিত মুহম্মদপুরের লক্ষ্মীনারায়ণ মন্দির। অষ্টকোণী মন্দিরের চূড়ার জন্যে পঞ্চরত্ন দেউলের মতো চালা ছাদের প্রচলন লক্ষণীয়। মন্দিরের অলঙ্করণে পৌরাণিক যুদ্ধের যুদ্ধকাহিনী, বিভিন্ন দেবদেবী, কৃষ্ণলীলা ও সমাজ-জীবনের দৃশ্যাবলিই প্রকল্প জুড়ে আছে। 

প্রাচীন বাংলার উল্লেখযোগ্য মন্দিরসমূহ : কুমিল্লার সতেররত্ন মন্দির, গুঞ্জর মন্দির, বিটেশ্বর কালী মন্দির, মেহরাম জগন্নাথ মন্দির, সরাইল কালী মন্দির, সিদ্ধেশ্বরীর মন্দির, চণ্ডীমুড়ার মন্দিরদ্বয়। কুষ্টিয়ার বল্লভপুরের মন্দিরসমূহ, খোরশেদপুর- গোপীনাথপুর মন্দির, গোস্বামী দুর্গাপুরের রাধারমণ মন্দির, বলারাম হাড়ির আখড়া বা মন্দির, ফুলবাড়ি মঠ, বারদী টেরাকোটা মন্দির, নলতার মন্দির, পীরজঙ্গ মন্দির, বনগ্রামের পঞ্চরত্ন মন্দির। চট্টগ্রামের চট্টেশ্বরী মন্দির, মনোহর শিবমন্দির, সীতাকুণ্ড মন্দির, আদিনাথের মন্দির, ঢাকার রমনা কালীবাড়ি, ঢাকেশ্বরী মন্দির, সিদ্বেশ্বরীর কালীবাড়ি, জয়কালী মন্দির, লক্ষ্মীনারায়ণ মন্দির, লস্কর দীর্ঘির শিব মন্দির, বুড়ো শিবধাম। দিনাজপুরের কান্তজীর মন্দির, বোদেশ্বরীর মন্দির, গোরক্ষনাথের মন্দির, গোবিন্দ নগরের দুর্গ মন্দির। নোয়াখালীর জগন্নাথ মন্দির, রামঠাকুরের আশ্রম, ভুলুয়ার বারাহী দেবীর মন্দির। পাবনার জোড়-বাংলা মন্দির, জগন্নাথ মন্দির, কপিলেশ্বর শিব মন্দির, পোতাজিরা নবরত্ন মন্দির, দোচালা মন্দির বা শেঠের বাংলা। ফরিদপুরের কালীয়া বা খালিয়ার জোড়- বাংলা মন্দির, নলিয়ার জোড়- বাংলা মন্দির, মথুরাপুর দেউল, বেলগাছি চৈতন্যদেবের মন্দির, হরোয় মদনমোহন মন্দির, ননীক্ষীর প্রাচীন মন্দির। বগুড়ার যোগীর বা যুগীর ভবন। বরিশালের সরকার মঠ, শিকারপুরের তারা মন্দির, গোবিন্দগঞ্জের মঠ, সুতালড়ী মঠ। ময়মনসিংহের বোকাই নগরের মন্দির, একাবিংশরত্ন মন্দির, পাতোয়াইর মন্দির। যশোরের লক্ষ্মীনারায়ণ মন্দির, দশভূজার ও জোড়-বাংলা মন্দির, দোলমঞ্চ, রায়গ্রামের জোড়-বাংলা মন্দির, পঞ্চরত্ন মন্দির, গুঞ্জানাথ শিব মন্দির। রংপুরের বর্ধনকুঠী মন্দির, রাজশাহীর পুঠিয়ার গোবিন্দ মন্দির, মঙ্গলবাড়ির শিবমন্দির, গোপাল মন্দির, ভীমের পাঠি, সিলেটের জয়ন্তীপুরের কালী মন্দির, ঢুপীর মঠ। উল্লিখিত মন্দিরসমূহ প্রাচীন স্থাপত্য ও ভাস্কর্যের নিদর্শন বহন করে আছে।
Post a Comment (0)
Previous Post Next Post