↬ সমবায় আন্দোলন
↬ সমবায় আন্দোলনের গুরুত্ব
ভূমিকা : অর্থনৈতিক উদ্দেশ্য সাধনের জন্যে কতিপয় লোকের সংঘবদ্ধ হওয়ার পদ্ধতিকে ‘সমবায়’ ব্যবস্থা বলে অভিহিত করা হয়। মানবজীবনে সম্মিলিত প্রয়াস আনে সুবিপুল সম্ভাবনা। সাধারণত যেখানে একক প্রচেষ্টায় কোনো উল্লেখযোগ্য সাফল্য অর্জন সম্ভবপর হয় না, সেক্ষেত্রে সমবেত প্রচেষ্টার প্রয়োজন পড়ে। সকলে সম্মিলিতভাবে যে কজটি যত সহজে সম্পাদন করতে পারে, পৃথক পৃথকভাবে তা বাস্তবায়িত করা তত সহজ নয়। সকলে মিলে কাজ করতে পারলে তাতে সাফল্য অনিবার্য হয়ে ওঠে। এ পরিপ্রেক্ষিতে প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ কালভার্টের মতে,
‘কিছু সংখ্যক লোক যখন কোনো অর্থনৈতিক স্বার্থসাধনের জন্যে স্বেচ্ছায় সম্মিলিত হয় তখন তাকে ‘সমবায়’ বলা হয়।’
এর ওপর ভিত্তি করেই সমবায় আন্দোলনের উদ্ভব ও বিকাশ সাধিত হয়েছে।
সমবায় আন্দোলনের ইতিহাস : জার্মানি হচ্ছে সমবায় আন্দোলনের জন্মভূমি। অর্থনীতিবিদ রাইফিজেন নামক এক মহান-হৃদয়বান জার্মান সমাজ-সংস্কারক মহাজনদের নির্মম শোষণ থেকে কৃষককূলকে রক্ষার জন্যে সমবায় আন্দোলনের সূত্রপাত করেন। আমাদের এই উপমহাদেশে উইলিয়াম নিকলসন সমবায়ের নীতি গ্রহণ করেন এবং একটি ঋণদান সমিতি আইন পাস করেন। এই আইনের ভিত্তিতে শহরে-গ্রামে-বন্দরে কৃষক, কারিগর ও স্বল্পবিত্ত মানুষের মধ্যে সমবায়িক কর্মপ্রচেষ্টা প্রসারের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। ১৯০৪ সালের কোঅপারেটিভ ক্রেডিট সোসাইটজ অ্যাক্ট পাস করে বাংলা গভর্নমেন্ট সমবায়ী উদ্যোগ গ্রহণ করে। সমবায় আন্দোলনকে ব্যাপকতর করার জন্যে ১৯১২ সালে নতুন কো-অপারেটিভ অ্যাক্ট জারি করা হয় এবং এই আইনে ঋণদান সমিতি ব্যতীত ক্রয়-বিক্রয়, উৎপাদন প্রভৃতি কার্যরত অনুরূপ সমিতিগুলোকেও সমবায় সমিতিরূপে স্বীকার করা হয়। এই সময় কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক সমবায় ব্যাংঙ্ক স্থাপন করা হয়। ১৯১৯ সালে ভারত শাসন আইনের মাধ্যমে সমবায়কে প্রাদেশিক সরকারের অন্তর্ভুক্ত করা হয়। পাকিস্তান আমলে সমবায় কৃষি ব্যাঙ্ক, সমবায় বীমা সমিতি, সমবায় ঋণদান সংস্থা, বিক্রেতা সমবায় সমিতি ইত্যাদি গড়ে ওঠে। তবে সরকারি কার্যোদ্যোগের অভাবে জনগণের মধ্যে সমবায় আন্দোলনের ভিত মজবুত না হলেও এর প্রসার ঘটেছিল।
সমবায়ের বৈশিষ্ট্য : সমবায় মানুষের অর্থনৈতিক উন্নয়নের মুক্তিদাতা। সমবায়ের পরিধি ছোট থেকে অনেক বড় হতে পারে। আদর্শ সমবায় সংগঠন সমাজের অবকাঠামোর পরিবর্তন করে অর্থনৈতিক স্বচ্ছলতা দান করে। বস্তুত সমবায় গড়ে ওঠে কতিপয় মূলনীতির ওপর ভিত্তি করে। সহযোগিতামূলক মনোভাব, একতা, সাম্য, সততা, নৈকট্য, গণতন্ত্র, স্বাধীনতা, মিতব্যয়িতা ইত্যাদি নীতির উপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠে- যেখানে মানুষের, সমাজের কল্যাণ সাধনই হল মূলমন্ত্র।
বাংলাদেশে সমবায় এবং সমবায় আন্দোলনের গুরুত্ব : বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর সমবায় আন্দোলনের গুরুত্ব তীব্রভাবে অনুভূত হয়। বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় মৌল নীতিমালার মধ্যে সামাজিক ন্যায়-বিচারভিত্তিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা গড়ে তোলার লক্ষ্যে সমবায় আন্দোলনের গুরুত্ব নিঃসন্দেহে উত্তম পদক্ষেপ। বাংলাদেশ তৃতীয় বিশ্বের একটি দরিদ্র ও কৃষিনির্ভর দেশ। কাজেই অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে একটি পশ্চাৎপদ দেশের পক্ষে সমবায় নীতি খুবই ফলপ্রসূ ও কার্যকর ব্যবস্থা। এখানে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে বিশেষ করে কৃষিক্ষেত্রে সমবায়ের প্রয়োজনীয়তা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের দেশের দরিদ্র, অসহায় কৃষককুল সারাদিন প্রাণপাত পরিশ্রম করে তাদের ক্ষুধার অন্ন সংগ্রহ করতে পারে না। উপরন্তু তারা ঋণভারে জর্জরিত থাকে। কায়িক পরিশ্রমে উৎপাদিত ফসল শেষপর্যন্ত মহাজনের গোলায় ওঠে ঋণের দায়ে। এছাড়া এদেশে কৃষিজাত পণ্য বাজারজাতকরণের ব্যবস্থাও ত্রুটিপূর্ণ। যে দেশের অর্থনীতি কৃষিনির্ভর এবং শতকরা ৮৫ ভাগ মানুষ কৃষির ওপর নির্ভরশীল সে দেশে সমবায়ের গুরুত্ব অপরিসীম। সমবায়ের মাধ্যমে উন্নত বীজ, সার প্রয়োগ এবং একত্রে চাষাবাদে অধিক উৎপাদন সম্ভব। কাজেই বাংলাদেশে সমবায় আন্দোলন জনপ্রিয় করে সমবায়ের মাধ্যমে উন্নত ধরনের বৈজ্ঞানিক চাষাবাদ, কুটিরশিল্পের প্রসার, মূলধন সংগ্রহ, কাঁচামাল সংগ্রহ, কৃষিপণ্য বিক্রি প্রভৃতি ক্ষেত্রে সাফল্য অর্জন সম্ভব।
১৯৭১ সনে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের সময় সমবায়ী উদ্যোগগুলো প্রবল বিপর্যয়ের মুখে পড়ে। স্বাধীনতার অব্যবহিত পরে সমবায়ী উদ্যোগকে সর্বোচ্চ পৃষ্ঠপোষকতা দেওয়া হয়। ১৯৭২ থেকে দুই ধরনের সমবায়ী নীতি অনুসৃত ও অনুশীলিত হতে দেখা যায় :
১। সমবায় বিভাগের অধীনে চিরায়ত সমবায়,
২। সমন্বিত পল্লী উন্নয়ন কর্মসূচির (IRDB) অধীনে দ্বিস্তরবিশিষ্ট নতুন সমবায় সমূহ,
পরে এই কর্মসূচিকে বাংলাদেশ পল্লী উন্নয়ন বোর্ড (BRDB) নামে প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ করা হয়। ফলে, বাহ্যত প্রচুর সমবায় সমিতি গঠিত হতে থাকে। সমিতির সংখ্যা ৩,৩৫৬ (১৯৭১) থেকে বেড়ে ১,২৪,৬০৪ (১৯৮৮)-এ উন্নীত হয়। একক বৃহত্তম প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ পল্লী উন্নয়ন বোর্ডের অধীনে ৬৫,০০২টি (১৯৯৫) রেটিস্ট্রিকৃত কৃষক সমবায় সমিতি এবং একই সময়কালে ভূমিহীনদের সমিতি রেজিস্ট্রিভুক্ত হয়েছে ৩৪,৩৯৫টি। ১৯৯৫ সালে বাংলাদেশের সমবায় সমিতিগুলোর সম্পদের মূল্যের পরিমাণ ছিল ৭.৯৬ বিলিয়ন।
বাংলাদেশে বিভিন্ন অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে সমবায় ব্যবস্থা চালু রয়েছে। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই আশানুরূপ সাফল্য প্রত্যক্ষ করা যায় নি। বাংলাদেশের সমবায় আন্দোলনের পথে যেসব বাধা রয়েছে তা হল- শিক্ষার অভাব, সততার অভাব, দুর্নীতির প্রভাব, স্বজনপ্রীতি, ঋণ আদায়ের অব্যবস্থা, জনসমর্থন ও মূলধনের অভাব, অর্থনৈতিক সঙ্কট, সর্বোপরি সমবায়ী মনমানসিকতার অভাব- এসব কারণে এদেশে সমবায় আশানুরূপ কোনো ফল ফলাতে পারছে না। তবে এর ব্যতিক্রমও রয়েছে। আমাদের দেশে এমন অনেক সমবায় সমিতি রয়েছে যার জন্ম, ইতিহাস ও ঐতিহ্য, সুনাম দেশজোড়া। সেসব সমবায় অনেক দরিদ্র জনগোষ্ঠীর ভাগ্য নির্মাতাও বটে। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞদের অভিমত এই যে, সমিতিগুলোর ব্যবস্থাপক সদস্যদের সমবায়ী মানসিকতা উল্লেখযোগ্যভাবে উন্নত। সমবায় সমিতিগুলো আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর সহযোগিতা এবং বেসরকারি সংগঠনগুলো বাংলাদেশের উন্নয়ন প্রচেষ্টায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। বিশেষত ইক্ষু ও দুধ উৎপাদক, জেলে ও তাঁতি এবং নারীদের সমবায় প্রতিষ্ঠানগুলো সমবায় আন্দোলনে বিশেষ সাফল্যের দৃষ্টান্ত।
সমবায় আন্দোলনের উপকারিতা : সমবায়ের উপকারিতা অপরিহার্য। ‘দশে মিলে করি কাজ হারি জিতি নাহি লাজ’ – এই মূলনীতি সামনে রেখে দশজনের সম্মিলিত কর্মপ্রচেষ্টার মাধ্যমে মূলধন বিনিয়োগ করে উৎপাদন ব্যবস্থাকে যেমন সহজ ও জনকল্যাণকর করে তোলা যায়, ঠিক তেমনি মধ্যবর্তী দালালদের অবাঞ্ছিত হস্তক্ষেপ বন্ধ করা যায়। সমবায়ের মাধ্যমে উৎপাদিত শস্য সুলভ মূল্যে জনগণের মধ্যে বিতরণ সম্ভব। বর্তমান যুগে বৃহদায়তন শিল্পের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র শিল্প এঁটে উঠতে পারে না। সমবায়ের মাধ্যমে সে অসুবিধা দূর করে স্বল্পবিত্ত লোকেরা দশজনে মিলে শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে পারে। সমবায় প্রতিষ্ঠানে অংশীদারগণ মালিক নয় বলে পরস্পরের মধ্যে সাম্যভাব গড়ে ওঠে এবং অধিকতর সহযোগিতার ফলে উৎপাদন বৃদ্ধি পায়। সমবায়ের মাধ্যমে পুরুষানুক্রমে খণ্ডিত জমি একত্রীকরণ করে অধিক ফসল উৎপন্ন করা যায়। কৃষকেরা সমবায়ের মাধ্যমে কৃষিঋণ, উন্নত সার ও বীজ সংগ্রহ করতে পারে। সমবায়ের মাধ্যমে অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টির হাত থেকে ফসল রক্ষার জন্য পাওয়ার পাম্পের সাহায্যে সেচ ও পানি নিষ্কাশন সম্ভব হয়। এক কথায়, অভিন্ন স্বার্থে স্বল্পবিত্ত লোকেরা সামান্য সম্পদ বিনিয়োগ করে উপকৃত হয় বলে সমগ্র বিশ্বে সমবায় প্রতিষ্ঠান আজ জনপ্রিয় হয়ে ওঠেছে।
উপসংহার : ‘Unity is strength’- একতাই বল- এই মূলমন্ত্রকে সামনে রেখে, আমাদের মতো দারিদ্র্য-পীড়িত দেশে কোটি কোটি দরিদ্র শ্রমজীবী মানুষের প্রয়োজনে পরস্পরের ক্ষুদ্র স্বার্থ বিসর্জন দিয়ে সমবায় আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। আমাদের মনে রাখতে হবে যে, এদেশ একটি কৃষিপ্রধান দেশ। এখানকার কৃষিব্যবস্থা এখনো যথেষ্ট উন্নত নয়। আধুনিকীকরণের মাধ্যমে কৃষিব্যবস্থার ক্ষেত্রে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনয়নের যে প্রচেষ্টা বর্তমানে চলছে তাতে সমবায়ব্যবস্থা যথেষ্ট সাফল্য আনতে পারে। শিল্পক্ষেত্রেও সমবায়ের প্রয়োগের বিশেষ প্রয়োজন রয়েছে। তবে এর সাফল্যের জন্য উপযুক্ত শিক্ষার প্রয়োজন। আশার কথা যে, বর্তমানে আমাদের দেশে বিভিন্ন কুটিরশিল্পে ও পরিবহন ক্ষেত্রে সমবায়ের সুফল পাওয়া যাচ্ছে। আমাদের জাতীয় জীবনে সামাজিক ন্যায়-বিচারভিত্তিক জীবন-চেতনা আরো জাগ্রত হলে সমবায় আন্দোলন উত্তরোত্তর জনপ্রিয়তা লাভ করবে। এক্ষেত্রে বিদ্রোহী-কবি কাজী নজরুল ইসলামের কবিতাগুচ্ছটি আমাদের কাছে স্মরণীয় ও বরণীয়-
‘ওরে নিপীড়িত, ওরে ভয়ে ভীত শিখে যা আয়রে আয়
দুঃখ জয়ের নবীন মন্ত্র ‘সমবায় সমবায়’
ক্ষুধার জ্বালায় মরেছি সুধার কলস থাকিতে ঘরে।
দারিদ্র ঋণ-অভাবে জ্বলেছি-না চিনে পরস্পরে,’