ভূমিকা : বাংলাদেশের অপূর্ব প্রাকৃতিক রূপসম্ভারের মত বাঙালি জাতির নিজস্ব মানসিকতা ও হৃদয়-সৌন্দর্যের মত পশুপাখির রূপ প্রকৃতিরও আছে এক স্বাতন্ত্র্যপূর্ণ বৈশিষ্ট্য, যা অনায়াসে চোখে পড়ার মত। বাংলার প্রকৃতি যেন আপন হাতে তার পশুপাখির রূপ-প্রকৃতি রচনা করে দিয়েছে। বিচিত্র বর্ণবাহারে ও অপূর্ব কণ্ঠ-মাধুর্যে তারা দীর্ঘকাল বাঙালি জাতির মনোহরণ করে এসেছে। বাংলাদেশের শ্যামলী-ধবলী হতে শুরু করে চন্দনা ‘বউ-কথা-কও’ পর্যন্ত- বাঙ্গ-প্রকৃতির হৃদয়ের সেই সরলতাময়, মাধুর্যপূর্ণ অভিব্যক্তির নিশ্চিত প্রতীক। পূর্ব-দিগন্তে সূর্যালোকের আগমনের আগেই তারা সমবেত কলকাকলিতে বাঙালির ঘুম ভাঙায়, সারাদিন সেবা ও সৌন্দর্যে করে মনোরঞ্জন, দিনান্তে এক অপূর্ব বিদায়-রাগিনী সৃষ্টি করে তারা আপন নীড়ে ফেরে। আবার রাত্রি-নিশীতে তারা বনান্তরাল থেকে আপন সংগীত-প্রসন্নতা দিয়ে বাংলাদেশের নৈশ আকাশ প্লাবিত করে দেয়।
পশুপাখি বাংলা সাহিত্য : বাংলা সাহিত্যের প্রাচীন চর্যাপদে কুমীর, কচ্ছপ, হরিণ, শেয়াল এমনি অনেক পশুরই উল্লেখ আছে। পশুপাখির উল্লেখ আছে শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যে। উল্লেখ আছে মধ্যযুগের মঙ্গল কাব্যে। দেবীর কাছে ‘পশুদের গোহারি’র ভেতর দিয়ে মনুষ্যেতর প্রাণীর দুঃখ-দুর্দশার চিত্র এঁকেছেন কবি। পশু-পাখির বিবরণ আছে পঞ্চতন্ত্রের গল্পে, রূপকথার আখ্যানে। বাংলা সাহিত্যের আসরে এদের আবির্ভাব নবাগত নয়, দীর্ঘকাল ধরেই এরা বাঙালির জীবন-ভাবনার সঙ্গে যুক্ত।
প্রধান গৃহপালিত পশু-গরু : বাংলাদেশের গৃহপালিত পশুদের মধ্যে গরু, মহিষ, ভেড়া, ছাগল, কুকুর, বিড়াল, গাধা ও ঘোড়ার নাম উল্লেখ করা যায়। ঘোড়া বাংলাদেশের পশু নয়। কিন্তু বহুকাল বাংলায় প্রতিপালিত হয়ে এখানকার প্রাণী হয়ে গেছে। গরুই বাংলাদেশের সর্বাধিক আদরের প্রাণী। ঘরে ঘরে সে শুধু প্রতিপালিত এবং আদরণীয়। তার দৈহিক বিশালতা না থাকলেও তার শরীরে এমন একটি বিশিষ্ট সৌন্দর্য আছে যা বাংলাদেশের পানি-বাতাসের সঙ্গে আশ্চর্যরূপে মিশে যায়। কৃষি মাতৃক বাংলাদেশের অর্থনীতিকে গরুই যুগ যুগ ধরে সমৃদ্ধ করে এসেছে এবং আজও করে চলেছে। সে লাঙল, গাড়ি ও বোঝা বহন করে। আর মাছে যখন দলবদ্ধভাবে চরে বেড়ায় তখন সৃষ্টি করে এক দুর্লভ সৌন্দর্য।
মহিষ, ভেড়া, ছাগল, গাধা, ঘোড়া, কুকুর, বিড়াল : “মোষ নিয়ে পার হয় রাখালের ছেলে।” -এটা বাংলাদেশের একটি সুলভ দৃশ্য। মহিষের গরুর মত ক্ষীর, দুধ, সর, ননী পাওয়া যায় এবং সে লাঙল ও গাড়ি টানে, বোঝা বহন করে মানুষের সেবা করলেও গরুর মত জনপ্রিয়তা লাভ করতে পারেনি। ভেড়া ও ছাগল দুধ দান করে এবং উপাদেয় মাংস উপহার দেয়। গাধা ও ঘোড়া বোঝা ও গাড়ি টানে। কুকুর ও বিড়াল দেয় সেবা ও সাহচর্য।
বাংলার অরণ্য-পালিত পশু ও সুন্দরবনের পশুপাখি : বাংলাদেশের প্রকৃতির কোলে যে পশুর স্বাধীনভাবে বিচরণ করে, তাদের কথা বলা যায়। তারা অরণ্যের শ্যামল ছায়ায় জন্মায় এবং অরণ্যের স্নেহে প্রবর্ধিত হয়। হিমালয়ের তরাই অঞ্চল এবং সুন্দরবন আরণ্যক পশুদের স্বাধীন বিহার-ভূমি। তারাই অঞ্চলে হাতি, চিতা, বাঘ ও নেকড়ে বাঘের সাক্ষাৎ পাওয়া যায়। সুন্দরবনের রয়াল বেঙ্গল টাইগার বিশ্ববিখ্যাত।
“সেখানে মানুষ কেউ যায় নাকো- দেখা যায় বাঘিনীর ডোরা
বেতের বনের ফাঁকে, -জারুল গাছের তলে রৌদ্র পোহায়
রূপসী মৃগীর মুখ দেখা যায়-।”
সুখ-দর্শন হরিণ সুন্দরবনের সৌন্দর্য। তাছাড়া, হায়না, চিতা বাঘ, নেকড়ে বাঘ তো আছেই। এর গভীর গহন অরণ্যে নানা গাছগাছালির মায়াবিস্তার। নদী খাল বিল খাঁড়ির ছড়াছড়ি। হেঁতাল-গরান-গেমা-গোলপাতা-পরেশ-পিপুল-বাইন-তরা গাছের বিরাট সাম্রাজ্য। আর তারই মধ্যে ঘুরে বেড়ায় আমাদের জাতীয় পশু সুন্দরবনের রয়াল বেঙ্গল টাইগার। নদীর চড়ায় রোদ পোহায় কুমির। বানীগাছের তলায় দলবদ্ধ হরিণের পাল। গাছে গাছে অসংখ্য বাঁদরের লম্ফঝম্ফ। বিষধর সাপের আনাগোনা। বনমুরগির ডাকে ঘুম ভাঙে সুন্দরবনের। অসংখ্য পাখির কলকাকলি। উচ্ছল নদীর বুকে গাঙচিল সাঁতার কাটে।
বাংলাদেশের শিয়াল তো কাব্য-মর্যাদা লাভ করেছে।– “রাতে ওঠে থেকে থেকে শিয়ালের হাঁক।” সারারাত ধরে পল্লী বাংলার শিয়ালের দল প্রহর ঘোষণা করে চলে। আর আছে নেউল। সর্পসঙ্কুল বাংলাদেশে নেউলের একটি বিশিষ্ট ভূমিকা আছে। এর যেখানে উপস্থিতি সেখানে সাপের অনুপস্থিতি।
বাংলার বিচিত্র পাখি : বাংলাদেশের পাখিদের একটি নিজস্ব সৌন্দর্য আছে। বাংলার কাকের কণ্ঠে প্রথম প্রভাত-রাগিনীটি বেজে ওঠে। তারপর শ্যামা, ফিঙ্গে, দোয়েল, পাপিয়া তাদের বিচিত্র কলতানে সৃষ্টি করে অপূর্ব ঐকতান। পূর্বাকাশে অরুণোদয়ের রক্তিমার সঙ্গে মিলেমিশে তাদের সংগীত পৃথিবীর মৃন্ময় পাত্রটিকে হিরন্ময় করে তোলে। এরা গ্রাম-বাংলার মুখর গায়ক, উদাসী বাউল। বাঙালি কবিরা এদের প্রশস্তি রচনা করেছেন। বুলবুল একেবারে বাংলার ঘুমপাড়ানী গানে চির-অমরত্ব লাভ করে আছে। বসন্তের কোকিল বহু প্রশংসিত। শিমুল পলাশ দাড়িম্ব ও মাধবী মঞ্জরীর রক্তিম প্রগলভতার দিনে কোকিলের পঞ্চম তান এক অনির্বচনীয় সুর-মূর্ছনায় বাংলার আকাশকে প্লাবিত করে।
ময়না ও কাকাতুয়া শিশু-পাঠ্যপুস্তকে স্থান গ্রহণ করেছে তাদের নিজস্ব জনপ্রিয়তার গুণে। চন্দনা-টিয়াও বাংলাদেশে বিশেষ জনপ্রিয়। গ্রীষ্মকালে চাতকের বারি-প্রার্থনা, জ্যোৎস্না-নিশীথে, নিদ্রা-জাগরণে ‘বউ-কথা-কও’ পাখির ডাক এক অন্যবদ্য সুর মূর্ছনায় বাংলাদেশের আকাশকে প্লাবিত করে।
পানির পাখি : বাংলাদেশ পুকুর-দীঘি, খাল-বিল, নদী-নালার দেশ। কাজেই বাংলাদেশ জলচর পাখিদের বিশেষ প্রিয়স্থান। বাংলার পুকুর-দীঘিতে গৃহপালিত পাতিহাঁস-রাজহাঁসের সারি প্রায়ই চোখে পড়ে, আর চোখে পড়ে মৎস্য-ধ্যানে নিমগ্ন বক ও মাছরাঙা। কালো মেঘের বুকে উড্ডীয়মান বুক-পঙ্ক্তির দৃশ্য অতীব সুন্দর। “সে আকাশ পাখনায় নিঙড়ায় লয়ে। কোথায় বক মাছরাঙা উড়ে যায় আশ্বিনের মাসে।” এছাড়া, চলনবিল অঞ্চলে, পদ্মা, যমুনা, মেঘনায় এবং দক্ষিণের সমুদ্র উপকূলে দেখা যায় ভারত পাখি, ধনেশ, বেলেহাঁস, কাদাখোঁচা, জলপিপি, পানকৌড়ি, চিল, গাঙচিল, গাঙ-শালিক ইত্যাদি পাখি।
প্রাণী-সংরক্ষণ নীতি : আজ প্রযুক্তিবিদ্যার প্রসার ঘটেছে। বেড়েছে লোকসংখ্যা। নগর-সভ্যতার বিস্তার হয়েছে। দিকে দিকে গড়ে উঠেছে ছোট-বড় কত ক্ষুদ্র-বৃহৎ কলকারখানা। পত্তন হয়েছে শিল্পনগরীর। মানুষ প্রয়োজনের তাগিদে বন কেটে বসত করছে। লোপ পেয়েছে গহীন অরণ্য। হারিয়ে গেছে অনেক সাধারণ বনভূমি। সুন্দরবনের বৃহৎ অংশ জুড়ে মানুষ এখন নতুন গ্রাম-গঞ্জের পত্তন করেছে। আজও সেখানে অরণ্য-সম্পদ লুণ্ঠন ও প্রাণী নিধনের অবাধ লীলাক্ষেত্র। মিলিয়ে যাচ্ছে অরণ্যচারী কত পশুপাখি। প্রকৃতির ভারসাম্য নীতিতে আজ বিপর্যয়ের অশুভ ছায়াপাত। মানব সভ্যতার সামনে আজ এক মহাসংকট। তাই বিশ্বের সর্বত্র পশুপাখি সংরক্ষণের এত উদ্যোগ-আয়োজন। জীব, জীবেতর, প্রকৃতি প্রত্যেকের সঙ্গেই প্রত্যেকের শৃঙ্খল-বন্ধন। সেজন্যেই আজ প্রাণী-সংরক্ষণ নীতি গৃহীত হয়েছে। প্রতিষ্ঠিত হয়েছে অভয়ারণ্য।
উপসংহার : বাংলাদেশের পশুপাখির বাংলার প্রকৃতির রূপ-মাধুরীর অবিভাজ্য অঙ্গ। একসময় যখন এদেশ ইংরেজের কবলে পতিত হয়েছিল তখন তারা নির্মমভাবে বাংলার পশুপাখিকে নিধন করেছিল। বলাবাহুল্য যে, তাতে বাংলার প্রকৃতিকে, তার প্রাকৃতিক সৌন্দর্যকে নিষ্ঠুর ঘাতকের মত হত্যা করা হয়েছিল। এমন ঘটনা আজও অহরহ ঘটছে। রূপসী বাংলার এই রূপ-ক্ষয় প্রতিরোধ করার জন্যে জাতীয়ভাবে সচেষ্ট হতে হবে। এছাড়া, বর্তমানে যেমন বৃক্ষরোপণ অভিযান শুরু হয়েছে, ঠিক তেমনিভাবে পশুপালনেরও ব্যবস্থা করতে হবে। এভাবেই আমাদের প্রকৃতির ভারসাম্য রক্ষা পাবে। পশুপাখি গাছগাছালি নিয়েই আমাদের প্রকৃতি-পরিবেশ। এ প্রকৃতির-পরিবেশেই আমাদের জীবন। আমাদের বাঁচন।