↬ বঙ্গবন্ধু যমুনা সেতু
↬ বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে যমুনা সেতু
ভূমিকা : স্বপ্নের সেতু যমুনা সেতু। এটি কেবল সেতু বা স্বপ্নই নয় বাংলাদেশের মানুষের দীর্ঘদিনের লালিত আকাঙ্ক্ষার সফল বাস্তবায়ন এবং সামাজিক, রাষ্ট্রীয় ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে, যোগাযোগ ব্যবস্থার ক্ষেত্রে এক যুগান্তকারী পদক্ষেপ। যমুনা নদীর উপর দিয়ে এ সেতু নির্মাণের মাধ্যমে বাংলাদেশের পূর্ব ও পশ্চিমাঞ্চলের মানুষের দীর্ঘদিনের একটি লালিত স্বপ্ন বাস্তবে রূপ নিয়েছে। দেশের অবহেলিত উত্তরাঞ্চলের যোগাযোগ আর উন্নয়নের ক্ষেত্রে যমুনা সেতুর গুরুত্ব আজ সর্বজনস্বীকৃত। একবিংশ শতাব্দীর দ্বারপ্রান্তে উদ্বোধিত এই সেতু নতুন যুগের মোকাবিলার ক্ষেত্রে এক অনন্য ভূমিকা পালন করবে। সেতুটি নির্মাণের প্রথম পর্যায় থেকে শেষ পর্যন্ত বিভিন্ন দেশি বিদেশি নির্মাণসংস্থা কাজ করেছে।
পটভূমি বা সেতু নির্মাণের আদিকথা : যমুনার উপর একটি সেতু নির্মাণের প্রথম আনুষ্ঠানিক সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় ১৯৬৬ সালে প্রাদেশিক পরিষদের অধিবেশনে। এ পরিষদের সর্বসম্মত প্রস্তাব ছিল, ‘যমুনা নদীর উপর বাহাদুরাবাদ ও ফুলছড়ির মধ্যে একটি সেতু নির্মিত হোক।’ অতঃপর ১৯৭০ সালে তৎকালীন পাকিস্তানে সাধারণ নির্বাচনের প্রাক্কালে রেডিও এবং টেলিভিশনে সম্প্রচারিত জাতির উদ্দেশ্যে দেয়া এক ভাষণে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আওয়ামী লীগের নির্বাচনী অঙ্গীকারে যমুনা সেতু নির্মাণের বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করেন। ১৯৭৩ সালে প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জাপান সফরের সময় জাপান সরকারকে যমুনা সেতু নির্মাণের গুরুত্ব ব্যাখ্যা করেন এবং সহযোগিতা চান। পরবর্তী সময়ে ১৯৭৬ সালে জাপানিজ ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সি সেতুর সম্ভাব্যতা যাচাই শেষ করে। আর তখন থেকেই যমুনা বহুমুখী সেতু নির্মাণের পরিকল্পনা শুরু হয়। ১৯৮২ সালে পেট্রোবাংলার সমীক্ষা পরিচালিত হয়। ১৯৮৪ সালের জুন মাসে মন্ত্রিসভার বৈঠকে সেতু নির্মাণের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।
সেতু নির্মাণের প্রাথমিক প্রস্তুতি : যমুনা বহুমুখী সেতু প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য ১৯৮৫ সালের ৪ জুলাই তৎকালীন প্রেসিডেন্ট হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ‘যমুনা বহুমুখী সেতু কর্তৃপক্ষ’ গঠনের জন্য অধ্যাদেশ জারি করেন। সেতু নির্মাণের জন্য অভ্যন্তরীণ সম্পদ সংগ্রহের উদ্দেশ্যে ‘যমুনা সেতু সারচার্জ এবং লেভী’ চালু করে আরো একটি অধ্যাদেশ জারি করা হয়। ১৯৯৪ সালের জুন মাস পর্যন্ত লেভী ও সারচার্জ বাবদ সংগৃহীত অর্থের পরিমাণ দাঁড়িয়েছিল ৫০৮ কোটি টাকা। ১৯৯২ সালে বেগম খালেদা জিয়ার সরকারের সময়ে দাতাসংস্থাগুলো শর্ত সাপেক্ষে যমুনার উপর সেতু নির্মাণের জন্য আর্থিক সহায়তা দিতে সম্মত হলে আন্তর্জাতিক দরপত্র আহ্বান করা হয়।
স্থান নির্বাচন : ১৯৮৬ সালের মার্চে ইউএনডিপি, আরপিট, এনডিইসিও এবং বিসিএলকে সেতু নির্মাণের উপযুক্ত স্থান নির্বাচনের জন্য নিযুক্ত করা হয়। ব্যাপক পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে সাতটি স্থানের মধ্যে সিরাজগঞ্জ এবং ভূয়াপুর, সেতুর জন্য সবচেয়ে উপযুক্ত স্থান হিসেবে বিবেচিত হয়।
সেতুর আকার ও আকৃতি : তৎকালীন সময়ে ৪.৮ কিলোমিটার দীর্ঘ, ১৮.৫ মিটার প্রশস্ত সেতু যা পৃথিবীর একাদশ, এশিয়ার পঞ্চম ও বাংলাদেশের বৃহত্তম সেতু ছিল বঙ্গবন্ধু যমুনা সেতু। যমুনার বিশালতা ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের মধ্যে নদী বক্ষ ভেদ করে সুকঠিন ইস্পাত, পাথর ও কংক্রিটে নির্মিত এ সেতু ধনুকের মত ঈষৎ বাঁকা। রেলপথ, বিদ্যুৎ লাইন, গ্যাস লাইন ও টেলিযোগাযোগ লাইন সম্বলিত এ সেতুর মোট প্রকল্প এলাকা ৭৮৭৯.৩৯ একর এবং স্প্যান সংখ্যা ৪৯টি। ১২৬৩টি ডেক সেগমেন্ট, ১২১টি পাইল, পাইলের জন্য ইস্পাত ৩৪,০০০টন, ৫০টি পিলার ও ৪ লেন বিশিষ্ট এ সেতুর পূর্ব ও পশ্চিম তীরের সংযোগ সড়কের দৈর্ঘ্য যথাক্রমে ১৫.৩ ও ১৪.৪ কিলোমিটার এবং উভয় পার্শ্বে গাইড ব্যান্ডের দৈর্ঘ্য ২.২ কিলোমিটার।
নির্মাণ ব্যয় ও সহযোগিতা : বঙ্গবন্ধু যমুনা সেতু বাস্তবায়নে ব্যয় হয় প্রায় চার হাজার কোটি টাকা। তন্মধ্যে তিনটি উন্নয়ন সংযোগী সংস্থা- আইডিএ, এডিবি ও ওইসিএফ (জাপান) প্রত্যেকে ২০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার করে মোট ৬০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার অর্থ যোগান দেয়। অবশিষ্ট অর্থ বাংলাদেশ সরকারের নিজস্ব তহবিল থেকে ব্যয় করা হয়েছে।
নির্মাণ কাজ শুরু ও উদ্বোধন : ১৯৯৪ সালের ১৬ অক্টোবর বঙ্গবন্ধু যমুনা সেতুর নির্মাণ কাজ শুরু হয়। এ বৃহৎ প্রকল্পের বাস্তবায়নের ৪৪ মাস সময় লাগে যা নির্ধারিত সময় অপেক্ষা ৬ মাস বেশি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২৩ জুন ১৯৯৮ যমুনা নদীর উপর নির্মিত আত্মগৌর ও অগ্রগতির অপূর্ব নিদর্শন বঙ্গবন্ধু যমুনা সেতু উদ্বোধন করার মধ্য দিয়ে একটি স্বপ্নের ফলক উন্মোচিত করেন।
অর্থনৈতিক উন্নয়নে বঙ্গবন্ধু যমুনা সেতু : একটি দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নে সমন্বিত যাতায়াত ব্যবস্থা গড়ে তোলা অপরিহার্য। বঙ্গবন্ধু সেতু বাস্তবায়নের ফলে যাতায়াত ও জ্বালানি ব্যবস্থার সমন্বয়সহ বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে সঙ্গতিপূর্ণ অবস্থার সৃষ্টি হবে। সুষম অর্থনৈতিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে সমতার প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য।
যোগাযোগ ক্ষেত্রে প্রভাব : বঙ্গবন্ধু যমুনা সেতুর মাধ্যমে দেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে স্বল্প ব্যয় ও কম সময়ে সুষ্ঠুভাবে যাত্রী ও মালামাল পরিবহন সহজতর হবে। ফলে এ অঞ্চলের প্রায় ৩ কোটি অধিবাসীর আর্থসামাজিক উন্নয়নের গতি ত্বরান্বিত হবে।
কৃষিক্ষেত্রে প্রভাব : বঙ্গবন্ধু যমুনা সেতুর বদৌলতে অবহেলিত চাষীরা সফলের ন্যায্যমূল্য পাবে, যা দারিদ্র্য বিমোচনে সহায়তা করবে। ঐ অঞ্চলে উৎপাদিত পণ্য সহজে বাজারজাত করা যায়নি বলে উজ্জ্বল সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও কৃষিক্ষেত্রে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যমাত্রায় উৎপাদন বাড়ানো সম্ভব হয় নি। কিন্তু সেতুটি বাস্তবায়নের ফলে এ বাধা দূরীকরণের মাধ্যমে জাতীয় উন্নতি ত্বরান্বিত হবে।
জ্বালানি ক্ষেত্রে প্রভাব : বঙ্গবন্ধু যমুনা সেতুর আন্তঃসংযোগ বিদ্যুৎ লাইন এবং গ্যাস লাইন দেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের জ্বালানি ঘাটতি বহুলাংশে লাঘব করবে, যা বন উজাড় রোধ করে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় সহায়ক হবে। তাছাড়া জ্বালানি সরবরাহ ঐ অঞ্চলে কৃষিভিত্তিক শিল্প প্রতিষ্ঠার সহায়ক হবে এবং ঐ অঞ্চলের তেলভিত্তিক বিদ্যুৎ স্টেশনগুলো গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎ স্টেশনে রূপান্তরিত রা সম্ভব হবে। এতে বছরে প্রায় ৪০ মিলিয়ন ডলার অর্থ সাশ্রয় হবে।
কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে প্রভাব : বঙ্গবন্ধু যমুনা সেতু এশীয় মহাসড়কের গুরুত্বপূর্ণ স্থানে অবস্থিত হওয়ায় এটি আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক স্থল যোগাযোগ নেটওয়ার্কের সঙ্গে যুক্ত করবে গোটা বাংলাদেশকে। ফলে দেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে গড়ে উঠবে নতুন নতুন শিল্প-কারখানা এবং সৃষ্টি হবে ব্যাপক কর্মসংস্থান। এতে দেশের অর্থনৈতিক বুলিয়াদ মজবুত হবে, বেকারত্ব হ্রাস পাবে এবং বাংলাদেশ পরিণত হবে সোনার বাংলায়।
শিল্প-বিকেন্দ্রীকরণে প্রভাব : সুষ্ঠু যোগাযোগ ব্যবস্থার অভাবে দেশের উত্তরাঞ্চলে ব্যাপক শিল্পায়ন সম্ভব হয় নি। কিন্তু বঙ্গবন্ধু যমুনা সেতু নির্মাণের ফলে দেশের উত্তরাঞ্চলে শিল্পের বিকেন্দ্রীকরণের মাধ্যমে উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে, মজবুত হবে দেশের অর্থনৈতিক বুনিয়াদ এবং খুলে যাবে নতুন দিগন্তের দ্বার।
টেলিযোগাযোগ ক্ষেত্রে প্রভাব : প্রযুক্তির উৎকর্ষতার যুগে প্রযুক্তির বিপ্লব ঘটাতে সুষ্ঠু টেলিযোগাযোগ ব্যবস্থার বিকল্প নেই। যান্ত্রিক সভ্যতার অন্যতম প্রয়োজনীয় যোগাযোগ মাধ্যম টেলিযোগাযোগ। বঙ্গবন্ধু সেতু নির্মাণের ফলে এ সেতুতে সংযুক্ত টেলিযোগাযোগ লাইন দেশের উভয় অঞ্চলের মানুষের অশেষ কল্যাণ ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে যুগান্তকারী সুফল বয়ে আনবে। এরই ফলশ্রতিতে সম্প্রসারিত হবে গোটা দেশের টেলিযোগাযোগ নেটওয়ার্ক।
বনায়নে প্রভাব : বঙ্গবন্ধু যমুনা সেতু নির্মাণকল্পে নদীশাসন তথা ড্রেজিং করার ফলে দেশের উত্তরাঞ্চলে এক বিরাট অংশ মরুভূমিতে পরিণত হয়েছে। তাই সেখানকার পরিবেশগত ভারসাম্য রক্ষার জন্য বনায়ন কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে। ফলে দেশের বনভূমির পরিমাণ বৃদ্ধি পাবে যা দেশের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
উপসংহার : একবিংশ শতাব্দীর সূচনালগ্নে বঙ্গবন্ধু সেতুর সমাপ্তি বাংলাদেশের মত একটি উন্নয়নশীল দেশের জন্য বিশেষ আশীর্বাদ। এ সেতু দেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের তুলনামূলক সুবিধাদি কাজে লাগিয়ে সার্বিক উন্নয়নে কর্মকাণ্ডের অনুঘটক হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। আগামী শতাব্দীতে আমাদের অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক উন্নয়নে বহুদিনের কাঙ্ক্ষিত ‘বঙ্গবন্ধু সেতু’ একটি সুস্পষ্ট মাইলফলক হিসেবে চিহ্নিত হবে।