বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন, চীন ও ভারতের ভূমিকা

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে কেন্দ্র করে তৎকালীন বিশ্বের তিনটি বৃহৎ শক্তি তাদের নিজ নিজ অবস্থান থেকে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে ও বিপক্ষে অবস্থান গ্রহণ করে। দুটি সমাজতান্ত্রিক দেশ সোভিয়েত ইউনিয়ন ও চীনের অবস্থান ছিল পরস্পরবিরোধী। আদর্শগতভাবে চীন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র দুই মেরুতে অবস্থান করলেও ক্রমবর্ধমান সোভিয়েত প্রভাববলয় প্রতিহত করতে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রশ্নে তারা বিরোধী ভূমিকায় অবর্তীন হয়েছিল। অন্যদিকে তৎকালীন বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহৎ পরাশক্তি সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং প্রতিবেশী দেশ ভারত পরম বন্ধুর ন্যায় বাংলাদেশের পাশে এসে দাঁড়িয়ে ছিল। এমনকি শেষ পর্যন্ত ভারত সরাসরি যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে বাংলাদেশের বিজয় নিশ্চিতকরণে মূখ্য ভূমিকা পালন করে। 

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা : বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নীতি প্রথম থেকেই বাঙালিস্বার্থের পরিপন্থি ছিল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের লক্ষ্য ছিল পাকিস্তান নেতৃবৃন্দের বিরাগভাজন না হওয়া। মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস নিক্সন প্রশাসন পাকিস্তানের জন্য নৈতিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সমর্থন যুগিয়েছিল। পাকিস্তানকে সমর্থন করার পেছনে প্রেসিডেন্ট নিক্সনের ব্যক্তিগত সহানুভূতি, চীনের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক উন্নয়ন, দীর্ঘ পাক-মার্কিন সামরিক ও বেসামরিক সম্পর্ক বড় ভূমিকা পালন করেছে। ভারতের সাথে সোভিয়েত ইউনিয়নের ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক ও সামরিক সম্পর্কের প্রেক্ষাপটে দক্ষিণ এশিয়ায় সোভিয়েত ইউনিয়নের আধিপত্য খর্ব করার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানঘেঁষা নীতি অনুসরণ করে। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত মার্কিন নীতিতে তিনটি বৈশিষ্ট্য ধরা পড়ে। 
  • সমস্যাটিকে পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ সমস্যারূপে চিহ্নিত করা। 
  • ত্রাণ কাজে আর্থিক সাহায্য অব্যাহত রাখা। 
  • গোপনে পাকিস্তানে সামরিক সাহায্য অব্যাহত রাখা। 
পাকিস্তানের অখণ্ডতা বিপন্ন হোক নিক্সন প্রশাসন তা চায়নি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এ সময় এক পাকিস্তানের আওতায় একটি রাজনৈতিক সমাধানেরও চেষ্টা করেছিল। কিন্ত সোভিয়েত ইউনিয়নের তৎপরতায় তা সম্ভব হয়নি। ১৯৭১ সালের ৩ ডিসেম্বর পাক-ভারত সর্বাত্মক যুদ্ধ শুরু হয়ে গেলে প্রেসিডেন্ট নিক্সন পাকিস্তানকে সব ধরনের নৈতিক ও কূটনৈতিক সহযোগিতা দেওয়ার জন্য হেনরি কিসিঞ্জারকে নির্দেশ দিয়েছিলেন, যা ‘TIT POLICY’ নামে অভিহিত হয়ে আছে। এ নীতির আওতায় এমন সব সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছিল, যা ছিল পাকিস্তানঘেঁষা। এসব নীতি পাকিস্তানের স্বার্থ রক্ষা করেছিল। যুক্তরাষ্ট্র প্রথমে ভারতের জন্য বরাদ্দকৃত সাহায্য ৮৭.৬ মিলিয়ন ডলার বন্ধ করে দেয়। জাতিসংঘে ভারতবিরোধী তৎপরতা চালানো হয়। যুদ্ধবিরতি চুক্তি যাতে স্বাক্ষরিত হয় তারও উদ্যোগ নিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র। ৪ ডিসেম্বর জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে যুক্তরাষ্ট্র পূর্ব পাকিস্তানে যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব করে। কিন্তু সোভিয়েত ইউনিয়নের ভেটো প্রয়োগের ফলে যুদ্ধবিরতি প্রস্তাব বাতিল হয়ে যায়। এক পর্যায়ে যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানের পশ্চিম অংশ যাতে ভেঙে না যায় সে ব্যাপারে ক্রেমলিনকে অনুরোধ করেছিল। 

মুক্তিযুদ্ধের শেষ পর্যায়ে এসে ১৯৭১ সালের ৯ ডিসেম্বর প্রেসিডেন্ট নিক্সন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জারকে বঙ্গোপসাগরে সপ্তম নৌবহর প্রেরণের নির্দেশ দেন। এজন্য গঠন করা হয় ‘টাক্সফোর্স-৭৪’। সপ্তম নৌবহরকে মালাক্কা প্রণালিতে জড়ো হওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়। তিন দিন পর ১২ ডিসেম্বর সপ্তম নৌবহরের পারমাণবিক রণতরী ইউএসএস এন্টারপ্রাইজসহ অন্য সব যুদ্ধ জাহাজ ও জেটবহরকে বঙ্গোপসাগরে পৌঁছতে বলা হয়। কিন্তু সোভিয়েত ইউনিয়নের একটি নৌবহর ভারত মহাসাগরে অবস্থান করায় এবং তৎক্ষণিকভাবে সোভিয়েত ইউনিয়ন মার্কিন সপ্তম নৌবহরকে ঠেকাতে আরো দুটি টাস্কফোর্স ভারত মহাসাগরে প্রেরণ করলে মার্কিন সপ্তম নৌবহর বঙ্গোপসাগরে প্রবেশ করেনি। ভারতকে ভীতি প্রদর্শন ও পশ্চিম পাকিস্তানে আক্রমণ পরিচালনায় নিরুৎসাহিত করা এবং একই সঙ্গে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর মনোবল চাঙা করার উদ্দেশ্যে সপ্তম নৌবহর প্রেরণ করা হয়েছিল। তবে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে শেষ পর্যায়ে সপ্তম নৌবহর পাঠানো হয়েছিল পশ্চিম পাকিস্তানকে রক্ষা করতে। পাকিস্তানের পতন প্রতিহত করতে যুক্তরাষ্ট্র আরও একটি যে উদ্যোগ নেয় তা হলো যুদ্ধ বিরতিতে যাওয়া। এই লক্ষ্যে ৪ ডিসেম্বর ১৯৭১ যুক্তরাষ্ট্র চীনসহ কয়েকটি অস্থায়ী সদস্য নিরাপত্তা পরিষদের সভাপতিকে আলোচনার জন্য অধিবেশন আহ্বান জানায়। অধিবেশনে মার্কিন প্রতিনিধি জর্জ ডব্লিউ বুশ যুদ্ধ বিরতির প্রস্তাব উত্থাপন করে। ৫ ডিসেম্বর সেই প্রস্তাবের উপর ভোট হয়। ভোটে যুক্তরাষ্ট্র চীন সহ ১১টি সদস্য পক্ষে ভোট দেয়। সোভিয়েত, পোল্যান্ড বিপক্ষে ভোট দেয়। আর ব্রিটেন ও ফ্রান্স ভোটদানে বিরত থাকে। ৬ ডিসেম্বর আর্জেন্টিনার নেতৃত্বে ৮টি অস্থায়ী সদস্য আবারো যুদ্ধ বিরতি প্রস্তাব উত্থাপন করে এবং ভোট হয়। ভোটের ফলাফল একই দাঁড়ায়। সোভিয়েতের ভোটের কারণে যুদ্ধ বিরতি হয়নি। 

যুক্তরাষ্ট্র ভারতে আশ্রয় নেওয়া বাঙালি শরণার্থীদের ত্রাণ কাজে সহায়তা করে। ২৩ সেপ্টেম্বর ১৯৭১ সিনেটের কেনেডি ত্রাণ কাজের জন্য ৪০০ মিলিয়ন ডলারের বরাদ্ধ করে বির উত্থাপন করেন। প্রেডিসেন্ট নিক্সন ২৫০ মিলিয়ন ডলার বরাদ্ধ করেন। ভারতের পশ্চিমবঙ্গে, ত্রিপুরা, আসাম ও মেঘালয়ে আশ্রয় নেওয়া লাখ লাখ বাঙালি শরণার্থীদের বিভিন্ন রাজ্যে স্থানান্তর করার প্রয়োজন হয়ে পড়লে যুক্তরাষ্ট্র পরিবহন বিমান দিয়ে সহায়তা করে। জুন ১৯৭১ যুক্তরাষ্ট্রের বিমান বাহিনীর ৪টি পরিবহন বিমান ত্রিপুরা থেকে শরনার্থী স্থানান্তর শুরু করে। মার্কিন সরকার পাকিস্তানঘেঁষা নীতি অনুসরণ করলেও মার্কিন সংবাদপত্রগুলো এবং মার্কিন বুদ্ধিজীবীগণ পূর্ব পাকিস্তানে গণহত্যা বন্ধ করা এবং নির্বাচিত সরকারের হাতে শাসনক্ষমতা ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য পাকিস্তানের প্রতি আহ্বান জানিয়েছিলেন। মার্কিন জনগোষ্ঠীর বিরাট একটি অংশ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সমর্থন জানিয়েছিল। মার্কিন সিনেটর কেনেডি মার্কিন সরকারকে শান্তি প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছিলেন। কংগ্রেসের সদস্য কর্নেলিয়ার গ্যালায়ার পাকিস্তানকে অস্ত্র সরবরাহের জন্য সরকারের সমালোচনা করেছিলেন। মার্কিন সংবাদপত্রগুলোও অস্ত্র সরবরাহের ঘটনার সমালোচনা করে। 

সোভিয়েত ইউনিয়নের ভূমিকা : সোভিয়েত ইউনিয়ন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ব্যাপক সমর্থন জানিয়েছিল। সোভিয়েত ইউনিয়ন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে শুধু সমর্থনই করেনি, বরং জাতিসংঘে তিন-তিনবার ভেটো প্রয়োগ করে মুক্তিযুদ্ধকে চূড়ান্ত লক্ষ্যে পৌঁছে দিয়েছিল এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতার পথ প্রশস্ত করতে সহায়তা করেছিল। সোভিয়েত ইউনিয়ন এক পর্যায়ে এই যুদ্ধকে ‘জাতীয় মুক্তিযুদ্ধ’ হিসেবেও আখ্যায়িত করেছিল। মুক্তিযুদ্ধের প্রায় নয় মাস সোভিয়েত নেতৃবৃন্দ বারবার সংঘাত এড়ানো, উত্তেজনা হ্রাস এবং গণহত্যার নিন্দা ও রাজনৈতিক সমাধানের ওপর গুরুত্ব আরোপ করে আসছিলেন। 

১৯৭১ সালের ৯ আগস্ট ভারত ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে মৈত্রী চুক্তি তথা সামরিক চুক্তি স্বাক্ষরিত হলে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ব্যাপারে ভারত-সোভিয়েত ইউনিয়নের সম্পৃক্ততা নতুন মাত্রা লাভ করে। সোভিয়েত ইউনিয়ন দক্ষিণ এশিয়ায় মার্কিন আধিপত্য ঠেকানোর জন্য ভারতকে সকল ধরনের কূটনৈতিক ও সামরিক সহায়তা প্রদান করে। ভারতের মাধ্যমে সোভিয়েত ইউনিয়ন বাংলাদেশকে সামরিক অস্ত্র ও অন্যান্য সরঞ্জামাদি দিয়ে মুক্তিসংগ্রামকে ত্বরান্বিত করে। কূটনৈতিক ক্ষেত্রেও সোভিয়েত ইউনিয়ন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে অবস্থান নেয়। ১৯৭১ সালের ২০ সেপ্টেম্বর তৎকালীন সোভিয়েত পররাষ্ট্রমন্ত্রী আন্দ্রে গ্রোমিকো মার্কিন পররাষ্ট্র সচিব রজার্সকে বলেছিলেন, “পূর্ব পাকিস্তানের ঘটনাবলি এখন আর পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ ঘটনা নয়।” 

১৯৭১ সালের ৩ ডিসেম্বর পাকিস্তান ভারত আক্রমণ করলে ভারত ও পাকিস্তান সরাসরি যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। পাক-ভারত যুদ্ধে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভারতের পক্ষে সমর্থন ব্যক্ত করে। সার্বিক যুদ্ধাবস্থা পর্যবেক্ষণ করে সোভিয়েত ইউনিয়ন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে জাতিসংঘে উত্থাপনের দাবি জানায়। ১৯৭১ সালের ৪ ডিসেম্বর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে পশ্চিমা শক্তিগুলো জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে পূর্ব পাকিস্তান যুদ্ধবিরতি প্রস্তাব উত্থাপন করে। সোভিয়েত ইউনিয়ন এ প্রস্তাবে ভেটো প্রয়োগ করে। ভেটোর পক্ষে যুক্তি দেখিয়ে সোভিয়েত প্রতিনিধি জ্যাকব মার্টিন বলেছিলেন, মার্কিন নেতৃত্বে পশ্চিমা প্রস্তাব একতরফা। উপমহাদেশের শান্তির প্রশ্নে এতে স্পষ্ট কোনো কথা বলা হয়নি। এর ঠিক দুদিন পর বেলজিয়াম, ইতালি ও জাপান যৌথভাবে যুদ্ধবিরতি সম্পর্কিত অপর একটি প্রস্তাব আনলে সোভিয়েত ইউনিয়ন তাতেও ভেটো দেয়। পাক-ভারত যুদ্ধের দ্বিতীয় সপ্তাহে পূর্বাঞ্চল ফ্রন্টে যখন পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ওপর ভারতীয় বাহিনীর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়, তখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আবারও যুদ্ধবিরতি প্রস্তাব আনে। সোভিয়েত ইউনিয়ন এবারও তৃতীয়বারের মতো নিরাপত্তা পরিষদে ভেটো প্রয়োগ করে। সোভিয়েত প্রতিনিধি তখন বলেছিলেন, যুক্তরাষ্ট্র ও চীন উপমহাদেশে উত্তেজনা বৃদ্ধি করছে। তিনি দাবি করেন, পূর্ব পাকিস্তানে একটি রাজনৈতিক সমাধানের প্রস্তাব ছাড়া অন্য কোনো প্রস্তাব গ্রহণযোগ্য হলে তা হবে একতরফা। সোভিয়েত ইউনিয়নের কূটনৈতিক তৎপরতার জন্যই আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ‘জাতীয় মুক্তিযুদ্ধ’ হিসেবে চিহ্নিত হয়। 

চীনের ভূমিকা : বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ সমাজতান্ত্রিক দেশ চীনের ভূমিকা অনেকটা প্রশ্নবোধক। বিশ্বের অন্যতম পরাশক্তি সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র সোভিয়েত ইউনিয়ন যখন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে সমর্থন করে বাংলাদেশের জনগণের পাশে এসে দাঁড়িয়েছিল, তখন বিশ্বের অপর পরাশক্তি সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র। চীন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছিল। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা এবং পাকিস্তানের পক্ষ অবলম্বন করার পেছনে একাধিক চীনা নীতি কাজ করেছিল। 
প্রথমত, দক্ষিণ এশিয়ায় ক্রমপ্রসারমান সোভিয়েত প্রভাব মোকাবিলার জন্য চীনের প্রয়োজন ছিল পাকিস্তানের সঙ্গে সহযোহিতা।
দ্বিতীয়ত, চীন মনে করত ভারত পাকিস্তানের অখণ্ডতা নষ্ট করার জন্য বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে হস্তক্ষেপ করেছে। এর মাধ্যমে পাকিস্তানকে দুর্বল করে দিয়ে দক্ষিণ এশিয়ায় ভারত তার আধিপত্য বিস্তার করবে সোভিয়েত ইউনিয়নের সহযোগিতায়, যা চীনের নিরাপত্তার জন্য হুমকিস্বরূপ। এ সমীকরণে চীন পাকিস্তানের পক্ষ নেয়।
তৃতীয়ত, চীন যদি পাকিস্তানের পাশে না দাঁড়াত, তাহলে চীনের যেসব মিত্ররাষ্ট্র রয়েছে, তাদের মধ্যে চীনের বন্ধুত্ব ও সহযোগিতার প্রতি সন্দেহ জাগত।
চতুর্থত, চীন নিজেই একটি বহুজাতিক রাষ্ট্র। সেখানে জাতিগত দ্বন্দ্ব আছে এবং আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার প্রশ্নে চীনে এখনো অনেক সমস্যা বিরাজ করছে। কাজেই চীনের পক্ষে বাঙালিদের স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রামকে সমর্থন জানানো সম্ভব ছিল না।
আরো একটি বিশেষ কারণে চীন পাকিস্তানের পক্ষ নেয়। সত্তরের দশকের গোড়ার দিকে চীন-মার্কিন সম্পর্ক নতুন মাত্রা ধারণ করে। বিশ্বে সোভিয়েত ইউনিয়নের ক্রমবর্ধমান আধিপত্য প্রতিহত করার জন্য চীন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র একই প্লাটফর্মে এসে মিলিত হয়। ১৯৭১ সালের ৯-১১ জুলাই পর্যন্ত মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জারের গোপনে চীন সফরের মাধ্যমে চীন-মার্কিন সম্পর্কের বীজ রোপিত হয়। চীন-মার্কিন সম্পর্ক স্থাপনের এ সময়ে পাকিস্তান তৃতীয় পক্ষ হিসেবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বিশ্বরাজনীতির এ ঘূর্ণিপাকে চীন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নিজেদের স্বার্থেই পাকিস্তানের প্রতি সমর্থন ব্যক্ত করে। পাকিস্তান ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে স্বাক্ষরিত ‘সেন্টো’, ‘সিয়েটো’ সামরিক চুক্তির মতো পাকিস্তানের সাথে চীনের কোনো সামরিক চুক্তি না থাকলেও এসব ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে চীন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানের পক্ষে সমর্থন জানায়। 

সর্বোপরি, একটি সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে চীন সরকারের যেখানে শোষিত, নির্যাতিত ও স্বাধীনতাকামী বাঙালিদের পাশে এসে দাঁড়ানো উচিত ছিল, সেখানে চীন বরং বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছিল। এর পেছনে কাজ করেছিল চীনের জাতীয় স্বার্থ, নিরাপত্তা ও আঞ্চলিক অখণ্ডতা নিশ্চিত করার নীতি। চীন ১৯৭৫ সালের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর ১৫ আগস্ট বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রদান করে। 

ভারতের ভূমিকা : বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতের ভূমিকা ছিল খুবই বন্ধুত্বসুলভ। মুক্তিযুদ্ধের শুরু থেকেই মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে ভারত বিপুলসংখ্যক শরণার্থীদের আশ্রয়দান, তাদের ভরণপোষণ, মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণ ও অস্ত্র সরবরাহ, বহির্বিশ্বে এবং জাতিসংঘে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত গঠনের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। শুধু শরণার্থীদের পিছনেই ভারতের খরচ হয়েছে ৭০০ মিলিয়ন ডলার। এভাবে সরকারি ভূমিকার পাশাপাশি ভারতবাসী, রাজনৈতিক দল ও পেশাজীবীদের ভূমিকা ছিল রীতিমতো বিস্ময়কর। ফলে বাঙালির বিজয় ত্বরান্বিত হয়েছিল। 

১৯৭১ সালের ৯ আগস্ট ভারত ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে একটি মৈত্রী চুক্তি তথা সামরিক চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। ভারত-সোভিয়েত ইউনিয়ন সামরিক চুক্তির পর ভারত বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে আরও গভীরভাবে জড়িয়ে পড়ে। এ চুক্তির ফলে ভারত পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ব্যাপারে বড় ধরনের সিদ্ধান্ত নিতে পেরেছিল। ১৯৭১ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী মস্কো সফর করেন। শুধু তা-ই নয়, বাংলাদেশের পক্ষে জনমত গড়ে তোলার জন্য ইন্দিরা গান্ধী একই সময়ে আরও কয়েকটি পশ্চিমা দেশ সফর করেন। এরপরই বিশ্ববাসী বাংলাদেশের গণহত্যার ব্যাপারে জানতে পারে। ১৯৭১ সালের ৩ ডিসেম্বর পাকিস্তান ভারত আক্রমণ করলে ভারত ও পাকিস্তান সরাসরি যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। ভারত-বাংলাদেশ যৌথ কমান্ড গঠিত হয়। এ দিন পশ্চিম ফ্রন্টে পাকিস্তান ও ভারতের সেনাবাহিনীর মধ্যে তুমুল যুদ্ধ শুরু হয়। ভারতের ব্যাপক বিমান হামলা পাকিস্তানি বাহিনীকে চরমভাবে পর্যুদস্ত করে। ফলে মাত্র ১৩ দিনের মাথায় পাকিস্তানি বাহিনী আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়। ৬ ডিসেম্বর ভারত (দ্বিতীয় দেশ) স্বাধীন দেশ হিসেবে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পূর্বাঞ্চলে পাকবাহিনীর আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে ভারত একতরফাভাবে যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করে। ফলশ্রুতিতে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের অভ্যুধয় ঘঠে। ১৬ ডিসেম্বর পূর্বাঞ্চলে পাকবাহিনীর আত্মসমর্পণের পর ১৯৭১ সালের ২১ ডিসেম্বর জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে যুদ্ধবিরতি প্রস্তাব পাস হয়। অনেক রাজনৈতিক বিশ্লেষক মনে করেন যে, ভারতের সাহায্য ছাড়া এত অল্প সময়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জন করা সম্ভব ছিল না। 

পরিশেষে বলা যায়, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে কেন্দ্র করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, সোভিয়েত ইউনিয়ন (বর্তমান রাশিয়া) ও চীন এই তিন পরাশক্তি এবং ভারত নিজেদের জাতীয় স্বার্থ, জাতীয় নিরাপত্তা ও আধিপত্য বিস্তারের এক অঘোষিত প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়েছিল। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পাকবাহিনী আত্মসমর্পণ করলে বাংলাদেশ নামে একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের অভ্যুদয় ঘটে। পরিবর্তিত বিশ্বের বাস্তবতায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের স্বাধীনতা স্বীকার করে নেয়। ১৯৭২ সালের ৪ এপ্রিল যুক্তরাষ্ট্র স্বাধীন দেশ হিসেবে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়। চীন ১৯৭৫ সালের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর ১৫ আগস্ট বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রদান করে। মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে দক্ষিণ এশিয়ার বুকে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্মের মাধ্যমে বাঙালি জাতি তাদের স্বকীয়তা, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য নিয়ে বিশ্বের বুকে নিজেদের স্থান করে নিতে পেরেছে। পরিবর্তিত বিশ্বপরিস্থিতিতে বাংলাদেশ আজ বিশ্বের অন্যতম গণতান্ত্রিক দেশ।

1 Comments

Post a Comment
Previous Post Next Post