ভূমিকা : বিজ্ঞানের বদৌলতে মানুষের নানা ধরনের বিশ্বাসের গ্রন্থি যত শিথিল হচ্ছে, বিতর্কের পরিধিও ততই বাড়ছে। বর্তমান যুগে অধিকাংশ মানুষ অকুণ্ঠিতচিত্তে অনেককিছুই মেনে নিতে নারাজ। অনেকেই বিভিন্ন মতবাদ বা বিষয়কে আসামীর কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে নিরপেক্ষ বিচারকের ভূমিকায় নিজেদের কল্পনা করতে পারলে খুশি হয়। কিন্তু প্রকৃত বিচারের সময় অধিকাংশ ক্ষেত্রেই নিরপেক্ষতা বজায় থাকে না এবং একই বিষয় নিয়ে অসংখ্যের রায়দানের ফলে প্রবল সমস্যা দেখা দেয়। এই সমস্যা থেকেই যুক্তি-তর্ক বা বিতর্ক, যার যথার্থ সমাধান কোনদিন কোনমতেই হয়তো সম্ভব নয়।
বিতর্কের অতীত ঐতিহ্য : ঠিক কখন বিতর্কের শুরু তা নির্ণয় করা কঠিন। তবে সভ্যতার সূচনা থেকে বিতর্কের অস্তিত্ব ছিল বলে ধারণা করা হয়। মানুষ তার নিজের সাথে যেমন প্রতিনিয়ত যুক্তির যুদ্ধে অবতীর্ণ হয় তেমনি সমাজও যুক্তির মাধ্যমে গ্রহণ-বর্জন করে এগিয়ে চলে। বিদ্যাচর্চা হিসেবে প্রাচীন ভারতে ছিল তর্ক ও ন্যায়শাস্ত্রের বিশেষ ভূমিকা। তার্কিকরা ক্ষুরধার যুক্তির সাহায্যে ভুল ও মিথ্যা নির্ণয় করতেন, সত্যে উপনীত হতেন। মহান দার্শনিক প্লেটো প্রাচীন গ্রিসে তাঁর একাডেমিতে বিতর্কের প্রাতিষ্ঠানিক সূচনা করেছিলেন। তাঁর মতে, শিক্ষা পদ্ধতির পূর্ণতা দিতে ৩৫ ঊর্ধ্ব বয়সে বিতর্কের অনুশীলন করা ছিল জরুরী। মধ্যযুগে পণ্ডিতে-পণ্ডিতে যুক্তির লড়াই চলেছে। শ্রীচৈতন্য তর্কযুদ্ধে কেশব কাশ্মিরীকে হারিয়ে ছিলেন। পনের শতকের বাঙালি ন্যায়শাস্ত্রজ্ঞ রঘুনাথ শিরোমণি তর্কবিদ্যায় খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। আধুনিক রাষ্ট্র ব্যবস্থায় বিতর্ক গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে নিয়েছে এবং প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ করেছে। গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থায় সংসদ বা আইন সভাতে রয়েছে তর্ক-বিতর্কের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। আধুনিক গণতন্ত্রের অন্যতম পুরধা রাষ্ট্র। গ্রেট ব্রিটেনের House of Commons- এ যে ধারায় বিতর্ক করা হয়, ঠিক একই ধারা সংসদীয় বিতর্কে প্রযোজ্য। বিচার ব্যবস্থায়ও বিতর্কের মধ্য দিয়ে সত্যে উপনীত হওয়া এবং ন্যায় প্রতিষ্ঠা যে কোন বিচার কাজেরই উদ্দেশ্য।
মন্দ দিক : বিতর্কের পশ্চাতে নানা কারণ বিদ্যমান। অনেক সময় মানুষের ‘অহংবোধ’ তাকে তার্কিক করে তোলে। “আমি যা বুঝি তাই শ্রেষ্ঠ, আমি যা জানি তার আর অন্যথা হতে পারে না”- এই বিচিত্র ধারণা থেকে নিজের অজ্ঞাতসারেই মানুষ অনেকক্ষেত্রে বিতর্কের জালে জড়িয়ে পড়ে। মানুষ আপন জেদ বজায় রাখতে গিয়ে অনেক সময় নানা বিপত্তিও সৃষ্টি করে। কখনো-বা নিজের শান্ত নিরুপদ্রপ জীবনের মধ্যে অশান্তির আগুন জ্বালায় এবং তারপর নিজেই সে আগুনে তিলে তিলে দগ্ধ হয়।
বিতর্কের উপযোগিতা : তর্ক-বিতর্কের বিভিন্ন ক্ষতির দিক থাকা সত্ত্বেও এর অনেক উপযোগিতাও রয়েছে। বিতর্কের মধ্য দিয়ে অনেক সময় বহু জিনিসের সত্য-স্বরূপটি উদ্ভাসিত হয়। একই বিষয় নিয়ে ভিন্ন ভিন্ন জন যখন পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে আলোচনা করেন, যখন নিজ বিচার-বিশ্লেষণ অকপটে তুলে ধরেন তখন বিষয়টি নানান দৃষ্টিকোণ থেকে ধরা পড়ে। এর ভাল-মন্দ, শুভ-অশুভ, সৎ-অসৎ-সমস্ত দিকগুলো সম্পর্কেই বুঝার সুযোগ ঘটে।
বিতর্ক-সভার রীতিনীতি : সর্বপ্রথম বিতর্ক-সভার আলোচনার জন্যে একটি বিষয় ঠিক করে নেয়া হয়। অতঃপর বাছাই হয় বক্তা। দুটি দলে বক্তারা বিভক্ত থাকেন। একদল বিতর্কিত বিষয়ের পক্ষে বলেন, অন্যদল বলেন বিপক্ষে। বক্তৃতার সূচনা করেন দলপতিরা। প্রতিটি বক্তার জন্যে সমপরিমাণ সময় বরাদ্দ থাকে। এ সময় তিন মিনিট হতে পারে, আবার দশ-পনেরো মিনিটও হতে পারে। বক্তা যত বড় প্রভাবশালীই হোন না কেন, নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে তাঁকে বক্তব্য উপস্থাপন করতে হবে। সময়সীমা অতিক্রম করামাত্রই বিতর্ক-সভার পরিচালক ঘণ্টা বাজানো নির্দেশ দিবেন এবং তখন আলোচনা থামাতে বক্তা আইনত বাধ্য। অনেক সময় লক্ষ্য করা যায় যে, পরিচালকের নির্দেশে কর্ণপাত না করে বিতর্কে অংশগ্রহণকারী অনর্গল বলে চলছেন। সেক্ষেত্রে পরিচালককে বার বার হাতুড়ি পেটাতে দেখা যায়। কখনো-বা আরো কঠোর হয়ে জোর করে বক্তাকে থামিয়ে দিতে হয়। আজকাল অনেক সময় আলোক-সংকেতের সাহায্যে বিতর্ক-সভার সময়সীমা নির্দেশ করা হয়ে থাকে। বিতর্কস্থল সভা হয়ে ওঠা দরকার। সেখানে কিছু শ্রোতা উপস্থিত থাকবেন। বিতর্কিত বিষয়ের আলোচনা শোনবার সময় তারা হর্ষধ্বনি করে স্বাগত জানাতে পারেন এবং অসন্তোষের কথাও আভাসে-ইঙ্গিতে ব্যক্ত করতে পারেন। তবে সবকিছুরই মাত্রাজ্ঞান থাকতে হবে। কে বা কোন দল বিতর্কে বিজয়ী হলেন তা নানাভাবে স্থির হয়। এক বা একাধিক বিচারকের রায় চূড়ান্ত বলে গণ্য হতে পারে। আবার কখনো-বা উপস্থিত শ্রোতৃমণ্ডলীর ভাল-লাগা বা মন্দ লাগার ওপরেই বিতর্কে বিজয়ীর ভাগ্য নির্ভর করে।
বিতর্ক-সভা : বর্তমানে বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন প্রকারের বিতর্ক-সভা লক্ষ্য করা যায়। তবে স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় ইত্যাদি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেই এদের প্রাধান্য। স্কুল-কলেজেও আবার নানা পর্যায়ের বিতর্ক-সভা দেখা যায়। বিতর্ক-সভায় কখনো বিদ্যার্থীদের ব্যক্তিগত পারদর্শিতার যাচাই হয়, কখনো আবার আন্ত-শ্রেণী প্রতিযোগিতার মাধ্যমে কোন বিশেষ শ্রেণীর দক্ষতা নিরূপিত হয়ে থাকে। এছাড়া, আন্তঃ স্কুল বা আন্তঃ কলেজ প্রতিযোগিতা তো আছেই। কখনো কখনো বিটিভিতে আন্তঃ বিশ্ববিদ্যালয় বিতর্ক প্রতিযোগিতাও অনুষ্ঠিত হতে দেখা যায়।
বিতর্ক-সভার সুফল : বিতর্ক-সভায় অংশগ্রহণ করে নানাজন নানাভাবে উপকৃত হন। যিনি বক্তা তাঁর সাহস, আত্মবিশ্বাস, প্রত্যুৎপন্নমতিত্ব এবং গুছিয়ে সুন্দরভাবে প্রকাশ করার ক্ষমতা বাড়ে। নিয়মিত বিতর্ক-সভায় অংশগ্রহণ করে তিনি এমনকি শ্রেষ্ঠ বাগ্মীর পারদর্শিতা অর্জন করতে পারেন। এছাড়া, যাঁরা শ্রোতা, তাঁরাও লাভবান হন নানা দিক দিয়ে। তাঁদের জ্ঞান বাড়ে, স্বাধীন বিচার-শক্তি উজ্জীবিত হয় এবং সবচেয়ে বড় কথা, অনেক সময় তাঁরা নিজেরাও আলোচনায় অংশ নিতে উদ্বদ্ধ হন।
তর্ক ও বিতর্ক-সভায় পার্থক্য : অনেক সময় তর্কে আলোচনার মূল বিষয় বিলুপ্ত হয়। অসহিষ্ণুতার ফলে একজনের বলা শেষ না হতেই অন্যজন বলতে শুরু করেন। এছাড়া, আলোচনার মধ্যে ক্রমবর্ধমান উত্তাপ অনেক সময় ব্যক্তিগত ভুল বুঝাবুঝির সৃষ্টি করে। কিন্তু বিতর্ক-সভায় এ ধরনের ক্ষতির সম্ভাবনা কম। পদ্ধতি-প্রকরণ বক্তাকে সেখানে এমন ভাবে নিয়ম-শৃঙ্খলার বাঁধনে আবদ্ধ করে রাখে যে, ইচ্ছে থাকলেও বেশিরভাগ সময়ই তিনি অন্যায় বা অযৌক্তির পথে যেতে পারেন না। এছাড়া, তর্কের সময় নিজের বিশ্বাস ও জ্ঞানবুদ্ধি-মত সবাই কথা বলে, কিন্তু বিতর্ক-সভায় বক্তা যে মতে বিশ্বাস করেন না তার সপক্ষেও বলতে পারেন।
আদর্শ বক্তা : বিতর্ক-সভায় আদর্শ বক্তারা গুছিয়ে সুন্দরভাবে নিজ নিজ বক্তব্যকে পেশ করেন। তাঁরা অযথা উত্তেজিত হন না, বিপক্ষের প্রতি অশোভন বা অশালীন মন্তব্য করে নিজেদের বক্তব্যকে লঘু করেন না। বরং বিপক্ষ বক্তা কি বলছেন, তা অভিনিবেশ সহকারে শোনেন, অনেক সময় তাঁদের সারকথা টুকে রাখেন। এর ফলে সুবিধে হয় যে, নিজেদের বক্তব্য উপস্থাপিত করার সময় তাঁরা প্রয়োজন অনুযায়ী পূর্ববর্তী বক্তাদের অভিমত সমর্থন বা খণ্ডন করতে পারেন। আদর্শ বক্তার বাচনভঙ্গীর মধ্যে ঋজুতা ও স্পষ্টতা থাকে। বক্তব্য-বিষয়কে তিনি সংহত আকারে পরিবেশন করেন, এক-কথা বারংবার বলে আলোচনাকে অযথা নীরস একঘেয়ে ও শ্রুতিকটু করেন না। তাঁর চলন-বলন, ভাব-ভঙ্গী, পোশাক-পরিচ্ছদ-সবকিছুই এমন হয়ে থাকে যাতে উপস্থিত শ্রোতারা তাঁর সম্পর্কে আদৌ কোন বিরূপ মনোভাব পোষণ করার অবকাশ পান না।
বিতর্ক সভার বিষয়বস্তু : নানা প্রকার বিষয় নিয়ে বিতর্ক-সভা অনুষ্ঠিত হতে দেখা যায়। তবে বিষয়বস্তু বিতর্কমূলক হতে হবে। যেমন : ছাত্রকে কি রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করা উচিত? ধর্ম শিক্ষা জাতি গঠনের পক্ষে অপরিহার্য? ইত্যাদি।
উপসংহার : এই গণতন্ত্রের যুগে মতামত প্রকাশের স্বাধীনতা আছে। কিন্তু সেই মতামত যুক্তিসঙ্গত বা সত্যনিষ্ঠ হওয়া প্রয়োজন। বিপক্ষীয় যুক্তির কষ্টিপাথরে নিজের বিশ্বাসের সত্যকে যাচাই করে নিতে না পারলে সত্যের পূর্ণ মূল্যায়ন হয় না। তার ফলে অনিবার্যরূপে ভ্রান্তি-বিলাস এসে পড়ে। সেই ভ্রান্তি-বিলাসের ফলে মানুষের দুর্গতির অন্ত থাকে না; তার জীবনে ঘনিয়ে আসে এক চরম সর্বনাশ। এক-চক্ষু হরিণের মত মানুষ চলে ভ্রান্তি-বিলাসের পথে এবং তা হয় মৃত্যুরই নামান্তর। বিতর্ক-সভা পারস্পরিক বুঝা-পড়ার পবিত্র ক্ষেত্র, সত্যের মূল্যায়নের যথার্থ বিচারালয়।