↬ জীবন রক্ষায় রক্তদান
↬ রক্ত দিন, জীবন বাঁচান
↬ রক্তদান কর্মসূচি
ভূমিকা :
‘পরের জন্য আত্মবিসর্জন ভিন্ন পৃথিবীতে স্থায়ী সুখের অন্য কোন মূল্য নেই।’ – বঙ্কিমচন্দ্র।
মানুষের বড় পরিচয় সে সামাজিক জীব। পারস্পরিক সহযোগিতায় তার অগ্রগতি, পরহিতে প্রাণদান তার স্থায়ী সুখ, প্রেমমৈত্রীর মেলবন্ধনে তার অস্তিত্ব বিকাশ। বিচ্ছিন্নতায় তার ধ্বংস। ‘রক্তদান’ সেই পরহিত ব্রতেরই এক সুমহান কর্ম। বর্তমান বিশ্বে এর ব্যাপ্তি ও গভীরতা তাই আরও বেশি।
রক্তের গ্রুপ : মানুষের রক্তের চারটি গ্রুপ- A, B, AB আর O গ্রুপ। রক্তই জীবন। শরীরে রক্ত থাকলেই মানুষ থাকে সজীব ও সক্রিয়। আর রক্তের অভাব ঘটলেই টান পড়ে প্রাণশক্তিতে। শরীরে রক্তাল্পতা বা রক্তশূন্যতা ঘটলে শরীর হয়ে পড়ে অসুস্থ। কোনো রাসায়নিক প্রক্রিয়ায় আজও রক্ত তৈরি সম্ভব হয় নি। তাই রক্তের প্রয়োজনে মানুষ মানুষের কাছেই ছুটে আসে। দুর্ঘটনা, বড় ধরনের যে কোনো অপারেশনে অপররিহার্যভাবে রক্ত সঞ্চালনের ওপর নির্ভরশীল। রক্তে ক্যান্সার বাসা বাঁধলেও অকালে ঘনিয়ে আসে অনিবার্য মৃত্যু। কিন্তু বিজ্ঞান আজ আবিষ্কার করেছে, রক্তাল্পতা রক্তশূন্যতায় আক্রান্ত মানুষের দেহে রক্ত দিতে পারলে আর্ত মরণাপন্ন মানুষ আবার সজীব হয়ে ওঠে নতুন প্রাণশক্তি পেয়ে। তাই সুস্থ মানুষ তার দেহের রক্ত দিতে এগিয়ে আসে অকালে ঝরে যাওয়ার হাত থেকে অন্যকে বাঁচাতে। চিকিৎসাশাস্ত্রে রক্তের প্রয়োজনীয়তা ক্রমশই বাড়ছে।
মহৎ কর্ম : দেশ ও সমাজের মহৎ কর্মগুলোর মধ্যে অন্যতম মহৎ কর্ম হল রক্তদান। ব্যক্তির স্বেচ্ছায় দেয়া রক্তের বিনিময়ে একজন মুমূর্ষু রোগীর জীবন রক্ষা পায়। এভাবে রক্তদান দেশ ও জাতির জন্য কল্যাণ বয়ে আনতে পারে। তাছাড়া শিক্ষা ও সেবার মান উন্নয়ন ও গণসচেতনতার কারণে রক্তদান এ যুগে একটি সামাজিক আন্দোলনে পরিণত হয়েছে। সে সঙ্গে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানও রক্তদান কর্মসূচি পালনের মাধ্যমে দেশবাসীকে রক্তদানের মতো মহৎ কর্মে উদ্বুদ্ধ করছে। সুতরাং রক্তদানের সকল পদক্ষেপই মহৎ কর্মের অন্তর্ভুক্ত।
রক্তদানের নিয়ম : এক দেহের রক্ত অন্য দেহে সঞ্চালনের মাধ্যমে রোগীর চিকিৎসা করা একটি জটিল প্রক্রিয়া। অভিন্ন গ্রুপের রক্ত পেলেই তা রোগীর শরীরে সঞ্চালন করা যায়। রক্তদাতাকে সুস্থ-সবল এবং ১৮-৫৭ বছর বয়সী হতে হবে। দাতার শরীরের তাপমাত্রা হতে হবে ৯৯ ডিগ্রির নিচে। রক্তচাপ থাকতে হবে ১০০/৬০ থেকে ২০০/৯০ এর মধ্যে এবং রক্তদাতাকে জটিল রোগমুক্ত হতে হবে। রক্তদান প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয় একজন চিকিৎসকের তত্ত্বাবধানে। একজন সুস্থ মানুষ প্রতি তিন মাস অন্তর অন্তর রক্ত দান করতে পারে।
রক্তদান সম্পর্কে অমূলক ধারণা : আমাদের দেশে স্বেচ্ছায় রক্তদান এখনও জনপ্রিয় হয়ে উঠে নি। তবে পেশাদার রক্তদাতা অর্থের বিনিময়ে নিয়মিত রক্তদান করে থাকে। কিন্তু এসব পেশাদার রক্তদাতার রক্ত গ্রহণ খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। কেননা এদের মধ্যে প্রায় সবাই নেশাগ্রস্ত এবং বিভিন্ন সংক্রামক ও মরণব্যাধিতে আক্রান্ত। তাই সুস্থ ও স্বাভাবিক জীবনের অধিকারী ব্যক্তিদেরকে রক্তদানে এগিয়ে আসতে হবে। কিন্তু আমাদের দেশে রক্তদান সম্পর্কে অনেকের মধ্যে অমূলক ধারণা বিদ্যমান। রক্তদানের কথা শুনলে অনেকেই ভয়ে চমকে ওঠেন। অনেকে মনে করেন, রক্তদানে স্বাস্থ্যহানি ঘটে। এসব ধারণা নিতান্তই অমূলক। আমাদের দেহে প্রতিদিন রক্ত সৃষ্টি হচ্ছে এবং পুরানো রক্ত অকেজো হয়ে পড়ছে। রক্ত না দিলেও স্বাভাবিক নিয়মে রক্তের অকেজো হয়ে যাওয়া কেউই ঠেকাতে পারবে না। প্রতি তিন মাস অন্তর যে কোনো সুস্থ-সবল মানুষ রক্ত দান করতে পারে। এতে স্বাস্থ্যহানির কোনো আশঙ্কা থাকে না।
রক্তদান ও রক্ত সংরক্ষণ নীতি : উপযুক্ত বয়সে একজন সুস্থ ব্যক্তির দেহ থেকে ২৫০ সি.সি. রক্ত এককালে টেনে নেওয়া যায়। এতে শরীরের কোনো ক্ষতি হয় না। ঘাটতি রক্ত সাতদিনের মধ্যেই পূর্ণ হয়ে যায়। শুধু রক্তদান নয়, রক্ত সংরক্ষণও এর একটি প্রয়োজনীয় দিক। প্রতি সুস্থ মানবদেহ থেকে ২৫০ সি.সি. রক্ত নিয়ে একটি বোতলে রাখা হয়। বোতলটি ৫০ সি.সি. অ্যাসিড সাইট্রেটডেক্সট্রোজ সম্বলিত। রক্তের গ্রুপ ধরে প্রত্যেকটি বোতলকে পৃথক পৃথক শ্রেণিতে ভাগ করা হয়। প্রতিটি বোতলের গায়ে সেই রক্তের ব্যবহারযোগ্য সময়-সীমাও উল্লেখ থাকে। রক্তের অবিকৃত থাকা নির্ভর করে তাপমাত্রা ও অন্যান্য পরিপার্শ্বিকতার ওপর। ৪ ডিগ্রি থেকে ৬ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড তাপসমন্বিত ফ্রিজে তিন মাস পর্যন্ত এই রক্ত বিশুদ্ধ থাকে।
রক্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে সতর্কতা : রক্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে রক্ত গ্রহীতা এবং রক্তদাতাকে একই শ্রেণীর রক্তের অধিকারী হতে হবে। রক্তের গ্রুপ সামঞ্জস্যপূর্ণ না হলে গ্রহীতার রক্তে প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়, এমনকি মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে। তাছাড়া রক্ত গ্রহণের সময় কোনো প্রকার ব্যবহৃত সুই বা সিরিঞ্জ ব্যবহার না করে সম্পূর্ণ নতুন সুই বা সিরিঞ্জ ব্যবহার করতে হবে।
বাংলাদেশে নিরাপদ রক্তসঞ্চালন কার্যক্রম : বাংলাদেশে নিরাপদ রক্তসঞ্চালন কার্যক্রম বর্তমানে মানবজীবন রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। এ কার্যক্রমের আওতায় বিশেষজ্ঞ হাসপাতাল, সামরিক হাসপাতাল এবং সবগুলো জেলা হাসপাতালসহ দেশে মোট ৯৭টি হাসপাতালে নিরাপদ রক্ত সরবরাহ ও সঞ্চালনের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে।
রক্তদানের বিভিন্ন কর্মসূচি : বর্তমানে নানা সেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠান স্বেচ্ছায় রক্তদান কার্যক্রমে এগিয়ে এসেছেন। এদের মধ্যে অগ্রণী ও জনপ্রিয় সংগঠন ‘সন্ধানী’। তাছাড়া সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে সাধারণ মানুষকে রক্তদানে অনুপ্রাণিত করা হচ্ছে। রক্তদাতাগণ সন্ধানীতে এলে তাদেরকে একটি শণাক্তপত্র দেয়া হয়, যা তারা পরবর্তীতে যখন তাদের বা তাদের আত্মীয়ের রক্ত প্রয়োজন হবে তখন তারা তা প্রদর্শন করলে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে দেশের যে কোনো সন্ধানী কেন্দ্র থেকে রক্ত সংগ্রহ করতে পারে।
উপসংহার : জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সব মানুষের রক্তই লাল। তাই রক্তদান ঘুচিয়ে দেয় সাদা-কালোর প্রভেদ, ঘুচিয়ে দেয় ধর্মীয় ব্যবধান। রক্তদান তাই সর্বমানবিক এক মহান সেবাকর্ম। এক ব্যাগ রক্ত জীবন বাঁচাতে পারে একজন মুমূর্ষু ব্যক্তির। এ প্রেক্ষাপটেই একুশ শতকের মানুষের কাছে প্রথম স্বাস্থ্যবার্তা : ‘জীবন রক্ষায় আমিই দেব নিরাপদ রক্ত।’ তাই নিরাপদ রক্ত দিতে এগিয়ে আসতে হবে, বাঁচাতে হবে অমূল্য জীবন। সামিল হতে হবে ‘রক্ত দিন, জীবন বাঁচান’ আন্দোলনে। রক্তদান এক পবিত্র কর্তব্য ও মনুষ্যত্বের প্রকাশ।