দীর্ঘ দুই শ বছরের ব্রিটিশ শাসন, শোষণ ও ঔপনিবেশিকতার বেড়াজাল থেকে মুক্ত হয়ে ১৯৪৭ সালে সৃষ্টি হয়েছিল দুটি রাষ্ট্র-ভারত ও পাকিস্তান। ১২০০ মাইলের ব্যবধানে অবস্থিত দুটি অঞ্চল যথাক্রমে পূর্ববঙ্গ (বর্তমানে বাংলাদেশ) ও পশ্চিম পাকিস্তান (বর্তমান পাকিস্তান) নিয়ে সৃষ্টি হয়েছিল পাকিস্তান। সৃষ্টির শুরু থেকেই পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর বিমাতাসুলভ আচরণ, ভাষাগত বিরোধ, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক শোষণ-বঞ্চনা পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালি জনগোষ্ঠীকে পশ্চিম পাকিস্তানের প্রতি অসন্তুষ্ট করে তোলে। ফলে বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে বাঙালির অধিকার আদায়ের যে সংগ্রাম শুরু হয়, ’৬৬-এর ছয়দফা, ’৬৯-এর গণ-অভ্যুত্থান ও ’৭১-এর স্বাধীনতা সংগ্রামের মাধ্যমে তার পরিসমাপ্তি ঘটে।
ভাষা আন্দোলন : ১৯৪৭ সালে দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে সৃষ্ট পাকিস্তান গঠিত গয়েছিল তৎকালীন পূর্ববঙ্গ ও পশ্চিম পাকিস্তান নিয়ে। দেশের ৫৬ শতাংশ জনগোষ্ঠীর বসবাস ছিল পূর্ববঙ্গে এবং তাদের ভাষা ছিল বাংলা। অন্যদিকে পশ্চিম পাকিস্তানে বাস করতে দেশের অবশিষ্ট ৪৪ শতাংশ, যাদের কেবল সাত শতাংশের ভাষা ছিল উর্দু। এ ধরনের এক প্রেক্ষাপটেও পাকিস্তানের নয়া শাসকগোষ্ঠী বাংলাকে বাদ দিয়ে কেবল উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়। পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ভাষা বাংলা হওয়া সত্ত্বেও সম্পূর্ণ অগণতান্ত্রিক উপায়ে পূর্ব পাকিস্তানে উর্দুকে অবিভক্ত পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষার প্রশ্নে সূচিত ষড়যন্ত্রের মোকাবেলায় পূর্ব বাংলার জনগণের মধ্যে যে জাতীয় চেতনার উন্মেষ ঘটেছিল তা-ই ক্রমান্বয়ে বাঙালি জাতীয়তাবাদের বিকাশ ঘটিয়েছে। পাকিস্তানি শাসনের দীর্ঘ ২৩ বছর ধরে পূর্ব পাকিস্তানের জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে একটার পর একটা ষড়যন্ত্র হয়েছে; তার সবই জনগণ সম্মিলিতভাবে ব্যর্থ করে দিয়েছে। অত্যাচার, শোষণ ও ষড়যন্ত্র চিরকালই অবহেলিত জনগোষ্ঠীর সুপ্ত শক্তির বহিঃপ্রকাশ ঘটায়। পূর্ববঙ্গ তথা বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম হয়নি। ভাষা আন্দোলন আমাদেরকে এমন একটা ইস্যু দিয়েছিল যাতে সমস্ত শ্রেণি, গোষ্ঠী ও ধর্মের মানুষের স্বার্থ নিহিত। ফলে তা নিছক একটা বিশেষ ইস্যুতে আন্দোলন না হয়ে জাতীয় আন্দোলনে রূপ লাভ করেছিল। তাছাড়া ভাষা আন্দোলন বাঙালি জাতিকে তার ‘আত্মপরিচয়’ অনুসন্ধানের মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছিল, যা শেষ পর্যন্ত স্বাধীনতা অর্জনের মাধ্যমে বেরিয়ে এসেছিল। অতএব, দেখা যাচ্ছে, ১৯৫২ সালে যে ভাষা আন্দোলনের সূচনা হয়েছিল তা গণতান্ত্রিক আন্দোলন, ছয়দফা, ১১ দফা, গণ-অভ্যুত্থান ও সর্বশেষ স্বাধীনতা সংগ্রামের মধ্য দিয়ে স্বাধীন, সার্বভৌম বাংলাদেশ সৃষ্টির পথ তৈরি করে দিয়েছে।