মার্চের দিনগুলি

রচনা : আন্তর্জাতিক নারী দিবস

↬ বিশ্ব নারী দিবস

↬ বিশ্ব নারী দিবস ও বাংলাদেশের নারী


ভূমিকা : নারী আন্দোলনের ইতিহাসে একটি বিশেষ দিন ৮ মার্চ। বাংলাদেশসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে আন্তর্জাতিক নারী সমাজ এই দিনটি পালন করে। নারী অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে জাতিসংঘ ৮ মার্চ ‘আন্তর্জাতিক নারী দিবস’ হিসেবে ঘোষণা করে। 

ইতিহাস বা পটভূমি : ১৮৫৭ সালের ৮ মার্চ আমেরিকার নিউইয়র্ক শহরে একটি সুচ কারখানার মহিলা শ্রমিকগণ কারখানার মানবেতর পরিবেশ, অসম মজুরী ও ১২ ঘণ্টা কর্মদিবসের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করলে তাদের উপর পুলিশী নির্যাতন শুরু হয় এবং বহু মহিলা শ্রমিক কারাগারে নিক্ষিপ্ত হন। পরবর্তী সময়ে ১৮৬০ সালে ৮ মার্চ নিউইয়র্কের সুচ কারখানার মহিলা শ্রমিকরা ‘মহিলা শ্রমিক ইউনিয়ন’ গঠন করেন এবং নিজেদের আন্দোলন চালিয়ে যেতে থাকেন। ১৯০৮ সালের ৮ মার্চ নিউইয়র্কের দরজি শ্রমিকরা নারীর ভোটাধিকারের দাবিতে আন্দোলন শুরু করে এবং ১৯১০ সালে নারীর ভোটাধিকার স্বীকৃত হয়। এই সূত্র ধরে ক্লারা জেট্‌কিন্‌ ১৯১০ সালে পার্টির সম্মেলনে সিদ্ধান্ত নেন যে, প্রতিটি দেশের নারী শ্রমিকরা প্রতি বছর মার্চের যে-কোনো একটি দিন নারীর অধিকার রক্ষা দিবস হিসেবে পালন করবে। ১৮৫৭ ও ১৯০৮ সালের ৮ মার্চ সংগ্রামের সূচনা দিবস হওয়ায় ৮ মার্চকেই আন্তর্জাতিক নারী দিবস হিসেবে পালনের জন্যে নির্বাচন করা হয়। ১৯১০ সালের ২৭ আগস্ট কমিউনিস্ট নেত্রী ক্লারা জেট্‌কিন্ ও কাথে ডাঙ্কার স্বাক্ষরিত একটি ঘোষণাপত্র কোপেনহেগেনে দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক নারী সম্মেলনে গ্রহীত হয়। এই সম্মেলনে ১৭টি দেশের ১০০ জনেরও বেশি নারী প্রতিনিধি উপস্থিত ছিলেন। এঁদের উপস্থিতিতে ক্লারা জেট্‌কিনের প্রস্তাব অনুযায়ী ৮ মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবস হিসেবে পালনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। জাতিসংঘ ১৯৭৫ সালের ৮ মার্চ এ দিনটিকে স্বীকৃতি দেয়। 

শ্রমিক নারীদের সেই আন্দোলনেই এখন সর্বস্তরের নারীর অধিকার আদায়ের সংগ্রাম ও নারী শ্রমিকদের দাবির সম্পর্ক গভীরভাবে রচিত হয়েছে। তবে একথাও সত্য যে, যত সহজে আমরা নারী আন্দোলনের কথা বলি, মেয়েদের আন্দোলন করার অধিকার কিন্তু অত সহজে আসে নি। সমাজের বাধা এবং পুরুষের ক্রুদ্ধ ভ্রূকুটি, দারিদ্র্য, জীবনের সর্বস্তরের অধিকারহীনতার বিরুদ্ধে আপোষহীন লড়াই করে তবেই নারী অধিকার অর্জন করেছে। অনেক নিষ্ঠুরতার ইতিহাস রয়েছে এর পেছনে। 

বিশ্বে নারীর অবস্থান : বিশ্ব আজ একবিংশ শতাব্দীতে পা রেখেছে, পা রেখেছে এক নতুন সহস্রাব্দে। আমরা যখন নতুন শতাব্দীর প্রথম ‘বিশ্ব নারী দিবস’ পালন করছি তখনও বিশ্ব নারী সমাজের অবস্থা কিন্তু মোটেই সুখকর নয়। এটাই সত্য যে, গত তিন দশকে লাতিন আমেরিকা, আফ্রিকা এবং পশ্চিম ও দক্ষিণ এশিয়ার নারী সমাজে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, রাজনীতি ও অর্থনীতিতে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি সাধিত হয়েছে। কিন্তু এটাও সত্য যে, নারী সমাজের উক্ত অগ্রগতি কোনো অবস্থাতেই একই সময়কালে পুরুষ সমাজ কর্তৃক অর্জিত অগ্রগতির সমকক্ষ নয়। আর উন্নয়নশীল দেশগুলোতে নারীসমাজের অবস্থা তো এখনো রীতিমত আশঙ্কাজনক। উন্নয়নশীল দেশগুলোতে দারিদ্র্যসীমার নিচে রয়ে গেছে প্রায় ৬০ কোটি নারী। অপরদিকে উন্নত দেশগুলোতে দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করা নারীদের সংখ্যা কম নয়। ইতালি, নরওয়ে, ফ্রান্স বা সুইজারল্যান্ডের মতো উন্নত দেশেও ২০ হতে ২৫ শতাংশ নারী দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করে। বলা বাহুল্য, এ হার পুরুষের তুলনায় অনেক বেশি। কোনো নির্দিষ্ট অঞ্চল বা দেশের কথা বাদ দিয়ে সমগ্র বিশ্ব-প্রেক্ষাপটে দু একটি তথ্য তুলে ধরলে বর্তমান বিশ্বে নারীদের অবস্থা আরো স্পষ্ট হবে। বিশ্বের অশিক্ষিত জনসংখ্যার দুই-তৃতীয়াংশই নারী এবং বিশ্বে দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাসকারীদের ৭০ শতাংশই নারী। 

বাঙালি নারীর অবস্থান : বেগম রোকেয়া থেকে বেগম সুফিয়া কামাল পর্যন্ত যে সময় অতিবাহিত হয়েছে সে সময়ে তাঁরা যে বাংলার নারীর স্বীয় মর্যাদা, অধিকার, নারীমুক্তির অবিচ্ছেদ্য অংগ্রামে লিপ্ত ছিলেন তা আজ আমাদের কাছে নারীমুক্তি আন্দোলনের উদাহরণ ও প্রেরণা। কিন্তু দুঃখজনক যে আজও আমাদের দেশের নারীরা পুরুষশাসিত-সমাজের কাছে অবহেলিত। এদেশের আর্থ-সামাজিক পরিবেশে গোঁড়ামি, ধর্মীয় ফতোয়া প্রবল। ফলে নারী অধিকার লঙ্ঘিত হয় সবচেয়ে বেশি। নারীর সমঅধিকার ও নারীমুক্তির কথা জোর গলায় বলা হচ্ছে, কিন্তু নারীর অবস্থানে প্রত্যাশিত পরিবর্তন হয় নি। আজও অসংখ্য নারী এসিড নিক্ষেপ, ধর্ষণ আর যৌতুকের শিকার হচ্ছে। গৃহপরিচারিকার উপর চালানো হচ্ছে অমানুষিক নির্যাতন। এমন একটি দিনও নেই যেদিন খবরের কাগজে নারী নির্যাতনে দু-একটি মর্মান্তিক ঘটনা না ছাপা হচ্ছে। যদিও বিভিন্ন উন্নয়ন-কর্মকাণ্ডে নারীসমাজের অংশগ্রহণও লক্ষণীয়। গার্মেন্টস শিল্পে লক্ষ লক্ষ নারী শ্রমিক কাজ করছে। আবার পরীক্ষার মেধাতালিকায়ও মেয়েদেরই প্রাধান্য লক্ষ করা যাচ্ছে। তারপরও সমাজে নারীদের প্রতি কেমন জানি একটা অবহেলার দৃষ্টি। 

নারী-উন্নয়নের প্রয়োজনীয়তা : নারী শুধু পুরুষের নম্র সহচরী নয়। বর্তমানে নারী পুরুষের সঙ্গে বুদ্ধির খেলায় মেতেছে। বীরাঙ্গনা বেশে যুদ্ধ করছে শত্রুর সঙ্গে। সাহসিক অভিযানে পাল্লা দিয়েছে পুরুষের সঙ্গে। রাজনীতিতে পুরুষের সহযাত্রিনী। দেশের কাজে আত্মদানের গৌরবে গরবিনী। ধর্মে-সমাজসংস্কারে তার ভূমিকা অনন্য। সাহিত্যে-বিজ্ঞানে বিশ্বজয়ের স্বীকৃতি। নারী এখন সংগ্রামী জীবনের অংশীদার। জীবন-যুদ্ধের অন্যতম শরিক। 

বস্তুত নারীর মর্যাদা আর অবস্থান থেকেই অনুধাবন করা যায় একটি দেশ কতখানি সভ্য এবং উন্নত। তাই নারীকে পূর্ণাঙ্গ মর্যাদা দেবার জন্যে জাতি-ধর্ম-বর্ণ, পেশা-শ্রেণি নির্বিশেষে সকলের গণতান্ত্রিক সমানাধিকার প্রতিষ্ঠা করতে হবে। নারীকে দিতে হবে তার ন্যায্য পারিশ্রমিক ও যথাযথ মর্যাদা। 

উপসংহার : আমাদের দেশে আন্তর্জাতিক নারী দিবস এখনো সভা, সেমিনার, সিম্পোজিয়ামের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। বাস্তবে নারীর অবস্থানের তেমন কোনো পরিবর্তনই হয় নি। বস্তুত উন্নত-অনুন্নত-উন্নয়নশীল নির্বিশেষে সকল দেশেই নারীরা কম-বেশি বৈষম্যের শিকার। এই বৈষম্য এক দিনে ঘটে নি, ঘটেছে ধীরে ধীরে। কিন্তু বিশ্বব্যাপী মানবজাতির অর্ধেক এই নারীজাতির অগ্রগতি সাধন করতে হবে দ্রুত, ধীরে ধীরে নয়। সেজন্যে দরকার নারী পুরুষ নির্বিশেষে ইতিবাচক সচেতনতা সৃষ্টি। 


এই রচনাটি আরেকবার সংগ্রহ করে দেওয়া হলো


বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম রচিত কবিতার এ চরণগুলোর মাধ্যমেই সমাজে নারীর ভূমিকা কতটুকু তা সহজেই বোঝা যায়। শুধু বাংলাদেশ-ই নয়, বরং বিশ্বব্যাপী উন্নয়নের ধারায় নারীর উন্নয়ন বা উন্নয়নে নারীর অংশগ্রহণ এক অবিচ্ছেদ্য বিষয় হিসেবে দেখা যায়। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে, লিঙ্গবৈষম্য, মৌলবাদি শাসন-শোষণ, অশিক্ষা-কুশিক্ষা, অর্থনৈতিক দৈনদশাসহ নানা বিষয় নারীর ক্ষমতাকে আজ কুক্ষিগত করার পাশাপাশি নারীর অগ্রযাত্রার পথে বাঁধার সৃষ্টি করেছে। তাই নারীর উন্নয়নের পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টিকারি এসব সমস্যা থেকে নারীর উত্তরণের পথ সুগম করে সমাজের সকল প্রকার উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণসহ প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করতে প্রতিবছর ৮ মার্চ পালন করা হয় আন্তর্জাতিক নারী দিবস। বিশ্বের অন্যান্য দেশের ন্যায় বাংলাদেশেও প্রতিবছর এ দিবসটি পালন করা হয়ে থাকে সরকারি ও বেসরকারিভাবে।

নারী দিবসের ইতিহাস : নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যকে সামনে রেখে প্রতিবছর ৮ মার্চ বিশ্বব্যাপী আন্তর্জাতিক নারী দিবস পালন করা হয়। নারী দিবসের পেছনের ইতিহাস থেকে জানা যায়, দৈনিক ১২ ঘণ্টা পরিশ্রম, নিম্ন মজুরি, অমানুষিক নির্যাতন ও খাদ্যের অভাবের প্রতিবাদে ১৮৫৭ সালের ৮ মার্চ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কের পোশক শিল্পের নারী শ্রমিকেরা বিক্ষোভে ফেটে পড়েছিলেন। এতে অনেকেই গ্রেপ্তার ও হয়রানির শিকার হন। আবার ১৮৬০ সালের ৮ মার্চ নারী শ্রমিকেরাই নিজস্ব ইউনিয়ন গঠন করেন। তখন নারী শ্রমিকদের সংগ্রাম স্বীকৃতি লাভ করে। পরবর্তী সময়ে অর্থাৎ ১৯০৮ সালের ৮ মার্চ বিপুল সংখ্যক নারী শ্রমিক স্বল্প শ্রমঘণ্টা, ন্যায্য মজুরি এবং ভোটাধিকারের দাবিতে আন্দোলন শুরু করেন। এ ঘটনার দুবছর পর অর্থাৎ ১৯১০ সালের ৮ মার্চ ডেনমার্কের কোপেনহেগেনে অনুষ্ঠিত সাম্যবাদি নারীদের আন্তর্জাতিক সম্মেলনে ৮ মার্চ কে ঘোষণা করা হয় আন্তর্জাতিক নারী দিবস হিবেবে। আর এ ঘোষণার প্রস্তাব রাখেন জার্মান কমিউনিস্ট আন্দোলনের নেত্রী ক্লারা জেটকিন। অবশেষে ১৯৭৪ সালে জাতিসংঘ এই দিনটিকে আন্তর্জাতিক নারী দিবস হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। সেই থেকে নারী শ্রমিক ছাড়াও বিশ্বের সর্বস্তরের নারীর অধিকার আদায়ের দিবস হিসেবে প্রতিবছর ৮ মার্চ বিশ্বব্যাপী পালন করা হয়ে থাকে আন্তর্জাতিক নারী দিবস হিসেবে।

নারী দিবসে জাতিসংঘের প্রতিপাদ্য
বছর জাতিসংঘের প্রতিপাদ্য
১৯৯৬ অতীত উদ্‌যাপন এবং ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা
১৯৯৭ নারী এবং শান্তি
১৯৯৮ নারী এবং মানবাধিকার
১৯৯৯ নারীর প্রতি সহিংসহতামুক্ত পৃথিবী
২০০০ শান্তি স্থাপনে একতাবদ্ধ নারী
২০০১ নারী ও শান্তি : সংঘাতের সময় নারীর অবস্থান
২০০২ আফগানিস্তানের নারীদের বাস্তব অবস্থান ও ভবিষ্যৎ
২০০৩ লিঙ্গ সমতার মাধ্যমে নিরাপদ ভবিষ্যৎ
২০০৬ সিদ্ধান্ত গ্রহণে নারী
২০০৭ নারী ও নারী শিশুর ওপর সহিংসতার দায়মুক্তির সমাপ্তি
২০০৮ নারী ও কিশোরীদের ক্ষেত্রে বিনিয়োগ
২০০৯ নারী ও কিশোরীর প্রতি সহিংসতা বন্ধে নারী-পুরুষের একতা
২০১০ সমান অধিকার, সমান সুযোগ- সকলের অগ্রগতি
২০১১ শিক্ষা, প্রশিক্ষণ, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ক্ষেত্রে নারীর সমান অংশগ্রহণ
২০১২ গ্রামীণ নারীদের ক্ষমতায়ন- ক্ষুধা ও দারিদ্র্যের সমাপ্তি
২০১৩ নারীর প্রতি সহিংসতা বন্ধে পদক্ষেপ নেওয়ার এখনই সময়
২০১৪ নারীর ক্ষমতায়ন ও মানবতার উন্নয়ন
২০১৬ অধিকার মর্যাদায় নারী-পুরুষ সমানে সমান
২০১৭ নারী-পুরুষ সমতায় উন্নয়নে যাত্রা, বদলে যাবে বিশ্ব, কর্মে নতুন মাত্রা
২০১৮ সময় এবং নারীর, উন্নয়নে তারা, বদলে যাচ্ছে গ্রাম-শহরের কর্ম-জীবনধারা
২০১৯ সবাই মিলে ভাবো, নতুন কিছু করো, নারী-পুরুষ সমতার নতুন বিশ্ব গড়ো
২০২০ প্রজন্ম হোক সমতার : সকল নারীর অধিকার
২০২১ Women in leadership : Achieving an equal future in a COVID-19 world

নারীর উন্নয়ন সমস্যা ও উন্নয়ন : ইতোপূর্বে বিশ্ব নারী সম্মেলনে বিভিন্ন দেশের সরকার প্রধানগণ একমত হয়েছিলেন যে, মেয়েদের বিশ্বের অনেক দেশেই এমনকি সৌদি আরবের মত দেশেও নারী নেতৃত্বের বিষয়টি লক্ষ্য করা যায়। কিন্তু তা সত্ত্বেও ওইসব দেশের নারীদের অনেক বিষয়-ই এখনও অনেকটাই শিকলে বন্দি অবস্থায় রয়েছে। আর নারী উন্নয়নের ক্ষেত্রে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সরকার প্রধানদেরর ভাষা আর বাস্তবায়ন সমান্তরাল রেখায় না চলার বিষয়টি সহজেই পরিলক্ষিত হচ্ছে। বর্তমান সময়ের খতিয়ানে বহ দেশের নারী নীতি আর কর্মে দেখা যাচ্ছে এসব বৈপরীত্যের প্রতিফলন। এর পেছনে দেখা যায় তার সরলার্থ, সরকারগুলোর সদিচ্ছার অভাব প্রভৃতি। নারীর সম্মুখ-যাত্রাপথ অর্গলমুক্ত করে দেওয়ার জন্য সম্পদের সদ্ব্যবহারসহ বাজেট-বরাদ্দের অনিহায় তারই প্রকাশ পাওয়া যায়। আর এক্ষেত্রে বিশ্বের কিছু উন্নত দেশগুলোও এর ব্যতিক্রম নয়।

বাংলাদেশে স্বাধীনতা পরবর্তী সময় থেকে এ পর্যন্ত কয়েকটি সূচকে আমাদের সমাজে নারীর বেশ অগ্রগতি সাধিত হয়েছে। দেশের বিভিন্ন ক্ষেত্রের উচ্চ পদে নারীরা এসেছেন। সূচকগুলো লক্ষ্য করলে দেখা যায়, আমাদের সমাজে আগের তুলনায় নারীর শিক্ষার হার বেড়েছে, বেড়েছে শিল্প ও অর্থনীতিতে তার অংশগ্রহণের মাত্রা এবং সীমানা। প্রসূতিমৃত্যুর হারও উল্লেখযোগ্য হারে কমেছে। বর্তমানে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীসহ জাতীয় সংসদের প্রধান বিরোধী দলীয় প্রধানরা এবং সরকারের বিভিন্ন উচ্চ পদে নারী হওয়ার পরেও আমাদের সমাজে আজও নারীরা অনেক ক্ষেত্রেই মারাত্মক অবহেলার শিকার হচ্ছেন। পাশাপাশি ধর্ষণ, এসিড নিক্ষেপ, পারিবারিক সহিংসতাসহ আরও কত ধরনের লাঞ্ছনা আর আক্রমণের শিকার যে নারীদের প্রতিনিয়তই হতে হচ্ছে তা প্রতিদিন বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত রিপোর্টসহ আমাদের সমাজের দিকে দৃষ্টিপাত করলে সহজেই চোখে পড়ে।

নারীর অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন : যদিও বিগত দিনগুলোর তুলনায় আমাদের সমাজের নারীরা আজ অনেক বেশি স্বাধীন ও ক্ষমতাশীল। কিন্তু পুরুষের তুলনায় পারিবারিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক জীবনের নানা ক্ষেত্রে নারীদের আজও যে বৈষম্যের শিকার হতে হচ্ছে তা অস্বীকার করার কোন উপায় নেই। বিশেষত এ বৈষম্য নারীর অর্থনৈতিক ক্ষমতায়নের ক্ষেত্রে বিশেষভাবে লক্ষ করা যায়। এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, নারীর অর্থনৈতিক ক্ষমতায়নের সঙ্গে তার সার্বিক ক্ষমতায়নের দিকটি অঙ্গাঅঙ্গিভাবে জড়িত। নারীর অর্থনৈতিক ক্ষমতার বহুমুখী ইতিবাচক দিক থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশে আজও এক্ষেত্রে বৈষম্যমূলক চিত্র লক্ষ করা যায়। আমাদের সমাজে শ্রমক্ষেত্রে নারী-পুরুষের অংশগ্রহণের এখনও বিস্তর ব্যবধান রয়েছে। অর্থনৈতিক কাজে অংশগ্রহণকারী নারীরা যে পুরুষদের তুলনায় কম মজুরি পেয়ে থাকেন সে কথা বলাই বাহুল্য। এ কথা সকলের জানা আছে যে, নারী শ্রমিকের অর্থনৈতিক ক্ষমতায়নের ওপর বিশ্বায়নের প্রভাব পড়ছে। আর বাংলাদেশের তৈরি পোষাক শিল্প (গার্মেন্ট শিল্প) খাতে নারীদের অংশগ্রহণ হচ্ছে তাদের কর্মসংস্থানের একটি বড় ক্ষেত্র। বাংলাদেশের গার্মেন্টস শিল্পে প্রায় লাখ লাখ নারী শ্রমিক কর্মে নিয়োজিত রয়েছেন। বিশ্বায়নের প্রভাবে মূল্য প্রতিযোগিতা বাড়লেও অনেক ক্ষেত্রেই ব্যাহত হচ্ছে এই গার্মেন্টস শিল্পের নারী শ্রমিকদের অধিকার। প্রয়োজন অনুযায়ী তাদের মজুরি বাড়ছে না আবার অনেক সময় তাঁরা যথাসময়ে মজুরি প্রাপ্তি থেকেও বঞ্চিত হন।

বাংলাদেশে নারী ক্ষমতায়নে প্রধান সীমাবদ্ধতা সমূহ : এদেশে নারী ক্ষমতায়নের ক্ষেত্রে যেসকল সমস্যা বা সীমাবদ্ধতা বা প্রতিবন্ধকতা লক্ষ্য করা যায় সেগুলো হচ্ছে- সামাজিক প্রেক্ষাপট, দারিদ্রতা, শিক্ষাক্ষেত্রে নারীদের অনগ্রসরতা, নারীদের যথেষ্ট সচেতনতার অভাব, ধর্মীয় গোঁড়ামি, সুযোগ ও সুশিক্ষার অভাব ইত্যাদি। এসব সমস্যা বা সীমাবদ্ধতা দূর করা সম্ভব না হলে বাংলাদেশে সহজে নারীর ক্ষমতায়ন প্রতিষ্ঠা করা সম্ভবপর নয়।

নারী উন্নয়ন ও ক্ষমতায়নের জন্য যেসকল বিষয়ের ওপর জোর দেওয়া জরুরী : নারী উন্নয়ন ও ক্ষমতায়নের জন্য বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান কর্তৃক যে সকল বিষয়ের ওপর জোর দেওয়া হয়েছে-
  • নারী উন্নয়নে প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো শক্তিশালী করণ,
  • জাতীয় মহিলা উন্নয়ন পরিষদের উন্নয়ন,
  • সংসদীয় স্থায়ি কমিটি গঠন,
  • তৃণমূল পর্যায়সহ বিভিন্ন থানা ও জেলা পর্যায়ে নারী উন্নয়ন কার্যক্রমকে অধিকমাত্রায় শক্তিশালী করার ব্যবস্থা করা,
  • নারী ও জেন্ডার সমতা বিষয়ে ব্যাপক গবেষণা কার্যক্রম বৃদ্ধি করা ও গবেষণার সুপারিশের আলোকে নারী উন্নয়নের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা,
  • নারী নির্যাতন যে কোন মূল্যে ও যেকোন উপায়ে প্রতিহত করা,
  • সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধি করা,
  • নারীদের আর্থিক অবস্থার উন্নয়ন ঘটানোর ব্যবস্থা করা,
  • বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান সমূহকে নারী উন্নয়নের লক্ষ্যে এগিয়ে আসা,
  • দেশের বিভিন্ন জায়গায় নারী উন্নয়ন প্রশিক্ষণ কেন্দ্র গড়ে তোলা ইত্যাদি।

নারী অর্থনৈতিক ক্ষমতায়নসহ সার্বিক উন্নয়ন নিশ্চিত করতে সরকারের বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ ও তার বাস্তবায়ন জরুরী। যেমন- শিক্ষাক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণের পাশাপাশি শ্রমবাজারে তাদের অংশগ্রহণ বাড়াতে দক্ষতা বৃদ্ধি ও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা, নারীদের সহজ শর্তে ঋণ দেওয়া, যাতায়াত ও যানবাহনের সুব্যবস্থা করা, নারীর প্রতি পুরুষের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনের জন্য সচেতনতা বৃদ্ধি করা, নারীর জন্য বিশেষায়িত বিনিয়োগ করা, গৃহস্থালির কাজে নারীর সঙ্গে পুরুষদের সম্পৃক্তকরণ ইত্যাদি। আর উপরোক্ত পদক্ষেপগুলোর যথাযথ বাস্তবায়নের ওপরেই নির্ভর করে জাতীয় উন্নয়ন ও অগ্রগতির ধারা এবং সহস্রাব্দ উন্নয়নের লক্ষমাত্রা অর্জন। সময়ের চাহিদা অনুযায়ি একটি কার্যকর গণতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা গড়ার ক্ষেত্রে নারীর সম-অধিকার, নারীর ক্ষমতায়ন, পরিবার-সমাজ ও রাষ্ট্রে নারীর উপযুক্ত মর্যাদা প্রদান অপরিহার্য। এক্ষেত্রে সরকারসহ বিভিন্ন এনজিও এবং দেশের নারী-পুরুষ তথা সকল স্তরের জনগণকে এগিয়ে এসে নারী উন্নয়নের জন্য অগ্রণী ভূমিকা রাখতে হবে। কারণ, এ কথা সকলেরই স্মরণ রাখা দরকার যে, নারী-পুরুষের ক্ষমতার সুষম বণ্টন ছাড়া দেশের সামাগ্রিক উন্নয়নকে ত্বরান্বিত করা ও সহস্রাব্দ উন্নয়নের লক্ষমাত্রা অর্জন করা কোনভাবেই সম্ভব নয়।


আরো দেখুন :
রচনা : একবিংশ শতাব্দীর নারী সমাজ
প্রতিবেদন : নারী নির্যাতন একটি সামাজিক ব্যাধি
অনুচ্ছেদ : নারী শিক্ষা
রচনা : নারী শিক্ষার গুরুত্ব
রচনা : অর্থনৈতিক উন্নয়নে নারী সমাজ
নারী বন্দীর কুফল
ভাষণ : নারী শিক্ষার গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা
রচনা : নারীর ক্ষমতায়ন
ভাষণ : জাতিগঠনে নারী সমাজের ভূমিকা
নারী শিক্ষার গুরুত্ব নিয়ে বাবা ও মেয়ের মধ্যে সংলাপ
আন্তর্জাতিক নারী দিবস উদযাপন উপলক্ষে বন্ধুকে ই-মেইল
অনুচ্ছেদ : নারী দিবস
প্রতিবেদন : জাতি গঠনে নারীসমাজের ভূমিকা
রচনা : পণপ্রথা / যৌতুক প্রথা একটি জাতীয় সমস্যা
ভাষণ : নারী নির্যাতন ও পণপ্রথা বিরোধী
রচনা : দারিদ্র বিমোচনে নারী সমাজের ভূমিকা
রচনা : সভ্যতা বিনির্মানে নারীর অবদান
Post a Comment (0)
Previous Post Next Post