বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতি তথা বিশ্বরাজনীতির একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা। স্নায়ুযুদ্ধকালে সংঘটিত বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ সমগ্র বিশ্বকে দুটি শিবিরে ভাগ করে দিয়েছিল। দক্ষিণ এশিয়ার বলয় পেরিয়ে বিশ্বরাজনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ সময়ে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল। ১৯৭১ সালে স্বাধিকার প্রশ্নে বাঙালির এ সশস্ত্র সংগ্রাম দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার রাজনীতি ও মুক্তিসংগ্রামে বিরাট প্রভাব বিস্তার করে। ভিয়েতনামে মার্কিন আগ্রাসন নিয়ে একদিকে যখন সমগ্র ইন্দো-চীনজুড়ে তীব্র মার্কিনবিরোধী জনমত তৈরি হচ্ছিল এবং মার্কিনিদের চূড়ান্ত পরাজয়ের প্রক্রিয়া শুরু হয়ে গিয়েছিল, অন্যদিকে তখন বিশ্বব্যাপী ক্রমবর্ধমান সোভিয়েত প্রভাবকে নস্যাৎ করার লক্ষ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র চীনের সঙ্গে সম্পর্ক বৃদ্ধির উদ্যোগ নিয়েছিল। দক্ষিণ এশিয়ার সোভিয়েত ইউনিয়নের আধিপত্য ঠেকানোর জন্যও যুক্তরাষ্ট্র মরিয়া হয়ে ওঠে। সত্তরের দশকে ভারতের সঙ্গে সোভিয়েত ইউনিয়নের শক্তিশালী অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিক সম্পর্কের ফলে দক্ষিণ এশিয়ায় সোভিয়েত প্রভাব ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পায়। ১৯৫৪ সালের ৮ সেপ্টেম্বর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে পাকিস্তান, ফ্রান্স, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, ফিলিপাইন ও থাইল্যান্ডকে নিয়ে সিয়েটো (SEATO) সামরিক জোট গঠিত হলেও এ অঞ্চলে কমিউনিস্ট প্রভাব প্রতিহত করা যায়নি। আদর্শগতভাবে চীন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র দুই মেরুতে অবস্থান করলেও বিশ্বব্যাপী সোভিয়েত প্রভাব প্রতিহত করতে নিজেদের মধ্যে সম্পর্কের ক্ষেত্রে তারা নতুন মাত্রা যোগ করে। চীন-মার্কিন সম্পর্ক সৃষ্টিতে দক্ষিণ এশীয় দেশ পাকিস্তান প্রধান মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকা পালন করে। বিশ্বব্যাপী ক্রমবর্ধমান সোভিয়েত প্রভাব ঠেকানোর জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও চীন যখন পাকিস্তানের মাধ্যমে নতুন সম্পর্কের মাইলফলক নির্মাণে ব্যস্ত, সেই পরিস্থিতিতে ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণার মধ্য দিয়ে পাকিস্তানের দখলদার বাহিনীর বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়ে যায়।
বিশ্ব প্রেক্ষাপট : দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সমগ্র বিশ্ব দুটি শিবিরে বিভক্ত হয়ে পড়ে- একদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে পুঁজিবাদী বিশ্ব, অন্যদিকে সোভিয়েত ইউনিয়নের নেতৃত্বে পূর্ব ইউরোপীয় দেশগুলোসহ চীনকে নিয়ে সমাজতান্ত্রিক বিশ্ব। নিজেদের প্রভাব-প্রতিপত্তি, সামরিক শ্রেষ্ঠত্ব ও মতাদর্শ প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে পুঁজিবাদী বিশ্ব ও সমাজতান্ত্রিক বিশ্ব অস্ত্র প্রতিযোগিতায় মেতে ওঠে। গঠিত হয় ‘ন্যাটো’, ‘ওয়ারশ প্যাক্ট’ – এর মতো সামরিক জোট। দুটি শিবিরের এই অস্ত্র প্রতিযোগিতার মুখে সমগ্র বিশ্বে একটি স্নায়ুযুদ্ধ (Cold war) পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। বার্লিন প্রাচীর বরাবর জার্মানিকে বিভক্ত করে তার দুই পাশে অবস্থান নেয় ‘ন্যাটো’ ও ‘ওয়ারশ’ জোটের দেশগুলো। ১৯৬২ সালে কিউবায় সোভিয়েত মিসাইল মোতায়েনকে কেন্দ্র করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে যুদ্ধাবস্থার সৃষ্টি হয়। সমগ্র বিশ্ব তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের মুখোমুখি এসে দাঁড়ায়। শেষ পর্যন্ত সোভিয়েত ইউনিয়ন কিউবা থেকে সোভিয়েত মিসাইল প্রত্যাহার করলে কিউবা সংকটের সমাধান হয়। বিশ্বরাজনীতির এমনই এক সংকটময় ক্রান্তিকালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ সংঘটিত হয়।
সোভিয়েত ইউনিয়ন ও ভারতের ভূমিকা : বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে পরাশক্তিগুলো, বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, সোভিয়েত ইউনিয়ন ও চীন সরাসরি না হলেও পরোক্ষভাবে জড়িয়ে গিয়েছিল। সোভিয়েত ইউনিয়ন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ব্যাপক সমর্থন জানিয়েছিল। অন্যদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও চীন তাদের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটেই এর বিরোধিতা করেছিল। সোভিয়েত ইউনিয়ন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে শুধু সমর্থনই করেনি, বরং জাতিসংঘে তিন-তিনবার ভেটো প্রয়োগ করে মুক্তিযুদ্ধকে চূড়ান্ত লক্ষ্যে পৌঁছে দিয়েছিল এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতার পথ প্রশস্ত করতে সহায়তা করেছিল। এমনকি মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনীর চূড়ান্ত বিজয়ের মুহূর্তে ১৯৭১ সালের ৯ ডিসেম্বর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যখন ভারত মহাসাগরে পারমাণবিক শক্তিচালিত রণতরী ইউএসএস এন্টারপ্রাইজসহ সপ্তম নৌবহর পাঠিয়েছিল, তার পাল্টা ব্যবস্থা হিসেবে সোভিয়েত ইউনিয়নও তখন ভারত মহাসাগরে দুটো টাস্কফোর্স প্রেরণ করেছিল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভারত মহাসাগরে সপ্তম নৌবহর পাঠিয়েছিল দক্ষিণ এশিয়ায় মার্কিন উপস্থিতি জানান দিয়ে পরোক্ষভাবে ভারত ও সোভিয়েত ইউনিয়নের ওপর চাপ সৃষ্টি করার জন্য। কিন্তু ভারত মহাসাগরে তাৎক্ষণিক সোভিয়েত নৌবহরের উপস্থিতি যুক্তরাষ্ট্রের সপ্তম নৌবহরের সম্ভাব্য ভূমিকাকে নস্যাৎ করে দিয়েছিল। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে পরাশক্তিগুলোর ভূমিকা পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, ভূ-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট এবং নিজেদের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক স্বার্থেই সোভিয়েত ইউনিয়ন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও চীন প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে নিজেদের অবস্থান ব্যক্ত করেছে। সোভিয়েত ইউনিয়ন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে শুধু সমর্থনই করেনি, এক পর্যায়ে এই যুদ্ধকে ‘জাতীয় মুক্তিযুদ্ধ’ হিসেবেও আখ্যায়িত করেছিল। মুক্তিযুদ্ধের প্রায় নয় মাস সোভিয়েত নেতৃবৃন্দ বারবার সংঘাত এড়ানো, উত্তেজনা হ্রাস এবং গণহত্যার নিন্দা ও রাজনৈতিক সমাধানের ওপর গুরুত্ব আরোপ করে আসছিলেন। অন্যদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও চীন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার বলে এতে বাইরের হস্তক্ষেপকে অযাচিত বলে ঘোষণা করে। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ পাকবাহিনী ‘অপারেশন সার্চলাইট’ ছদ্মনামে যে গণহত্যা শুরু করে, বহির্বিশ্বের মানুষ তা জানতে পারে বেশ কিছুদিন পর। এক্ষেত্রে ভারতের ভূমিকা ছিল অগ্রগণ্য। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর এক পর্যায়ে ভারতে লাখ লাখ বাংলাদেশি শরণার্থীর উপস্থিতির কারণে ভারত ও পরোক্ষভাবে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে।
১৯৭১ সালের ৯ আগস্ট ভারত ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে একটি মৈত্রী চুক্তি তথা সামরিক চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। ভারত-সোভিয়েত ইউনিয়ন সামরিক চুক্তির পর ভারত বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে আরো গভীরভাবে জড়িয়ে পড়ে। এ চুক্তির ফলে ভারত পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ব্যাপারে বড় ধরনের সিদ্ধান্ত নিতে পেরেছিল। ১৯৭১ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী মস্কো সফর করেন। শুধু তা-ই নয়, বাংলাদেশের পক্ষে জনমত গড়ে তোলার জন্য ইন্দিরা গান্ধী একই সময়ে আরো কয়েকটি পশ্চিমা দেশ সফর করেন। এরপরই বিশ্ববাসী বাংলাদেশের গণহত্যার ব্যাপারে জানতে পারে। সোভিয়েত ইউনিয়ন দক্ষিণ এশিয়ায় মার্কিন আধিপত্য ঠেকানোর জন্য ভারতকে সকল ধরনের কূটনৈতিক ও সামরিক সহায়তা প্রদান করে। ভারতের মাধ্যমে সোভিয়েত ইউনিয়ন বাংলাদেশকে সামরিক অস্ত্র ও অন্যান্য সরঞ্জামাদি দিয়ে মুক্তিসংগ্রামকে ত্বরান্বিত করে। কূটনৈতিক ক্ষেত্রেও সোভিয়েত ইউনিয়ন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে অবস্থান নেয়। ১৯৭১ সালের ২০ সেপ্টেম্বর তৎকালীন সোভিয়েত পররাষ্ট্রমন্ত্রী আন্দ্রে গ্রোমিকো মার্কিন পররাষ্ট্র সচিব রজার্সকে বলেছিলেন, ‘পূর্ব পাকিস্তানের ঘটনাবলি এখন আর পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ ঘটনা নয়।’ সোভিয়েত ইউনিয়নের কূটনৈতিক তৎপরতার জন্যই জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে পূর্ব পাকিস্তান যুদ্ধবিরতি প্রস্তাব নাকচ হয়ে যায় এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ‘জাতীয় মুক্তিযুদ্ধ’ হিসেবে চিহ্নিত হয়।
১৯৭১ সালের ৩ ডিসেম্বর পাকিস্তান ভারত আক্রমণ করলে ভারত ও পাকিস্তান সরাসরি যুদ্ধে জাড়িয়ে পড়ে। পাক-ভারত যুদ্ধে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভারতের পক্ষে সমর্থন ব্যক্ত করে। সার্বিক যুদ্ধাবস্থা পর্যবেক্ষণ করে সোভিয়েত ইউনিয়ন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে জাতিসংঘে উত্থাপনের দাবি জানায়। ১৯৭১ সালের ৪ ডিসেম্বর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে পশ্চিমা শক্তিগুলো জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে পূর্ব পাকিস্তান যুদ্ধবিরতি প্রস্তাব উত্থাপন করে। সোভিয়েত ইউনিয়ন এ প্রস্তাবে ভেটো প্রয়োগ করে। ভেটোর পক্ষে যুক্তি দেখিয়ে সোভিয়েত প্রতিনিধি জ্যাকব মার্টিন বলেছিলেন, মার্কিন নেতৃত্বে পশ্চিমা প্রস্তাব একতরফা। উপমহাদেশের শান্তির প্রশ্নে এতে স্পষ্ট কোনো কথা বলা হয়নি। এর ঠিক দুদিন পর বেলজিয়াম, ইতালি ও জাপান যৌথভাবে যুদ্ধবিরতি সম্পর্কিত অপর একটি প্রস্তাব আনলে সোভিয়েত ইউনিয়ন তাতেও ভেটো দেয়। পাক-ভারত যুদ্ধের দ্বিতীয় সপ্তাহে পর্বাঞ্চল ফ্রন্টে যখন পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ওপর ভারতীয় বাহিনীর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়, তখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আবারও যুদ্ধবিরতি প্রস্তাব আনে। সোভিয়েত ইউনিয়ন এবারও তৃতীয়বারের মতো নিরাপত্তা পরিষদে ভেটো প্রয়োগ করে। সোভিয়েত প্রতিনিধি তখন বলেছিলেন, যুক্তরাষ্ট্র ও চীন উপমহাদেশে উত্তেজনা বৃদ্ধি করছে। তিনি দাবি করেন, পূর্ব পাকিস্তানে একটি রাজনৈতিক সমাধানের প্রস্তাব ছাড়া অন্য কোনো প্রস্তাব গ্রহণযোগ্য হলে তা হবে একতরফা। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পূর্বাঞ্চলে পাকবাহিনীর আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে ভারত একতরফাভাবে যুদ্ধবিরতি গোষণা করে। স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটে।
১৯৭১ সালের ৩ ডিসেম্বর ভারত-বাংলাদেশ যৌথ কমান্ড গঠিত হয়। এ দিন পশ্চিম ফ্রন্টে পাকিস্তান ও ভারত সরাসরি যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। ১৯৭১ সালের ৬ ডিসেম্বর ভারত সর্বপ্রথম স্বাধীন দেশ হিসেবে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়। ভুটানও ৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রদান করে। ১৬ ডিসেম্বর পূর্বাঞ্চলে পাকবাহিনীর আত্মসমর্পণের পর ১৯৭১ সালের ২১ ডিসেম্বর জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে যুদ্ধবিরতি প্রস্তাব পাস হয়। সোভিয়েত ইউনিয়ন যুদ্ধবিরতি প্রস্তাব পাসের সময় অনুপস্থিত থাকে।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সোভিয়েত ইউনিয়ন ও ভারতের ভূমিকা অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। সোভিয়েত ইউনিয়নের সামরিক ও কূটনৈতিক সহায়তার জন্যই যুদ্ধক্ষেত্রে এবং আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে বাঙালি জাতি নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব ও স্বাধীনতা অর্জন করতে সক্ষম হয়। সোভিয়েত ইউনিয়ন যদি জাতিসংঘে তার ভেটো প্রয়োগ না করত, তাহলে ভারতীয় বাহিনীর পক্ষে নিরাপত্তা পরিষদে গৃহীত যুদ্ধবিরতি প্রস্তাবের বিরোধিতা করে যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়া সম্ভব ছিল না। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর সোভিয়েত ইউনিয়ন পরাশক্তি হিসেবে সর্বপ্রথম বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয় ১৯৭২ সালের ২৪ জানুয়ারি। মুক্তিযুদ্ধে সোভিয়েত ইউনিয়ন ও ভারতের সামরিক, কূটনৈতিক ও রাজনৈতিক অবদান বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
চীনের ভূমিকা : বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সমাজতান্ত্রিক দেশ চীনের ভূমিকা অনেকটা প্রশ্নবোধক। বিশ্বের অন্যতম পরাশক্তি সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র সোভিয়েত ইউনিয়ন যখন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে সমর্থন করে বাংলাদেশের জনগণের পাশে এসে দাঁড়িয়েছিল, তখন বিশ্বের অপর পরাশক্তি সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র চীন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছিল। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা এবং পাকিস্তানের পক্ষ অবলম্বন করার পেছনে একাধিক চীনা নীতি কাজ করেছিল। প্রথমত, দক্ষিণ এশিয়ায় ক্রমপ্রসারমান সোভিয়েত প্রভাব মোকাবিলার জন্য চীনের প্রয়োজন ছিল পাকিস্তানের সঙ্গে সহযোগিতা। কেননা, চীন মনে করত সোভিয়েত ইউনিয়ন ভারতের সাহায্য নিয়ে দক্ষিণ এশিয়ায় তা প্রভাব বৃদ্ধি করছে এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের আসল উদ্দেশ্য হচ্ছে চীনকে শত্রুরাষ্ট্র দ্বারা পরিবেষ্টিত করা। চীন ও সোভিয়েত ইউনিয়ন সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র হলেও সীমান্ত নিয়ে দুদেশের মধ্যে একাধিকবার সংঘর্ষ বেঁধেছে। ১৯৬৯ সালে সীমান্ত বিরোধকে কেন্দ্র করে চীন ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে বড় ধরনের যুদ্ধ সংঘটিত হয়। এর পর থেকে চীন-সোভিয়েত সম্পর্ক আর স্বাভাবিক হয়নি। অবিশ্বাস, সংশয় ও সন্দেহের আবর্তে দুদেশ দুই মেরুতে অবস্থান নেয়। দ্বিতীয়ত, ভারত প্রথম থেকেই বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সাথে নিজেকে জড়িয়ে ফেলে। ভারতের সঙ্গে চীনের সম্পর্ক অত্যন্ত শীতল ছিল। ১৯৬২ সালে সীমান্ত নিয়ে চীন ও ভারতের মধ্যে বড় ধরনের যুদ্ধ বাঁধে। এ যুদ্ধে ভারত চীনের নিকট মারাত্মকভাবে পরাজয় হয়। এরপর থেকে চীন ভূ-রাজনৈতিক পয়োজনেই পাকিস্তানের সাথে সামরিক সম্পর্ক গড়ে তোলে। পাকিস্তান-চীন সম্পর্ক সময়ের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ প্রমাণিত হয়েছে বহুবার। চীন মনে করত ভারত পাকিস্তানের অখণ্ডতা নষ্ট করার জন্য বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে হস্তক্ষেপ করেছে। এর মাধ্যমে পাকিস্তানকে দুর্বল করে দিয়ে দক্ষিণ এশিয়ায় ভারত তার আধিপত্য বিস্তার করবে সোভিয়েত ইউনিয়নের সহযোগিতায়, যা চীনের নিরাপত্তার জন্য হুমকিস্বরূপ। এ সীকরণে চীন পাকিস্তানের পক্ষ নেয়। তৃতীয়ত, চীন যদি পাকিস্তানের পাশে না দাঁড়াত, তাহলে চীনের যেসব মিত্ররাষ্ট্র রয়েছে, তাদের মধ্যে চীনের বন্ধুত্ব ও সহযোগিতার প্রতি সন্দেহ জাগত। চতুর্থত, চীন নিজেই একটি বহুজাতিক রাষ্ট্র। সেখানে জাতিগত দ্বন্দ্ব আছে এবং আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার প্রশ্নে চীনে এখনো অনেক সমস্যা বিরাজ করছে। কাজেই চীনের পক্ষে বাঙালিদের স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রামকে সমর্থন জানানো সম্ভব ছিল না। আরো একটি বিশেষ কারণে চীন পাকিস্তানের পক্ষ নেয়। সত্তরের দশকের গোড়ার দিকে চীন-মার্কিন সম্পর্ক নতুন মাত্রা ধারণ করে। বিশ্বে সোভিয়েত ইউনিয়নের ক্রমবর্ধমান আধিপত্য প্রতিহত করার জন্য চীন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র একই প্লাটফর্মে এসে মিলিত হয়। ১৯৭১ সালের ৯-১১ জুলাই পর্যন্ত মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জারের গোপনে চীন সফরের মাধ্যমে চীন-মার্কিন সম্পর্কের বীজ রোপিত হয়। চীন-মার্কিন সম্পর্ক স্থাপনের এ সময়ে পাকিস্তান তৃতীয় পক্ষ হিসেবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বিশ্বরাজনীতির এ ঘূর্ণিপাকে চীন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নিজেদের স্বার্থেই পাকিস্তানের প্রতি সমর্থন ব্যক্ত করে। পাকিস্তান ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে স্বাক্ষরিত ‘সেন্টো’, ‘সিয়েটো’ সামরিক চুক্তির মতো পাকিস্তানের সাথে চীনের কোনো সামরিক চুক্তি না থাকলেও এসব ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে চীন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানের পক্ষে সমর্থন জানায়।
সর্বোপরি, একটি সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে চীন সরকারের যেখানে শোষিত, নির্যাতিত ও স্বাধীনতাকামী বাঙালিদের পাশে এসে দাঁড়ানো উচিত ছিল, সেখানে চীন বরং বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছিল। এর পেছনে কাজ করেছিল চীনের জাতীয় স্বার্থ, নিরাপত্তা ও আঞ্চলিক অখণ্ডতা নিশ্চিত করার নীতি।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা : বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নীতি প্রথম থেকেই বাঙালিস্বার্থের পরিপন্থি ছিল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের লক্ষ্য ছিল পাকিস্তান নেতৃবৃন্দের বিরাগভাজন না হওয়া। মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস নিক্সন প্রশাসন পাকিস্তানের জন্য নৈতিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সমর্থন যুগিয়েছিল। পাকিস্তানকে সমর্থন করার পেছনে প্রেসিডেন্ট নিক্সনের ব্যক্তিগত সহানুভূতি, চীনের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক উন্নয়ন, দীর্ঘ পাক-মার্কিন সামরিক ও বেসামরিক সম্পর্ক বড় ভূমিকা পালন করেছে। ভারতের সাথে সোভিয়েত ইউনিয়নের ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক ও সামরিক সম্পর্কের প্রেক্ষাপটে দক্ষিণ এশিয়ায় সোভিয়েত ইউনিয়নের আধিপত্য খর্ব করার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানঘেঁষা নীতি অনুসরণ করে। প্রেসিডেন্ট নিক্সন ব্যক্তিগতভাবে ভারতবিরোধী ছিলেন, এমন তথ্যও আন্তর্জাতিকভাবে পরিচিত গবেষণা সাময়িকী থেকে জানা গেছে। মার্কিন সরকার পাকিস্তানঘেঁষা নীতি অনুসারণ করলেও মার্কিন সংবাদপত্রগুলো এবং মার্কিন বুদ্ধিজীবীগণ পূর্ব পাকিস্তানে গণহত্যা বন্ধ করা এবং নির্বাচিত সরকারের হাতে শাসনক্ষমতা ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য পাকিস্তানের প্রতি আহ্বান জানিয়েছিলেন। মার্কিন জনগোষ্ঠীর বিরাট একটি অংশ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সমর্থন জানিয়েছিল। মার্কিন সিনেটর কেনেডি মার্কিন সরকারকে শান্তি প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছিলেন। কংগ্রেসের সদস্য কর্নেলিয়ার গ্যালায়ার পাকিস্তানকে অস্ত্র সরবরাহের জন্য সরকারের সমালোচনা করেছিলেন। মার্কিন সংবাদপত্রগুলোও অস্ত্র সরবরাহের ঘটনার সমালোচনা করে। উল্লেখ্য, ১৯৭১ সালের অক্টোবর মাসে সৌদি আরব থেকে যুক্তরাষ্ট্রের সরবরাহ করা ৭৪টি জঙ্গিবিমান পাকিস্তানে পাঠানো হয়েছিল।
মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত মার্কিন নীতিতে তিনটি বৈশিষ্ট্য ধরা পড়ে।
- সমস্যাটিকে পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ সমস্যারূপে চিহ্নিত করা।
- ত্রাণ কাজে আর্থিক সাহায্য অব্যাহত রাখা।
- গোপনে পাকিস্তানে সামরিক সাহায্য অব্যাহত রাখা।
পাকিস্তানের অখণ্ডতা বিপন্ন হোক নিক্সন প্রশাসন তা চায়নি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এ সময় এক পাকিস্তানের আওতায় একটি রাজনৈতিক সমাধানেরও চেষ্টা করেছিল। কিন্তু সোভিয়েত ইউনিয়নের তৎপরতায় তা সম্ভব হয়নি। ১৯৭১ সালের ৩ ডিসেম্বর পাক-ভারত সর্বাত্মক যুদ্ধ শুরু হয়ে গেলে প্রেসিডেন্ট নিক্সন পাকিস্তানকে সব ধরনের নৈতিক ও কূটনৈতিক সহযোগিতা দেওয়ার জন্য হেনরি কিসিঞ্জারকে নির্দেশ দিয়েছিলেন, যা ‘TIT POLICY’ নামে অভিহিত হয়ে আছে। এ নীতির আওতায় এমন সব সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছিল, যা ছিল পাকিস্তানঘেঁষা। এসব নীতি পাকিস্তানের স্বার্থ রক্ষা করেছিল। যুক্তরাষ্ট্র প্রথমে ভারতের জন্য বরাদ্ধকৃত সাহায্য ৮৭.৬ মিলিয়ন ডলার বন্ধ করে দেয়। জাতিসংঘে ভারতবিরোধী তৎপরতা চালানো হয়। যুদ্ধবিরতি চুক্তি যাতে স্বাক্ষরিত হয় তারও উদ্যোগ নিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র। ৪ ডিসেম্বর জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে যুক্তরাষ্ট্র পূর্ব পাকিস্তানে যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব করে। কিন্তু সোভিয়েত ইউনিয়নের ভেটো প্রয়োগের ফলে যুদ্ধবিরতি প্রস্তাব বাতিল হয়ে যায়। এক পর্যায়ে যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানের পশ্চিম অংশ যাতে ভেঙে না যায় সে ব্যাপারে ক্রেমলিনকে অনুরোধ করেছিল।
মুক্তিযুদ্ধের শেষ পর্যায়ে এসে ১৯৭১ সালের ৯ ডিসেম্বর প্রেসিডেন্ট নিক্সন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জারকে বঙ্গোপসাগরে সপ্তম নৌবহর প্রেরণের নির্দেশ দেন। এজন্য গঠন করা হয় ‘টাস্কফোর্স-৭৪’। সপ্তম নৌবহরকে মালাক্কা প্রণালিতে জড়ো হওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়। তিন দিন পর ১২ ডিসেম্বর সপ্তম নৌবহরের পারমাণবিক রণতরী ইউএসএস এন্টারপ্রাইজসহ অন্য সব যুদ্ধজাহাজ ও জেটবহরকে বঙ্গোপসাগরে পৌঁছতে বলা হয়। কিন্তু সোভিয়েত ইউনিয়নের একটি নৌবহর ভারত মহাসারে অবস্থান করায় এবং তাৎক্ষণিকভাবে সোভিয়েত ইউনিয়ন মার্কিন সপ্তম নৌবহরকে ঠেকাতে আরো দুটি টাস্কফোর্স ভারত মহাসাগরে প্রেরণ করলে মার্কিন সপ্তম নৌবহর বঙ্গোপসাগরে প্রবেশ করেনি। ভারতকে ভীতি প্রদর্শন ও পশ্চিম পাকিস্তানে আক্রমণ পরিচালনায় নিরুৎসাহিত করা এবং একই সঙ্গে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর মনোবল চাঙা করার উদ্দেশ্যে সপ্তম নৌবহর প্রেরণ করা হয়েছিল। তবে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে শেষ পর্যায়ে সপ্তম নৌবহর পাঠানো হয়েছিল পশ্চিম পাকিস্তানকে রক্ষা করতে।
১৯৭১ সাল মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে বাংলাদেশ থেকে প্রায় ১ কোটি মানুষ শরণার্থী হিসেবে ভারতে আশ্রয় নেয়। বাঙালি শরণার্থীরা মূলত ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা, আসাম ও মেঘালয়ে আশ্রয় নেয়। আশ্রয় নেওয়া লাখ লাখ শরণার্থীদের বিভিন্ন রাজ্যে স্থানান্তর করার প্রয়োজন হয়ে পড়ে। এই সময়ে যুক্তরাষ্ট্র পরিবহন বিমান দিয়ে সহায়তা করে। জুন ১৯৭১ যুক্তরাষ্ট্রের বিমান বাহিনীর ৪টি পরিবহন বিমান ত্রিপুরা তেকে শরণার্থী স্থানান্তর শুরু করে।
যুক্তরাষ্ট্র ভারতে আশ্রয় নেওয়া বাঙালি শরণার্থীদের ত্রাণ কাজে সহায়তা করে। ২৩ সেপ্টেম্বর ১৯৭১ সিনেটর কেনেডি ত্রাণ কাজের জন্য ৪০০ মিলিয়ন ডলারের বরাদ্দ করে বিল উত্থাপন করেন। প্রেসিডেন্ট নিক্সন ২৫০ মিলিয়ন ডলার বরাদ্দ করেন।
পাকিস্তানের পতন প্রতিহত করতে যুক্তরাষ্ট্র আরও একটি উদ্যোগ নেয় তা হলো যুদ্ধ বিরতিতে যাওয়া। এই লক্ষ্যে ৪ ডিসেম্বর ১৯৭১ যুক্তরাষ্ট্র চীনসহ কয়েকটি অস্থায়ী সদস্য নিরাপত্তা পরিষদের সভাপতিকে আলোচনার জন্য অধিবেশন আহ্বান জানায়। নিরাপত্তা পরিষদ ঐ দিনই বিকেল ৪টার সময় অধিবেশন বসে। এই অধিবেশনে মার্কিন প্রতিনিধি জর্জ ডব্লিউ বুশ যুদ্ধ বিরতির প্রস্তাব উত্থাপন করেন। ৫ ডিসেম্বর সেই প্রস্তাবের উপর ভোট হয়। ভোটে যুক্তরাষ্ট্র চীন সহ ১১টি সদস্য পক্ষে ভোট দেয়। সোভিয়েত, পোল্যান্ড বিপক্ষে ভোট দেয়। আর ব্রিটেন ও ফ্রান্স ভোটদানে বিরত থাকে। ৬ ডিসেম্বর আর্জেন্টিনার নেতৃত্বে ৮টি অস্থায়ী সদস্য আবারো যুদ্ধ বিরতি প্রস্তাব উত্থাপন করে এবং ভোট হয়। ভোটের ফলাফল একই দাঁড়ায়। সোভিয়েতের ভেটোর কারণে যুদ্ধ বিরতি হয়নি।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে কেন্দ্র করে তিনটি বৃহৎ শক্তি তাদের নিজ নিজ অবস্থান থেকে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে ও বিপক্ষে অবস্থান গ্রহণ করে। দুটি সমাজতান্ত্রিক দেশ সোভিয়েত ইউনিয়ন ও চীনের অবস্থান ছিল পরস্পরবিরোধী। আদর্শিক মতাদর্শের চেয়ে জাতীয় স্বার্থ, জাতীয় নিরাপত্তা ছিল এখানে প্রধান। আদর্শগতভাবে চীন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র দুই মেরুতে অবস্থান করলেও ক্রমবর্ধমান সোভিয়েত প্রভাববলয় প্রতিহত করতে তারা পরস্পর একই অবস্থানে এসে দাঁড়িয়েছিল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, সোভিয়েত ইউনিয়ন (বর্তমান রাশিয়া) ও চীন এই তিনটি পরাশক্তিই নিজেদের জাতীয় স্বার্থ, জাতীয় নিরাপত্তা ও আধিপত্য বিস্তারের এক অঘোষিত প্রতিযোগিতায় লিপ্ত ছিল। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পাকবাহিনী আত্মসমর্পণ করলে বাংলাদেশ নামে একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের অভ্যুদয় ঘটে। পরিবর্তিত বিশ্বের বাস্তবতায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের স্বাধীনতা স্বীকার করে নেয়। ১৯৭২ সালের ৪ এপ্রিল যুক্তরাষ্ট্র স্বাধীন দেশ হিসেবে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়। চীন ১৯৭৫ সালের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর ১৫ আগস্ট বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রদান করে। মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে দক্ষিণ এশিয়ার বুকে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্মের মাধ্যমে বাঙালি জাতি তাদের স্বকীয়তা, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য নিয়ে বিশ্বের বুকে নিজেদের স্থান করে নিতে পেরেছে। পরিবর্তিত বিশ্বপরিস্থিতিতে বাংলাদেশ আজ বিশ্বের অন্যতম গণতান্ত্রিক দেশ।